যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_২৩ জাওয়াদ জামী জামী

0
245

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী জামী

ঘুম ভাঙ্গলে আরমানের বাহুবন্ধনে নিজেকে দেখেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ঘুমন্ত আরমানকে।

” এই যে অসভ্য মাস্টার, নিজেকে তো সভ্য প্রমান করতে দিনরাত তৎপর থাকেন, এখন যে বেশ আরাম করে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন আমাকে। আর দিব্যি বেঁচেও আছেন। গতরাতে যেন কি বলেছিলেন? আমাকে জড়িয়ে ধরা আর কিং কোবরা কিংবা ব্ল্যাক ম্যাম্বাকে জড়িয়ে ধরার সমান। কোথায় গেল আপনার সেই বড় বড় বাতেলা! ” মাশিয়ার ধাক্কায় জেগে উঠেই এমন আক্রমণাত্নক কথা শুনে আরমান বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

এদিকে মাশিয়া একমনে বলেই চলেছে,

” নিজেকে সাধু প্রমান করতে মানুষ কতকিছুই বলে, তার জলজ্যান্ত প্রমান আপনি। এটাসেটা, হেন তেন, ব্লা ব্লা বলে নিজেকে ব্রক্ষ্মচারী দেখানোর চেষ্টা করেছে এতদিন। সে নিজে এমন অসভ্য কাজ করবে সেটাতে দোষ নেই, কিন্তু আমি অসভ্য বললেই দোষ! ”

এতক্ষণে আরমানের কাছে সবটা ক্লিয়ার হলো। আর সবটা মাথায় ঢুকতেই রাগে ওর শরীর কাঁপতে থাকে।

” ওহ আচ্ছা, এখন সব দোষ আমার? রাতে যে তুমিই নিষেধ করা স্বত্বেও আমার কলিজার ভেতর ঢুকছিলে সেটা কি কিছুই নয়? আমি কি তোমাকে একবারও বলেছিলাম, তুমি এসো, আমার কলিজায় এসে বসো? তুমি নিজে থেকেই আমার কলিজায় জেঁকে বসলে আবার আমাকেই ব্লেম করছ? তোমাকে বেয়াদব বললেও দুনিয়ার সকল বেয়াদবদের অপমান করা হবে। সরে বস, আমাকে বিছানা থেকে নামতে দাও। এখনই আমাকে কলপাড়ে যেতে হবে, পুরো শরীর সাবান দিয়ে ধুতে হবে। ভাবা যায়, সারারাত কিং কোবরার লেডিস ভার্সনকে জড়িয়ে রেখেছিলাম! তাইতো বলি আমার শরীর এত চুলকাচ্ছে কেন! কপাল ভালো আমার শরীরে এখন পর্যন্ত ফোস্কা পরেনি। ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝলাম। ” আরমান মাশিয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

মাশিয়া বিছানায় বসে রাগে ফুঁসছে। ও যতবারই আরমানকে জব্দ করতে যায়, ততবারই ওর কাছে পরাজিত হয়। যা ওর জন্য চরম অপমানের। কিন্তু মাশিয়া হার মেনে নেয়ার পাত্রী নয়। ও যেকোন মূল্যেই আরমানকে শায়েস্তা করতে বদ্ধ পরিকর।

আয়েশা খানম বুঝতে পারেন তার ছেলে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে কিছুই ঠিক নেই। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও যে ওদের মধ্যে নেই সেটাও তিনি আবিস্কার করেছেন। ওরা দু’জন দু’জনকে সহ্য করতে পারেনা এটাও তিনি বোঝেন। আয়েশা খানম সব সময়ই ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় থাকেন। ওদের দু’জনের মধ্যে এমন দা-কুড়াল সম্পর্ক চলতে থাকলে সংসার হবে কিভাবে? প্রশ্নটা আয়েশা খানমকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। তিনি এসব ভাবতে গেলেই চোখে অন্ধকার দেখেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে আরমানের সাথে কয়েকবার কথা বলতে চেয়েছেন, কিন্তু আরমান নানা অযুহাতে এড়িয়ে গেছে। আয়েশা খানম ভেবে পাননা কিভাবে তার ছেলে আর মাশিয়ার সম্পর্কের সমীকরণ বদলাবেন। তিনি তার ছেলেকে সুখী দেখতে চান। ছেলের মুখে হাসি ফোটাতে চান। কিন্তু কিভাবে কি করবেন সেটা ভেবে পাচ্ছেননা।

শশীর পরীক্ষা শেষ হয়েছে সাতদিন হয়। পরীক্ষা শেষ হতেই আয়েশা খানম মাশিয়াকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। গ্রামে আয়েশা খানমের ছোট ভাই থাকেন। তিনি গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। তিনি বারবার আয়েশা খানমকে অনুরোধ করেছেন তিনি যেন মাশিয়াকে নিয়ে একবার গ্রাম থেকে বেরিয়ে যান। তাই শশীর পরীক্ষা শেষ হতেই তিনড শশী আর মাশিয়াকে নিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়ে চারদিন থেকে এসেছেন।

নতুন ধানে ভরে গেছে বাহিরের উঠান। পনের জন মিলে সেসব ধানের মাড়াইয়ের কাজ করছে। আরমান ঘুরে ঘুরে কাজের তদারকি করছে। মাঝেমধ্যে সে-ও মজদুরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। ওদের বাড়ির পাশ দিয়েই রাস্তা। সেই রাস্তায় পাশের দুই গ্রামের লোকজন চলাফেরা করে। ভ্যান, অটোরিকশা, বাইক হরদম চলাচল করে সেই রাস্তায়। বাহিরের উঠানে কাজ করার সময় রাস্তা দিয়ে গমনরত লোকজন সবই দেখতে পায়। বাহিরের উঠানে প্রবেশপথ ছাড়া সবটুকুই কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়া।

মাশিয়া শশীর সাথে বাগানে গিয়ে আমড়া গাছে ঢিল ছুঁড়তে ব্যস্ত। বড় আমড়া গাছে থোকায় থোকায় মিষ্টি আমড়া ঝুলছে। শশী আমড়া নামানোর জন্য কাউকেই পায়নি, বিধায় ওরা ঢিল দিয়ে আমড়া নামানোর চেষ্টায় আছে।

মাশিয়া অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করেছে তিনটা মেয়ে রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে ওদের বাহিরের উঠানে উঁকিঝুকি মা’র’ছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে বাগান। আরমানের বাড়ি পূর্ব-পশ্চিম লম্বা হওয়ায় বাহিরের উঠান, বাড়ি আর বাগানের পাশ ঘেঁষে যাওয়া রাস্তার পাশে কেউ দাঁড়ালেই বাগান থেকেও দেখা যায়, তেমনি বাহিরের উঠান থেকেও দেখা যায়। মাশিয়া শশীকে ইশারা করে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়ে তিনটা হাসছে আর কথা বলছে। একজন আরেকজনকে ইশারায় কিছু একটা দেখাচ্ছে। আর সেটা দেখে মাঝখানের মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। মাশিয়ার কেমন খটকা লাগলো। ও শশীকে বাগানে রেখেই দৌড়ে বাড়ির ভেতরে যায়। সেখান থেকে যায় বাহিরের উঠানে। সেখানে আরমান কয়েকজন মজদুরের সাথে কাজ করছে। পনেরোজন মজদুরের মাঝে স্লিভলেস খয়েরি রঙের টিশার্ট, ট্রাউজার পরিহিত আরমানকে দেখেই আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছে। অচেনা যে কেউ ওকে দেখলে অতি সাধারণ বলে ভুল করবেনা। রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় গামছা পেঁচিয়ে রেখেছে। কপাল কিংবা জুলফি বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পরলে মাথার গামছা খুলে ঘাম মুছে আবারও গামছাখানি মাথায় পেঁচিয়ে নিচ্ছে।

মাশিয়া বাহিরের উঠানে এসে এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় রাস্তার দিকে। সেখান থেকে আরমানকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাশিয়ার বুঝতে বাকি থাকলনা মেয়েগুলো কাকে দেখে এমন করছে। ও আবার ঘুরে বাড়ির ভেতর চলে আসে। কাজের ব্যস্ততায় আরমান এসবের কিছুই লক্ষ্য করলনা।

মাশিয়া বাগানে এসে আবারও কাঁটাতারের বেড়ার কাছে যায়। শশীও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মাশিয়া শশীকে কিছু না বলে মেয়েদের উদ্দেশ্যে জোরে শিষ বাজায়। পরপর কয়েকবার শিষ বাজাতেই মেয়েরা সেটা লক্ষ্য করল। মাশিয়া ওদের হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকল। মাশিয়ার এভাবে ডাকায় মেয়েরা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বলাবলি করে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসল মাশিয়ার দিকে।

” বাচ্চারা, এভাবে কি দেখছিলে? যে বস্তুটিকে তোমরা পর্যবেক্ষন করছিলে, সেই বস্তুটি কিন্তু মোটেও সুবিধার নয়। সে একজন রিটায়ার মাস্টার। একজন অবলা, নিষ্পাপ ছাত্রীকে নির্যাতনের দায়ে তার মাস্টারির খেল খতম হয়েছে। তার থেকে দূরে থাক বুঝলে? নয়তো সেই বস্তুটি যদি তোমাদের এমন উঁকিঝুঁকি মা’র’তে দেখে তবে তিন রাস্তার মোড়ে নিয়ে গিয়ে তার স্পেশাল থেরাপি তোমাদের দিতে দুইবারও ভাববেনা। সে আবার ঐ থেরাপির স্পেশালিষ্ট। ”

মাশিয়ার কথা শুনে শশী খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। গত কয়মাসে মাশিয়ার সাথে ওর খুব ভাব হয়েছে।

এদিকে মাশিয়ার কথা শুনে মেয়ে তিনজনও হকচকিয়ে গেল। ওরা ইতিউতি করল কিছুক্ষণ। এরপর একজন মুখ খুলল,

” উনাকে দেখে মোটেও খারাপ বলে মনে হয়নি। গত দেড়মাস যাবৎ উনাকে আমরা দেখছি। উনি কখনোই আমাদের দিকে ভুল করেও তাকাননি।আপনি অযথাই তার নামে মিথ্যা বলবেননা। যে ছাত্রীকে তিনি নির্যাতন করেছিলেন, হয়তো সেই ছাত্রীই পাজি ছিল। মূল দোষী সেই ছাত্রীই ছিল। আজকাল ভালো মানুষের শত্রুর অভাব নেই। ”

মেয়েটির কথা শুনে মাশিয়া হা হয়ে গেছে। ওর চোখ রসগোল্লার আকার ধারণ করেছে। মেয়েটির কথার প্রত্যুত্তর করার মত কোন কথাই ওর মুখে জোগায়না।

” তুই ঠিকই বলেছিস, লামিয়া। ভাইয়াটা যা হ্যান্ডসাম। আবার তাকে দেখলেও মনে হয় সে খুব ভদ্র। কোন ভদ্র মানুষ কাউকে নির্যাতন করতেই পারেনা। রাকিবের সাথে তার কত পার্থক্য দেখেছিস? রাকিব তোর পেছনে দিনের পর দিন ছ্যাঁচড়ার মত ঘুরেছে, তুই পাত্তা না দিলেও তোকে বিরক্ত করেছে। কিন্তু এই ভাইয়া মোটেও তেমন নয়। তার চাকরি হয়তো সেই শাঁকচুন্নি ছাত্রীর জন্যই গেছে। ” মাশিয়াকে অবাক করে আরেকটা মেয়ে বলল।

মাশিয়া এবার তেড়ে যায় মেয়েগুলোর দিকে। ওদের মাঝে কাঁটাতারের বেড়া না থাকলে মেয়েগুলোর আজ খবর ছিল। মাশিয়াকে তেড়ে আসতে দেখে মেয়েরা হতভম্ব হয়ে গেছে। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে যেতে দেখে এগিয়ে আসল শশী।

” শোন আপুরা, এতক্ষণ তোমরা যাকে উঁকিঝুঁকি মে’রে দেখছিলে সেই ব্যাক্তিটি আসলে ইনার সম্মানিত জামাই। যেই ছাত্রীকে কথিত নির্যাতনের দায়ে তার চাকরি গেছিল, সেই ছাত্রীই ইনি। এবার বুঝেছ কাহিনী? ”

শশীর কথা শুনে মেয়েরা সেখানে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়না। ওরা চলে যেতেই শশী পেট ফাটানো হাসিতে মত্ত হলো। মাশিয়া ওকে টেনে বাড়ির ভেতর নিয়ে আসল।

মাশিয়া বাড়ির মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি আরমানের দিকে। আরমান কাজের ফাঁকে লক্ষ্য করল মাশিয়া ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও মাশিয়ার দিকে তাকায় কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে। ঠিক তখনই মাশিয়া ওকে চোখ মারল। আরমানের আর কিছু জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠলনা। ও এদিকওদিক তাকিয়ে কাজে মন দেয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here