যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_৬ জাওয়াদ জামী জামী

0
317

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৬
জাওয়াদ জামী জামী

” আম্মা, তুমি সুধা, শশীকে নিয়ে দুইদিনের মধ্যেই ঢাকা চলে এস। আমি ডক্টরের কাছে এ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে রেখেছি। আগামী শনিবার বিকেলে তোমাকে ডক্টরের কাছে যেতে হবে। ”

” বাপ, তুই এত অস্থির হইতাছিস ক্যানো! আমার কিছুই হয়নাই। এত চিন্তা করিসনাতো, বাপ। ”

” তোমার কিছুই হয়নি মানে? বুকে ব্যথা কি এমনি এমনিই হয়? ঘুমের মধ্যে শ্বাস নিতে না পারা এটাও এমনিতেই হয়? আমি তোমাকে ঢাকা আসতে বলেছি, তুমি আসবে। একটা কথাও আমি শুনতে চাইনা। ” আরমান এবার ধমকে উঠল।

ছেলের রা’গী গলা শুনে আয়েশা খানম একটু দমে গেলেন। তিনি জানেন তার ছেলেটা খুব সহজে রা’গে’না। কিন্তু একবার রাগলে কাউকে মানেনা। তাই তিনি ছেলেকে রা’গি’য়ে দিতে চাইলেননা।

” বাপ, শশীর পরীক্ষার আর পঁচিশ দিন বাকি আছে। মাইয়াডা এম্নেই ফাঁকিবাজ। এখন ঢাকা যাওনের কথা শুনলেই নাইচ্যা উঠব। ওর কোচিং বন্ধ কইরা এখন কি ঢাকা যাওন ঠিক হইব? ”

” আম্মা, তুমি কি ভুলে গেছ, তোমার ছেলে একজন শিক্ষক? আমার বোন আমার কাছে আসবে আর ওকে আমি পড়াবোনা এটা কি হতে পারে? তুমি কি ভয় পাচ্ছ যে আমি শশীর কোচিং এর শিক্ষকদের মত ভালো পড়াতে পারবনা? ”

” এইটা তুমি কি কইলা, বাপ! আমার বাপের মত করে কয়জন শিক্ষক পড়ায়! আচ্ছা তোমার কথাই আমি মাইনা নিলাম। দুইদিন পরই আমি সুধা, শশীরে নিয়া ঢাকা আসতেছি। তবুও তুমি কষ্ট পাইওনা। আমার একটাই বাপ তুমি। তোমার কষ্ট আমি সহ্য করবার পারিনা। ”

মা’য়ের কথা শুনে আরমানের ঠোঁটের কোন প্রসারিত হয়। হুট করেই যেন সকল কষ্ট হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আজ দশটা বছর যাবৎ যেই মা তার সকল সাধ-আহ্লাদ, শখ বিসর্জন দিয়ে আরমানকে মানুষ করেছে, আরমানের স্বপ্ন পূরণের সারথি হয়েছে, সেই মা’য়ের অসুখের কথা শুনে ওর হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠেছিল। এক মুহূ্র্তের জন্য মনে হয়েছিল, নিজের কোন অঙ্গহানী হয়েছে। বাবার মৃ’ত্যু’র পর ও অর্ধেকটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই মা’কে হারিয়ে পুরো শেষ চায়না। যেকোন মূল্যেই আরমান ওর মা’কে সুস্থ দেখতে চায়। মা’য়ের পা’য়ে দুনিয়ার সকল সুখ বিলিয়ে দিতে চায়। মা’য়ের অপূর্ণ সকল সাধ পূরণ করতে চায়। নিজেও সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে চায়। আর সাফল্যের সেই চূড়ায় মা’য়ের হাত ধরে উঠতে চায়।

আরমান ফোন রাখতেই আয়েশা খানম ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পরলেন, ছেলের পছন্দের খাবার তৈরী করবেন তিনি । তিনি তার বড় মেয়ে সুধাকে বললেন, পিঠা বানাতে হবে । সুধাকে পাঠালেন, পাশের বাড়ি থেকে হাঁস কিনে আনতে। তার ছেলে হাঁসের মাংস ভিষণ পছন্দ করে। তিনি নিমেষেই তিনি ভুলে গেলেন তার বুকে অসুখের বাসা বেঁধেছে। অসুখটা ধীরে ধীরে নিংড়ে নিচ্ছে তার প্রানশক্তি।

প্রতিদিনের অভ্যাসবশত আরমান হাঁটতে বেরিয়েছে। রাত আটটার পর ও কিছুক্ষণ রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে। কখনোবা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যায়। কর্মব্যস্ত জীবনের কিছু সময় আরমান ও তার বন্ধুরা নিজেদের জন্য রেখেছে। সপ্তাহের দুইদিন ওরা রাত সাড়ে আটটায় আড্ডার জন্য একত্রিত হয়। দুই-আড়াই ঘন্টা একসাথে কাটিয়ে বাসায় ফিরে। আজকে ও একা একাই হাঁটছে। ইট-পাথরের এই রাজ্যে মাঝেমধ্যে নিজেকে বড্ড একা লাগে। আজ থেকে নয় বছর আগে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছিল। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে লড়াই করতে হয়েছে, প্রথম দিকে কষ্ট হলেও একসময় নিজেকে কষ্টসহিষ্ণু হিসেবে আবিষ্কার করেছে। এবং একটা সময় সফলও হয়েছে। এই নয় বছরে গ্রামে খুব একটা যাওয়া হয়নি। পড়াশোনায় ব্যস্ত রেখেছিল নিজেকে। গ্রামের সেই আরমান হুট করেই পরিনত হয় একজন দ্বায়িত্বশীল ভাই, কর্তব্যপরায়ন ছেলেতে। তাই পড়াশোনা শেষ করেই চাকরির জন্য উঠেপড়ে লাগে। মা’য়ের এতদিনের কষ্ট লাঘবের সময় এসেছে। বাবার যোগ্য ছেলে হয়ে সে দুনিয়াকে দেখাতে চায়, মাথার ওপর বাবা নামক বটগাছটা হুট করে হারিয়ে গেলেও মা’য়ের আঁচলের ছায়ায় থেকেও নিজেকে গড়ে তোলা যায়। প্রয়োজন শুধু নিজের ধৈয্য আর অধ্যাবসায়ের।

” হ্যাল্লো লেকচারার। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন! আপনাকে কখন থেকে ফলো করছি, কিন্তু আপনার কোন সাড়াই পাইনা! এটা আপনার সেই অজপাড়াগ্রাম নয়। এটা ঢাকা। এখানে পথ চলতে হলে চারদিকে নজর রাখতে হয়। নইলে দেখবেন কোনদিন রাস্তায় হাত-পা ভেঙে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। ” নিজের ভাবনার মাঝে ডুব দিয়েছিল আরমান। হঠাৎ অপরিচিত গলার আওয়াজে থমকে দাঁড়ায়। সামনে তাকাতেই দেখল ওকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে পাঁচজন ছেলে। প্রত্যেকের হাতে রয়েছে হকিস্টিক। আরমান এমন অবস্থায় কখনোই পরেনি। তাই ও একটু ভয়ই পায়। রাস্তায় ভালো করে চোখ বুলাতে দেখল পুরো রাস্তা প্রায় ফাঁকা। মাঝেমধ্যে দুই চারটা গাড়ি যাচ্ছে আসছে।

” আপনারা কে? কি চান? ”

” লেকচারার দেখছি ভিষণ স্মার্ট! সরাসরিই কাজের প্রসঙ্গে চলে এসেছে! আ’ম ইমপ্রেসড। মেয়ে হলে নির্ঘাত আপনার প্রেমে পরে যেতাম। অবশ্য দেখতে শুনতে আপনি প্রেমে পরার মতই একজন। ” লম্বামত একটা ছেলে চোখ টিপে বলল। আরমান এমন কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেছে।

” সরে দাঁড়ান, আমাকে যেতে দিন। ” আরমান এই মুহুর্তে কথা বাড়াতে চাচ্ছেনা।

” ওহ্ লেকচারার, এমন যাই যাই করছেন কেন? শুনেছি আপনি সিঙ্গেল। ফ্ল্যাটে আপনার জন্য অপেক্ষারত কেউই নেই। তারপরও কেন এত তাড়াহুড়ো! ”

আরমান বুঝতে পারছে ছেলেগুলো ওকে ইচ্ছে করেই খোঁচাচ্ছে। ও তাদের কথার প্রত্যুত্তর করলেই বিপদ বাড়বে বৈ কমবেনা। তার ভেতরে ভেতরে রা’গ হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।

” তো লেকচারার, আজকাল নাকি ভার্সিটিতে নিজের শক্তি দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন? আর জন্যও নাকি ভার্সিটির ক্রাশ বয়ে পরিনত হয়েছেন! শক্তি প্রদর্শন করা ভালো। কিন্তু তাই বলে সব জায়গায় নিজেকে জাহির করার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই। বিশেষ করে মেয়েদের কাছে নিজের বীরত্ব জাহির করলেই যে হিরো হওয়া যায় তা কিন্তু নয়। নিজেকে জাহির করতে হলে বীরত্বের পাশাপাশি ক্ষমতা আর টাকাটাও কিন্তু জরুরী। যার কোনটাই আপনার কাছে নেই। আশা করছি আমি যেটা বলছি সেটা বোঝার মত বুদ্ধি আপনার খুপরিতে আছে? তাই এরপর থেকে কিছু করার আগে কমপক্ষে দশবার ভাববেন। নয়তো এর পরেরবার আপনাকে সাবধান করতে নয় ঠ্যাঙ্গাতে আসব। ”

ছেলেটার কথা শোনামাত্রই আরমানের চোখ দপ করে জ্ব’লে উঠল। আপনাআপনিই হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে এদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। কিন্তু ও ভালো করেই জানে পাঁচজনের বিপরীতে লড়তে যাওয়া বোকামী বৈ কিছুই নয়। ওর কাছে যদি এখন একটা লাঠিও থাকত, তবে ও ছেলেগুলোর সাথে লড়াই করার কথা চিন্তা করত। জোরে জোরে তিনবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল আরমান। এই মুহুর্তে ছেলেগুলোর সাথে লাগতে চায়না কিছুতেই।

” মনে থাকবে আপনার কথা। এবার আমি আসতে পারি? ” লম্বাটে সেই ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল আরমান। কারন তাকে দেখেই লিডার মনে হচ্ছে।

” কি লেকচারার, যাওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? ফ্ল্যাটে কি পোষা পাখি রেখে এসেছেন? প্রতিবেশিরা জানে আপনি পাখি পোষেন? ” ছেলেটা খিকখিক করে হেসে উঠল।
সাথে সাথেই বাকি চারজন ছেলেও বিশ্রীভাবে হেসে উঠল। ওরা যে কি ইঙ্গিত করেছে সেটা বোঝার মত বোকা নয় আরমান।

এদিকে হাসতে হাসতে সেই ছেলেটা আরমানেে কাঁধে হাত রেখেছে। নিজের কাঁধে এমন নোংরা মনের ছেলের হাতের অস্তিত্ব অনুভব করতেই আরমান আর স্থির থাকতে পারলনা। হ্যাঁচকা টানে ছেলেটার হাত থেকে হকিস্টিক নিয়ে তার পায়ে আঘাত করল। আচমকা আঘাত পেয়েই ছেলেটা আর্তনাদ করে রাস্তায় বসে পরল। বাকিরা আরমানের এমন কাজে হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা ভূপাতিত ছেলেটার দিকে এগিয়ে যায় সাহায্য করতে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরমান আরেকজনের হাত থেকে হকিস্টিক ছিনিয়ে নিয়ে একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলল। এবার বাকি দুইজন ছেলে অশ্রাব্য কয়েকটা গালি দিয়ে এগিয়ে আসে আরমানের দিকে। ঠিক তখনই পুলিশের টহলকারী গাড়ীর আওয়াজে ওরা থেমে যায়।

রাস্তার পাশে জটলা দেখে টহলকারী গাড়ী থেমে যায়।

” কি হচ্ছে এখানে? ” একজন বেরিয়ে আসল গাড়ি থেকে।

” হ্যালো অফিসার, আমি একজন শিক্ষক। এদেরকে আমি চিনিনা। হুট করেই এরা আমাকে বিরক্ত করতে শুরু করে। অশ্লীল কথাবার্তা বলায় একে আমি আঘাত করেছি। ” গাড়ি থেকে একজন সাব ইন্সপেক্টর বেরিয়ে এসেছিল। তাকে দেখেই আরমান কথা বলল।

সাব ইন্সপেক্টর এগিয়ে যায় ছেলেগুলোর দিকে। ততক্ষণে আরমান নিজের ফোন বের করে একজনের নম্বরে ডায়াল করেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here