#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১১+১২
জাওয়াদ জামী জামী
” এরা আমার মেয়েকে কি ভেবেছে? যার তার সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে! আমার মেয়ে কি ফেলনা! ” মিরাজ মোর্তাজা তার হাতে থাকা বায়োডাটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেললেন। রাগে তার মুখাবয়ব র’ক্ত বর্ণ ধারন করেছে।
” এত হাইপার হচ্ছ কেন? বায়োডাটা দেখলেই যে সেখানে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এমনটাতো নয়। আমাদের যেখানে পছন্দ হবেনা, সেখানে বিয়ে দেবনা, সিম্পল কথা। আর তুমি সবাইকে মাশিয়ার জন্য ছেলে দেখতে নিষেধ করে দাও এক্ষুণি। ” কল্পনা মোর্তাজা স্বামীর ডান হাত নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন।
” ছেলে দেখতে নিষেধ করে দেব মানে? তুমিইতো মাশিয়ার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছ। আবার সেই তুমিই বলছ বিয়ে দেবেনা! ” মিরাজ মোর্তাজা সবিস্ময়ে বললেন।
” আমি বলেছি পাত্র দেখতে নিষেধ করতে। বিয়ে দেবনা এটাতো বলিনি। আগামী একমাসের মধ্যেই মাশিয়ার বিয়ে আমি দেব। শুধু বলেছি, সবাইকে আর কষ্ট করে আমার মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে হবেনা। পাত্র আমি পছন্দ করেছি। ” কল্পনা মোর্তার ঠোঁটের কোনে সন্তুষ্টির হাসি। তার চোখমুখে আজ প্রশান্তির ছোঁয়া দেখতে পেলেন মিরাজ মোর্তাজা।
” পাত্র পছন্দ করেছ মানে! পাত্র কে? আগে বলনি কেন? ”
” আমি কি আগে দেখেছিলাম নাকি। গত পরশুদিনই না দেখলাম পাত্রকে। গত দুইটা রাত আর গতকাল সারাদিন অনেক ভেবে দেখলাম আরমানের মত পাত্র হাজারে একটাও পাওয়া যাবেনা। ” কল্পনা মোর্তাজা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন।
” আরমান! মানে মাশিয়ার টিচার? তুমি যা বলছ ভেবে বলছতো? ”
” হুম। শুধু ভাবিইনি। খোঁজও নিয়েছি। গতকাল সকালে একজনকে আরমানের গ্রামে পাঠিয়েছিলাম আরমান আর ওর পরিবার সম্পর্কে জানতে। সেখানকার সবাই একবাক্যে আরমান এবং ওর পরিবার সম্পর্কে পজিটিভ কথা বলেছে। তারা আরমানের মত ছেলেই হয়না। আবার ভার্সিটিতে পড়তে ও যেখানে থাকত সেখানে এবং ভার্সিটির ওর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের কাছেও ওর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি, সেখানেও সব পজিটিভ পেয়েছি। ”
” কল্পনা, তুমি ভেতরে ভেতরে এতকিছু করেছ! আরমান ভাল ছেলে এটা আমি জানি। আর সে পাত্র হিসেবেও যে পারফেক্ট এটাও মানি। কিন্তু তুমি তো জানোই মাশিয়ার সাথে আরমানের সম্পর্ক কেমন? তুমি কি মনে কর, মাশিয়া এই বিয়েতে রাজি হবে? আবার আরমানও কি মাশিয়াকে বিয়ে করতে চাইবে? আরমানের যে রেজাল্ট ও ভবিষ্যতে ভার্সিটিতে না-ও থাকতে পারে। যেকোন সময় ও ভালো জায়গায় জব পেয়ে যাবে। শুনেছি ও এবার বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর সেই ছেলে মাশিয়াকে বিয়ে করতে চাইবে বলে আমি মনে করিনা। ইনফ্যাক্ট ও নিজে মাশিয়ার সকল অপকর্ম বল আর কাজকর্ম যাই বলোনা কেন সবই দেখেছে। ”
” তুমি আগেই এত হতাশ হচ্ছ কেন! আমরাতো চেষ্টা করতেই পারি। মানলাম মাশিয়া বেয়াড়া, উশৃংখল। ও কিন্তু আমাদের ভুলের জন্যই এমন হয়েছে। আর এই বয়সে এমন একটুআধটু হতেই পারে। সেটা আমাদেরকেই শোধরাতে হবে। আর শোধরাবার কাজ আমাদের থেকে আরমান ভালো করতে পারবে। আমরা ওকে সাপোর্ট দেব মাশিয়াকে ঠিক করতে। শোন, আগেই এতকিছু না ভেবে আমরা আরমানের ফ্ল্যাটে যাই চল। শুনলাম ওর আম্মা অসুস্থ। এই সুযোগে তাকেও দেখে আসব আবার ওদের বিয়ের ব্যাপারেও আলোচনা করব। ”
” কল্পনা, আমার কাছে বিষয়টা ভালো লাগছেনা। নিজের মেয়ে জন্যই ওকে আরমানের সাথে বেঁধে দেয়ার কথা ভাবতে পারছিনা। আরমানের সাথে ওর আকাশপাতাল তফাৎ। তফাৎ যদি কয়েক কিলোমিটারের হয় তবে সেটা চেষ্টা করলেই কমানো যায়। কিন্তু আকাশপাতাল তফাৎ তুমি কেমন করে ঘোচাবে? আর যেখানে আমাদের মেয়েই এর জন্য দায়ী। ”
“আমি বললামনা, একমাত্র আরমানই ওকে ঠিক করতে পারবে৷ যে যতই তফাৎ হোকনা কেন সেটা আরমানই ঘোচাবে। ওকে আমার যেমনতেমন ছেলে বলে মনে হয়নি। তুমি ভুলে গেছ, বিয়ের পর যখন প্রথম এই বাড়িতে আসলাম, আমি কতটা আনাড়ি ছিলাম। তোমাদের সোসাইটির সাথে মিশতে পারতামনা, আরও অনেক কিছুই পারতামনা। কত কিছু জানতামনা। কিন্তু তুমি সব সময়ই আসার পাশে থেকেছ। আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছ। আজ আমি যা হয়েছি তার মূলেই আছ তুমি। তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। তুমি সেদিন আমার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলে বলেই আমি অনেকটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছি নিঃসংকোচে। তেমনি আরমানও না হয় মাশিয়ার দ্বায়িত্ব নেবে। ওর চলার পথের সাথী হবে। ” স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে মিরাজ মোর্তাজা আর না করতে পারলেননা। তার সামনে বসা এই মধ্যে বয়সী নারীর জন্য তিনি সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন। তার ভালোবাসা আর সহযোগিতায় তিনি হয়ে উঠেছেন একজন আদর্শ স্বামী, আদর্শ বাবা আর সর্বসাকুল্যে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে। বাবা-মা’র পরেই কল্পনা মোর্তাজা তার জীবনে এসেছে ধ্রুবতারা হয়ে।
” ঠিক আছে। মানলাম তোমার কথা। আগামীকালই আমরা যাব। কালকে শুক্রবার আরমানকেও বাসায় পাব আমরা। ওর সামনেই সব কথা হবে। ”
মিরাজ মোর্তাজার আশ্বাস পেতেই শ্বাস ছাড়লেন কল্পনা মোর্তাজা। তিনি কায়মনে প্রাথর্ণা করতে থাকেন নিজের মেয়ের জন্য। মেয়ের একটুখানি সুখের জন্য তিনি সৃষ্টিকর্তার নিকট দু হাত পেতে অঝোরে কাঁদলেন পুরোটা রাত। সে রাতে জায়নামাজই হলো তার কান্নার সাথী।
” চন্দ্র, বই, খাতা নিয়ে আমার কাছে আয়। আজকে তোর ফিজিক্স পরীক্ষা নিব। ” আরমানের ডাক শুনে শশীর মাথায় হাত।
” একটু আগেই না আমরা ঘুড়ে আসলাম। তার রেশ না কাটতেই তুমি আমাকে পরীক্ষা দিতে বলছ, ভাইয়া! আজকে থাক। কাল তুমি যা বলবে তাই শুনব। ” শশী ইনিয়েবিনিয়ে বলল।
” ঘুড়ে আসলি ভালো কথা। এর সাথে পড়ার সম্পর্ক কোথায়? বেশি কথা না বলে যা বলছি তাই কর। কালকে কেমিস্ট্রি পরীক্ষা নিব। এক মিনিট দেরি করলে সময় দশ মিনিট কমিয়ে দিব। আর আজকে ফিজিক্সে হান্ড্রেডে হান্ড্রেড না পেলে কালকের পরীক্ষা থেকে পনের মিনিট সময় কেটে নিব। কালকের পরীক্ষায় হান্ড্রেড না পেলে পরের পরীক্ষায় বিশ মিনিট কাটব। এভাবে শেষ পরীক্ষার রেজাল্টের ওপর নির্ভর করছে তুই আগামী মাসে বাবার বাড়িতে থাকবি না শ্বশুর বাড়িতে থাকবি। ” আরমানের প্রচ্ছন হুমকিতে ভয় পায় শশী। ওর আর কথা বাড়ানোর সাহস হয়না। সুরসুর করে বই খাতা নিয়ে আরমানের কাছে যায়।
সুধা রান্নাঘরে আয়েশা খানমের সাথে পিঠা বানাচ্ছে। আরমান পাটিসাপটা পিঠা পছন্দ করে। তাই গ্রামে যাওয়ার আগে আয়েশা খানমের ছেলেকে আরেকবার পাটিসাপটা বানিয়ে খাওয়ানোর সাধ জেগেছে। তিনি বাড়ি থেকে আসার সময় চালের গুঁড়া, গুড় এনেছিলেন। আজ তিনি আরমানকে দিয়ে দুধ কিনিয়েছেন। সেই দুধের ক্ষীর দিয়েই পাটিসাপটা বানাচ্ছেন।
শশী কিছুক্ষণ আইগুঁই করে পড়ায় মনোযোগ দেয়। আরমানের তৈরী করা কোয়েশ্চেনে পরীক্ষা দিচ্ছে ও। শশীর পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে আরমান ঘড়ির দিকে তাকায়। এখন রাত সাড়ে নয়টা বাজছে। এই সময় কে আসতে পারে ভেবে ওর কপালে ভাঁজ পড়ল।
এদিকে আয়েশা খানমের পিঠা বানানো শেষ। তিনি মেয়েকে নিয়ে ড্রয়িংরুম, রান্নাঘর গোছগাছ করছেন। এই সময় কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে তিনি সুধার দিকে তাকালেন। মৃদুস্বরে সুধাকে বললেন আরমানকে ডাকতে। এদিকে আরমান রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। ও সোজা গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
দরজা খুলে সামনে দাঁড়ানো অতিথিদের দেখে সত্যিই অবাক হয় আরমান। ও ভাবতেও পারেনি মিরাজ মোর্তাজা আর তার স্ত্রী ওর ফ্ল্যাটে আসবে। ও মৃদুস্বরে অতিথিদের সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বলল। কল্পনা মোর্তাজা তার স্বামীর পিছুপিছু ভেতরে ঢুকলেন। তাদের পেছনে বেশ কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে ঢুকল মিরাজ মোর্তাজার ড্রাইভার।
আয়েশা খানম আর সুধা ড্রয়িংরুমেই ছিলেন। অচেনা তিনজনকে দেখে আয়েশা খানম একটু বিব্রত হন। আরমান এগিয়ে এসে আয়েশা খানমের সাথে মিরাজ মোর্তাজা আর তার স্ত্রী’র পরিচয় করায়।
কল্পনা মোর্তাজা মাঝারি আকারের ফ্র্যাটের চারপাশে তাকালেন। একদম সাদামাটা বলতে যা বোঝায় ফ্ল্যাটটা সেরকমই। ফার্নিচারের তেমন বালাই নেই। একপাশে একটা টি টেবিলকে ঘিরে কয়েকটা চেয়ার পেতে রাখা আছে। মেঝেতে মাদুর বিছানো। মাদুরের ওপর খাবার ঢাকনা দিয়ে রাখা। কল্পনা মোর্তাজার বুঝতে অসুবিধা হয়না আরমান একা থাকে জন্যই এখনও ফ্ল্যাট ফাঁকা আছে।
” স্যার, আপনারা বসুন। ” আরমান নিস্প্রভ গলায় বলল।
” ইয়াং ম্যান আমরা তোমাকে বোধহয় অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিলাম? আসলে একটা পার্টি এ্যাটেন্ড করে আসলাম তাই দেরি হল। ” মিরাজ মোর্তাজা এমনভাবে বললেন যেন আরমান জানত তারা আজ আসবে।
” ইট’স ওকে, স্যার। আমরা জেগেই ছিলাম। আপনারা বসুন। ” আরমান হাতের ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে দিল।
কল্পনা মোর্তাজা আয়েশা খানমের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
” আপনার শরীর এখন কেমন আছে, আপা? আরমানের কাছে সেদিন শুনেছিলাম আপনি অসুস্থ? ”
” এখন আগের থাইকা ভালো আছি। আমার ছেলে চায়না আমি খারাপ থাকি। ” হাসিমুখে বললেন আয়েশা খানম।
” সোনার টুকরা ছেলে আপনার। কয়জন মা এমন সন্তান গর্ভে ধরে৷ ” কল্পনা মোর্তাজাও হেসে বললেন।
ড্রাইভার তার হাতের প্যাকেটগুলো আয়েশা খানমের হাতে দিয়ে বাহিরে চলে যায়।
” আসেন এইখানে বসেন। আপনাগো বসতে দেয়ার মত ভালো কিছু দিতে পারতেছিনা। আরমান এখনও কিছুই কিনেনি। ওরে জিনিসপত্র কিনতে কইলেই কয়, একা একা থাকি এত কিছু কিনে কি করব। ” আয়েশা খানম অতিথিদের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসতে দিতে লজ্জা পাচ্ছেন।
” ও তো ঠিকই বলেছে। একা একা থাকে। এতকিছুর দরকার কি। ” মিরাজ মোর্তাজা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
শশী ড্রয়িংরুমে গলার আওয়াজ পেয়ে দরজা থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে। কল্পনা মোর্তাজা দরজার আড়ালে দাঁড়ানো মেয়েটাকে দেখে ফেললেন।
” এটা তোমার বোন বুঝি? আরেকটা কই? ” সুধাকে দেখিয়ে বললেন কল্পনা মোর্তাজা।
আরমান শশীকে ডাকলে ও এসে সবাইকে সালাম দেয়।
আয়েশা খানম অতিথিদের সাথে কথা বলছেন
আরমান মা’য়ের পাশে বসে তাদের গল্প শুনছে। আর মাঝেমধ্যে দুই একটা কথা বলছে। সুধা আর শশী রান্নাঘরে নাস্তা সাজাচ্ছে। আয়েশা খানম অতিথিদের রাতের খাওয়ার কথা বললে তারা জানায় খেয়ে এসেছে। তাই তিনি মেয়েদের হালকা নাস্তা সাজাতে বললেন।
” আপনার ছেলেমেয়ে কয়ডা, আপা? ”
” আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটার বিয়ে দিলাম সাতদিন আগেই। আর মেয়ে আপনার ছেলের ছাত্রী। ” কল্পনা মোর্তাজা আয়েশা খানমে পছন্দ করে ফেলেছেন। সহজ-সরল এই মানুষটিকে যে কেউ পছন্দ করতে বাধ্য। যার কথাবার্তায় গ্রাম্যতা স্পষ্ট। অথচ এ নিয়ে তার কোন লুকাছাপা নেই। নেই কোন লজ্জা। নিজেকে একটা বারের জন্যও অযোগ্য কিংবা ছোট মনে করছেনা। কিংবা তাদের সামনে হীনমন্যতায়ও ভুগছেননা। ছেলের প্রতি তার মনে অগাধ ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছেন। এই মানুষটার দিকে তাকালেই কল্পনা মোর্তাজার চোখে পানি আসছে। বারবার মনে হচ্ছে, একজন মা হিসেবে তিনি আয়েশা খানমের সমকক্ষ কখনোই হতে পারবেননা। কল্পনা মোর্তাজা উসখুস করছেন কিভাবে তিনি মাশিয়ার বিয়ের কথা তুলবেন। সামনে বসা ভদ্রমহিলার ব্যক্তিত্ব্যের সামনে তার নিজেকে কেমন ফিঁকে লাগছে।
” আপনি ছেলের বিয়ে করায় বড় দ্বায়িত্ব পালন করছেন। আমার যে কবে সেই সৌভাগ্য হইব আল্লাহই জানেন। কবে যে ছেলেরে বিয়ে করাইতে পারমু। ”
কল্পনা মোর্তাজার ভাগ্য যেন সুপ্রসন্ন হয়। তিনি এতক্ষণ যে সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন সেই সুযোগ তিনি অযাচিতভাবে পেয়েই যান।
” দেরি না করে শুভ কাজটা করিয়েই দেন। আপনার ছেলেতো অযোগ্য নয়। ”
গল্প অন্য প্রসঙ্গ থেকে নিজের বিয়ের প্রসঙ্গে আসায় আরমান লজ্জায় পরে যায়। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এরপর রান্নাঘরে এসে বোনদের কাজে সাহায্য করতে হবে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করল।
” এইবার বিয়া দিমু । অনেক কওনের পর আমার ছেলে রাজি হইছে। এখন গ্রামে গিয়া আত্মীয় স্বজনদের কইয়া দিমু আমার বউমা খুঁজনের লাইগ্যা। চাঁন্দের লাহান বউমা আনমু আমার ছেলের জন্য। আপ্নেরাও একটা মেয়ে দেইখেন। যে আমার আরমানের সুখ-দুঃখ বুঝবো, হের বিপদআপদে আগলায় রাখব। এক কথায় আদর্শ বউয়ের হইব যে। এমন একটা মেয়ে খুঁইজা দিয়েন। ” আয়েশা খানম বিনীত অনুরোধ করলেন।
কল্পনা মোর্তাজা স্বামীর দিকে তাকালেন। সময় এসেছে, এবার আসল কথাটা পাড়তে হবে।
” আপা, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলার অনুমতি চাচ্ছি। ” মিরাজ মোর্তাজা ইতস্তত করে বললেন।
” কি কইবেন, ভাই সাহেব? এম্নে অনুমতি নিতে হইবনা। আপনি কইয়া ফালান। ”
” আপনি চাইলে আরমানের জন্য আমার মেয়েকে দেখতে পারেন। আশা করছি আপনার ওকে অপছন্দ হবেনা। হয়তো আপনার চাওয়া মত আদর্শ মেয়ে সে নয়। কিংবা ভদ্র বা শান্তও নয়। তবুও বাবা-মা হিসেবে আমরা তাকে আরমানের মত ছেলের হাতে দিতে চাইব। আপনাদের শাসনে, আদরে ও একজন আর্দশ পুত্রবধূ, স্ত্রী, ভাবী এবং সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করবে। ” মিরাজ মোর্তাজা অনেক আশা নিয়ে আয়েশা খানমের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আরমান রান্নাঘর থেকে সব শুনে নড়তেও ভুলে গেছে। ওর চোখের সামনে ভাসছে উদ্ধত একটা মেয়ের প্রতিচ্ছবি। যে কাউকেই পরোয়া করেনা। সবাইকে নিজের মত করে নাচাতে চায়। যে কাউকে সম্মান করতে জানেনা। এমন একটা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে কল্পনাই করতে পারছেনা আরমান। ও এখন মা’য়ের উত্তর শোনার অপেক্ষায় আছে।
মিরাজ মোর্তাজার প্রস্তাবে যারপরনাই অবাক হয়েছেন আয়েশা খানম। ইনারা এত ধনী হওয়া স্বত্বেও তাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে নিজেদের মেয়েকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন! তবে আয়েশা খানম তাদের চোখে নির্ভেজাল অনুরোধই দেখলেন। তাদের চোখে শুধুই মেয়ের জন্য উদ্বেগ খেলা করছে। সেখানে কোনও ছলনা নেই। তিনি কল্পনা মোর্তাজার দিকে তাকালেন। তার মুখ জুড়ে মমতার ছাপ প্রকট হয়ে উঠেছে। শহুরে বেশভূষার প্রলেপে মুছে যায়নি তার শরীর থেকে শেকড়ের গন্ধ। আয়েশা খানমের মত তারও শেকড় অচেনা কোন গ্রামে। সে আভিজাত্যের জমকালো জগতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেও কোথাও থেকে গেছে গ্রামের সেই মমতাময়ী নারীর ছায়া। মানুষ হিসেবে ইনারা মোটেও খারাপ নন। ইনাদের ভেতর অহংকারের লেশমাত্রও নেই। ইনারা যে কাউকে সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনা মোটেও।
” ঠিক আছে, ভাইসাহেব। আমি আপ্নের মেয়েরে দেখতে যাব। আপ্নেদের মত বাবা-মা’য়ের সন্তান কখনোই খারাপ হইতে পারেনা। হয়তো অর্থ-বিত্তের প্রভাবে তার ওপরে অহংবোধ জমা হইছে। কিন্তু হয়তো হেয় ভেতরে ভেতরে খাঁটি মানুষই রইছে। ”
আয়েশা খানমের কথা শুনে মিরাজ মোর্তাজা, কল্পনা মোর্তাজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী জামী
” আম্মা, তুমি এটা কি করলে? তুমি কি চাওনা তোমার ছেলে বেঁচে থাকুক? ” মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে নিয়ে বিদায় নিতেই, আরমান ওর আম্মাকে বলল।
” এইসব কি কও, বাপ! আল্লাহ্ আমার মাথায় যত চুল আছে, তত আয়ু তোমারে দিক। তুমি আমার আন্ধার ঘরের বাতি। এমন কথা আর মুখে আইনোনা। ” আয়েশা খানমের গলা ভারি হয়ে আসল। আরমান সেটা বুঝতে পেরে মা’কে ডান হাতে জড়িয়ে ধরল।
” তুমি যে উনাদের কথা দিলে, তাদের মেয়েকে দেখতে যাবে, তাদের মেয়ের সম্পর্কে আগে জানবে না? না জেনেই কেন কথা দিলে, আম্মা? ” আরমান মৃদুস্বরে বলল।
” তারা মানুষ ভালো। তাদের কোনকিছুই আমার কাছে অতিরিক্ত মনে হয়নি। তাই আমি কথা দিছি। তোমার কি সেই মেয়েরে পছন্দ নয়? ”
” বিষয়টা পছন্দ-অপছন্দের নয়, আম্মা। বিষয়টা হলো তাদের মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটা তার বাবা-মা’র মত নয়। চরম অবাধ্য সে। ”
” হয়তো বাপ-মায়ে’র শাসন পায়নি। শাসনের অভাবেই এমনডা হইছে। দুনিয়ায় কি সব মানুষই সমান, বাপ? দশ বছর আগে তুমি যেমন আছিলা, এখনই কি তেমনই আছো? নাইতো? তেমনি সেই মেয়ে এখন আমার যেমন আছে কয় বছর পর যে এমনই থাকবো এইডা কিন্তু না। মানুষ বদলায়। মানুষের মন স্থির থাকেনা কোনকালেই। বয়সের সাথে সাথেই মানুষ পাল্টায় যায়। ”
” কিন্তু আম্মা, আমি শিওর ঐ মেয়ে পাল্টানোর নয়। হাজার বছরের সাধনায়ও ওকে তুমি বদলাতে পারবেনা। ও অন্য ধাতুতে গড়া। বাবা-মা’র আচরণ দেখে যদি তুমি সেই মেয়েকে জাজ করতে যাও, তবে তুমি ভুল। ” আরমান ওর মা’কে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
” আমি কথা দিছি, বাপ। তারে আমার দেখবার যাওনই লাগব। তবে যদি তোমার পছন্দের কেউ থাকে, আমারে কও। আমি তাদের না কইরা দিমু। ”
” নাহ্ তেমন কেউই নেই। আমি শুধু বলতে চাইছি, তুমি যাকে পুত্রবধূ করতে চাইছ, সে ম্যারেজ ম্যাটেরিয়াল নয়। ”
” ভাইয়া, তুমি আম্মা’র কথার মাঝে বাঁধা দিচ্ছ কেন! আম্মা সাধ করেছে তার ছেলের জন্য বউ দেখতে যাবে, তোমার উচিত আম্মাকে সাপোর্ট দেয়া। লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে এদিকসেদিক ঘুরঘুর করা। কন্যা দেখতে কি কি ফলমিষ্টি নিবা গোপনে সেগুলোর লিস্ট করা। কিন্তু সেটা না করে তুমি আম্মার ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিতে চাইছ! ” শশী এবার মা-ছেলের মধ্যে কথা বলেই ফেলল।
আরমান শশীর দিকে রাগী চোখে তাকাতেই এগিয়ে আসল সুধা।
” শশীতো ঠিকই বলেছে, ভাইয়া। তোমার বিয়ের কথা শুনে আমাদের দুই বোনের যে কত আনন্দ হচ্ছে সেটাকে তুমি ভেস্তে দিতে চাইছ কেন? তোমার কোন কথাই আমরা শুনবনা। কাল সন্ধ্যায় আমরা পাত্রী দেখতে যাবই। ”
” তোরা এখন বুঝবিনা, কোন জিনিস দেখার জন্য উদগ্রীব হচ্ছিস। বাবা-মা’কে দেখে মেয়ের বিচার করছিস। একবার তার সামনে যা, তার মুখ ঝামটা সহ্য কর, তারপর বুঝবি কাকে দেখার জন্য পা’গ’ল হয়েছিলি। ”
” বাপ, এইডা কোন ধরনের কথা কইলা? তোমার ভাষাতো এমন ছিলনা। আমরা মেয়ে দেখতে যাইতাছি, তারে সাথে কইরা আনবার যাইতাছিনা। আগে মেয়ে দেখি, পছন্দ হয় কিনা সেইডাও দেখি। তারপর পাকা কথা দিমু। আর তুমি যে কইলা, মেয়ের বাবা-মা’রে দেইখা, মেয়েরে পছন্দ করতাছি। বিষয়ডা খানিকটা সত্য। বাবা-মায়ে’র স্বভাব সব ছেলেমেয়েরাই পায়। তবে সেইডা কারও তারাতারি প্রকাশ পায়, কারও প্রকাশ পাইতে দেরি হয়। হয়তো এই মেয়ের বেলায়ও সেইডা প্রকাশ এখনও পায়নাই। ”
আরমান বুঝতে পারছে ওর আম্মার মাথায় মাশিয়ার বিষয়টা গেঁথে গেছে। তাকে আর এখান থেকে সরিয়ে আনা যাবেনা। সে মেয়েটাকে দেখেই তবে ছাড়বে।
” শুনলে, ভাইয়া? এবার আম্মার কথা শুনে কনে দেখতে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও। আমরা কাল সন্ধ্যায় যাচ্ছি সেখানে। ” শশীর আর আনন্দ ধরছেনা।
” পা’গ’ল নাকি! আমি যাব ঐ মেয়েকে দেখতে? তোদের শখ হয়েছে তোরা গিয়ে দেখে আয়। আমি এরমধ্যে নেই। ”
” তুমি এমনভাবে বলছ, যেন সে একটা পা’গ’ল? আর আমরা সেখানে গেলে আমাদের কা’ম’ড়ে দেবে? শুধু শুধু ভয় দেখাও কেন! ” শশী মুখ গোমড়া করে বলল।
” ভয় দেখাচ্ছিনা, সত্যিই বলছি। মেয়েটাকে বিশ্বাস নেই। তোদের কথাবার্তা শুনে কা’ম’ড়ে দিতেও পারে। কা’ম’ড়া’নো’র সম্ভাবনা তখনই বেড়ে যাবে, ও যখন শুনবে তোরা আমার বোন। সাবধানে থাকবি কিন্তু সেখানে গিয়ে। ”
” বাপ, তুমি আবারও মেয়েডারে অসম্মান করতাছ? তোমারে ছোট থাইকা শিখাইছি, মেয়েদের কখনোই অসম্মান করবানা। তাদের সম্মান দিবা, ভালোবাসা দিবা। দেখবা তারাও তোমারে মাথায় তুইলা রাখব। মনে রাইখো, তুমি যা দিবা সেডাই ফেরত পাইবা। ”
” বুঝেছি, আম্মা। তবে তোমরা তাকে দেখতে যাচ্ছ যাও। কোন কথা দিয়ে বসোনা কিন্তু। তাকে দেখবে, সবার সাথে কথা বলবে এরপর বাসায় চলে আসবে। আমি সকাল গাড়ি ঠিক করে রাখব। ”
” আচ্ছা। এবার আইসা খাইয়া নাও। ”
” মাশিয়াত বিনতে মোর্তাজা, আপনার মন কোথায় আছে? এর আগেও বলেছি ক্লাস করতে ইচ্ছে না করলে বাহিরে গিয়ে দাঁড়াবেন। আপনার জন্য অন্যদের মনযোগ নষ্ট হোক সেটা আমি চাইনা। ” ক্লাস নেয়ার ফাঁকেই আরমান লক্ষ্য করেছে মাশিয়া ওর কথা না শুনে কিছু একটা করছে।
” আমি এর পরের ক্লাসের একটা নোট দেখছিলাম। ” মাশিয়া চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
” যখনকার কাজ তখন করবেন। তবে চেষ্টা করবেন ক্লাসের নোটগুলো বাসা থেকে সল্ভ করে আনার। যদি না পারেন তবে সেটা সেই স্যারকে বলবেন অথবা আমাকে ক্লাস শেষে আমাকে বলবেন। বোঝাতে পেরেছি? ”
” হুম। ” মাশিয়া আর কিছু না বলে নোটগুলো রেখে দেয়। আর মনে মনে আরমানকে গালি দিতে থাকে।
” মাস্টার, একবার তোমাকে বাগে পাই, তখন বুঝবে মাশিয়া কি জিনিস। খালি আমার ওপর মাতব্বরি ফলতে চাওয়া? এমন ফাঁদে তোমাকে ফেলব, তুমি কেঁদেও কূল পাবেনা। ”
” মনে মনে গালি দিতে চাইলে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ান আর যত খুশি গালি দিন। তখন অবশ্য মনে মনে না দিয়ে জোড়েই গালি দিতে পারবেন। ” আরমান মাশিয়ার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে ও গালি দিচ্ছে।
আরমানের কথায় মাশিয়া চমকে যায়। সেই সাথে অবাকও হয়। ওর মাথায় ঢুকছেনা মনে মনে গালি দিল ও, কিন্তু সেটা মাস্টার বুঝল কিভাবে!
” মাশিয়া, ওঠ। আর কত ঘুমাবে? উঠে রেডি হয়ে নাও। আজকে বাসায় মেহমান আসবে। ” মাশিয়া আজ তারাতারি ভার্সিটি থেকে এসেছে। এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। বিকেল পাঁচটা বাজতেই ওর ভাবী দোলনের ডাকে ঘুম ভাঙল।
” ডাকছ কেন, ভাবিপু? আরেকটু ঘুমাতে দাও। তোমার বিয়ে হয়েছে আটদিন। এখন তোমার হানিমুনে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা না করে আমার ঘুমের চৌদ্দটা বাজাচ্ছ কেন? ”
” আমার হানিমুনে যেতে আরও কয়দিন লেগে যাবে। এখন আমার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা কর। উঠে ফ্রেশ হও। এরপর সুন্দর পোশাক পরে রেডি হয়ে নাও। ”
” আমি কিছুই করতে পারবনা। ” মাশিয়া ওর ভাবির কথা না শুনে আবারও শুয়ে পরল। দোলন ওকে ডেকেও তুলতে পারলনা। বাধ্য হয়ে সে কল্পনা মোর্তাজার কাছে যায়।
” মাশিয়া, অনেক ঘুমিয়েছ। এবার ওঠ। তোমার পাপা লিভিং রুমে তোমার অপেক্ষা করছে। ” কল্পনা মোর্তাজা মাশিয়াকে টেনে তুললেন।
” মম, তুমিও ডাকাডাকি শুরু করলে? আরেকটু ঘুমাতে দাও। কিছুক্ষণ পর পাপার সাথে কথা বলে নিব। ”
” সারারাত ঘুমানোর জন্য কি যথেষ্ট নয়? তুমি যদি এখন না ওঠ, তবে শরীরে পানি ঢেলে দেব। মেহমানরা কখন যেন এসে যাবে। কিন্তু তুমি এখনও পরে পরে ঘুমাচ্ছ! ”
” মেহমান আসার সাথে আমার ঘুমানোর সম্পর্ক কি! মেহমান আসলে তোমরা আছ তাদের আপ্যায়নের জন্য। এরমধ্যে আমাকে টানছ কেন? ”
” মেহমান আসছেই তোমার জন্য। ”
” বোঝ ঠ্যালা। আমি আবার কি করেছি! আমাকে দিয়ে তাদের কি কাজ? ”
” তারা তোমাকে দেখতে আসছে। ” কল্পনা মোর্তাজার কথা কারেন্টের মত কাজ করল। মাশিয়া এক ঝটকায় উঠে বসল।
” কিহহহহ। আমাকে দেখতে আসছে মানে কি? আমি কি গ’রু নাকি ছা’গ’ল, যে আমাকে দেখতে আসবে? ” মাশিয়ার চিৎকারে বদ্ধ রুম প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
” আস্তে কথা বল। তুমি কোন গ’রু, ছা’গ’ল নও। তুমি অসভ্য একটা মেয়ে। অবশ্য সেটা আমি পাত্রপক্ষকে জানাইনি। আর তারা ছেলেকে বিয়ে করাবে। সেজন্য মেয়ে কেমন সেটা দেখার অধিকার তাদের আছে। ”
” আমি কোথাও যাবনা। তুমি বাহিরে যাও। আমি দরজা বন্ধ করে ভেতরেই থাকব। ”
” আর একটা কথা বললে তোমাকে টেনে থা’প্প’ড় মা’র’ব। বেয়াদবির একটা সীমা থাকে। যেটা ক্রস করা তোমার জন্য বোকামি হবে। তুমি প্রথমে ফ্রেশ হবে এরপর মার্জিত পোশাক পরবে এবং মেহমান আসলে তাদের সামনে যাবে এবং তাদের সাথে ভালোভাবে কথা বলবে। তাদের প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দেবে। মনে রেখ তোমার কারনে যদি তোমার বাবার কোন অসম্মান হয়, তবে আজই তোমার এই বাড়িতে শেষ দিন। তোমাকে গ্রামে তোমার দাদুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। সেখানেই একা থাকবে তুমি। ” কল্পনা মোর্তাজা আর সেখানে থাকলেননা। দৃঢ় পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কল্পনা মোর্তাজা যাওয়ার পর মাশিয়া কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থাকল। ও বেশ বুঝতে পারছে বাবা-মা ওর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ওর কোন নিষেধই তারা শুনবেনা। এমনকি ও কিছু করতে গেলেই তারা সেটার জন্য শাস্তি দিতেও দুইবার ভাববেনা। ও যেন এই মুহুর্তে অকূলপাথারে পরেছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। কিছুক্ষণ পর দোলনের ডাকে ওর হুশ ফিরল। বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।
” তোমার নাম কি, মা? ” মধ্যবয়সী নারীর ডাকে সম্বিৎ ফিরে মাশিয়ার। ও লিভিং রুমের সোফায় বসে সামনে বসা মানুষগুলোর গোষ্ঠী উদ্ধার করছিল।
” মাশিয়াত বিনতে মোর্তাজা। ”
” মাশা-আল্লাহ সুন্দর নাম। শুনলাম তুমি নাকি না খাইয়াই ঘুমায় গেছিলা? এমুন কইরোনা গো, মা। এতে শরীলডা খারাপ হইয়া যায়। ”
এবার সেই মধ্যবয়সী নারীর কথা শুনে মাশিয়া আকাশ থেকে পরল। ওর বুঝে আসছেনা পাপা-মম কি দেখে এমনভাবে কথা বলা একজন মহিলার ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতে চাচ্ছে। ও মনে মনে ভাবছে, যার মা এভাবে কথা বলে, তার ছেলে না কিভাবে কথা বলবে। মাশিয়ার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এমন সময় মাশিয়া বুঝল, ওর পাশে এসে একজন বসল। ও লিভিং রুমে ঢোকার সময়ই দেখেছিল একজন সুন্দরী মধ্যবয়সী মহিলার সাথে দুইজন মেয়ে এসেছে। সেই মেয়েগুলোর একজনই ওর পাশে বসেছে। মাশিয়া স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। একটু এদিকওদিক হলেই মম ওকে থাপড়ানোর হুমকি দিয়েছে। মাশিয়া পাশে বসা মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি।
” তোমাকে একটু দেখছি। কিছু মনে করোনা। ভাইয়ার বউয়ের সব ঠিকঠাক আছে কিনা সেটাতো আমাকেই দেখতে হবে। তাইনা বলো? ” ”
মাশিয়া কিছু না বলে ওপর-নিচে মাথা নাড়ায়। মেয়েটার কথায় ও বিরক্ত হয়েছে।
” আহ্ শশী। কিসব বলছিস? ” আরেকজনের মৃদু ধমক শুনে মাশিয়া বুঝল মেয়েটির নাম শশী।
” আমিতো ঠিকই বলেছি, আপু। ভাইয়ার কথা মিলিয়ে নিতে হবেনা? ভাইয়াইতো বলেছিল, এই মেয়ে সুযোগ পেলেই আমাদের কা’ম’ড়ে দিতে পারে। আমাকে তো সেটা পরখ করতে হবে নাকি? হাজার হলেও কা’ম’ড় দেয় এমন কোন মেয়ের সাথে আমার ভাইয়ার বিয়ে দিতে পারিনা। ” শশীর কথা শুনে আয়েশা খানম আর সুধা লজ্জায় মাথা নিচু করে।
কল্পনা মোর্তাজা তার স্বামীর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আর মাশিয়াতো পারলে সব তছনছ করে দেয়। লিভিং রুমে বর্তমানে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।
” তবে ভাইয়া যাই বলুক না কেন, তুমি কিন্তু বেশ সুন্দরী। ভাইয়ার সাথে তোমাকে মানাবে। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তবে কা’ম’ড় দেয়ার অভ্যাস থাকলে সেটা ছেড়ে দাও। বিয়ের পর তোমার কা’ম’ড়া’নো’র অভ্যাস থাকলে দুইমাসের মধ্যে দেখবে তোমার একটা দাঁতও থাকবেনা। ভাইয়া আবার দাঁত তোলায় এক্সপার্ট। আর দাঁত না থাকলে আমার আম্মার হাতের রান্না করা মাংস খেতে পারবেনা। আম্মার হাতের হাঁসের মাংস ভুনা হেব্বি টেস্টি হয়। ঐটা না খেলে তোমার লাইফে বড় জিনিস মিস করে যাবে। ”
শশীর কথা শুনে মিরাজ মোর্তাজা হো হো করে হেসে উঠলেন। আয়েশা খানম চোখ বড় করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ওকে চুপ থাকতে বললেন। কল্পনা মোর্তাজাও হাসছেন।
মাশিয়া এবার রেগে কল্পনা মোর্তাজার দিকে তাকায়। কল্পনা মোর্তাজা ইশারায় ওকে বসে থাকতে বললেন। বাধ্য হয়ে মাশিয়াকে সেখানেই বসে থাকতে হল।
” শশী, একটু চুপ করবি বইন? তুই আগেই আপুকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিস। আমার ভাইয়া কি ভয়ংকর কেউ? আমার ভাইয়ার মত ভাইয়া সারা দেশ খুঁজলে দশটা পাওয়া যাবেনা। ” সুধা পরিবেশ হালকা করতে বলল।
” তুমি ওর কথায় কিছু মনে কইরোনা, মা। এই মেয়ে একটু বেশি কথা কয়। আমার আরমান খাঁটি একখান মানুষ। সে কখনোই অন্যায় করেনা আর অন্যায়কে মাইনাও নেয়না। ”
আরমান নামটা কানে আসতেই ঝট করে কল্পনা মোর্তাজার দিকে তাকায় মাশিয়া। সেটা লক্ষ্য করেই সুধা বলল,
” তোমার শিক্ষক আরমানের কথাই বলছে, আম্মা। ”
” মম, তোমরা ঐ মাস্টারের মা-বোনদের বাসায় আসতে বলেছিলে? তোমরা জানোনা ঐ মাস্টার যখনই সুযোগ পায়, তখনই আমাকে অপমান করে। ইনফ্যাক্ট আজও সে আমাকে অপমান করেছে। তোমরা ভাবলে কি করে, ঐ মাস্টারকে আমি বিয়ে করব? আমি জীবনেও ঐ হিটলার মাস্টারকে বিয়ে করবনা। ” আয়েশা খানম তার মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে যেতেই খেঁকিয়ে উঠল মাশিয়া। ও এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছে। তারা চলে যেতেই সে আগ্নেয়গিরির ন্যায় ফেটে পরল।
” তোমার হ্যাঁ কিংবা না তে কিছুই আসে যায়না। আগে দেখ তারা তোমাকে পছন্দ করে কিনা। তারা পছন্দ করলে শুকরিয়া আদায় করবে, বুঝলে? এখনকার দিনে আরমানের মত ছেলে পাওয়া দুষ্কর। তারা যদি তোমাকে পছন্দ করে, তবে আমরা সাতদিনও দেরি করবনা। বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে। ”
” আমি কিছুতেই ঐ মাস্টারকে বিয়ে করবনা। নেভার এভার। ”
” তাহলে আমাকে তোমার চিরদিনের জন্য হারাতে হবে। ” কল্পনা মোর্তাজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন।
হতভম্ব মাশিয়া ছলছল নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। ওর আজ নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই ধুলার ধরনীতে ও নিঃস্ব, জরাজীর্ণ এক নারী মাত্র। যার মূল্য কেউই দিতে চায়না। টুপ করে দু ফোঁটা নোনা জল ঝরে পরল ওর চোখের কোন বেয়ে।
আরমান আপাতত স্বস্তিতে আছে। আয়েশা খানম তাদেরকে তেমন কিছু বলে আসেননি। তবে আরমান আয়েশা খানমের হাবভাবে বুঝতে পেরেছে মাশিয়াকে তার পছন্দ হয়েছে। তিনি যেকোনো মুহূর্তে আরমানের কাছে বিয়ের কথাটা তুলবেন। তবে আরমান সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ও এই প্রথমবার আম্মার কথার বিপক্ষে যাবে। মাশিয়াকে ও কখনোই বিয়ে করবেনা।
চলবে…