#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১৩
জাওয়াদ জামী জামী
পরদিন মাশিয়া আর ভার্সিটিতে যায়না। ও ভার্সিটির টাইমেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
আরমান তার নির্ধারিত ক্লাস নিয়ে চলে যায় সুপারশপে। বাসা থেকে বেরোনোর সময় শশী ওর হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। সেসব কিনতেই ও সুপারশপে যায়।
মাশিয়া সারাটা সকাল রিশাদের সাথে কফিশপে বসে কাটিয়েছে। ও রিশাদের কাছে মনের যত রাগ উগড়ে দিয়েছে। এই সুযোগে রিশাদও ওকে আরমানের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে। দুপুর গড়াতেই মাশিয়ার হুশ ফিরল। অন্যদিন এতক্ষণে ও বাসায় থাকে । কিন্তু আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। আর সময়ক্ষেপন না করে বিল মিটিয়ে ও রিশাদকে নিয়ে কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসল।
আরমান ব্যাগ হাতে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রোদে ওর মাথা ঘোরাচ্ছে। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। কপাল বেয়ে ঘামের সরু রেখা নেমে এসেছে ভ্রুর নিচে। পকেট থেকে রুমাল বের করে আরেকবার পুরো মুখ মুছে নেয়। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আশেপাশে একটা রিক্সাও চোখে পরছেনা।
” আরে এতো দেখছি দুই টাকার মাস্টার! বাব্বাহ্ মাস্টার দেখছি সুপারশপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! আবার ব্যাগও জিনিসপত্রে ভর্তি! তা বলছি কি, সুপারশপের বিল মেটানোর টাকা কাছে ছিল? নাকি বাকিতে এনেছেন?”
রোদে, গরমে এমনিতেই মেজাজ খিঁচরে ছিল তারউপর কারও এমন অপমানজনক কথা শুনে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল মাশিয়া ঠোঁটের কোনে৷ ব্যাঙ্গের হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে রিশাদ।
” আমি করেছি না করেছি, সেটা নিয়ে আপনার এত মাথা ব্যথা কেন? নিজের চরকায় তেল দিন। শুনেছি পরপর দুইবার সেকেন্ড সেমিস্টারে ফেইল করেছেন? এখন যেভাবে চলছেন, এমন করলে আগামী দুই সেমিস্টারও একই ক্লাসরুমে কাটাতে হবে। কান খুলে শুনে রাখুন, শিক্ষক আমি, কোন ভিখারি নই। তাই সুপারশপে আমিও কেনাকাটা করতে পারি। ” রাগে আরমানের চোখমুখ র’ক্তবর্ণ ধারন করেছে।
” বেইবি, লেকচারারের দেখি রাগও আছে! লটারি লেগে গেছে তার। আর এজন্যই তেজী ঘোড়ার মতো ছটফট করছে। ” ওদের কথার মাঝে রিশাদ ফোঁড়ন কাটে।
” ঠিকই বলেছ। আমার পাপার প্রপার্টি, বাংক-ব্যালেন্স এসবের মালিক আমিও। আর সে বুঝেশুনেই আমার পাপা-মমকে পটিয়েছে। পাপা-মম তো এই মাস্টার বলতে পা’গ’ল। আমার কোন কথাই শুনছেনা। আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছ? ” মাশিয়া আরমানকে উপেক্ষা করে রিশাদের সাথে কথা বলছে।
আরমান রাগে ফুঁসছে। পাব্লিক প্লেস না হলে এই মুহুর্তে ও মাশিয়াকে থাপ্পড় দিতে একবারও ভাবতনা।
” সব বুঝেছি, বেইবি। তুমি তোমার পাপার অর্ধেক প্রপার্টির মালিক। কিন্তু তোমাকে হাত করা সহজ নয় দেখে তোমার বাবাকে হাত করেছে। যে করেই হোক তোর সব প্রপার্টি তার চাই, সেটাইতো? সা’পও ম’র’ল, লাঠিও ভাঙ্গলনা পদ্ধতিতে কাজ করছে লেকচারার। সবই হচ্ছে তোমার বাবার প্রপার্টির জন্য। এই লেকচারার ভিষণ চালু। নিজেকে সবার সামনে সাধু প্রমান করে ভেতরে ভেতরে দাবার চাল দিতে দক্ষ সে। ঠিক বলেছিতো লেকচারার? ” রিশাদ শেষ কথাটা বলে আরমানের কাঁধে হাত রাখল।
নিজের কাঁধে রিশাদের হাতের ছোঁয়া পেতেই আরমান তার হাতে থাকা ব্যাগ নিচে রেখেই, রিশাদের নাক বরাবর ঘুষি মা’র’ল। আচমকা ঘুষি খেয়ে রাস্তায় ছিটকে পরল রিশাদ। ওর নাকমুখ, মাথা ব্যথায় দপদপ করছে। কিছুক্ষণের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল। মাশিয়া আরমানের এমন কাজে ভয় পেয়ে গেছে। ও চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে।
” ইউ ব্লাডি ফুল। আমার কাঁধে হাত রাখার সাহস পাও কিভাবে? ভবিষ্যতে আমার সামনে আবার আসলে মে’রে মাটিতে পুঁতে দেব। এরপর কাউকে লোভী বলার আগে কয়েকবার ভাববে। আই স্পিট অন মিরাজ মোর্তাজা’স ওয়েলথ। সবাইকে নিজের মত মনে কর তাইনা? এই মেয়ের পেছনে তুমি এমন ঘুরঘুর কর বিনা স্বার্থেই? হুম? তোমার এই মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করার জন্য এর বাবার প্রাপার্টি ছাড়া আর কোন কারন খুঁজে পাইনা আমি। বাবার সম্পদের অহংকার ছাড়া কিচ্ছু নেই এই মেয়ের মধ্যে। সি ইজ আ টোটাল ননসেন্স গার্ল। ” আরমান লক্ষ্য করল ওদের কথপোকথন শুনে আশেপাশের কয়েকজন মানুষ ওদের দেখছে। তাই সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।
এদিকে মাশিয়া আরমানের মুখে নিজের সম্পর্কে এমন অপমানজনক কথা শুনে তেড়ে আসল আরমানের দিকে।
” আমি ননসেন্স! আমি ননসেন্স হলে আপনি কি? আপনি যে একটা ভিখারি। যে আমার পাপার সম্পত্তির লোভে নিজের মা’কে আমার বাসায় পাঠিয়েছেন। আপনার মা যেই শুনেছে আমি অনেক সম্পদের মালিক, তখনই মেয়েদের নিয়ে নাচতে নাচতে আমাদের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছে। আপনার মত লোভী, ভিখারিকে আমি বিয়ে করতে চাইনা। ”
” সাট আপ ইউ স্টুপিড গার্ল। কথা বলতে গিয়ে নিজের সীমা অতিক্রম করোনা। তাহলে ফল মোটেও ভালো হবেনা। ” আরমান কথার মাঝেই হাতের ইশারায় একটা রিক্সা ডাকে।
” কি করবেন আপনি? বিয়ে করবেননা আমাকে? তাহলে অনেক কিছু হাতছাড়া হয়ে যাবে আপনার! তারপর কি ভার্সিটির জবটা করবেন? অবশ্য জব না করে কোথায় যাবেন! জবটাই তো আপনার একমাত্র সম্বল। ওটা হারালে রাস্তায় বসে যেতে হবে। শেষ অব্দি কার ফল খারাপ হবে? আমার না আপনার? ”
এই মুহুর্তে আরমানের কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। এদিকে রিক্সাও এসে গেছে। ও ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসল। আর মাশিয়া নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আরমানকে যাচ্ছেতাই বলছে। আরমান শুধু এক নজর মাশিয়ার দিকে তাকায়।
পুরো রাস্তা আজকের ঘটনার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একবার ভাবল আরমান। শেষে রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। রাগের বশেই কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল সে। যেখান থেকে ওকে ফেরানোর সাধ্য কারও নেই। বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে শশীকে ফোন দিয়ে নিচে আসতে বলল।
অসময়ে নিজের অফিসে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত আরমানকে দেখে বেশ অবাকই হয়েছেন মিরাজ মোর্তাজা। তবে আরমানের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন কিছু একটা ঠিক নেই।
” আরে ইয়াং ম্যান! তুমিতো আমাকে সারপ্রাইজ দিলে। এস বস। ”
আরমান মিরাজ মোর্তাজাকে সালাম দিয়ে চেয়ার টেনে বসল।
” আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিল। ”
” কথাবার্তা পরে হবে। আগে তুমি গলা ভিজিয়ে নাও। ভার্সিটি থেকে এসেছ বোধহয়? তোমাকে টায়ার্ড দেখাচ্ছে। ” মিরাজ মোর্তাজা ইন্টারকমে তার পিওনকে জুস পাঠাতে বললেন।
” স্যার, আমার কথা আগে শুনুন। তারপর যদি মনে করেন আমাকে আপ্যায়ন করা যায়, তবেই জুস আনতে বলবেন। ”
আরমানের কথা শুনে মিরাজ মোর্তাজার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। শঙ্কা এসে বাসা বাঁধে বুকের কোটরে।
” গুরুতর কিছু মনে হচ্ছে? আচ্ছা আগে বল কি হয়েছে? ”
” আমাকে আপনি নিজের মেয়ের জন্য হঠাৎ কেন সিলেক্ট করেছেন? ” কোন জড়তা ছাড়াই বলল আরমান।
” তোমার নিষ্ঠা, সততা, ব্যাক্তিত্ব, তোমার রেজাল্ট, জব এসব দেখে। ” মিরাজ মোর্তাজা একবাক্যে সত্যিটাই বললেন।
” যদি এই মুহুর্তে আমি জব ছেড়ে দেই তবেও কি আপনার মেয়ের জন্য আমাকে বেছে নেবেন? ”
” কি ব্যাপার বলতো? মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে এবং সেটা ভালো কিছুই নয়। ” মিরাজ মোর্তাজার গলায় শঙ্কা প্রকাশ পায়।
” আপনার মেয়ে মনে করে আমি আপনার প্রপার্টির লোভে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। তার ভাষায় আপনাকে আমি পটিয়েছি। সেকারণেই আমার আম্মা আর বোনদের আপনার বাসায় পাঠিয়েছিলাম। ”
” হোয়াট! মাশিয়া এসব বলেছে? ”
” জ্বি। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই, যেটা আপনি দেননি। আমার জব না থাকলেও কি মাশিয়ার জন্য আপনি আমাকে ভাববেন? ”
মিরাজ মোর্তাজা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকলেন আরমানের দিকে। তিনি কিছু বলার ভাষা হারিয়েছেন তাকে চুপ থাকতে দেখে আরমান মৃদু হেসে আবারও মুখ খুলল।
” মানছি আপনি একজন আদর্শ পিতার দ্বায়িত্ব পালন করতে চেয়েছেন। কিন্তু ভুল আপনি করেছেন। যার বিয়ের কথা ভাবছেন, সে বিয়েতে রাজি কিনা সেটা আগে জেনে নেয়া দরকার ছিল। নিজের মেয়ের সম্পর্কে সবকিছুই জানেন আপনি। আপনার মেয়ে কোন ধাতুতে গড়া সেটাও আপনার অজানা নয়। ”
” আমরা ওর পছন্দের ওপর ভরসা কোন কালেই করিনা। অবশ্য ওর কোন পছন্দের মানুষও নেই। আমরা ভেবেছিলাম তুমিই একমাত্র ওকে ঠিক পথে আনতে পারবে। একমাত্র তোমার কাছেই ও জব্দ হয়। ”
” নিজের মেয়েকে জব্দ করতে গিয়ে তাকে আমার সাথে বেঁধে দিতে চাইছেন! একবারও ভাবলেননা, এতে আপনার মেয়ের প্রতিক্রিয়া কি হবে? কিংবা এর প্রভাব আমার ও আমার পরিবারের ওপর কিভাবে পরবে? ” আরমানের কন্ঠে নিখাঁদ বিস্ময়।
” তুমি কি করতে চাইছ? ” মিরাজ মোর্তাজা নিচু গলায় বললেন। তিনি বুঝতে পারছেন তার আশার আলো ধীরে ধীরে নিভতে চলেছে।
” কিছু করতে চাইনা। বলতে চাই। আমি জব ছাড়লে কি আপনি আপনার মেয়ের জন্য আমাকে ভাববেন? আপনার উত্তর যদি ‘ হ্যাঁ ‘ হয়, তবে আমি কালকেই জব ছাড়ব। এবং ওকে আমার সাথে গ্রামে যেতে হবে। সেখানেই তাকে থাকতে হবে যতদিন না সে শোধরায়। ওকে আমার পরিবার, পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। আমার মত করে থাকতে হবে। আমি চাষাবাদ করব, সেখানে তাকে সহযোগিতা করতে হবে। মোটকথা, একজন আদর্শ গ্রাম্য বধূ হয়ে উঠতে হবে তাকে। এবং যতদিন সে না শোধরাবে, ততদিন সে আপনার বাসায় বছরে দুইবার আসবে এবং সেখানে দুই রাতের বেশি থাকতে পারবেনা। এবং আপনার উত্তর যদি ‘ না ‘ হয় তবেও আমি জব ছাড়ব। অন্য এক প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সেখানে জয়েন করব। আপনার জবাবের অপেক্ষা এবং আশা উভয়ই করছি আমি। তবে সেটা এখনই না জানালেও চলবে। আসছি। ” আরমান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
” আরে উঠছ কেন? তুমি টায়ার্ড। খাবার চলে আসবে এখনই। যেওনা। ” মিরাজ মোর্তাজার গলায় অনুনয়।
” আজ নয়। আপনার উত্তরের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। ” আরমান বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।
বাসায় এসে আরমান সোজা ওয়াশরুমে ঢুকল।গোসল সেড়ে বেরিয়ে এসে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। আজকের ঘটনা ভুলতে চায় সে। সেজন্য একটা শান্তির ঘুম দরকার। ওর স্থির বিশ্বাস মিরাজ মোর্তাজা ওর প্রস্তাবে কিছুতেই রাজি হবেননা। আর যাইহোক কোন বেকার ছেলের সাথে কোন বাবা-মা’ই তাদের মেয়েকে তুলে দেবেননা।
” মাশিয়া কোথায়? বাসায় আছে? ” মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে কোন সম্ভাষণ ছাড়াই জিজ্ঞেস করলেন।
” খাচ্ছে। একটু আগেই বাসায় এসেছে। ” কল্পনা মোর্তাজা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঘটেছে।
মাশিয়া ডাইনিং টেবিলে সাজানো কয়েকরকম তরকারি থেকে শুধু চিংড়ি ভুনা নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল। মিরাজ মোর্তাজা যে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেদিকে ওর খেয়ালই নেই। হঠাৎই সামনে থেকে খাবারের প্লেট সরে যেতেই ও বিরক্ত হয়ে ঘার ঘুরিয়ে তাকায়।
” পাপা, তুমি? কিছু বলবে? ” আর কিছুই বলতে পারলনা মাশিয়া। গালে সপাটে একটা থাপ্পড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে পাপা ওকে থাপ্পড় মেরেছে।
” আরমানকে কি বলেছ? এত সাহস পেয়েছ কোথায় থেকে? ”
এবার মাশিয়া বুঝল কেন ওকে থাপ্পড় হজম করতে হল৷
” যা বলেছি ঠিক বলেছি। ” ফুঁপিয়ে কাঁদছে মাশিয়া।
” তার মানে তুমি বলতে চাইছ, আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল? ”
” ভুল এবং বিরক্তিকর সিদ্ধান্ত ছিল। ” মাশিয়ার কান্না কিছুতেই থামছেনা।
” তোমার কাছে যেটা ভুল এবং বিরক্তিকর সেটাই আমাদের কাছে সঠিক। আর সেটা মানতে তুমি বাধ্য। তোমার ভালো চাই আমরা। যেভাবে তুমি চলাফেরা কর, সেটা আর যাইহোক ভালো কিছু হতে পারেনা। তোমাকে আমরা একজন আদর্শ পাত্রের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম। ”
” চাইনা আমার এমন আদর্শ স্বামী। সে একটা অসভ্য, বর্বর মানুষ। মেয়েদের সে সম্মান দিতে জানেনা। আর আমাদের ফ্যামিলির সাথে তার ফ্যামিলি কোনদিক দিয়ে যায় বলতে পার? আমার আত্মীয় বন্ধুরা যেখানে হাই সোসাইটি বিলং করে, সেখানে আমি একজন শিক্ষকের স্ত্রী হয়ে জীবন পার করব? ”
” অন্যের উদাহরণ দেয়ার আগে নিজের যোগ্যতা একবার যাচাই কর। তোমার আত্মীয়, বন্ধুরা যেখানে হাইলি এডুকেটেড সেখানে তুমি কি? অবশ্য তোমাকে এভাবে বলে আমি আরমানকে ছোট করতে পারবনা। তোমার ভাগ্য ভালো যে, আরমানের মা তোমাকে পছন্দ করেছে। তিনি এখন ছেলের মতামতের অপেক্ষা করছেন। আরমান ছাড়া অন্য কেউ যদি তোমার জীবনে আসে, তবে তাদের অর্থ থাকবে ঠিকই, তারা কেউই আরমানের মত ব্যাক্তিত্বের হবেনা, ওর মত আদর্শবান হবেনা। ”
” তুমি যতই ঐ মাস্টারের সাফাই গাওনা কেন, তাকে আমি কিছুতেই বিয়ে করবনা। ”
” তাহলে তুমি বোধহয় আমাকে ছাড়াই বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার প্ল্যান করেছ? সেটা যদি করেই থাক, তবে শুনে রাখ, আমার মৃ’ত্যু’র পর তুমি আমার চেহারা দেখতে পাবেনা। এমনকি আমার মৃ’তদেহের আশেপাশে তোমার ছায়াটুকুও থাকবেনা। আজকের পর থেকে আমার মুখ তুমি দেখবেনা। ” কল্পনা মোর্তাজা এতক্ষনে মুখ খুললেন।
” মম! তুমি এভাবে বলোনা। তোমাদের ছাড়া আমি থাকতে পারবনা। আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি, মম। ”
” তুমি যদি আমাদের সত্যিই ভালোবেসে থাক, তবে বিয়ের প্রস্তুতি নাও। সেই সাথে প্রস্তুতি নাও আরমানের সাথে তার গ্রামে যাওয়ার। এবং এখন থেকে তোমাকে সেখানেই থাকতে হবে, যতদিন না তুমি নিজেকে বদলাতে পার। ” মিরাজ মোর্তাজার কথায় তার দিকে তাকালেন কল্পনা মোর্তাজা। তার চোখের তারায় খেলা করছে প্রশ্ন।
মাশিয়া বাবার কথা শুনে নিজে কি বলবে ভেবে পায়না। তবে কি আর কোন পথ খোলা নেই! এদিকে মমও ওকে কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। যেটা মান্য করার কথা ও ভাবতেও পারছেনা। ও কিছুতেই সইতে পারবেনা মা’য়ের মৃ’ত্যু। আবার আজ প্রথমবার বাবা ওর গায়ে হাত তুলেছে। যেটা মাশিয়ার কাছে অসম্ভব ব্যাপার। সবকিছু মিলিয়ে মাশিয়া বুঝতে পারছে ওকে হার মানতেই হবে। এতকিছুর পরও ওর মনের গভীরে বাবা-মা’র প্রতি এক গাঢ় অভিমান জমাট বাঁধল।
” তুমি নিচে ঐ কথা বললে কেন? ” মিরাজ মোর্তাজা রুমে আসলে, তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
” কোন কথা? ”
” আরমানের গ্রামে যাওয়ার কথা। ”
স্ত্রী’র কথায় মাথা তুলে তার দিকে তাকালেন মিরাজ মোর্তাজা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন। এরপর একে একে সব বলতে থাকলেন।
পরদিন একটু দেরিতে ভার্সিটিতে যায় আরমান। ও রাতেই রিজাইন লেটার তৈরী করেই রেখেছে। ভার্সিটিতে যেয়ে শুধু জায়গামত পৌঁছে দিয়েই ও বাসায় ফিরবে। এরপর আম্মাকে সব জানাতে হবে।
ডিপার্টমেন্ট ঢুকতেই আরমানকে পিওন জানায়, চেয়ারম্যান স্যার তার জন্য নিজের কেবিনে অপেক্ষা করছেন। আরমান কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে উত্তর হাতড়ে বেড়ায়। কিন্তু কোন উত্তর পায়না সে।
” এসো ইয়াং ম্যান। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ” মিরাজ মোর্তাজা হাসিমুখে বললেন।
” আমাকে কেন ডেকেছেন, স্যার? ”
” ইয়াং ম্যান, আমরা মানুষরা প্রত্যেকেই স্বার্থপর। নিজেদের স্বার্থ ব্যাতীত আমরা অন্য কিছুই ভাবতে পারিনা। এই যে আমাকে দেখ। আমি মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে ভুলে গেছি তোমারও কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, কিছু বলার থাকতে পারে। কিন্তু আমি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কথাই ভেবে চলেছি। আবার তুমি, নিজের এবং পরিবারের ভালোটা চিন্তা করতে গিয়ে আমার মেয়েকে চাইছনা, তাই কঠিন শর্তের বেড়াজালে বেঁধেছ আমাকে। কিন্তু ঐ যে বললাম, আমরা মানুষ বড়ই স্বার্থপর। তাই মেয়ের ভালোর জন্য তোমার শর্ত আমাকে মেনে নিতেই হচ্ছে। দাও তোমার রেজিগনেশন লেটার। ”
মিরাজ মোর্তাজার কথায় আরমানের মাথায় যেন ঝাঁকে ঝাঁকে বাজ পড়ল। ও কল্পনাও করতে পারেনি ওর এমন কঠিন শর্তে এই ভদ্রলোক সহজেই রাজি হয়ে যাবেন! হঠাৎই ওর পা দুটো বেইমানী করতে শুরু করল। তারা আর দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছেনা।
চলবে….