যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_১৯ জাওয়াদ জামী জামী

0
278

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী জামী

ঘুমের মধ্যে আচমকা লা’থি খেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল আরমান। আশেপাশে তাকিয়ে মাশিয়া ব্যাতীত কাউকে দেখলনা। তবে সে গভীর ঘুমে মগ্ন। আরমানের বুঝে আসলনা, মাশিয়া যদি ঘুমিয়েই থাকে তবে ওকে কে আঘাত করল! এদিকে ওর চোখে প্রচন্ড ঘুম। ঘুমের জন্য আর বসে থাকতে পারলনা। বাম কাত হয়ে শুতেই আবারও জবরদস্ত লা’থি খেয়ে উঠে বসল। এবার ওর পেটে প্রকান্ড লা’থি হেঁকেছে মাশিয়া।লা’থি’র চোটে আরমানের দম বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক হতে নিজেকে কিছুক্ষণ সময় দেয়। ব্যথাটা সহনীয় পর্যায়ে আসতেই ও মাশিয়াকে এক হ্যাঁচকায় টেনে তুলে ওর গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আচম্বিতে থা’প্প’ড় খেয়ে মাশিয়ার মাথা বনবন করতে থাকে। ও ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে থাকে আরমানের দিকে। এরপর ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

” এভাবে মা’র’লে’ন কেন? আমার গালকে কি আপনার থা’প্প’ড় প্র্যাকটিসের ময়দান মনে হয়? অসভ্য মাস্টার। অবলা নারীকে নূন্যতম সম্মান দিতে জানেনা। তার বাড়িতে থাকছি জন্য যা খুশি তাই করছে! ” মাশিয়ার গলায় কান্নার আভাস স্পষ্ট।

” বেয়াদব মেয়ে, নিজেই আমাকে দুই দুইবার লাথি মা’র’ল। তারউপর আবার গলাবাজিও করছে। আর একবার যদি আমার শরীরে তোমার পা টাচ করেছে, তবে সাথে সাথে পা দুটো ভেঙ্গে ফেলব। ” আরমান ভিষণ রেগে গেছে।

আরমানের কথা শুনে থমকায় মাশিয়া। ও কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছে।

” ও মাই আল্লাহ! আপনাকে লা’থি মা’র’লা’ম কখন! আমিতো ঐ মিতুল ন্যাকুকে লা’থি দিয়েছি। সে আমার কানের কাছে আরু বেইবি, আরু বেইবি বলে ঘ্যানঘ্যান করছে। এত ন্যাকামি সহ্য করতে পারিনা। তা-ও আবার আপনার মত অসভ্য মাস্টারকে নিয়ে। বুইড়া বেটাকে আরু বেইবি ডাকছে। জাস্ট ডিজগাস্টিং। ”

মাশিয়ার কথা শুনে আরমান কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাশিয়ার কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে। পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও কিছুটা বুঝতে পারে।

” তুমি এখানে মিতুলকে কোথায় পেলে? তুমি ফুলবাড়িয়া মানে আমার গ্রামে আছ। আর তোমার ফ্রেন্ড মিতুল সে আছে ঢাকায়। আমাকে ইচ্ছে করে মে’রে আবার অযুহাত দিচ্ছ, ফাজিল মেয়ে? তুমি যেমন বেয়াদব, তোমার চিন্তাধারা ঠিক তেমনই ফালতু আর তোমার স্বপ্নও তোমার মতই বেয়াদব। এমন ফালতু স্বপ্নতো আমরা দেখিনা। ইচ্ছে করছে কানের নিচে আরও দুই-চারটা লাগিয়ে দেই। ”

আরমান যে রেগে গেছে এটা বেশ বুঝতে পারছে মাশিয়া। সেই সাথে এটাও বুঝে গেছে ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। আর স্বপ্নেই মিতুলকে লাথি মা’র’তে গিয়ে আরমানকে মেরেছে। বিষয়টা বোধগম্য হতেই ও মুখ কাঁচুমাচু করে আরমানের দিকে তাকায়।

” ভুল আমার নয়। ভুল আপনার। আপনি কেন আমার পাশ ঘেঁষে শুয়েছেন? এখন আমি যদি স্বপ্নে মিতুলকে মা’রি কিন্তু আমার বর্ডারের আশেপাশে আপনি এসে যান তবে লাথিটাতো আপনাকেই লাগবে তাইনা? এরপর থেকে একটু দূরে শোবেন। বলাতো যায়না এরপর হয়তো আপনার নাকেই পাঞ্চ করলাম। ঘুমের মধ্যেই নাক ভেঙে র’ক্তা’র’ক্তি কাণ্ড ঘটল। ”

” নিজে অন্যায় করে আমার ঘাড়ে দোষ দিচ্ছ? আজ থেকে সাবধান না হলে পরবর্তীতে মেঝেতে তোমার জায়গা হবে, কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। ” আরমান আর কিছু না বলে শুয়ে পরল। মেজাজ ভালোই খারাপ হয়েছে।

” রীতিমত নারী নির্যাতন করছেন আপনি। এরপর আবারও আমাকে থা’প্প’ড় দিলে, আমি সোজা থানায় যাব। কেইস করব আপনার নামে। ” আরমানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে মাশিয়া।

” ওয়েলকাম। যেখানে খুশি সেখানে যেতে পার। তবে যাবার আগে তোমার অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে ভেবে দেখ। তুমি যেমন মেয়ে, তোমাকে মনের সুখ মেটাতে কেউ মা’র’বে’না। মা’র’বে তোমার বেয়াদবির জন্য। তুমি মামলা করবে আর আমি বসে থাকবনা নিশ্চয়ই? তোমার বিপক্ষে সাক্ষী জোগাড় করতে আমার কষ্ট হবেনা মোটেও। ” মাশিয়ার হুমকিকে একটুও পাত্তা দিলনা আরমান।

এদিকে নিজেকে এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য হতে দেখে কান্না পায় মাশিয়ার। আরমানকে ও কোনভাবেই জব্দ করতে পারছেনা। রাগে ওর মাথা দপদপ করছে।

দুপুরে আয়েশা খানম মাশিয়াকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। আরমান, সুধা, শশী ওরা নিজের মত খাচ্ছে। মাশিয়া মাছের কাঁটা বাছতে পারেনা জন্য, মাছ রান্না হলেই আয়েশা খানম ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেন। যেটা আরমানের মোটেও পছন্দের নয়।

” আম্মা, তুমি ওকে খাওয়াতে গিয়ে নিজের খাওয়ার কথা ভুলে যেওনা। এতবড় মেয়েকে মুখে তুলে খাওয়াতে তোমার বিরক্ত লাগেনা? আমারতো দেখেই রাগ উঠে। ও মাছ বেছে খেতে না পারলে খাবেনা। তাই বলে তোমার ওকে খাইয়ে দিতে হবে কেন? ”

” হিংসা আম্মা, হিংসা। আপনার এই ছেলে আস্ত একটা হিংসার গ্যারাজ। আপনার বুইড়া-দামড়া ছেলেকে আপনি মুখে তুলে খাওয়াননাতো তাই রাগে ফুঁসছে। আবার আমার খাবারেও নজর দিচ্ছে। কাল থেকে আপনার হিটলার ছেলেকে মাছ না দিয়ে আমাকে দেবেন। ছোটবেলা থেকে বেশি বেশি খাইয়েছেন জন্য আমাকে হিংসা করছে। তার ভাগের পিসটা আমার প্লেটে আসছে এটাই তার হিংসার কারণ। আপনার মত ভালো আম্মার ছেলে কিভাবে এত হিংসুক হয় সেটা আমার বুঝে আসছেনা। ” মাশিয়া আরমানকে জ্বা’লা’নো’র সুযোগ হাতছাড়া করলনা।

” এই তুমি চুপ করবে? আজকাল বেশি কথা বলতে শিখেছ। এখন থেকে কথাপ্রতি তোমাকে একটা করে থা’প্প’ড় লাগাবো। দেখব তখন কত কথা বলতে পার। ফাজিল মেয়ে একটা। ” আরমান বেশ রেগে গেছে।

” দেখলেন, আম্মা? কিভাবে নারী নির্যাতন করে! আজকাল ভালো মানুষের মূল্য কেউই দেয়না। আমাকে উঠতে-বসতে কিভাবে নির্যাতন করে দেখেছেন? এই হিটলারের নির্যাতন সইতে সইতে কোনদিন দেখবেন আমি শূন্যে মিলিয়ে গেছি। আরেক টুকরা মাছ নিনতো। রাতে আপনার ছেলেকে মাছ না দিলেও চলবে। মাশাআল্লাহ এমনিতেই তার মাথায় অনেক কুবুদ্ধি। বেশি মাছ খেলে কুবুদ্ধি আরও বাড়বে। ”

” আমার মাথায় যদি কুবুদ্ধি থাকে, তবে তোমার মাথায় কি আছে? অত্যাচারি মহিলা। ওর অত্যাচারে ভার্সিটিসুদ্ধ মানুষ তটস্থ থাকত। সে আবার আরেকজনকে বলে তার মাথায় কুবুদ্ধি। ”

” বাপ, চুপচাপ খাইয়া নেও। আমার মা’কে আমি খাওয়ায় দিতাছি , আমার তো কোন অসুবিধা হয়না। তুমি এম্নে কও ক্যা? যতদিন আমার শরীলে শক্তি আছে আমি ততদিন আমার মা’য়েরে খাওয়ায় দিমু। তুমি এরপর কোনদিন আর কিছু কইবানা। ” মা’য়ের কথা শুনে আরমান আর কিছু বললনা।

মাশিয়া মনের সুখে আয়েশা খানমের হাতে খাচ্ছে। আর মাঝেমধ্যে আরমানকে জব্দ করতে এটাসেটা বলছে।

” উমম আম্মা, সেই মজা। আপনার হাতে ম্যাজিক আছে। আপনি যেই খাবারেই হাত দেন, সেই খাবারই অমৃত হয়ে যায়। এটার স্বাদ অন্য কেউ বুঝবেনা। কোন বুইড়া-দামড়াতো অবশ্যই নয়। আপনার হাতের ছোঁয়ায় করলা ভাজিও মিষ্টি লাগছে। অপূর্ব, অসাধারণ। আহ্ কি শান্তি। ”

মাশিয়ার ভাবভঙ্গি দেখে সুধা, শশী ঠোঁট টিপে হাসছে। ওরা বুঝতে পারছে আরমানকে রাগানোর জন্যই কথাগুলো বলছে মাশিয়া। আয়েশা খানমও মাশিয়ার কথায় হাসছেন। শুধু আরমান চুপচাপ খেতে থাকে। ওর আম্মা ওকে চুপ থাকতে বলেছেন। তাই ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও ও কিছু বলতে পারছেনা। তবে রাগী চোখে বারবার তাকাচ্ছে মাশিয়ার দিকে। যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দেবে ওকে।

” আম্মাআআআআ, দেখেন হিটলার কিভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আজ রাতে আমি আপনার কাছে ঘুমাব। নয়তো আপনার হিটলার ছেলে আমাকে একা পেয়ে গলা টিপে মা’র’বে। আপনিতো জানেননা, প্রতি রাতেই সে আমাকে ধমকায়। আমাকে বাড়ির সব কাজ করতে বলেছিল। কিন্তু আমি কাজ করতে পারিনা তাই সে আমাকে প্রচুর হেনস্তা করে। আপনিই বলুন, আমি জীবনে কখনো বাড়ির কোন কাজ করেছি? আমি তাকে কতবারই বলেছি, বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে এসেছি, সব কাজ আমাকে করতেই হবে। আমাকে কিছুদিন সময় দিন। ধীরে ধীরে সব শিখে নিব। দেখবেন একদিন আমি সবার মনের মত হয়ে উঠব। কিন্তু সে আমার কোন কথাই শোনেনা। ” কান্নার ভঙ্গিতে আবারও বলল মাশিয়া।

মাশিয়ার কথা শুনে আরমান চুড়ান্ত পর্যায়ের অবাক হয়েছে। ও কখনোই যেসব কথা মাশিয়াকে বলেনি, আজ মাশিয়া সেসব কথা বানিয়ে বলছে! ওর নামে বিচার দিচ্ছে ওরই মা’য়ের কাছে!

” বাপ, আমার মা এইসব কি কইল? তুমি ওরে কাজের জন্য ধমকাও! তুমিতো এমন ছিলেনা, বাপ। তুমি আমার সোনার টুকরা ছেলে। তোমার মুখে এইসব কথা মানায়না। আর কখনোই তুমি বউমারে ধমকাইবেনা। কাজের জন্যও কিছু কইবানা। কাজ করার জন্য আমরা আছি। আমার মা’য়ে আমার বাড়িতে প্রজাপতির লাহান উইড়া বেড়াইবো। আমি তারে দেইখা আমার চোখের শান্তি নিমু। ”

” আম্মা, এই মেয়ের কথা তুমি বিশ্বাস করোনা। এই মেয়ে খুবই ধুরন্ধর সেই সাথে মিথ্যাবাদী। সে তোমার কাছে আমাকে খারাপ বানাতে চায়। ” আরমান স্তিমিত গলায় বলল।

” দেখেছেন, আম্মা? আমাকে মিথ্যাবাদী বলল, আবার ধুরন্ধরও। এবার আমার কান্না পাচ্ছে। আম্মা, আমি কাঁদতে শুরু করলাম। ” মাশিয়া সত্যিই কাঁদতে শুরু করল।

” মা’গো কাইন্দনা। আরমান তোমারে আর কিছুই কইবনা। সে এরপর তোমারে কিছু কইলে আমি তার বিচার করমু। তুমি দেইখা নিও। ” আয়েশা খানম মাশিয়াকে শান্তনা দিচ্ছেন।

মাশিয়া কেঁদেই চলেছে। আয়েশা খানম, সুধা, শশী অনেক বোঝানোর পর ও কান্না থামায়। ওড়নায় চোখ মুছে সবার অলক্ষ্যে আরমানকে চোখ টিপে ভেংচি কাটল মাশিয়া।

আরমানের বুঝতে বাকি থাকেনা মেয়েটা এতক্ষণ কান্নার অভিনয় করেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here