#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৭
জাওয়াদ জামী জামী
” আম্মা, তুমি খাবে কখন? এভাবে কতদিন অন্যের মাছের কাঁ’টা বেছে দেবে? যার কাজ তাকেই করতে দাও। তার যদি মাছ খাওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে সে নিজেই মাছের কাঁ’টা বাছবে। ” আয়েশা খানমকে মাশিয়ার জন্য মাছের কাঁ’টা বাছতে দেখে রেগে যায় আরমান।
” বাপ, তুমিতো জানোই বউমা কাঁ’টা’র জন্য মাছ খাইতে পারেনা। তা-ও এইভাবে কথা কও কেন? তোমরা খাইয়া নেও। আমি তোমগোরে খাওয়া হইলেই খামুনে। ”
” আম্মা, প্লিজ এভাবে সাফাই গাইবেনা বলে দিচ্ছি। আরও কতদিন তুমি এভাবে আরেকজনের মাছের কাঁ’টা বেছে দিবে? যার কাজ তাকে করতে দাও। কাজ না পারলে তাকে সেটা শিখতে হবে। এভাবে তুমি তার সব কাজ করে দেয়ায় কোন সমাধান হবেনা। তুমি ছোটবেলা থেকেই আমাদের শিখিয়েছ, নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে অন্যের কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব থাকেনা। নিজের কাজ নিজেই করার মধ্যে লজ্জা থাকতে নেই। তবে আজ কেন তুমি আরেকজনের হয়ে সাফাই গাইছো? সে যতদিন মাছের কাঁ’টা বাছতে না পারবে ততদিন প্রয়োজনে সে মাছ খাবেনা। বুঝেছ আমার কথা? ”
মাশিয়া চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। আরমানের দিকে চোখ তুলে তাকানোর মত সাহস ওর নেই। চুপচাপ ভাতের প্লেটে আঁকিবুঁকি করছে। ওর ডাগর আঁখিতে উপচে পড়ছে নোনাজল। যেকোন মুহূর্তে ওরা ঝরে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে আরমানের রাগের কারন ও ঠিকই বুঝতে পেরেছে।
সুধা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর গম্ভীর ভাইয়ার দিকে। যে কখনোই কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলেনি। ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাইকে সম্মান করেছে। যে কারনে সব সময়ই ও ভাইকে নিজের আর্দশ মানে। কিন্তু আজ তার ভাইয়া এসব কি বলছে!
শশীও খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে ওর ভাইয়ার দিকে। এ কোন ভাইয়াকে দেখছে ও!
” আরমান! তুমি কি ভুইলা গেছ কারে কি কইতাছো? হেয় তোমার বউ। হেয় সব ছাইড়া তোমার ভরসায় এই সংসারে আইছে। কিন্তু সেই তুমিই যদি তারে আঘাত কর, তবে হেয় সইবো কেম্নে? আমি বউমারে মাছের কাঁ’টা বাইছা দিতাছি, এতে আমার কুন কষ্ট হয়না। কিন্তু তুমি এত কথা কইতাছো কেন? ” আয়েশা খানম আজ প্রথমবার ছেলের ওপর রেগে উঠলেন। যিনি তার ছেলের সাথে আজ পর্যন্ত উঁচু গলায় কথা বলেননি, আজ তিনি ছেলেকে ধমকালেন।
এদিকে আরমানও কম যায়না। ও যেন আম্মার কথার প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য তৈরীই ছিল।
” আমাকে ধমক দিলেই কি সত্যিটা বদলে যাবে, আম্মা? আমাকে তুমি দেখাতে পারবে কোন শ্বাশুড়ি তার ছেলের বউকে পাঁচ-ছয় মাস লাগাতার মাছের কাঁ’টা বেছে দেয় কিংবা মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, তার সব কাপড় ধুয়ে দেয় ? হ্যাঁ, তবে প্রয়োজনবোধে দিতে পারে কিছুদিন। দিনের পর দিন কেউই এমনটা করবেনা। এতকিছুর পরও যদি অপরদিক থেকে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করত, নিজের কাজ নিজে করার চেষ্টা করত তবে তোমাকে বাঁধা দেয়ার কোন কারনই আমার ছিলনা। কিন্তু সে আজ পর্যন্ত তোমার প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতাটুকুও দেখায়নি,সম্মানতো দূরের কথা। আর এখানেই আমার আপত্তি। ”
আয়েশা খানম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন তার ছেলে প্রচন্ড রেগে আছে। আর তিনি তার ছেলের রাগ সম্পর্কে ভালো করেই জানেন। তাই তিনি ছেলেকে আরও রাগিয়ে দিতে চাইলেননা। তবে মাশিয়ার অপমানও তিনি সইতে পারছেননা।
” বাপ, বউমা আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। দুনিয়ার সগ্গলেরই কি সম্মান প্রকাশের ধরন এক হয়, বাপ? মানুষ হিসাবে আমগোর কি কুন পার্থক্য নাই? সগ্গলেই কি আমরা সমান? বউমাও তাই। তার হয়তো প্রকাশ করার ধরন অন্যরকম। তুমি এসব নিয়া মাথা ঘামাইওনা। তুমি খাইয়া নেও। ” আয়েশা খানম নরম গলায় বললেন। তিনি চাইছেননা আরমান আরও রেগে যাক।
” তুমি কি চাও আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই? এবং সেটা চিরদিনের জন্য? ”
আরমানের কথা শুনে আয়েশা খানমের হাত থেমে গেছে। তার চোখে জমা হয়েছে বেদনার অশ্রুজল।
” বাপ! তুমি কি কইলা! তুমি ভালো কইরাই জানো, তুমি আমার কি। তোমার মুখের দিকে তাকায়াই আমি আইজও বাঁইচা আছি। তুমি এমন কথা কইবার পারলে, বাপ? ”
” কাঁদবেনা, আম্মা। তুমি ভালো করেই জানো, তোমার এক ফোঁটা চোখের পানির মূল্য আমি সারাজীবনেও দিতে পারবনা। তাই বলছি, আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করবেনা। তুমি যদি আমাকে চোখের সামনে দেখতে চাও, তবে আমার কথা তোমাকে মানতে হবে। আজ থেকে ও নিজের সব কাজ নিজেই করবে। এমনকি ওর কাপড়চোপড়ও ও নিজেই ধুবে। শিল্পী আপা ওর কোন কাজ করে দেবেনা। এবং যতদিন না সে নিজেকে পরিবর্তন করছে, ততদিনই ওকে নিজের কাজ নিজেরই করতে হবে। সেটা আমি বাড়িতে থাকলেও করবে, না থাকলেও করবে। তুমি আমার কাছে ওর পক্ষে কোন সাফাই দেবেনা, এমনকি ওর কাজের ব্যাপারে একটা মিথ্যাও বলবেনা। ও কোন কাজ করবেনা কিন্তু তুমি বলবে সব কাজই ও করেছে এটা হবেনা। ”
আরমানের শর্ত শুনে আয়েশা খানম হতাশ হলেন। মাশিয়াও চমকে উঠল। কিভাবে করবে সে নিজের কাজ! যেখানে সামান্য বিছানা গোছাতে গেলেই ওর কালঘাম ছুটে যায়। তবে এই মুহূর্তে ও আরমানের সাথে কথা বলতে চাওয়ার মত বোকামি করতে চায়না। এখন সা’পে’র লেজে পা দেয়া, আর আরমানের সাথে কথা বলতে চাওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারন ওর কাছে এখন আরমানকে বি’ষ’ধ’র সা’পে’র থেকে কম কিছু মনে হচ্ছেনা।
সেই রাতেও আরমান তার লাইব্রেরীতে ঘুমাল। মাশিয়ার রাত কাটল ভয়ে ভয়ে। বাহিরে কোনও শব্দ হলেই ও ভয়ে কাঁপছে।
” বউমা, এই ধরো টাকা। সুধার সাথে গিয়া নিজের জন্য সালোয়ার কামিজ কিন্না আনো। ” পরদিন সকালে আয়েশা খানম মাশিয়াকে ছয় হাজার টাকা দিলেন।
” আমারতো অনেকগুলি সালোয়ার কামিজ আছে, আম্মা। ” মাশিয়া বেশি কিছু বললনা। গত রাতের ঘটনার পর থেকেই ওর মন খারাপ। মাথায় নানান চিন্তা ঘুরঘুর করছে।
” অনেকগুলা আছে তো কি হইছে! আবার কিনবা। এইডা ধান বিক্রির টাকা। তোমাগোর তিনজনকে ধান বিক্রির টাকা থাইকাই দিতাছি। আগে রসুন হইল, সরিষা হইল সেইগুলা বিক্রির টাকা খরচ করিনাই। ঐ টাকাগুলান জমি কিনবার জন্য রাইখা দিছি। কয়দিন পর আবারও গম বিক্রির টাকা দিমুনে। ”
মাশিয়া তৈরী হয়ে আয়েশা খানমের ঘরে এসে দেখল মা ছেলে কথা বলছে।
” আম্মা, আমার আবার যেতে হবে কেন বলতো? সুধা, শশী ওরা কি মার্কেট চেনেনা! ওরা প্রতিদিনই কলেজে যায়। সবকিছু ওদের পরিচিত। তুমি শুধু শুধুই এর ভেতর আমাকে টানছ। ”
” হেরা প্রতিদিন কলেজে যায়। কেনাকাটা করবার যায়না। আর তাছাড়া কোন কিছু কিনার দরকার থাকলে হেরা মিতু বউমার সাথে যায়। আমি তোমার দুই বোনকে একা কেনাকাটা করবার পাঠাইনা। আর এখন যখন তুমি বাড়িতেই আছো, তখন মিতু বউমাকে কষ্ট দেয়ার দরকার নাই। ”
” আচ্ছা, কি আর করা। তুমি ওদেরকে তারাতারি রেডি হতে বল। আমি অটোরিক্সা ডাকছি। ” আরমান একটিবারের জন্যও মাশিয়ার দিকে তাকায়না সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আয়েশা খানম গমনরত ছেলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তিনি মাশিয়ার কাছে আসলেন। পরম স্নেহে হাত রাখলেন মাশিয়ার মাথায়।
” মাগো, সংসার একটা বিচিত্র জায়গা। এইখানে যেমন অফুরান ভালবাসা, মায়া রইছে, তেমনি রাগ, হিংসা, ঘৃণাও রইছে। তুমি যদি চাও তয় রাগ, হিংসা, ঘৃণা বাদ দিয়া শুধু ভালবাসা আর মায়া বাইছা নিবার পারবা। দেখবা তোমার জীবনে তখন সীমাহীন সুখেরা রাজত্ব করব। পুরুষ মানুষ হইল মোমের মতন। তাদের উপরেরটা শক্ত দেখা গেলেও, ভালোবাসা নামক আ’গু’নে’র কাছে গইলা পানি হইয়া যায়। ভালোবাসা দিয়াই তাগোরে বশ করন লাগে। তাগোরে যতই দূরে ঠেইলা দিবা, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে যাইব। ভালোবাসাই হইল তাগোরে বাইন্ধা রাখনের হাতিয়ার। তাই কইতাছি, তুমি আমার ছেলেরে দূরে যাইতে দিওনা। ওরে ভালোবাসা দিয়া বাইন্ধা নেও। তুমি আইজ না বুঝলেও একদিন ঠিকই বুঝবা যে, আমার আরমানের মত ছেলে সচরাচর দেখা যায়না। একদিন তুমি আফসোস করবা আরমানের মত পরশপাথরকে দূরে ঠেইলা দিছিলা জন্য। এতদিন যা হওয়ার হইছে। তুমি ওর সাথে কথা কও, ওরে রাগবার দিওনা। ওর রাগ যেমন কঠিন তেমনই ওর ঘৃণা আরও বেশি কঠিন। আমার কথা বুঝবার পারছ তুমি? ”
মাশিয়া কিছু না বলে মাথা নাড়ায়। ওর ভেতরে চিন্তার ঝড় বইছে।
শপিংমলের সামনে এসে অটোরিকশা দাঁড়ালে ওরা নেমে আসে। মাশিয়া ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে শপিংমলের দিকে। ও আগে কখনোই এত ছোট মলে শপিং করেনি। মনে মনে ভাবছে, এখানে কি পছন্দমত সালোয়ার কামিজ পাওয়া যাবে?
” হেই আরমান, হোয়াট আ সারপ্রাইজ! কতদিন পর তোমার সাথে দেখা হল! আজকাল ঘাপটি মে’রে থাকতেও শিখে গেছ! ”
বেশ সুশ্রী একটা মেয়ে কোথায় থেকে এসে আরমানের বাহু জড়িয়ে ধরল। সুধা আর শশী একে-অপরকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সুধা আঁড়চোখে মাশিয়ার দিকে তাকালে মাশিয়ার থমথমে মুখ দেখে ঢোক গিলল।
” স্নিগ্ধা! তুমি এখানে? কেমন আছো? ”
” আমি সব সময়ই ভালো থাকি, হ্যান্ডসাম। তুমি আগের থেকে বেশি এ্যাট্রাকটিভ হয়ে গেছ দেখছি! ঘটনা কি? আমিতো জানতাম বিয়ের পর মেয়েদের পরিবর্তন হয়, কিন্তু তোমাকে দেখে সেই ধারনা পাল্টে গেল। ”
স্নিগ্ধা নামক মেয়েটির কথায় আরমান হাসল।
” তুমি আগের মতই ফাজিল আছো। একাই এসেছ নাকি সাথে কেউ আছে? ”
” উহু একাই এসেছি। কিন্তু তুমিতো একা নও দেখছি। এরা কারা? ”
আরমান শশী আর সুধাকে স্নিগ্ধার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
” দুইজনের পরিচয় তো জানলাম। তৃতীয়জনটি কে? তার সাথেও পরিচয় করাও। ”
আরমান ইতস্তত করে বলল,
” এ মাশিয়া। আমার আম্মার ছেলের বউ। ”
আরমানের কথা শুনে স্নিগ্ধা হাসিতে ফেটে পরল। অনেক চেষ্টায় হাসি থামিয়ে বলল,
” তোমার আম্মার ছেলেটি কে? তোমার কি কোন বড় ভাই আছে? বড় ভাইয়ের বউ হলে, মাশিয়া তোমার ভাবি হয়। আর যদি ছোট ভাইয়ের বউ হয়, তবে সে তোমার ছোট বোনের মত। তাকে যেকোন একটা সম্ভাষণ করা তোমার জন্য ফরজ কাজ। ”
” মাফ কর। আমি আমার আম্মার একমাত্র ছেলে। সে হিসেবে এ আমার বউ। হয়েছে? ”
স্নিগ্ধা ওদের সাথে কথা বলল। ওরা এতক্ষণ ধরে শপিংমলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধার সাথে কথা বলে আরমান জানতে পারল, সে-ও কেনাকাটা করবে। এদিকে আরমানের এসব মোটেও ভালো লাগেনা।
” সুধা, তোরা গিয়ে কেনাকাটা কর। আমি এখানেই আছি। আমি এই কফিশপে বসছি। তোরা শপিং করে এখানে আসিস। ” আরমান শপিংমলে লাগোয়া কপিশপ দেখিয়ে বলল।
সুধা আর কিছু না বলে ওদের নিয়ে ভেতরে গেল।
শপিং শেষে ওরা কফিশপে যায়। সেখানে আরমান ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কফিশপে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে ওরা বেরিয়ে পরল। এখন সোজা বাড়ির দিকে যাবে।
স্নিগ্ধা আরমানের পাশে হাঁটছিল।
” এখনই চলে যাবে? কতদিন পর দেখা হলো। কিন্তু মন খুলে গল্পই করতে পারলামনা। ভার্সিটি লাইফ শেষ হওয়ার পর বন্ধুদের সাথে হয়না বললেই চলে। সবাই মিলে জম্পেশ আড্ডা দিতাম। অবশ্য তুমি ব্যাতিক্রম ছিলে। পড়া ছাড়া কিছুই বুঝতেনা। আমরা তোমাকে দেখে হিংসা করতাম। কিন্তু এখন আমার স্টুডেন্টদের তোমার গল্প শোনাই। তোমার মত একজন আদর্শ মানুষের গল্প শুনে ওরা অভিভূত হয়ে যায়। ”
স্নিগ্ধা যেন সেই ভার্সিটি লাইফে ফিরে গেছে। আরমানের চোখেও ভেসে ওঠে সেইসব দিনগুলি। সেইসব স্মৃতি ভোলার নয়।
” সুধা, তোরা বাড়িতে যা। আমি পরে আসছি। ”
আরমান ওদেরকে অটোরিকশায় তুলে দেয়। মাশিয়া এতক্ষণ ওদের কথপোকথন শুনছে আর ফুঁসছে।
স্নিগ্ধাও ওদের থেকে বিদায় নেয়। ওদের অটো ছেড়ে দিলে আরমান স্নিগ্ধাকে নিয়ে রিক্সায় উঠল।
মাশিয়া অটোরিকশার পেছনে তাকিয়ে দেখল আরমান আর স্নিগ্ধা রিক্সায় উঠেছে।
চলবে…