যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_২৫ জাওয়াদ জামী জামী

0
293

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী জামী

ওরা যখন বাড়িতে আসল তখন সন্ধ্যা প্রায় ছুঁইছুঁই। বিকেল তার আলোটুকু নিভিয়ে নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। যেন ফিঁকে রংটুকু নিয়ে বিকেল দিগন্তে হারাতে চলেছে। সেই দিগন্তের ওপারে সন্ধ্যা নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে অপেক্ষায় রত।

আয়েশা খানম ছেলে আর ছেলের বউকে দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে গেলেন। যেন কয়েক যুগ পর ওদেরকে দেখছেন। আরমান ভেবে পায়না কেন ওর আম্মাকেই এত মমতাময়ী হতে হলো! যে মানুষটার সন্তান ছাড়া কখনোই কোনও কিছু প্রাধান্য পায়নি। আব্বার মৃ’ত্যু’র পর একটা আস্ত বটগাছের ন্যায় তিনি সন্তানদের আগলে রেখেছেন। কখনো ওদের শরীরে ফুলের টোকাটিও পরতে দেননি। এসএসসি পাশ করার পরই তিনি বউ হয়ে এসেছিলেন এই সংসারে। আবার অল্প বয়সেই বিধবাও হয়েছিলেন। তার আব্বা-ভাইয়েরা অনেকবার তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আবারও বিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু আম্মা সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য জলাঞ্জলী দিয়ে স্বামীর ভিটে কা’ম’ড়ে পরে থেকেছেন। স্বামীর রেখে যাওয়া অস্তিত্বদের মানুষ মত মানুষ করেছেন। এই সেই আম্মা যিনি কখনোই আব্বার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেননি। সব সময়ই স্বামী ও তার পরিবারের সবাইকে সম্মান করেছেন। বিনিময়ে আজ তিনি শ্বশুর বাড়ির মধ্যমনি।

” বাপ, এম্নে চাইয়া রইছ কেন? বাড়িতে যাইবানা? ” আরমান আম্মার দিকে তাকিয়ে নানান চিন্তায় বিভোর ছিল। আয়েশা খানমের ডাকে তার চিন্তা ভঙ্গ হয়। ”

” আম্মাআআআ, কেমন আছেন? আপনাকে অনেক মিস করেছি। আরিব্বাস আপনিতো দেখছি আগের থেকে সুন্দরী হয়ে গেছেন! আপনার রূপের গোপন রহস্য কি, আম্মা? ” মাশিয়ার এহেন কথায় আয়েশা খানম থতমত খেয়ে গেলেন। এই মেয়ে বলে কি!

মাশিয়ার কথা শুনে শশী এগিয়ে আসল।

” ভাবি, আমিও আম্মাকে এই কথাটাই তিনদিন আগে বলেছিলাম। কিন্তু আম্মা ধমক দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু দেখ একই কথাটা তুমি আম্মাকে বললে, আর আম্মা চুপচাপ শুনে গেল। আজ বুঝলাম, আম্মা আমার থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসে। ”

” তুই থাম কইলাম। খালি ফাও কথা কয়! যা আমার মা’য়েরে নিয়া ভিতরে যা। বাপ, তুমি সুধার সাথে কইরা জিনিসপত্র নিয়া আসো। আমারেও কিছু দেও। ”

” তুমি ভেতরে যাও, আম্মা। আমিই সবকিছু নিয়ে আসছি। ”

মাটির ঘরে অনেকদিন পর এসে মাশিয়ার মন খুশিতে ভরে উঠল। বাহিরে প্রচন্ড গরম। অথচ এই ঘরটিতে শীতল মলয় এসে থেকে থেকেই দোলা দিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণের জানালা হাট করে খুলে দিল। প্রায় সাথে সাথেই হুহু করে দখিনা মলয় আছড়ে পড়লো, উড়িয়ে দিল মাশিয়ার দীঘল কালো কেশরাশি। মাশিয়া কিছুক্ষণ জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। উথাল-পাতাল মলয়ে শরীরে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। শিহরিত হচ্ছে শরীরের প্রতিটি র’ক্তকণিকা। শেষ বিকেল আর সন্ধ্যার এই সন্ধিক্ষণে অম্বরে নীলচে-কালো রংয়ের অপূর্ব সমাহার ঘটেছে। যেন কোন এক রমনী তার নিলচে-কালো আঁচল বিছিয়েছে সূদুর অম্বরে। মাশিয়া অভিভূত নয়নে তাকিয়ে থাকে অম্বর পানে।

” এভাবে দেবদাসীর মত বাহিরে তাকিয়ে কি দেখছ? এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে ফ্রেশ হয়ে এস। ” আরমানের কথা শুনে মাশিয়া ন্যাপসাক খুলে কাপড় বের করে কলপাড়ের দিকে যায়।

” আম্মা, এতদিন আপনার হাতের খাবার ভিষণই মিস করেছি। স্বীকার করতেই হবে আপনার মত রান্না খুব কম মানুষই করতে পারে। ” রাতে বারান্দার চৌকিতে বসে খাচ্ছে সবাই। খেতে খেতে মাশিয়া শ্বাশুড়ির রান্নার প্রসংশা করছে।

” কি কও, মা! এতদিন তোমার মা তোমারে রাইন্দা খাওয়াইছে, আর তুমি কইতাছ আমার হাতের রান্দনের অভাববোধ করছ! কতদিন পর মা’য়ের হাতের রান্দন খাইছ হেইডা ভালো লাগেনাই? তোমার পছন্দের খাবার মা’য়ে কেম্নে রান্ধে আমারে কইয়া দিও, আমি তোমারে রাইন্দা খাওয়ামুনে। ”

” আমার মমের হাতের রান্নাও অনেক মজার হয়। বিশেষ করে, রুই মাছের কালিয়া, কোপ্তা কারি, ইলিশের দোপেয়াজা। এতদিন মমের হাতের রান্না খেয়েছি ঠিক আছে, তারমধ্যেও আপনার রান্না মিস করেছি, ট্রাস্ট মি। আপনাদের দু’জনের রান্নার ধরন আলাদা। নিজ নিজ ক্ষেত্রে আপনারা সত্যিই পারদর্শী। ” মাশিয়া তৃপ্তি করে লাউ-চিংড়ি দিয়ে ভাত খাচ্ছে।

” আম্মা, আমি ঢাকার ঐ বাসাটা ছেড়ে দিয়ে আসিনি। সুধাকে মেডিকেল কোচিং-এ ভর্তি করিয়েছি। আগামী কয়েকমাস সুধা ঐখানেই থাকবে। ” আরমানের কথা শুনে বারান্দায় অবস্থিত প্রত্যেকেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। সবার একসাথে তাকানোয় আরমান অপ্রস্তুত হয়ে গেছে।

” কি কও, বাপ! সুধায় ঢাকা গিয়া একলাই থাকবো? ও একলা থাকপার পারবো! তাছাড়া সমত্ত একটা মাইয়া একলা একটা বাড়িতে থাকব, যদি কুন বিপদ হয়? ও ঢাকার পথঘাট কিছুই চিনেনা। তুমি বাড়িডা ছাইড়া দেও, বাপ। ” আয়েশা খানম ছেলের কথা শুনে ভিষণই চমকে গেছেন।

” আম্মা, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমিতো আছি নাকি? আমি ওকে ঢাকা নিয়ে যাব। প্রয়োজনে আমিও সুধার সাথে থাকব। ওকে সব চিনিয়ে দেব। তাছাড়া ঐ বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় আমার এক বন্ধুও থাকে ওর পরিবার নিয়ে। এছাড়াও বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি বেশ ভালো। সেখানে সুধার কোনও সমস্যা হবেনা। তুমি রাজি হয়ে যাও, আম্মা। তোমার স্বপ্ন ছিল আমি ডক্টর হই। কিন্তু আমি তোমার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। সুধাকে তোমার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ অন্তত দাও। ” আরমানের গলায় অনুনয়। যা স্পর্শ করল আয়েশা খানমের অন্তর।

” বাপ, তুমি ডাক্তার হইতে পারোনাই জন্য মন খারাপ করবানা কইলাম। আর নিজেরে দোষীও করবানা। তুমি অসুস্থ আছিলা তাই মেডিকেলে পরীক্ষা দিবার পার নাই। এই দোষতো তোমার না। তুমি মেডিকেলে পড়বার পারোনাই তো কি হইছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো খারাপ না। সেইখানে পড়তেও কপাল লাগে। ঠিক আছে, সুধা ঢাকা যাইব। কিন্তু ঐ বাসায় নাকি একটাই ঘর? সেখানে থাকবা ক্যাম্নে? ” আয়েশা খানমের কথায় আরমান হাঁফ ছাড়ল। ওর মুখে হাসি। ও হাসিমুখেই বলল,

” আম্মা, সেখানে একটা শোবার ঘর, একটা রান্নাঘর আর একটা ছোটমত ড্রয়িংরুম আছে। সেখানেই একটা ডিভান বসিয়ে নিলেই আমি থাকতে পারব। সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তুমি শুধু দিনরাত আমাদের জন্য দোয়া করবে। তোমার কাজ একটাই, বুঝলে? ”

” তুমি ডিভানে থাকবে আর আমি বিছানায় আরামে থাকব! এটা কখনোই হবেনা, ভাইয়া। আমি সেটা হতেই দেবনা। আমি ডিভানে থাকব, তুমি বেডরুমে থাকবে। ” সুধা মা-ছেলের কথার মধ্যে কথা বলল।

” তোকে মাতব্বরি করতে বলিনি। তোর কাজ পড়াশোনা করা, তুই সেটাই করবি। বাকি কাজগুলো আমিই করতে পারব। তাই চুপচাপ খেয়ে ঘরে গিয়ে পড়তে বস। ” আরমানের ধমকে ভড়কে যায় সুধা। ওর আর কিছু বলার সাহস হয়না।

মাশিয়া এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে মা ছেলের কথা শুনছিল। সেই সাথে দেখছিল ভাইবোনের খুনসুটি। মা-ছেলের, ভাইবোনদের মধ্যে এত ভাব দেখে ওর খুব ভালো লাগছে। আরমান যে ওর বোনদের খুব ভালোবাসে সেটা মাশিয়া আগেই বুঝেছে। আজ আবার নতুনভাবে বোনের জন্য ভাইয়ের ভালোবাসা দেখল। যে ভাই তার না হওয়া স্বপ্ন বোনকে দিয়ে পূরণ করতে চাচ্ছে।

শশীও কলেজে ভর্তি হয়েছে। ও এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছিল। শিক্ষা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিল। পরবর্তীতে আরমান ওকে ওদের জেলার সবচেয়ে ভালো কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। শশীর রেজাল্ট দেখে আরমানই সবথেকে বেশি খুশি হয়েছিল। বোনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছিল।

মাশিয়া বুঝতে পেরেছে এরা তিন ভাইবোন অসম্ভব ট্যালেন্ট। ওদের পাশে মাশিয়ার নিজেকে কেমন ফিঁকে লাগে। শশী দুষ্টু হলে কি হবে, পড়াশোনার ব্যাপারে ও সব সময়ই সিরিয়াস। সুধাও তাই। বরং শশীর থেকেও বেশি মনযোগী সুধা। মাশিয়ার বিশ্বাস সুধাও শশীর মতই ভালো রেজাল্ট করবে। ওদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মাশিয়ার হিমশিম খেতে হয়। আর যাইহোক মাশিয়া ওদের মত ট্যালেন্ট নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে ওর ও জিদ চেপে যায়। ইচ্ছে করে ভালো রেজাল্ট করার। সেই মত বই নিয়ে বসেও থাকে। পণ করে ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে দেখিয়ে দিবে। কিন্তু মাঝপথেই আবার সব পণ বাতাসে মিলিয়ে যায়। কিন্তু আরমান কখনোই হাল ছাড়েনা। ও মাশিয়ার পড়াশোনার দিকে কড়া নজর রাখে। এখনও সুধা, শশীর সাথে মাশিয়াকেও পড়তে হয়। দ্বিতীয় সেমিস্টার শেষ হয়েছে বলেও ছাড়া পায়না। তৃতীয় সেমিস্টারের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে এখন থেকেই।

বাড়িতে প্রায় সারা বছরই কোননা কোন ফসল থাকেই। তবে আরমান আপাতত সেদিকে নজর দিচ্ছেনা। সেসব তদারকির জন্য দুইজনকে রেখেছ। আরমান বর্তমানে সুধাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে। ও চায় সুধা মেডিকেলে পড়ুক। তার জন্য যত কষ্ট করতে হয় আরমান সব করবে। তবুও ওর আম্মার স্বপ্ন পূরণ করবেই। ওরা আর পাঁচ-সাতদিন পরই ঢাকা যাবে। আয়েশা খানম ব্যস্ত মেয়ের সাথে কি কি দেবেন সেসব নিয়ে। আরমান সুধাকে সবকিছু আগে থেকেই গুছিয়ে রাখতে বলেছে। সুধা ভাইয়ের কথামতই কাজ করছে। মাশিয়া শুধু বসে বসে এদের কাণ্ডকারখানা দেখছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here