#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী জামী
” মাগো, এই শাড়িডা পইরা বাইরে গিয়া বস। প্রতিবেশিরা সকাল থাইকাই তোমারে দেখবার আসতাছে। তুমি ঘুমায় রইছ জন্য তারা চইলা গেছিল। এখন আবার তারা আইছে। তারাতারি এইডা পইরা আইস। ” আয়েশা খানম একটা শাড়ি তুলে দিলেন মাশিয়ার হাতে। তিনি এই শাড়িটা বিয়েতে দেননি।
” আমি এখন কোন শাড়ি পরবনা। কাল সারারাত শাড়ি পরে শাড়িতে আমার বিরক্ত এসে গেছে। আমি সালোয়ার-কামিজেই ঠিক আছি। ”
মাশিয়ার কথা শুনে আয়েশা খানমের মন খারাপ হয়ে যায়। সেটা তিনি মাশিয়াকে বুঝতে না দিয়ে আবারও বললেন,
” এইডা গ্রাম। গ্রামে নতুন বউয়েরা বিয়ের পর কয়েকদিন শাড়িই পরে। তুমি এইভাবে বাহিরে গেলে নানানজন নানা কথা কইব। শাড়ি পরা, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশিদের সাথে পরিচিত হওয়া, এগুলাই গ্রামের রীতিনীতি। ”
” এসব রীতিনীতি মানার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। এসব ফাও রীতিনীতি মানুষ পায় কই! আমি শাড়ি পরতে পারিনা, পরে আনইজি লাগে, তারপরও আমাকে শাড়ি পরতে হবে! আমি পারবনা এসব। ” মাশিয়ার এহেন কথায় আয়েশা খানম মলিন হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
মাশিয়া হাতে থাকা শাড়ি বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। ও একবারও লক্ষ্য করলনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরমান সব কথাই শুনেছে।
” আজ পর্যন্ত আমি এবং আমার বোনেরা আম্মার কথা অমান্য করিনি। এবং চাইওনা কেউ তার কথার অমান্য করুক। আম্মা সব সময়ই গ্রামে সবার কাছে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের পাত্রী। তার এই সম্মান কোন ঠুনকো কারনে ধুলোয় লুটাক, এটা আমি হতে দেবনা। আম্মা যা করতে বলেছে, ভদ্র মেয়ের মত সেটাই করবে। রাইট নাউ। ” আরমানকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখে চমকায় মাশিয়া। কিন্তু আরমানের কথা শেষ হতেই ওর রাগ তরতরিয়ে বাড়তে থাকে।
” আপনি ভালো করেই জানেন, আমি কোন ভদ্র মেয়ে নই। আর তাছাড়া কারও সম্মান রক্ষা করার দ্বায়িত্বও আমার নয়। তাই কোন শাড়ি-ফারি আমি পরতে পারবনা। ” ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বলল মাশিয়া।
” আম্মার সম্মান রক্ষা করার দ্বায়িত্ব না হয় তোমার নেই, কিন্তু নিজের সম্মান তোমাকেই রক্ষা করতে হবে। তুমি যদি চাও প্রতিবেশিদের সামনে তোমার সম্মানের দফারফা হোক, তবে এতে আমার কোন দায় নেই। ” আরমানও কম যায়না। ও মাশিয়ার কথাকে পাত্তাই দিলনা।
” হোয়াট! কি করবেন আপনি? ”
” সেটা তোমাকে বলবনা নিশ্চয়ই? তবে আম্মার কথা না শোনার ফল ভালো হবেনা, এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি। ”
” ফল ভালো হবেনা মানে? আবার নিশ্চয়ই থা’প্প’ড় মা’র’বে’ন? আপনার মত অসভ্য, বর্বরের কাছ থেকে এটাই আশা করা যায়। ”
” শুধু থা’প্প’ড় মেরেই কি বেয়াদবদের বশে আনা যায়! থা’প্প’ড়ে’র বাহিরেও অনেক ট্রিক্স আছে। তোমার যদি ইচ্ছে করে সেসব ট্রিক্স দেখতে, তবে এভাবেই বাহিরে যেতে পার। আই সয়্যার পরের দশ মিনিটে তুমি এখানে এসে আমার হাত-পা ধরবে নিজের মুখ বাঁচাতে। ”
আরমানের গলায় এমন কিছু ছিল যা মাশিয়ার মনে ভয়ের সঞ্চার করল। ও আরমানের দিকে তাকায়। কিন্তু আরমান টেবিলে কিছু একটা খুঁজছে। কিছুক্ষণ পর একটা কাগজ পেতেই চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
মাশিয়া বিছানায় বসে পা দোলায় আর আরমানের দিকে তাকায়। কিন্তু আরমান এমন ভাব করছে যেন ঘরে মাশিয়ার কোন অস্তিত্বই নেই। অনেক চিন্তাভাবনার পর মাশিয়া শাড়িটা হাতে নেয়।
” এমন ক্লাউনের মত বসে আছেন কেন? বাহিরে যান, আর কাউকে পাঠিয়ে দিন। আমি একা একা শাড়ি পরতে পারবনা। ”
আরমান কাগজে কিছু একটা লিখছিল। মাশিয়ার কথায় মুখ তুলে তাকায়, কিন্তু কিছুই বলেনা। কাগজ কলম রেখে বাহিরে বেরিয়ে যায়।
সারা বিকেল উঠানে বসে কাটল মাশিয়ার। একের পর এক মেয়েরা আসছে আর কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাচ্ছে। তবে যাবার আগে তাদের সবাইকে পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করছেন আয়েশা খানম। তিনি মাশিয়াকে শাড়ি পরতে দেখে ভিষন খুশি হয়েছেন। একটু পর পর তিনি ছেলের বউয়ের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। হাসিমুখে সবার সাথে বউয়ের পরিচয় করাচ্ছেন। মাশিয়া এই মানুষটা সহ্য শক্তি দেখে অবাক হয়। সারারাত জার্নি করে এসেই কাজে লেগে পরেছে। তার চেহারায় কোন ক্লান্তির চিহ্ন নেই। সন্ধ্যার আগ দিয়ে সুধা মাশিয়াকে আয়েশা খানমের ঘরে নিয়ে যায়। মাশিয়া আরমানের ঘরে যেতে চাইলেও সুধা যেতে দেয়নি। এদিকে দুপুরের পর মাশিয়া আরমানের চেহারা দেখতে পায়নি। এতে অবশ্য মাশিয়ার কিছুই যায় আসছেনা।
রাত সাড়ে নয়টার দিকে আরমান বাড়িতে আসলেও তাকে ঘরে ঢুকতে দেয়া হয়না। ওর প্রয়োজনিয় জিনিসপত্র সুধা আম্মার ঘরে রেখেছিল।
” আম্মা, শহিদ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। সে আমাদের উত্তরচৌকির যে সাত বিঘা জমি চাষ করত, সেটা ফিরিয়ে নিব। এবার আমি সেখানে ধান চাষ করব। শহিদ ভাইও রাজি হয়েছে। পনের দিন পর থেকে চারা বোনার কাজ শুরু হবে। সেসব ঠিকঠাক করে আসলাম। ” দক্ষিণের ঘরের বারান্দার চৌকিতে বসে সবাই রাতের খাবার খাচ্ছে। আরমানের এমন কথায় সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।
” বাপ, তুমি কি সত্যিই আর চাকরি করবানা! ভার্সিটির চাকরি ভালো না লাগলে, অন্য চাকরি কর। সেই কবে গ্রাম থাইকা ঢাকা পড়বার গেছিলা। তুমি এসব চাষাবাদ করবার পারবানা। এসবে খুব কষ্ট, বাপ। তোমার আব্বা’য় কখনো কি তোমারে জমিতে নিয়া গেছে? সে কখনোই চায়নি তার ছেলে জমিজমা চাষ করুক। সে চাইছে, তার ছেলে পড়াশোনা কইরা সমাজের দশজনের মইধ্যে একজন হোক। ” আয়েশা খানম আদ্র গলায় বললেন।
” আম্মা, চাষাবাদ করা কি খারাপ? কৃষকরা কি মানুষ নয়? এই কৃষকরাই কিন্তু দেশের কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে দিনরাত পরিশ্রম করে। এরাই প্রকৃত মানুষ, খাঁটি দেশপ্রেমিক। ”
” আমি সেইডা কইনাই, বাপ। কৃষকরা না থাকলে দেশের মানুষ না খাইয়া থাকব এইডা আমি জানি। চাষাবাদ করবার জন্য দেশের অনেক কৃষক আছে। তুমি কেন? এত পড়াশোনা কইরা শেষ পর্যন্ত মাঠেঘাটে কাজ করবা? ” আয়েশা খানম মাশিয়াকে মাছের কাঁ’টা বেছে দিচ্ছেন আর কথা বলছেন।
” এতদিন তো শহরে কাটালাম। কিছুই পাইনি। মাঝখানে শহরের কিছু মানুষের কুৎসিত রূপ দেখলাম। এবার একটু গ্রামে থিতু হয়ে দেখি। ভালো না লাগলে আবার কোন একটা জব খুঁজে নিব। ”
” ভাইয়া, তুমি কি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তটা নিয়েছ? পারবেতো গ্রামে থাকতে? আর ভাবি? সে-তো শহরের মানুষ। সে কিভাবে এখানে থাকবে? ” সুধা জিজ্ঞেস করল।
” যার জন্ম, বেড়ে ওঠা গ্রামে। সে গ্রামে থাকতে পারবেনা! আমি নয় বছর ধরে ঢাকায় থাকি মানে এই নয় যে নিজের শেকড়কে ভুলে যাব। আর আজকের পর থেকে আমি যেখানে থাকব, তোর ভাবিও সেখানেই থাকবে। তাকে গ্রামের পরিবেশ, মানুষজনের সাথে মিশে যেতে হবে।এতেই তার মঙ্গল। ”
আরমানের কথা শুনে কেউ আর কিছুই বললনা। মাশিয়া ওর দিকে কিছুক্ষণ রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নেয়।
” আম্মা, তুমি তাকে কাঁটা বেছে দিলে নিজে খাবে কখন? আজ থেকে যার কাজ সে-ই করবে। তুমি কোন সাহায্য করবেনা। ভুলে যেওনা তুমি নিজেই অসুস্থ। এখন থেকে তুমি তার নয়, সে তোমার সেবা করবে। ” আয়েশা খানমকে মাছ বাছতে দেখে আবার কথা বলল আরমান।
” তুমি আমাগো মা-মেয়ের মইধ্যে আসবানা। চুপচাপ খাইয়া ঘরে যাও। ” আয়েশা খানম ছেলেকে ধমক দিলেন।
মাশিয়া সবার অলক্ষ্যে আরমানকে ভেংচি কেটে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
ঘরে ঢুকেই আরমান থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরময় ফুলেরা সুবাস ছড়াচ্ছে। ও এতক্ষণে বুঝল, তখন ওকে ঘরে ঢুকতে দেয়া হয়নি কেন। তিন আঙ্গুলে কপাল ঘষল সে। ওর এই এক বদঅভ্যেস। টেনশনে পরলেই তিন আঙ্গুলে কপাল ঘষবে। ফুলে ফুলে সাজানো বিছানার দিকে তাকিয়েই ওর মেজাজ খিঁচরে যায়। সেই সাথে রাগ উঠল সুধার ওপর। নিশ্চয়ই এসবের বুদ্ধি ওর মাথা থেকেই বেরিয়েছে। আরমানের চিন্তার মধ্যেই মাশিয়াকে ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে দরজা টেনে দেয় সুধা। যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করতে বলে দেয়।
ঘরে ঢুকে মাশিয়াও আরমানের মত হতভম্ব হয়ে গেছে।
” এসব কি! আর আপনিইবা এখানে কেন? রুম থেকে বেরিয়ে যান এখনই। ”
” আমার রুম থেকে আমাকেই বেরিয়ে যেতে বলছ? সাহস কত! এই শোন, আমাকে নাটক-সিনামার হিরো ভাবলে ভুল করবে। রুমে থাকতে না চাইলে বাহিরে যাও। তোমাকে আটকানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই। ” আরমান আর কিছু না বলে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরল।
” তাই যাব। আপনার মত অসভ্য মানুষের সাথে এক রুমে রাত কাটানোর ইচ্ছে আমার নেই। আপনি জন্মের মত ঘুমান। আমি বাহিরে গেলাম। ”
” মোষ্ট ওয়েলকাম। গুড নাইট। ”
” ইচ্ছে আপনাকে খু’ন করতে। কিন্তু আমি আপনার মত বর্বর নই বলে বেঁচে গেলেন। ” কিছুক্ষণ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর বলল মাশিয়া।
” এখনও রুমে কি করছ! তুমি বাহিরে গেলে আমি লাইট অফ করে দিব। ”
মাশিয়া দুপদাপ পা ফেলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দার এক কোনায় জলচৌকি পাতা আছে। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে জলচৌকিতে গিয়ে বসল। দক্ষিণের ঘরের দরজা বন্ধ। জানালার কপাট খোলা। সেখান থেকেই ড্রিম লাইটের আলো এসে পরেছে বারান্দায়। বাড়ির মূল দরজার কাছে একটা বাল্ব জ্বলছে। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার অনবরত ডাকে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। জলচৌকিতে বসে মনে মনে আরমানের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে ব্যস্ত মাশিয়া। ঠিক তখনই ওকে ভয়ের সাগরে হাবুডুবু খাইয়ে নিভে যায় বাড়ির সব লাইট। লোডশেডিং শুরু হয়েছে। হঠাৎ চারপাশটা অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়ায় মাশিয়ার কলিজা এক লাফে গলার কাছে আসে। যেকোন মুহূর্তে টুপ করে বেরিয়ে পরবে। ভয়ের কাছে হার মেনে দেয়াল হাতড়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে আরমান খাটের সাইড টেবিলে থাকা চার্জার লাইট অন করেছে।
ঘরে এসে হাঁফ ছাড়ল মাশিয়া। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে খাটের পাশে এসে দাঁড়ায়।
” খবরদার আমার এদিকে আসবেননা। তাকাবেননা আমার দিকে। মাঝখানে কোলবালিশ থাকুক। যদি আমার দিকে এসেছেন, তবে আপনার হাত কা’ম’ড়ে ছিঁ’ড়ে নিব। ”
” আমিতো জানি তুমি চতুষ্পদী প্রানীদের স্বজাতি। এটা আর ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার দরকার নেই। আমার নিজের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। আর তাছাড়া তোমার মধ্যে নারীসুলভ কোনকিছুই আমার চোখে পরেনি। তাই নিশ্চিত থাকতে পার। ”
আরমানের খোঁ’চা শুনে মাশিয়া কোলবালিশ ছুঁড়ে মা’র’ল ওর দিকে। এরপর ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পরল।
চলবে…
” মাগো, এই শাড়িডা পইরা বাইরে গিয়া বস। প্রতিবেশিরা সকাল থাইকাই তোমারে দেখবার আসতাছে। তুমি ঘুমায় রইছ জন্য তারা চইলা গেছিল। এখন আবার তারা আইছে। তারাতারি এইডা পইরা আইস। ” আয়েশা খানম একটা শাড়ি তুলে দিলেন মাশিয়ার হাতে। তিনি এই শাড়িটা বিয়েতে দেননি।
” আমি এখন কোন শাড়ি পরবনা। কাল সারারাত শাড়ি পরে শাড়িতে আমার বিরক্ত এসে গেছে। আমি সালোয়ার-কামিজেই ঠিক আছি। ”
মাশিয়ার কথা শুনে আয়েশা খানমের মন খারাপ হয়ে যায়। সেটা তিনি মাশিয়াকে বুঝতে না দিয়ে আবারও বললেন,
” এইডা গ্রাম। গ্রামে নতুন বউয়েরা বিয়ের পর কয়েকদিন শাড়িই পরে। তুমি এইভাবে বাহিরে গেলে নানানজন নানা কথা কইব। শাড়ি পরা, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশিদের সাথে পরিচিত হওয়া, এগুলাই গ্রামের রীতিনীতি। ”
” এসব রীতিনীতি মানার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। এসব ফাও রীতিনীতি মানুষ পায় কই! আমি শাড়ি পরতে পারিনা, পরে আনইজি লাগে, তারপরও আমাকে শাড়ি পরতে হবে! আমি পারবনা এসব। ” মাশিয়ার এহেন কথায় আয়েশা খানম মলিন হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
মাশিয়া হাতে থাকা শাড়ি বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল। ও একবারও লক্ষ্য করলনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরমান সব কথাই শুনেছে।
” আজ পর্যন্ত আমি এবং আমার বোনেরা আম্মার কথা অমান্য করিনি। এবং চাইওনা কেউ তার কথার অমান্য করুক। আম্মা সব সময়ই গ্রামে সবার কাছে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের পাত্রী। তার এই সম্মান কোন ঠুনকো কারনে ধুলোয় লুটাক, এটা আমি হতে দেবনা। আম্মা যা করতে বলেছে, ভদ্র মেয়ের মত সেটাই করবে। রাইট নাউ। ” আরমানকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখে চমকায় মাশিয়া। কিন্তু আরমানের কথা শেষ হতেই ওর রাগ তরতরিয়ে বাড়তে থাকে।
” আপনি ভালো করেই জানেন, আমি কোন ভদ্র মেয়ে নই। আর তাছাড়া কারও সম্মান রক্ষা করার দ্বায়িত্বও আমার নয়। তাই কোন শাড়ি-ফারি আমি পরতে পারবনা। ” ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বলল মাশিয়া।
” আম্মার সম্মান রক্ষা করার দ্বায়িত্ব না হয় তোমার নেই, কিন্তু নিজের সম্মান তোমাকেই রক্ষা করতে হবে। তুমি যদি চাও প্রতিবেশিদের সামনে তোমার সম্মানের দফারফা হোক, তবে এতে আমার কোন দায় নেই। ” আরমানও কম যায়না। ও মাশিয়ার কথাকে পাত্তাই দিলনা।
” হোয়াট! কি করবেন আপনি? ”
” সেটা তোমাকে বলবনা নিশ্চয়ই? তবে আম্মার কথা না শোনার ফল ভালো হবেনা, এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি। ”
” ফল ভালো হবেনা মানে? আবার নিশ্চয়ই থা’প্প’ড় মা’র’বে’ন? আপনার মত অসভ্য, বর্বরের কাছ থেকে এটাই আশা করা যায়। ”
” শুধু থা’প্প’ড় মেরেই কি বেয়াদবদের বশে আনা যায়! থা’প্প’ড়ে’র বাহিরেও অনেক ট্রিক্স আছে। তোমার যদি ইচ্ছে করে সেসব ট্রিক্স দেখতে, তবে এভাবেই বাহিরে যেতে পার। আই সয়্যার পরের দশ মিনিটে তুমি এখানে এসে আমার হাত-পা ধরবে নিজের মুখ বাঁচাতে। ”
আরমানের গলায় এমন কিছু ছিল যা মাশিয়ার মনে ভয়ের সঞ্চার করল। ও আরমানের দিকে তাকায়। কিন্তু আরমান টেবিলে কিছু একটা খুঁজছে। কিছুক্ষণ পর একটা কাগজ পেতেই চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
মাশিয়া বিছানায় বসে পা দোলায় আর আরমানের দিকে তাকায়। কিন্তু আরমান এমন ভাব করছে যেন ঘরে মাশিয়ার কোন অস্তিত্বই নেই। অনেক চিন্তাভাবনার পর মাশিয়া শাড়িটা হাতে নেয়।
” এমন ক্লাউনের মত বসে আছেন কেন? বাহিরে যান, আর কাউকে পাঠিয়ে দিন। আমি একা একা শাড়ি পরতে পারবনা। ”
আরমান কাগজে কিছু একটা লিখছিল। মাশিয়ার কথায় মুখ তুলে তাকায়, কিন্তু কিছুই বলেনা। কাগজ কলম রেখে বাহিরে বেরিয়ে যায়।
সারা বিকেল উঠানে বসে কাটল মাশিয়ার। একের পর এক মেয়েরা আসছে আর কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাচ্ছে। তবে যাবার আগে তাদের সবাইকে পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করছেন আয়েশা খানম। তিনি মাশিয়াকে শাড়ি পরতে দেখে ভিষন খুশি হয়েছেন। একটু পর পর তিনি ছেলের বউয়ের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। হাসিমুখে সবার সাথে বউয়ের পরিচয় করাচ্ছেন। মাশিয়া এই মানুষটা সহ্য শক্তি দেখে অবাক হয়। সারারাত জার্নি করে এসেই কাজে লেগে পরেছে। তার চেহারায় কোন ক্লান্তির চিহ্ন নেই। সন্ধ্যার আগ দিয়ে সুধা মাশিয়াকে আয়েশা খানমের ঘরে নিয়ে যায়। মাশিয়া আরমানের ঘরে যেতে চাইলেও সুধা যেতে দেয়নি। এদিকে দুপুরের পর মাশিয়া আরমানের চেহারা দেখতে পায়নি। এতে অবশ্য মাশিয়ার কিছুই যায় আসছেনা।
রাত সাড়ে নয়টার দিকে আরমান বাড়িতে আসলেও তাকে ঘরে ঢুকতে দেয়া হয়না। ওর প্রয়োজনিয় জিনিসপত্র সুধা আম্মার ঘরে রেখেছিল।
” আম্মা, শহিদ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। সে আমাদের উত্তরচৌকির যে সাত বিঘা জমি চাষ করত, সেটা ফিরিয়ে নিব। এবার আমি সেখানে ধান চাষ করব। শহিদ ভাইও রাজি হয়েছে। পনের দিন পর থেকে চারা বোনার কাজ শুরু হবে। সেসব ঠিকঠাক করে আসলাম। ” দক্ষিণের ঘরের বারান্দার চৌকিতে বসে সবাই রাতের খাবার খাচ্ছে। আরমানের এমন কথায় সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।
” বাপ, তুমি কি সত্যিই আর চাকরি করবানা! ভার্সিটির চাকরি ভালো না লাগলে, অন্য চাকরি কর। সেই কবে গ্রাম থাইকা ঢাকা পড়বার গেছিলা। তুমি এসব চাষাবাদ করবার পারবানা। এসবে খুব কষ্ট, বাপ। তোমার আব্বা’য় কখনো কি তোমারে জমিতে নিয়া গেছে? সে কখনোই চায়নি তার ছেলে জমিজমা চাষ করুক। সে চাইছে, তার ছেলে পড়াশোনা কইরা সমাজের দশজনের মইধ্যে একজন হোক। ” আয়েশা খানম আদ্র গলায় বললেন।
” আম্মা, চাষাবাদ করা কি খারাপ? কৃষকরা কি মানুষ নয়? এই কৃষকরাই কিন্তু দেশের কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে দিনরাত পরিশ্রম করে। এরাই প্রকৃত মানুষ, খাঁটি দেশপ্রেমিক। ”
” আমি সেইডা কইনাই, বাপ। কৃষকরা না থাকলে দেশের মানুষ না খাইয়া থাকব এইডা আমি জানি। চাষাবাদ করবার জন্য দেশের অনেক কৃষক আছে। তুমি কেন? এত পড়াশোনা কইরা শেষ পর্যন্ত মাঠেঘাটে কাজ করবা? ” আয়েশা খানম মাশিয়াকে মাছের কাঁ’টা বেছে দিচ্ছেন আর কথা বলছেন।
” এতদিন তো শহরে কাটালাম। কিছুই পাইনি। মাঝখানে শহরের কিছু মানুষের কুৎসিত রূপ দেখলাম। এবার একটু গ্রামে থিতু হয়ে দেখি। ভালো না লাগলে আবার কোন একটা জব খুঁজে নিব। ”
” ভাইয়া, তুমি কি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তটা নিয়েছ? পারবেতো গ্রামে থাকতে? আর ভাবি? সে-তো শহরের মানুষ। সে কিভাবে এখানে থাকবে? ” সুধা জিজ্ঞেস করল।
” যার জন্ম, বেড়ে ওঠা গ্রামে। সে গ্রামে থাকতে পারবেনা! আমি নয় বছর ধরে ঢাকায় থাকি মানে এই নয় যে নিজের শেকড়কে ভুলে যাব। আর আজকের পর থেকে আমি যেখানে থাকব, তোর ভাবিও সেখানেই থাকবে। তাকে গ্রামের পরিবেশ, মানুষজনের সাথে মিশে যেতে হবে।এতেই তার মঙ্গল। ”
আরমানের কথা শুনে কেউ আর কিছুই বললনা। মাশিয়া ওর দিকে কিছুক্ষণ রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নেয়।
” আম্মা, তুমি তাকে কাঁটা বেছে দিলে নিজে খাবে কখন? আজ থেকে যার কাজ সে-ই করবে। তুমি কোন সাহায্য করবেনা। ভুলে যেওনা তুমি নিজেই অসুস্থ। এখন থেকে তুমি তার নয়, সে তোমার সেবা করবে। ” আয়েশা খানমকে মাছ বাছতে দেখে আবার কথা বলল আরমান।
” তুমি আমাগো মা-মেয়ের মইধ্যে আসবানা। চুপচাপ খাইয়া ঘরে যাও। ” আয়েশা খানম ছেলেকে ধমক দিলেন।
মাশিয়া সবার অলক্ষ্যে আরমানকে ভেংচি কেটে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়।
ঘরে ঢুকেই আরমান থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরময় ফুলেরা সুবাস ছড়াচ্ছে। ও এতক্ষণে বুঝল, তখন ওকে ঘরে ঢুকতে দেয়া হয়নি কেন। তিন আঙ্গুলে কপাল ঘষল সে। ওর এই এক বদঅভ্যেস। টেনশনে পরলেই তিন আঙ্গুলে কপাল ঘষবে। ফুলে ফুলে সাজানো বিছানার দিকে তাকিয়েই ওর মেজাজ খিঁচরে যায়। সেই সাথে রাগ উঠল সুধার ওপর। নিশ্চয়ই এসবের বুদ্ধি ওর মাথা থেকেই বেরিয়েছে। আরমানের চিন্তার মধ্যেই মাশিয়াকে ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে দরজা টেনে দেয় সুধা। যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করতে বলে দেয়।
ঘরে ঢুকে মাশিয়াও আরমানের মত হতভম্ব হয়ে গেছে।
” এসব কি! আর আপনিইবা এখানে কেন? রুম থেকে বেরিয়ে যান এখনই। ”
” আমার রুম থেকে আমাকেই বেরিয়ে যেতে বলছ? সাহস কত! এই শোন, আমাকে নাটক-সিনামার হিরো ভাবলে ভুল করবে। রুমে থাকতে না চাইলে বাহিরে যাও। তোমাকে আটকানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই। ” আরমান আর কিছু না বলে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরল।
” তাই যাব। আপনার মত অসভ্য মানুষের সাথে এক রুমে রাত কাটানোর ইচ্ছে আমার নেই। আপনি জন্মের মত ঘুমান। আমি বাহিরে গেলাম। ”
” মোষ্ট ওয়েলকাম। গুড নাইট। ”
” ইচ্ছে আপনাকে খু’ন করতে। কিন্তু আমি আপনার মত বর্বর নই বলে বেঁচে গেলেন। ” কিছুক্ষণ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর বলল মাশিয়া।
” এখনও রুমে কি করছ! তুমি বাহিরে গেলে আমি লাইট অফ করে দিব। ”
মাশিয়া দুপদাপ পা ফেলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দার এক কোনায় জলচৌকি পাতা আছে। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে জলচৌকিতে গিয়ে বসল। দক্ষিণের ঘরের দরজা বন্ধ। জানালার কপাট খোলা। সেখান থেকেই ড্রিম লাইটের আলো এসে পরেছে বারান্দায়। বাড়ির মূল দরজার কাছে একটা বাল্ব জ্বলছে। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার অনবরত ডাকে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। জলচৌকিতে বসে মনে মনে আরমানের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে ব্যস্ত মাশিয়া। ঠিক তখনই ওকে ভয়ের সাগরে হাবুডুবু খাইয়ে নিভে যায় বাড়ির সব লাইট। লোডশেডিং শুরু হয়েছে। হঠাৎ চারপাশটা অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়ায় মাশিয়ার কলিজা এক লাফে গলার কাছে আসে। যেকোন মুহূর্তে টুপ করে বেরিয়ে পরবে। ভয়ের কাছে হার মেনে দেয়াল হাতড়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে আরমান খাটের সাইড টেবিলে থাকা চার্জার লাইট অন করেছে।
ঘরে এসে হাঁফ ছাড়ল মাশিয়া। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে খাটের পাশে এসে দাঁড়ায়।
” খবরদার আমার এদিকে আসবেননা। তাকাবেননা আমার দিকে। মাঝখানে কোলবালিশ থাকুক। যদি আমার দিকে এসেছেন, তবে আপনার হাত কা’ম’ড়ে ছিঁ’ড়ে নিব। ”
” আমিতো জানি তুমি চতুষ্পদী প্রানীদের স্বজাতি। এটা আর ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার দরকার নেই। আমার নিজের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। আর তাছাড়া তোমার মধ্যে নারীসুলভ কোনকিছুই আমার চোখে পরেনি। তাই নিশ্চিত থাকতে পার। ”
আরমানের খোঁ’চা শুনে মাশিয়া কোলবালিশ ছুঁড়ে মা’র’ল ওর দিকে। এরপর ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পরল।
চলবে…