যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_৩ জাওয়াদ জামী জামী

0
365

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৩
জাওয়াদ জামী জামী

” স্টুডেন্টস আমি আপনাদের ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্স পড়াব। আপনারা বই বের করুন। এখন পর্যন্ত কতটুকু পড়া হয়েছে আমাকে জানান। ” ক্লাসে এসে সময়ক্ষেপণ না করে পড়ানো শুলু করল আরমান। সে একাধারে স্টুডেন্টদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, আবার বুঝিয়েও দিচ্ছে।

” মাশিয়াত বিনতে মোর্তাজা স্ট্যান্ড আপ। অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছি আপনি মনযোগ দিয়ে শুনছেননা। এ্যানি প্রবলেম? বুঝতে সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন। ” আরমান অংক করা থামিয়ে মাশিয়াকে জিজ্ঞেস করল। আরমানের প্রশ্নে মাশিয়া রে’গে উঠল।

” আমার কথা না ভেবে যা করছিলেন করুন। অযথা জ্ঞান দিতে আসবেননা। নিজেকে কি আইনস্টাইনের নাতি মনে করেন! এরকম শিক্ষক খুঁজলেই দেশের প্রতি ঘরেই দুই-চারটা করে পাওয়া যাবে। অযথা নিজেকে হাই প্রোফাইল ভাবার কোন কারন দেখছিনা। ” মাশিয়ার কথায় পুরো ক্লাস স্তব্ধ হয়ে যায়। একজন শিক্ষকের অপমান মানতে সবার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কারও কিছুই করবার নেই। মাশিয়ার কথার উত্তর দেয়া মানেই নিজের বিপদ ডেকে আনা।

মাশিয়ার কথায় মৃদু হাসল আরমান। ও ভালোভাবেই বুঝতে পারছে সেদিনের ঘটনা মাশিয়ার মনে দাগ কেটেছে। তাই ও যথাসম্ভব চেষ্টা করবে আরমানকে অপমান করার। কিন্তু সে-ও দমে যাবার পাত্র নয়।

” প্রথমত, একজন শিক্ষক হিসেবে আমার দ্বায়িত্ব ক্লাসের প্রতিটি স্টুডেন্টের দিকে নজর দেয়া। তারা বুঝতে পারল কিনা জানতে চাওয়া। দ্বিতীয়ত, আমার দাদা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তিনি আইস্টাইন ছিলেননা। তাই আমার আইনস্টাইনের নাতি হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। তৃতীয়ত, হয়তো খুঁজলে দেশের প্রতিটি ঘরেই দুই-চারটা শিক্ষক পেয়ে যাবেন। এটা একটা দেশের জন্য গর্বের। আজ যে শিক্ষকদের আপনি হেয় করছেন, মনে রাখবেন তারাই কোন দেশের মানুষ গড়ার কারিগর। আপনি আজ এতদূর পর্যন্ত এসেছেন, এর পেছনেও শিক্ষকের অবদান আছে। আবার আপনার পরিবারের সবাইও কিন্তু কোনোনা কোন শিক্ষকের হাত ধরে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার হয়েছে। তাই আশা করব, আজকের পর থেকে শিক্ষকদের সম্মান দিয়ে কথা বলবেন। নিতান্তই যদি ক্লাসে মন দিতে না পারেন, তবে ক্লাসের বাহিরে গিয়ে দাঁড়ান। আমার ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন। ”

” হোয়াট! আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকব! আর ইউ ম্যাড? আমাকে বাহিরে যেতে বলার সাহস হয় কি করে আপনার? আপনার এই দাম্ভিকতার জন্য আপনাকে আমি কি করতে পারি জানেন? আমি অথোরিটিকে জানালে আপনার চাকরি যাবে। সো বি কেয়ারফুল। ” তেতে উঠল মাশিয়া।

” আপনি কি বাহিরে যাবেন? নাকি আমি আপনাকে টেনে বের করব? আপনি যাকে খুশি, যেখানে খুশি জানাতে পারেন। আই ডোন্ট কেয়ার। আমার ক্লাসের সময় নষ্ট করবেননা। বাহিরে যান। ”

” আমি কোথাও যাবনা। ”

” তাহলে মনযোগ দিয়ে আমি কি পড়াচ্ছি সেটা শুনবেন। এবং আমার প্রশ্নে ঠিকঠাক উত্তর দেবেন। নতুবা আপনাকে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। স্বয়ং চেয়ারম্যান স্যার মানে আপনার বাবা আসলেও আমি এটাই করব। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। ”

আরমানের এমন প্রচ্ছন্ন হুমকিতে ভড়কে যায় মাশিয়া। ও বুঝে গেছে এই শিক্ষক যা বলে সেটাই করেই তবে ছাড়ে। তার কথার অবাধ্য হলে সে মাশিয়াকে রুম থেকে বের করে দেবে এটায় কোন ভুল নেই। আর রুমের বাহিরে গিয়ে দাঁড়ানো মানে নিজের সম্মানকে ভার্সিটির সবার কাছে নিলামে তোলার সমান। যেটা মাশিয়া কিছুতেই চায়না। তাই সে ক্লাসে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে। যা ওর জন্য মোটেও সহজ নয়।

” বেইব, দেখেছিস আজকে স্যারকে কেমন হ্যান্ডু লাগছে? তার কথার ধরনও ইউনিক। তারউপর আজকে আবার নীল শার্টে এসেছে। তাকে দেখলেই প্রেম প্রেম পায়। তাকে দেখলেই সব ফেলে তার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। প্রেম সাগরের ঢেউয়ে উথালপাথাল ভাসতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে তার সাথে দিগন্তে হারাতে। ” মিতুলের কথায় সবাই ওর দিকে চোখ বড় করে তাকায়। কিন্তু মিতুলের সেদিকে খেয়ালই নেই। ও কল্পনার সাগরে ডুব দিয়েছে।

” জয়, তোর এই বেইবিকে এখনই নর্দমায় চুবিয়ে নিয়ে আয়। একে জাষ্ট আমার সহ্য হচ্ছেনা। আসছে ন্যাকা ষষ্ঠী। ঐ খচ্চরমার্কা মাষ্টারকে দেখে তার প্রেম প্রেম পায়! ঐ তুই এখনই ন্যাকা ষষ্ঠীকে বঙ্গোপসাগরে ফেলে রেখে আয়। সেখানে ইচ্ছেমত ঢেউয়ের সাথে রোমাঞ্চ করবে। এখন থেকে একে আড্ডায় রাখবিনা। ” মাশিয়া রা’গে গজগজ করতে থাকে।

” জয়, আমার মাশু বেইবকে রা’গ’তে নিষেধ করে দে না। তোরা আমার বেস্টু/বেস্টু। আর আরু আমার ক্রাশ। আমি আরুর ওপর কঠিনভাবে ক্রাশিত। আরু আমার ধ্যানজ্ঞান আমার স্বপ্ন। ” মিতুল জয়ের ডান হাতের আঙুলে নিজের বাম হাতের আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

” আরু কে, মিতুল সোনা? এই আরু কোথায় থেকে টপকালো? জীবনে কখনো এমন নামই শুনিনি। ” জয় অবাক হয়ে জানতে চাইল।

” আরু হলো আমার আরমান। সংক্ষেপে আরু। আমার আরু। তার সাথে নামটা বেশ মানিয়েছে তাইনা, বেইবি? ” ন্যাকা স্বরে জয়কে বলল মিতুল।

” ওহ্ গড। একে তুলে নাওনা কেন! ঘর শত্রু বিভীষণ কথাটা শুধু এর জন্যই প্রযোজ্য। যে মাষ্টার আমাকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে, ইনসাল্ট করছে, আর এই বিভীষণ কিনা শেষমেশ তারই প্রেমে পরল! একে আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নে। একে দেখলেই আমার এর সব চুল টেনে ছিঁ’ড়’তে মন চাচ্ছে। আহ্ণাদ করে আবার আরু ডাকছে! তার আরু। ঐ বুইড়া ব্যাডাকে আমার আরু বলতে ওর লজ্জা করছেনা! ডিজগাস্টিং। ”

” বেইবি, তুই ভালোবাসার মানে জানিসনা, তাই এভাবে বলতে পারছিস। ভালোবাসায় চুম্বক আছে বুঝলি? আর অপরদিকের ব্যাক্তির সাথে সেই চুম্বকের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকে। এরা একে অপরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। তাই…. ”

মিতুলকে কথা শেষ করতে না দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল মাশিয়া।

” রাখ তোর চুম্বক, আকর্ষন-বিকর্ষন। তুই চুম্বক গুলে পানি খা। হাতের কাছে পানি না পেলে নর্দমার পানি খা। প্রয়োজনে লাল পানি খেয়ে উচ্ছন্নে যা। কিন্তু আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা। ”

” আহ্ মিতুল, তুই কি শুরু করেছিস বলতো? দেখছিস মাশিয়া রে’গে আছে, তারপরও তুই ওর সামনে এসব বলছিস কেন? তোর ক্রাশকে তুই তাবিজ করে গলায় ঝুলিয়ে রাখ, কিংবা শরবত করে গুলে খা কেউ নিষেধ করবেনা। কিন্তু মাশিয়ার সামনে তোর ক্রাশ নিয়ে একটা কথাও বলবিনা। ” মাশিয়া আর তৃষার ধমকে চুপসে যায় মিতুলের মুখ। ও জয়ের হাত ধরে ওর দিকে অসহায় চোখে তাকায়।

এদিকে জয় পরেছে ফ্যাসাদে। সে অনেক আগে থেকেই মিতুলকে পছন্দ করে। যেটা মিতুল ব্যাতিত মাশিয়া আর তৃষা জানে। তাই মিতুলের এমন আচরণ ওকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু মিতুলকে কিছু বলার সাহস ওর নেই। ও জানে মিতুল হুটহাট এর-ওর ওপর ক্রাশ খায়। তবে সেটা স্বল্প দিনের জন্য। ও যেমন হুটহাট ক্রাশ খায়, তেমনি হুটহাটই তাকে ভুলে যায়। কিন্তু তারপরও মিতুলের এহেন কাজ ওকে কষ্ট দেয়। জয় কি করবে ভেবে পায়না। ও চুপসানো মুখে তাকিয়ে থাকে মাশিয়ার দিকে। কিন্তু মাশিয়ার এখন এসব দেখার সময় নেই। ও ভাবছে, কিভাবে আরমানকে শায়েস্তা করা যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মাশিয়ার মুখে হাসি ফুটল।

” গাইজ, চল ক্যান্টিনে যাই। আজ আমি তোদেরকে ট্রিট দেব। তোদের পছন্দের খাবার খাওয়াব। হ্যারি আপ, গাইজ। আর আধাঘন্টা পর ক্লাস। দেরি করলে ক্লাস মিস হবে। ” মাশিয়া কারও উত্তরের অপেক্ষা না করে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসল। ওর দেখাদেকি বাকিরাও বেরিয়ে আসল।

” মিতুল বেইবি, তুই কি খাবি বল? এই জয়, তৃষা তোরা তোদের পছন্দমত খাবার অর্ডার দে। ন্যাকু ষষ্ঠী তুইও বল কি খাবি? ” মাশিয়াকে হুট করেই যেন উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে। বন্ধুরা ভাবছে, মেয়েটা হঠাৎ কি হলো? কিছুক্ষণ আগেই যে রে’গে ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই সব রা’গ গেল কোথায়? ওরা মাশিয়াকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও সাহস করতে পারলনা। তাই মাশিয়ার কথামত খাবার অর্ডার করল। মাশিয়াও ওর পরিচিত কয়েকজনকে ডাকল ওদের সাথে যোগ দিতে। খাবার শেষ করে ওরা বেরিয়ে আসতেই ক্যান্টিন বয় এসে বিল ধরিয়ে দিলে মাশিয়া মৃদু হেসে ম্যানেজারের কাছে গেল।

ক্লাস শেষ করে অফিসে কিছুক্ষণ কাজ করে আরমান বাসায় ফেরার উদ্যোগ নেয়। ভার্সিটির মূল ভবন থেকে বেরিয়ে গেইটের দিকে যেতেই কেউ ওকে পেছন থেকে ডাক দেয়। আরমান ঘুরে তাকায়। একজন হ্যাংলামত ছেলে দৌড়ে আসছে ওর দিকে। কিন্তু আরমান তাকে চেনেনা।

” স্য স্যার, আপনিই তো আরমান স্যার? ” হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে।

” হুম। আপনাকে তো ঠিক চিনলামনা। আসলে আমি তিনদিন হয় ভার্সিটিতে জয়েন করেছি। তাই কাউকেই তেমন চিনিনা। ”

” আমি ভার্সিটির ক্যান্টিনে জব করি। আপনার একটা বিল ডিউ আছে। ম্যানেজার স্যার তাই আমাকে পাঠালো। ”

” বিল! কিসের বিল! আমিতো ক্যান্টিনে যাইনি। আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি বোধহয় অন্য কাউকে খুঁজছেন। ”

” না, স্যার, ভুল হচ্ছেনা। ম্যানেজার স্যার আপনার কথাই বলেছে। আর মাশিয়া ম্যাম আমাকে আপনার ছবিই দেখিয়েছে। ”

” মাশিয়া ম্যাম, আমার ছবি দেখিয়েছে মানে! এখানে মাশিয়া কোথায় থেকে আসল? যেহেতু আমি ক্যান্টিনে যাইনি, তাই বিল দেয়ার প্রয়োজনও বোধ করছিনা। ” আরমান বুঝল এটা মাশিয়ার কোন চাল হলে পারে। তাই সে না দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু সেই ছেলেটা ওর পিছুপিছু চলতে থাকে।

” স্যার, বিলটা আপনাকেই দিতে হবে। এটা মাশিয়া ম্যামের আদেশ। ম্যাম ম্যানেজার স্যারকে বলেছে, বিল আপনার নামে করতে। ”

” কি বলতে চাচ্ছ তুমি? ” আরমান এবার সম্ভাষণ পাল্টায়।

” স্যার, মাশিয়া ম্যাম তার দশজন বন্ধু নিয়ে ক্যান্টিনে লাঞ্চ করেছে। আর সেই বিল আপনার নামে করতে বলেছে। যেহেতু বিল আপনার নামে হয়েছে, সেহেতু এখন বিল আপনাকে দিতেই হবে। ”

সব শুনে আরমানের ভিষণ রা’গ হচ্ছে। মেয়েটা বেয়ারা, উশৃংখল ও সেটা জেনেছে। কিন্তু এমন চালু সেটা বুঝতে পারেনি। ও কিছু না বলে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল।

” কত টাকা হয়েছে? ”

” পাঁচ হাজার। ”

টাকার অংক শুনে আরমানের চোখ কপালে উঠল। ওর এবার সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

” আমার কাছে এখন এত টাকা নেই। পাশেই আমার ফ্ল্যাট। তুমি আমার সাথে গিয়ে টাকা নিয়ে এস। ” আরমান আর দাঁড়ায়না গটগট করে ক্যাম্পাস ত্যাগ করল।

আরমান চলে যেতেই পাশের ভবনের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে মাশিয়া। ওর ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি। আরমানকে শায়েস্তা করার উপায় পেয়ে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here