#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৫
জাওয়াদ জামী জামী
” মাহিনের বিয়েটা ঠিকঠাক মিটে গেলে মাশিয়াকেও বিয়ে দেব। তোমরা একটা ভালো পরিবারের খোঁজ কর। মাহিন, তুমি তোমার পরিচিতদের বলে রেখ। ” পাত্রী দেখে বাড়িতে ফেরার পথে বললেন কল্পনা মোর্তাজা।
” এখনই মাশিয়ার বিয়ে দিতে চাও, আম্মু! ওর তো পড়াশোনাই কমপ্লিট হয়নি। এখনই এত তারাহুরো কিসের? ” মাহিন বেশ অবাকই হয়েছে ওর মা’য়ের কথায়।
” ও আর কি পড়াশোনা করবে! গত দুই বছর যাবৎ দ্বিতীয় সেমিস্টারই পাশ করতে পারছেনা। এদিকে দিনকে দিন ওর উশৃংখলতা বেড়েই চলেছে। কারও কথা মানছেনা, ইচ্ছেমত যাকে খুশি তাকে অপমান করছে। আর কত দিন এগুলো সহ্য করব? প্রতিদিনই ওর নামে অভিযোগ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তার থেকে বরং বিয়ে দিই, সংসারটা অন্তত করতে শিখুক। ”
” তুমি যা বলছ ভেবে বলছতো, কল্পনা? তোমার কি মনে হয় ও মন দিয়ে সংসার করতে পারবে? যে মেয়েকে আমাদের কোন কথাই শোনানো যায়না, সেই মেয়ে স্বামী কিংবা শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কথা শুনবে বলে তুমি মনে কর! ” মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’র কথার জবাবে বললেন।
” শ্বশুর বাড়ির লোকজন তো আমাদের মত ছাড় দিয়ে চলবেনা। সেটা যে কারও বেলাতেই হতে পারে। আমরা ওর সকল অন্যায় প্রশ্রয় দিই বলে অন্যরাও যে তাই করবে এটা ভাবছ কেন তুমি? যেখানেই বিয়ে হোক মাশিয়াকে একটা না একটা সময় পর মানিয়ে নিতেই হবে। আজ ও এমন উশৃংখল বলে তো ওকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দিতে পারিনা। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলেই বিয়ে ওকে দিতেই হবে। সেই সময় এখন আসলে ক্ষতি কি? ”
স্ত্রী’র কথায় অকাট্য যুক্তি আছে ভেবে চুপ করে থাকলেন মিরাজ মোর্তাজা। মাহিনও মা’য়ের কথার উত্তর দেয়না। যদিও মা’য়ের সিদ্ধান্ত তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে বরাবরই বাবা-মা’ র বাধ্য ছেলে। তাই সব সময়ের মত চুপ থেকে তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।
” তবে তোমরা আরেকটা কথা শুনে রাখ, বিয়ের ব্যাপারে এখনই মাশিয়াকে কিছু বলোনা। আগে ভালো একটা পরিবার পাই, তারপর গোপনে সব খোঁজ খবর নিই। এরপর মাশিয়াকে জানাব। ” স্বামী-সন্তানকে চুপ থাকতে দেখে আবারও বললেন কল্পনা মোর্তাজা।
” কিন্তু আম্মু, মাশিয়া কি সহজেই বিয়েতে মত দেবে? ওকে রাজি করাবে কিভাবে? যদি হাঙ্গামা করে তখন? ”
” সব সময়ই যে ওর সব চাওয়া মেনে নিব এটা কি করে ভাবলে, মাহিন? ও এ পর্যন্ত যা করেছে তা মেনে নিয়েছি বলেই কি এখনও ওর সব কথাই মানতে হবে! ইদানীং ও একটু বেশিই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রিশাদের সাথে একটু বেশি ঘুরাফেরা করছে। আর তুমি নিশ্চয়ই জানো, রিশাদ ছেলে হিসেবে কেমন? আমি চাই ওর কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই রিশাদের নেটওয়ার্ক থেকে বেরিয়ে আসুক। আর সেই দ্বায়িত্ব আমাদেরকেই পালন করতে হবে। ”
আজ স্ত্রী’র কথার কোন উত্তর দিলেননা মিরাজ মোর্তাজা। তিনিও স্ত্রী’র ন্যায় মাশিয়ার ভালো চান। তার একমাত্র মেয়ে মাশিয়া। ইনফ্যাক্ট তাদের বংশের একমাত্র মেয়ে মাশিয়া। তার চার ভাইয়ের কোন মেয়ে নেই। সেই সুবাদে তিনি সব সময়ই মেয়েকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়েছেন, ওর সকল আবদার মেনে নিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই সীমাহীন ভালোবাসা, আর প্রশ্রয় পেয়েই মাশিয়া ধীরে ধীরে উশৃংখল আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এটা তিনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু তিনিও চাননা তার আদরের মেয়ে আরও অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাক। মেয়ের ভালোর জন্যই তিনিও রাজি হয়ে যান।
পার্টি শেষ করে মাশিয়া যখন বাসায় আসল তখন ঘড়িতে রাত দুইটা বাজে। কল্পনা মোর্তাজা মেয়ের অপেক্ষায় ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। কলিং বেল বাজতেই তিনি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
” মম, তুমি এখনও জেগে আছ! ঘুমালেই পারতে। এভাবে রাত জাগলে তোমার শরীর খারাপ করবেতো। ” মাশিয়া ভেতরে ঢুকল।
” কত বাজে এখন? কোন ভদ্র বাড়ির মেয়ে কখনো এত রাত পর্যন্ত বাসার বাহিরে থাকেনা। যে সময় আমার ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করার কথা, সেই সময় মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে! মাহিন ছেলে হয়ে কখনো এত রাত পর্যন্ত বাড়ির বাহিরে কাটায়নি। আজ মনে হচ্ছে তোমাকে আগে থেকেই যদি শাসন করতাম, তবে তুমি এতটা বাড়তেনা। তুমি যে চুড়ান্ত পর্যায়ের বেয়াদব হয়েছ, তা আজকেই দেখিয়ে দিয়েছ। ” রা’গে কল্পনা মোর্তাজার সর্ব শরীর কাঁপছে।
” সরি মম, আর কখনোই এমন হবেনা। আসলে কি পার্টিতে অনেক পুরোনো ফ্রেন্ডস এসেছিল। ওদের সাথে আড্ডা দিলাম, খাওয়াদাওয়া করলাম এরপর ছোটখাটো একটা আয়োজন ছিল, সেটায় এ্যাটেন্ড করতে গিয়ে রাত হয়ে গেল। কিন্তু তুমিওনা সেই আদ্যিকালের মায়েদের মত ট্রিট করছ! ”
” হ্যাঁ, আমি সেই আদ্যিকালের মা-ই থাকতে চাই। আজকালকার মায়েদের মত আধুনিক হতে চাইনা। আজ তোমাকে শেষ বারের মত বলছি, এরপর থেকে যেখানেই থাকোনা কেন সন্ধ্যার আগেই বাসায় তোমাকে দেখতে চাই। আমার কথার অন্যথা হলে, আমি যে আদ্যিকারের মায়েদের মত কি করতে পারি সেটাই তোমাকে দেখাব। যাও রুমে গিয়ে আমাকে উদ্ধার কর। ”
মা’য়ের রাগ দেখে আর কথা বাড়ালোনা মাশিয়া। এখন তার জম্পেশ ঘুম দরকার। বড্ড টায়ার্ড লাগছে।
আরমান ফার্ষ্ট সেমিস্টারের ক্লাস থেকে বেরোতেই মাশিয়ার মুখোমুখি হয়। মাশিয়াও আরমানকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড আরমানের দিকে ঘৃণাভরে চেয়ে থাকল। মাশিয়ার চোখের তারায় ফুটে ওটা ঘৃণা আরমানের দৃষ্টিগোচর হয়। ও মাশিয়াকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেই মাশিয়া আরমানের পায়ে পা বাঁধিয়ে দেয়। আচমকা এমন ঘটায় আরমান হুড়মুড়িয়ে ভূপাতিত হতে লাগতেই কেউ ওকে শক্ত করে ধরে ফেলল। নিজের পতন রোধ হতেই আরমান তাকায় তার অপ্রত্যাশিত সাহায্যকারীর দিকে। ওকে ধরে রাখতে তুষারের বেগ পেতে হচ্ছে।
তুষারকে দেখে বেশ বিব্রত হয় আরমান। ও তুষারের সাহায্যে উঠে দাঁড়ায়। বেচারার রা’গ ততক্ষণে আকাশ ছুঁয়েছে। পেছনে ঘুরে মাশিয়াকে কিছু বলতে গিয়ে দেখল সে মনের সুখে শিষ বাজিয়ে হেঁটে চলেছে।
” আমি আগেই বলেছিলামতো, ভায়া, মাশিয়া মানেই রণরঙ্গিণী। সে আপনাকে ছেড়ে দেয়ার মেয়েই নয়। সামনে আরও কতকিছু যে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে তা একমাত্র মাশিয়াই জানে। তবে ছোট্ট একটা পরামর্শ দেই, এরপর থেকে মাশিয়াকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবেন। ওর যা খুশি করুক। আপনি অনন্ত সম্মান বাঁচিয়ে চলুন। ”
” হুম। ” আরমান আর কিছুই বললনা। এই মুহুর্তে ওর কিছুই বলতে ইচ্ছে করছেনা। মেজাজ খিঁচে রয়েছে । বহুদিন পর আজ ওর একটু বেশিই রা’গ হচ্ছে।
” মাশিয়া, চল ক্লাসে যাই। ” মাশিয়া বসে বসে বাদাম চিবাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পরই যে ওর ক্লাস শুরু হবে, সেটা দিব্যি ভুলে বসেছে ও। তাই বাধ্য হয়ে তৃষা ওকে মনে করিয়ে দিল।
” আগামী পনের দিন কোন ক্লাসই করবনা বুঝলি? ভাইয়ার বিয়ের পর থেকে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করব। ”
” তুই বসে বসে বাদাম খা আমরা ক্লাস করে আসি। ভাইয়ার বিয়ে সেই পনের দিন পর, আর তুই আজ থেকেই বাহানা শুরু করেছিস! বুঝেছি তুই সেকেন্ড সেমিস্টারেই আটকে থাকতে চাস আরও কয়েক বছর। মিতুল, চল আমরা ক্লাস করে আসি। ” আসলে তৃষা আরমানের ক্লাস মিস দিতে চায়না। গত কয়েকদিনে ওরা বুঝতে পেরেছে শিক্ষক হিসেবে আরমানের তুলনা নেই। যদিও সে একটু স্ট্রিক্ট। তবে মানুষ হিসেবে খারাপ নয়।
” চল, বেইবি। আর যাইহোক আমি আমার আরুর ক্লাস মিস দিতে চাইনা। এবার ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সে আমার হায়েস্ট নম্বর আসবে দেখবি। সে আসলে জিনিয়াস। ” স্বভাবগত ন্যাকা স্বরে বলল মিতুল।
” আরে যা যা। লাগবেনা আমার তোদের মত বন্ধু। তোরা পারলে সারাদিন ঐ দুই টাকার মাস্টারের গলা ধরে ঝুলে থাক। আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়া। তোদের দেখে আমার বিরক্ত লাগছে। ” মাশিয়ার কথায় ওরা তিনজনেই কষ্ট পায়। কিন্তু মাশিয়াকে কিছু বলার সাহস ওদের নেই। তবে সে মাশিয়ার বিষয়ে কল্পনা মোর্তাজার সাথে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করে।
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে আরমান ক্যাম্পাসে বসেই ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দেয়। ছাত্র-ছাত্রীরা চেয়েছিল আরমান ওদের আলাদাভাবে পড়াক। কিন্তু আরমান চায়না টিউশনি করতে। তাই ও ক্লাস শেষ করেই ক্যাম্পাসে বসে সবাইকে পড়ায়। বিষয়টা মাশিয়া কয়েকদিন থেকেই লক্ষ্য করেছে। আরমানের জনপ্রিয়তা দেখে ওর রা’গ হয়। ইচ্ছে করে আরমানকে তার সেদিনের কৃতকর্মের শাস্তি দিতে। কিন্তু যখনই আরমানের দেয়া থাপ্পড়ের কথা মনে হয়, তখনই দমে যায়। ও আরেকবার পুরো ভার্সিটির সামনে অপমানিত হতে চায়না।
চলবে…