ক্যাম্পাস ভর্তি মানুষের সামনে দশাসই থা’প্প’ড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে মাশিয়াত। আজ অব্দি যে মাশিয়াতের শরীরে কেউ ফুলের টোকা দিতে পারেনি, সেই মেয়েকে কিনা একজন অজানা-অচেনা একজন থাপ্পড় দিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে! আঁড়চোখে ক্যাম্পাসের সর্বত্র অবলোকনের ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে। আশেপাশের কিছু অংশ ছাড়া বাকি সবকিছুই ওর চোখের আড়ালে। কিন্তু যতটুকুই ও অবলোকন করতে পেরেছে তাতেই রা’গে ওর শিরা-উপশিরায় র’ক্ত চলাচলের গতি বেড়ে গেছে। কয়েকজনকে মুখ টিপে হাসতে দেখে কপালের শিরার দপদপানি ক্রমান্বয়েই উর্ধগতি হচ্ছে। আরেকবার সেই অচেনা আগন্তুকের দিকে র’ক্তচক্ষুতে তাকালো। কিন্তু সে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে মাশিয়ার দিকেই। তার পেছনে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন তিনজন মেয়ে। যাদেরকে কিছুক্ষণ আগেই মাশিয়াত ও তার গ্যাং মিলে র্যাগ দিচ্ছিল। তিনজনকে জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ পাকিয়ে তাকায় সে। আর সেই মুহুর্তেই আগন্তুক মুখ খুলল।
” ভার্সিটিতে এসব করতেই আসা হয় বুঝি? বাবা-মা এখানে তাদের সন্তানকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পাঠায়, র্যাগিং করতে নয়। আর একদিনও যদি ভার্সিটিতে কাউকে র্যাগিং করতে দেখেছি, তবে সেদিনই তাকে ভার্সিটি চিরতরে ছাড়তে হবে। এরপর থেকে কেউ র্যাগ দিলে তোমরা সাথে সাথে প্রতিবাদ করবে। এই তোমরা নিজেদের ক্লাসে যাও। আর এইযে, তোমাকেই বলছি। যদি গুন্ডামী করার একান্তই ইচ্ছে হয়, তবে রাস্তায় গিয়ে করতে পার। ভুলেও ভার্সিটিতে গুন্ডামী করার কথা মাথাও আনবেনা। ” সেই তিনজন মেয়েকে ক্লাসে যেতে বলে, মাশিয়াকে একদফা ঝাড়ি দিয়ে গটগটিয়ে স্থানত্যাগ করল সে। মাশিয়াতকে একটুও পাত্তা দিলনা।
এতক্ষণে নড়েচড়ে বসল মাশিয়াতের গ্যাং। ওরা চারপাশের চিলচক্ষুতে তাকাল।
” দোস্ত, দেখ সবাই আমাদের দিকে কেমনভাবে তাকিয়ে আছে! যেন ওরা সা’পে’র পাঁচ পা দেখেছে। তোকে অপমান করায় সবাইকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। একমুহূর্তেই ওদের সাহস তরতর করে বেড়ে গেছে। ” মাশিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল তৃষা।
তৃষার কথায় যেন মাশিয়ার মাথায় আ’গু’ন ধরে যায়। রা’গে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
” কে এই অসভ্য মানুষ? তার সাহস হয় কিভাবে আমাকে থা’প্প’ড় দেয়ার! সে কি জানে আমি কে? কি আমার পরিচয়? আজ তার জন্য আমাকে ভার্সিটি ভর্তি স্টুডেন্টদের সামনে অপমানিত হতে হল! যে ভার্সিটির কেউ আজ পর্যন্ত আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি, আজ তারাই আমাকে দেখে হাসছে! ব্যঙ্গ করছে! তাকে আমি ছাড়বনা। এই মাশিয়া কি জিনিস সেটা তাকে বুঝিয়েই দিব। ”
” তুই ঠিকই বলেছিস। তাকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। নইলে ভার্সিটিতে আমাদের এতদিনের রেপুটেশন, পাওয়ার সব ধুলোয় মিশে যাবে। কেউ আমাদের পাত্তাই দিবেনা। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে আমাদের। ” মাশিয়ার আরেক বন্ধু মিতুল বলল। আসলে ওরা চাচ্ছে মাশিয়াকে ক্ষেপিয়ে দিতে।
মিতুলের কথাগুলো শুনে মাশিয়ার রা’গে’র পারদ আরেকটু বাড়ল। ও মনে মনে তার ভাষায় সেই অসভ্য ব্যাক্তিকে শায়েস্তা করার পণ করল।
” হেই গার্লস, আমি তার পরিচয় জেনে এসেছি। কেমিস্ট্রির শিক্ষক। কয়েকদিন আগেই জয়েন করেছে। কিন্তু কোন একটা সমস্যা থাকায় কয়েকদিন ভার্সিটিতে আসতে পারেনি। ” হাঁপাতে হাঁপাতে বলল জয়। সে যখনই দেখেছে কেউ একজন মাশিয়াকে থা’প্প’ড় মে’রে’ছে তখনই আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। আর সেই ব্যাক্তির পিছুপিছু গিয়ে তার পরিচয় জেনে আসে।
জয়ের কথা শুনে বাকি সবার চোখ কপালে উঠলেও মাশিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ওর কোন হেলদোল নেই। ও মনে মনে কিছু একটা পরিকল্পনা করছে।
” আরমান , আপনি কিছুক্ষণ আগে যাকে থা’প্প’ড় মে’রে’ছে’ন সে এই ভার্সিটির চেয়ারম্যানের একমাত্র মেয়ে। মেয়েটা ভিষণ জিদ্দি। চেয়ারম্যান স্যারের কানে কথাটা গেলে কি হবে সেটা ভাবতেই আমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। ” নিজের চেয়ারে বসে একটা বইয়ে চোখ বুঝাচ্ছিল আরমান। কারও কথা শুনে চোখ তুলে তাকায় আরমান। ওর কলিগ তুষারকে দেখে ইশারায় বসতে বলল।
” উইদাউট এনি রিজন, আমি কাউকে থা’প্প’ড় দেইনি। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? যেখানে ভয় করার কথা আমার, সেখানে আপনি ভয় পাচ্ছেন! তবে শুনে রাখুন, কেউ অন্যায় করলে আমি তাকে কখনোই ছাড় দেইনি। সে চেয়ারম্যান স্যারের মেয়ে হলেও নয়। আপনি রিল্যাক্স থাকুন। আমি সব সামলে নিব। ” চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে বলল আরমান।
” আপনাকে এভাবে নিশ্চিন্ত থাকতে দেখে আমি অবাক হচ্ছি, মশাই। যদি জানতেন ঐ মেয়েটা একটা সক্রিয় আ’গ্নে’য়’গি’রি তবে আপনি এমন নিশ্চিত থাকতে পারতেননা। তার ফু’ট’ন্ত লাভায় কখন যে আপনাকে আপাদমস্তক ডুবিয়ে দেবে, সেটা ডোবার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত টের পাবেননা। তাকে এই ভার্সিটির সকলেই একইসাথে ভয় ও সমীহ করে চলে। সময় থাকতে সাবধান হয়ে যান, ভায়া। ” তুষারের কথার ধরন শুনে না হেসে পারলনা আরমান।
” হোকনা সে সক্রিয় আ’গ্নে’য়’গি’রি কিংবা ফু’ট’ন্ত লাভা। এসবে আমি কেয়ার করিনা। আমি অবাক হচ্ছি আপনাকে দেখে। ভার্সিটির আর সকলে ঐ মেয়েকে সমীহ কিংবা ভয় করে কিনা জানিনা। কিন্তু আপনি মনে হয় তাকে যথেষ্ট ভয় করেন! কেন? ”
” সে চেয়ারম্যান স্যারের মেয়ে। তাকে ভয় না করে উপায় আছে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই চাকরি নিয়ে টানাটানি পরবে। তাই একটু তাল মিলিয়ে চলি, এই আর কি। বুঝতেই পারছেন আমরা ছাপোষা মানুষ। তাদের সাথে পাঙ্গা নিয়ে চলতে পারবনা। ”
তুষারের কথার উত্তর না দিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ ডুবায় আরমান। এই ধরনের কথা শুনতে ওর মোটেও ভালো লাগেনা।
” পাপা, পাপা, কোথায় তুমি? মম, পাপা কোথায়? ” বাসায় ঢুকেই চিৎকার করে বাবাকে ডাকছে মাশিয়া।
” কি হয়েছে তোমার! এভাবে চিৎকার করছ কেন, মাশিয়া? দিনদিন তুমি ম্যানার্সলেস হয়ে যাচ্ছ, এটা কি বুঝতে পারছ? ” মাশিয়ার চিৎকার শুনে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালেন মাশিয়ার মা কল্পনা মোর্তাজা।
” হাহ্, এখন দেখছি বাসায়ও আমাকে অপদস্ত হতে হচ্ছে! বাহিরের মানুষ আমাকে থা’প্প’ড় মা’র’বে, নিজের মা আমাকে দুরছাই করবে, ভবিষ্যতে আমার সাথে আরও কতকিছু যে হবে সেটা ওপরওয়ালাই জানেন। ”
” কে তোমাকে মে’রে’ছে? কেনইবা মে’রে’ছে! কি করেছ তুমি? কেউ তোমাকে এমনি এমনি মা’র’তে যাবেনা। ” কল্পনা মোর্তাজা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন মাশিয়ার দিকে।
নিজের মা’য়ের মুখে এমন কথা শুনে ধপ করে সোফায় বসে পরল মাশিয়াত। মা’র কথা শুনে ওর মাথা ঘোরাচ্ছে। সেই সাথে তড়াক করে রা’গ বেড়ে যায়।
” আমি কি সত্যিই তোমার মেয়ে? না মানে হসপিটালে তোমার সন্তানের সাথে আমি অদলবদল হইনিতো? আমার জানামতে কোন মা তার মেয়ের দুঃসময়ে এমন নিস্পৃহ থাকতে পারেনা। আর কিছু না-ই কর, অন্তত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারতে তো! ” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল মাশিয়া। ওর ডাগর ডাগর আঁখিদ্বয়ে জমেছে বর্ষার জলধারা। যখনতখন তাদের টুপটাপ পতন ঘটবে।
মেয়ের চোখে পানি দেখেও দেখলেননা কল্পনা মোর্তাজা। তিনি খুব ভালো করেই জানেন তার মেয়েটি কি পরিমানে জিদ্দি। তাই তিনি মাশিয়ার কথা আমলে নিলেননা।
” তুমি সত্যিই আমার মেয়ে। হসপিটালে অদলবদল হওয়ার কোন চান্সই ছিলনা। তোমার দাদিমা হসপিটালে তিনদিন আমার পাশে ঠাঁয় বসে ছিলেন। ডেলিভারি রুমেও তিনিই ছিলেন আমার পাশে। তাই মন থেকে কুচিন্তা বাদ দিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। অযথাই চোখের পানি ফেলোনা। এতে করে তোমার ডিহাইড্রেশন দেখা দেবে । ডক্টর, হসপিটাল করতে করতে আমার ব্লাড প্রেশার বাড়বে, তোমার পাপা’র হার্টের সমস্যা দেখা দিবেে। আর আমরা অসুস্থ হয়ে পরলে তোমাকে সামাল দেয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। কারন তোমাকে যে সামলাতে জানবে তাকে প্রস্তর কঠিন হতে হবে। আর এমন মানুষ হয়তো এখনও জন্মায়নি। যাও জলদি ফ্রেশ হয়ে এস, আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। ” কল্পনা মোর্তাজা মেয়ের দিকে না তাকিয়েই রান্নাঘরে গেলেন।
মাশিয়া হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ও নিশ্চিত কল্পনা মোর্তাজা কিছুতেই ওর মা হতে পারেনা। বাবা বাসায় আসলেই বিষয়টা ক্লিয়ার করতে চায় ও। এক হ্যাঁচকায় সোফা থেকে নিজের ব্যাগ তুলে নিয়ে দুমদাম পা ফেলে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরল।
মেয়েকে ওপরে যেতে দেখে হাঁফ ছাড়লেন কল্পনা মোর্তাজা। মাঝেমধ্যেই মেয়েটাকে নিয়ে তার ভিষণ চিন্তা হয়। অতিরিক্ত আদরে মেয়েটা উশৃংখল হয়ে গেছে। নিজেকে ছাড়া কাউকে চেনেনা, মানেনা। কি করে ওকে ঠিক পথে আনবেন সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনাও তার নেই। কিছুতেই মাশিয়াকে কোন কথাই শোনাতে পারেনা কেউই।
#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#সূচনা_পর্ব