যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_২৬ জাওয়াদ জামী জামী

0
295

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৬
জাওয়াদ জামী জামী

আয়েশা খানম কলপাড়ে কাপড় ধুচ্ছেন। সকাল সকাল তিনি অনেকগুলো কাপড় ধোয়ার জন্য ভিজিয়ে রেখেছেন। কাজের মেয়ে আসলে সেগুলো ধুয়ে দেবে। কিন্তু কাজের মেয়ে আজ হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই সে আসতে পারেনি। এদিকে সুধা, শশীও বাড়িতে নেই। তাই আয়েশা খানমকে বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীরেই কাপড় ধুতে হচ্ছে। মাশিয়া নিজের ঘরে আছে। শ্বাশুড়ি যে অসুস্থ শরীরে কাজ করছে সেটা মাশিয়া দেখেও দেখলনা। আবার আয়েশা খানমও মাশিয়াকে কাজ করার জন্য ডাকেননি।

আরমান বাড়িতে এসেই ওর আম্মাকে কাপড় ধুতে দেখল। আয়েশা খানম হাঁপাচ্ছেন। তার বুকও অল্প অল্প ব্যথা করছে। আরমান দৌড়ে যায় আয়েশা খানমের কাছে।

” আম্মা! তুমি কাপড় ধুচ্ছ কেন? শিল্পী আপা কই? তোমাকে হাজারবার নিষেধ করেছি এসব কাজ করবেনা। ” আরমান জোড় করে আয়েশা খানমকে কলপাড় থেকে সরিয়ে আনল।

” বাপ, শিল্পীর শরিলডা ভালো না। তাই আস আসেনাই। সুধা, শশীও কলেজে গেছে। তাই আমিই ধুইতাছি। ” আয়েশা খানম হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন।

” মাশিয়া কোথায়? ” আরমানের গলায় রা’গের আভাস স্পষ্ট।

আয়েশা খানম চমকে ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি বুঝতে পারলেন আরমানের রাগের কারন।

” কি কও, বাপ! বউমা কাপড় ধুইব কেন? হেয় কি বাপের বাড়িতে কুনদিন এইসব কাম করছে! তুমি ঘরে যাও। আমি কাপড় ধুইয়া আসতাছি। ”

” বাবার বাড়িতে এসব কাজ করেনি জন্য যে শ্বশুর বাড়িতেও করতে পারবেনা, এমন কথা কোথায লেখা আছে! ও তো প্রতিদিন কাপড় ধুচ্ছেনা বা বাড়ির কাজও করছেনা। একদিন করলে সমস্যা কোথায়? ”

” তুমি আর একটা কথাও কইবানা। আমি যতদিন বাঁইচা আছি, বউমার এসব কিছুই করতে হইবনা। আমি পোলার বিয়া দিয়া বউ আনছি, দাসী আনিনাই। ” আয়েশা খানম ছেলের কমানোর উপায় খুঁজছেন।

” সংসারের কাজ করলেই কি বাড়ির বউয়েরা দাসী হয়ে যায়? তাহলেও তুমিও এই বাড়ির দাসী? আমার চাচি, চাচাতো ভাইয়ের বউয়েরাও দাসী? আম্মা, তুমি লেখাপড়া জানা মানুষ হয়ে কেমন অশিক্ষিতের মত কথা বলছ, এটা কি বুঝতে পারছ? নিজের সংসারের কাজ করলে কেউ দাসী হয়না, আম্মা। মাশিয়াকে-ও নিজের দ্বায়িত্ব পালন করতে শিখতে হবে। ওকে বুঝতে হবে, ও বাড়ির একজন সদস্য। কিছু দ্বায়িত্ব কর্তব্য ওর ও আছে। নিজের কাজ নিজে করার মানসিকতাও ওকে গড়ে তুলতে হবে। তবেই সংসারে ব্যালান্স আসে। ”

” আমি সব জানি, বাপ। তবুও আমি চাইনা, বউমা এখনই এইসব কাম করুক। তার কাম করনের লাইগা সারাজীবন পইরা রইছে। এখন আমারে কলপাড়ে যাবার দেও। ”

” তুমি গোসল করে এস। কাপড় আমি ধুচ্ছি। ”

” তুমি পা’গ’ল হইছ, বাপ? এইসব কাম তোমার জন্য না। ”

” আমি আর একটা কথাও শুনতে চাইনা। যে কাজ করতে গিয়ে আমার আম্মার কষ্ট হয়, সেই কাজ যদি তার সন্তান করতে না পারে, তবে সেই সন্তানের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তুমি গিয়ে গোসল করে নাও। ”

আরমানের জিদের কাছে হার মেনে আয়েশা খানম গোসল করতে যান। আর আরমান কাপড়গুলো ধুয়ে, শুকাতে দেয়।

” আম্মা একা একা কাপড় ধুচ্ছিল, তুমি তাকে একটু সাহায্য করতে পারতে। তুমি জানো আম্মা অসুস্থ। ডক্টর তাকে ভারী কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছে। ” আরমান ঘরে এসে মাশিয়াকে শুয়ে থাকতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বলল। কিন্তু সেটা শোনার সাথে সাথে মাশিয়া রিয়্যাক্ট করে বসল।

” আমি কাপড় ধোব! তা-ও আবার এতগুলো কাপড়! ঢাকায় থাকতে আমাকে কখনোই নিজের কাপড় ধুতে হয়নি। ওয়াশরুমে কাপড় রেখে আসতাম, পরে সেগুলো আলমারিতে গোছানো অবস্থায় পেয়েছি। ”

” তোমার ঢাকার জীবন আর এখনকার জীবনের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। তুমি এখন এই বাড়ির বউ। আর বাড়ির বউদের একটুআধটু কাজ করতেই হয়। এতে সম্মান যায়না। আর তাছাড়া তোমাকে আমি আজকের কথা বলেছি। সব সময়ই যে তোমাকে কাপড় ধুতে হবে সেটা বলিনি। আম্মা কাপড় ধুতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। তাকে কিছুক্ষণ সাহায্য করলে তোমার কি খুব বেশি কষ্ট হতো? ”

” অবশ্যই কষ্ট হতো। আমিতো বলেইছি, এসবে আমার অভ্যাস নেই। তারপরও কেন একই কথা বলছেন? বিয়ে করার আগে একবার চিন্তা করে দেখেছেন , যাকে বিয়ে করছেন সে এসব কাজে অভ্যস্ত কিনা? তার থেকে বরং আরেকটা কাজের মেয়ে রাখতেন। যে আপনার বাড়ির কাজ বিনাবাক্যে করে দিত। যতসব চিপ মাইন্ডের লোকজন! বিয়ে করে বউ নয় কাজের মানুষ আনতে চায়! বাবার রাজ প্রাসাদ ছেড়ে এই মাটির বাড়িতে এসে থাকছি দেখেই একেকজন নিজেকে গড ভাবতে শুরু করেছে। মনে করেছে সে যেটা বলবে আমাকে সেটাই করতে হবে! ডিজগাস্টিং। ”

মাশিয়া কথা শেষ করতে পারে পারলনা আরমানের থাপ্পড় খেয়ে ওকে থেমে যেতে হয়।

” একটা সাধারণ কথাকে তুমি কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! তোমাকে কি আমার আম্মা কখনো কাজের মেয়ের মত ট্রিট করেছে? কাজের মেয়েকে কেউ কখনো মুখে তুলে খাইয়ে দেয়? তুমি বেয়াদব আমি জানতাম কিন্তু এতটা বেয়াদব সেটা বুঝতে পারিনি। বিয়ের আগে কাজ করোনি বলে কি বিয়ের পরও কাজ করতে হবেনা? এটা কোন অভিধানে লিখা আছে? তোমার মধ্যে যদি সহবৎ থাকত, তবে আজ তুমি এই ধরনের কথা বলতে পারতেনা। আজ মনে হচ্ছে তোমার বিয়ে করে আমি জীবনের সবথেকে বড় ভুল করেছি। আমিও পা’গ’ল, সেদিন কেন যে শপিংমলের সামনে তোমার কথা শুনে রিয়্যাক্ট করেছিলাম। সেদিন যদি তোমার কথাগুলো ইগনোর করতাম, তাহলে আজ আমাকে এভাবে ভুগতে হতোনা। আমার ক্যারিয়ার শেষ হতোনা।” আরমান রাগের চোটে চেয়ারে লা’থি মা’র’ল।

মাশিয়া আগে কখনোই আরমানকে এমন রাগতে দেখেনি। রাগে আরমানের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আরমানকে আরও কিছু বলে রাগিয়ে দিতে চায়না মাশিয়া। তাই চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

আয়েশা খানম বারান্দা থেকে সবকিছু শুনলেন। ছেলের এমন রাগ তিনি মেনে নিতে পারছেননা। আজ তাও আফসোস হচ্ছে, কেন সেদিন তিনি আরমানের বিরুদ্ধে গিয়ে ওর বিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। অঝোরে কাঁদতে থাকেন আয়েশা খানম। আজ মনে হচ্ছে, নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি তার ছেলের জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন।

আরমান রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও ও যখন বাড়িতে ফিরলনা তখন আয়েশা খানমের মনে চিন্তার পাহাড় বাড়তে থাকল। সারাদিন ধরে তার ছেলে না খাওয়া। ছেলের চিন্তায় তিনিও খাননি।

সুধা, শশী কলেজ থেকে এসে দেখল ওদের আম্মার মন খারাপ। ওরা অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পায়না। আবার মাশিয়াও ঘর থেকে একটিবারের জন্যও বের হয়নি। ওরা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা কি হয়েছে।

রাত নয়টার দিকে আরমান বাড়িতে আসল। ও এসে সরাসরি আম্মার ঘরে ঢুকল। সেখানেই রাতের খাবার খেয়ে ওর লাইব্রেরীতে গিয়ে শুয়ে পরল। সেখানে ছোট একটা চৌকি পেতে রাখা আছে।

” মা গো, মুখহাত ধুইয়া আসো। আমরা মা-মেয়েতে মিল্যা দুইডা খাইয়া লই। ” আয়েশা খানম মাশিয়াকে ডাকতে এসেছেন। মাশিয়াও জিদ করে না খেয়ে আছে।

” আমার ক্ষুধা নেই, আম্মা। ”

” সেই সকালে দুইডা রুটি খাইছ, সারাদিন এক ফোঁটা পানিও পেটে পড়েনাই। আর তুমি কইতাছো ক্ষুধা লাগেনাই? আমার কথা শোন, রাগ কইরনা। সংসার করবার গেলে কত ঝগড়াঝাটি হয়, সেইগুলাকে সাথে সাথেই মাটি চাপা দিতে হয় গো, মা। রাগ কখনো পুইষা রাখতে হয়না। তুমি রাগ যত পুইষা রাখবা, ততই তোমার ক্ষতি হইব। রাগ, জেদ, হিংসা, ঘৃণা কখনোই কারও মঙ্গল আনেনা। আমার আরমান বুঝদার একটা পোলা। ছোটবেলা থাইকাই ওয় শান্ত, ঠান্ডা। হেয় সহজেই রাগেনা। কিন্তু আবার যখন রাইগা যায় তখন সহজেই ঠান্ডা হয়না। কিন্তু আমার পোলার মনডা খুব নরম। তুমি ওর মনের মত হইয়া দেখ, ও তোমারে মাথায় তুইলা রাখব। দুনিয়ার সব সুখ তুমি না চাইলেও তোমার পায়ের কাছে আইনা লুটায়া দিব। মাগো, আমি চাই আমার পোলা সুখে থাকুক। তোমরা সুখে সংসার কর। আমার পোলাডা আমার নাই ঘরের ধন। সেই কবে ওর আব্বায় আমাগোরে ছাইড়া গেছে। তখন থাইকাই ঐ পোলার মুখের দিকে তাকায় আমি বাঁইচা রইছি। ওর কোন কষ্ট আমি সইবার পারিনা। ওরে তুমি কষ্ট পাইতে দিওনা গো মা। ” আয়েশা খানম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

মাশিয়া আয়েশা খানমের কথা শুনে ঠোঁট কা’ম’ড়ে মাথা নিচু করল। ও এক মায়ের কান্নায় কিভাবে শান্তনার প্রলেপ লাগাবে সেটা ভেবে পায়না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here