#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৩৫
জাওয়াদ জামী জামী
খাবার টেবিলে বসে সবাই খাচ্ছে। মিরাজ মোর্তাজা মেয়ের প্লেটে ওর পছন্দের খাবার তুলে দিচ্ছেন। মাশিয়া খেতে না চাইলেও মিরাজ মোর্তাজা ওকে ধমকে খাওয়াচ্ছেন। দোলন আঁড়চোখে সব পর্যবেক্ষন করছে। ও মাশিয়াকে কিছু বলার জন্য ছটফট করছে। তবে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি থাকায় একটু ইতস্তত করছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অবশেষে বলেই ফেলল,
” মাশিয়া, তুমি এ বাড়িতে এসেছ অনেকদিন হলো ।ঐ বাড়ির লোকজনের সঙ্গে তোমার কথা হয়? তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে তোমার কোন খোঁজ নিয়েছে? নাকি একবারে চলে এসেছ বলে তারা হাঁফ ছেড়েছে? আর তোমাকেও বলি, এত রাগ দেখানোর কি হয়েছে! মন চাইল আর সেখান থেকে চলে আসলে? একবারও ভাবলেনা, এতে এই পরিবারের ওপর কি প্রভাব পরবে? তাদের কত জায়গায় হেয় হতে হবে? ”
দোলনের কথা শুনে মিরাজ মোর্তাজা ও কল্পনা মোর্তাজা স্তব্ধ হয়ে গেছেন। দোলনের এই রূপ তাদের কাছে অচেনা। তারা দোলনকে থামানোর চেষ্টা করলেন।
” দোলন, এসব কি বলছ তুমি! চুপচাপ খেয়ে নাও। এত কথা কিসের? মেয়েটা খাচ্ছে সেটা তোমার চোখে পরছেনা? খাওয়ার সময় এসব কথা না বললেনই নয়? আর মাশিয়া কোনটা করবে কোনটা করবেনা সেটা আমরা বুঝব। তোমাকে এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে। ”
কল্পনা মোর্তাজা আজ প্রথমবার দোলনের ওপর রেগে উঠলেন। কিন্তু এতে দোলনের কোনও হেলদোল নেই। মাহিনেরও তাই। ও আপনমনে খেয়েই চলেছে। যেন কোন কিছুতেই ওর যায় আসেনা। মিরাজ মোর্তাজা ছেলের এরূপ নির্বিকার দেখে হাসলেন।
” আম্মু, ভাবতে আমাকে হবে। যেটা ভাবার কথা আপনাদের সেটা যদি আপনারা না ভাবেন তবে সেই দ্বায়িত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবেই। তাছাড়া আজ প্রথমবার এই বাসায় মাশিয়া খাচ্ছেনা। এর আগেও খেয়েছে, আর এখন ওকে যেমন দেখছি মনে হচ্ছে ভবিষ্যতেও খাবে। তাই ওর খাওয়া নিয়ে না ভেবে, ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুন। ”
” স্টপ ইট, প্লিজ। ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমি আমার পাপার বাড়িতে আছি এবং তারটাই খাচ্ছি। আমি কি করব না করব সেটা আমিই বুঝব। আমার ভাবনা তোমাকে ভাবতে কে বলেছে? একান্তই যদি কেউ আমার বিষয়ে ভাবে, তবে সেটা আমার পাপা-মম করবে। ” মাশিয়া রেগে খাবার টেবিল থেকে উঠে গেল।
কল্পনা মোর্তাজা গমনরত মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলেন। মিরাজ মোর্তাজা প্লেটে আঁকিবুঁকি করছেন। তিনি দোলনকে কিভাবে বলবেন , তিনি আর কল্পনা মোর্তাজা আরমান আর আয়েশা খানমের সাথে কথা বলেছেন। মাশিয়া এখানে আসার পরই তিনি আরমানকে ফোন দিয়েছিলেন। আরমান একটা কথা বলেই ফোন রেখেছিল সেদিন। কথাটা ছিল, ” মাফ করবেন, আমার জীবনে মাশিয়া নামক কোন নারীর অস্তিত্ব নেই। আজই তার অস্তিত্ব মুছে ফেলেছি চিরতরে। ”
বাধ্য হয়ে তিনি আয়েশা খানমকে ফোন করেছিলেন। আয়েশা খানমও জানিয়েছিলেন, তিনি ছেলের সিদ্ধান্তের বাহিরে কিছুই করতে পারবেননা, যতই তিনি মাশিয়াকে ভালবাসুন না কেন।
মিরাজ মোর্তাজা মাশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। এই বাসায় মাশিয়ার আগামী দিনগুলো যে খুব ভালো কাটবেনা সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
কল্পনা মোর্তাজা রুমে এসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আরমান মাশিয়াকে ত্যাগ করেছে, এই কথা তিনি সবাইকে কিভাবে বলবেন! তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সুধার কাছে। সুধাও তাকে ওর ফ্ল্যাটে যেতে নিষেধ করেছে। সাুধা জানিয়েছে, আরমান চায়না মাশিয়ার বাড়ির কারও সাথে সুধা কিংবা ওর পরিবারের কোনও সম্পর্ক থাকুক। সুধার কাছে থাকা মেইডকেও সুধা ফেরত পাঠিয়েছে এই বাসায়। মোটকথা, আরমান নিজের জীবন থেকে মাশিয়াকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এবং ওর সংসারে যাওয়ার সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।
রুমে এসে মাশিয়া কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল। আশ্চর্যজনক হলেও ওর দোলনের ওপর এখন মোটেও রাগ হচ্ছেনা। রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। কেন যেন ওর ভিষণ কান্না পাচ্ছে। মনের কোনে মেঘ জমেছে। তারা ঝরে পরতে প্রস্তুত। মাশিয়ার দুচোখ ভাসিয়ে তারা অনর্গল ঝরতে শুরু করল।
সেদিন সারাদিন মাশিয়া রুম থেকে বের হলোনা। নিজেকে বদ্ধ ঘরে আটকে রেখে শাস্তি দিয়ে শান্তি খুঁজছে।
পরদিন সকালে মাশিয়া ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হল। কল্পনা মোর্তাজা মাশিয়াকে ভার্সিটিতে যেতে দেখে চিন্তায় পরে গেলেন। তার চিন্তার একমাত্র কারণ হলো রিশাদ।
মাশিয়াকে দেখে তৃষা, মিতুল, জয় হৈ হৈ করে উঠল। চারপাশ থেকে মাশিয়াকে জড়িয়ে ধরল।
” দোস্ত, কি সারপ্রাইজ দিলি! হঠাৎ করে তুই আসবি আমরা ভাবতেও পারিনি। স্যার কোথায়? তাকে দেখছিনা যে? ” তৃষা এদিক ওদিক তাকিয়ে আরমানকে খোঁজার চেষ্টা করল।
তৃষার মুখে ‘ স্যার ‘ ডাক শুনে মাশিয়ার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। কিন্তু সকল অনুভূতিকে মাটি চাপা দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল,
” কেন আমি কি একা আসতে পারবনা? আমার কি একা আসা বারণ? সব সময়ই কেন আমার পাশে ঐ অসভ্য মাস্টারকে থাকতে হবে? তাকে ছাড়াও আমি পথ চলতে পারি, এটা তোরা জানিসনা? এখন থেকে আমি একাই ভার্সিটিতে আসব। তোরা আর কখনোই ঐ অসভ্য মাস্টারের নাম মুখে আনবিনা। ”
মাশিয়াকে রাগতে দেখে ওরা কেউ কিছু বললনা। তবে ওরা বুঝল মাশিয়া আর আরমানের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছে।
মাশিয়া নিয়মিত ক্লাস করছে। ভার্সিটি থেকে বাসায় এসে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। পারতপক্ষে ও দোলনের সামনে যাচ্ছেনা। তবে দোলন সুযোগ পেলেই ওকে দু-চার কথা শুনিয়ে দেয়। মাশিয়া সেসব মুখ বন্ধ করে সহ্যও করে। কল্পনা মোর্তাজা প্রতিবাদ করতে গেলেই দোলন তাকেও অপমান করতে ছাড়েনা। মোর্তাজা ভিলা এখন মাশিয়ার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে মানুষ চিনতে শিখছে ও।
ক্লাস থেকে বেরোতেই রিশাদের মুখোমুখি হয় মাশিয়া। রিশাদ ওকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসল।
” হেই বেইবি, হোয়াট আ সারপ্রাইজ! তুমি ভার্সিটিতে এসেছ! কিন্তু তুমি ঢাকায় কবে এসেছ? আমাকে জানাওনি কেন? তুমি ঢাকায় এসেছ কিন্তু আমাকে জানাওনি! খুব কষ্ট পেলাম, বেইবি। ”
আজ প্রথমবার রিশাদের এহেন কথায় বিরক্ত হয় মাশিয়া। ও রিশাদকে এড়িয়ে যেতে চাইলে রিশাদ ওর হাত ধরল।
” হাত ছাড়, রিশাদ। এটা কোন ধরনের অসভ্যতা? ” এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় মাশিয়া।
” বেইবি, আগেও তোমার হাত আমি বহুবার ধরেছি। তখনতো এমন রিয়্যাকশন দাওনি? তবে আজ কেন? আচ্ছা বাদ দাও, চল আমরা দূরে কোথাও আউটিংএ যাই। সেখানে শুধু তুমি আর আমি থাকব। খুব মাস্তি করব দু’জন। ”
রিশাদের কথায় অন্য কিছুর ইঙ্গিত। যেটা মাশিয়াও ধরতে পেরেছে। কিন্তু মাশিয়া এটা নিয়ে কোন উচ্যবাচ্য করলনা। সময় হঠাৎ করেই ওকে যেন বদলে দিয়েছে। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছে।
” সরি রিশাদ, আমি কোথাও যেতে পারবনা। ফোর্থ সেমিস্টার শুরু হতে দেরি নেই। আমাকে পড়তে হবে। ” মাশিয়া মনেপ্রাণে চাইছে এখন এখানে কেউ আসুক। রিশাদের থেকে নিস্তার পেতে চাইছে ও।
” ফোর্থ সেমিস্টার শুরু হবে আরও দুইমাস পর। তুমি পড়ার অনেক সময় পাবে। আর একদিন বাহিরে গেলে তোমার পড়াশোনার তেমন কোন ক্ষতি হবেনা। প্লিজ সুইটি, চলোনা। দূরে কোথাও যাই। ” রিশাদ নাছোরবান্দার ন্যায় মাশিয়াকে বিরক্ত করতে থাকে।
” ও জাস্ট শাট আপ, রিশাদ। আমি কি বলেছি সেটা তুমি শুনতে পাওনা? নাকি বুঝতে পারছনা? ভুলে যেওনা আমি ম্যারিড। তোমার সাথে যেখানে সেখানে বেড়াতে যেতে পারিনা আমি। ” কথাটা বলেই মাশিয়া ঠোঁট কামড়ে নিচে তাকালো। উত্তেজনার বশে কি বলে ফেলল ও! যে সম্পর্ক থেকে নিজেই বেরিয়ে এসেছে, আজ সেই সম্পর্কের দোহাই দিয়েই রিশাদকে আটকাচ্ছে! কেন এমন করল? অনেক চেষ্টা করেও উত্তর পায়না মাশিয়া।
” এমন ভাব করছ যেন সতীসাবিত্রী তুমি! মনে হচ্ছে আমার সাথে আগে কোথাও যাওনি? আমার বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিলে পার্টিও করেছ, সেখানে ড্রিংকও করেছ। কিন্তু সেই তুমিই আবার বিয়ের দোহাই দিচ্ছ! তা-ও যদি তোমার হাসবেন্ডের সংসার করতে। শুনেছি তাকে ছেড়ে চলে এসেছ। তবে এত এ্যাটিটিউড দেখাও কেন? এক কথায়, তুমি এখন সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস। তুমি চাইলে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পার বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। আমিও তোমার সাথে যা খুশি তাই করতে পারি, তুমিও বাঁধা দিতে পারবেনা। শুনে রাখ, অন্যের ছুঁড়ে ফেলা জিনিসদের এত এ্যাটিচিউড থাকতে নেই। ”
রিশাদ কথা শেষ করতেই পারলনা মাশিয়া ওর গালে সজোরে থাপ্পড় মারল। রাগে ফুঁসছে মাশিয়া। সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। পরপর কয়েকটা থাপ্পড় মেরে ক্ষান্ত দেয়।
” ইউ বাস্টার্ড, তোমার সাহস বেড়ে গেছে দেখছি। কান খুলে শুনে রাখ, মাশিয়া যেই পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন সে সব সময়ই মাথা উঁচু করে বাঁচতে জানে। তোমার মত থার্ড ক্লাস ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম এটাই তোমার সাত পুরুষের কপাল। তোমার সাথে যেভাবে বন্ধুত্ব করেছিলাম সেভাবেই তোমাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি এটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। তোমাকে পায়ের নিচে পিষে মারতে আমার দুই মিনিট লাগবে মাত্র। ভবিষ্যতে নিজের লিমিট ক্রস করবেনা আশা করছি। আর যদি ভুল করেও সেটা কর, তবে তোমার পরিনতি খুবই জঘন্য হবে। ”
কাঁপতে কাঁপতে মাশিয়া গাড়ির কাছে আসে। কিছুতেই ওর রাগ কমছেনা। গাড়িতে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। হাতের ব্যাগ ছুঁড়ে মারল গাড়ির মেঝেয়। সিটে শরীর এলিয়ে দিল। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকল। আজকের আগে আরমান ওকে থাপ্পড় মেরেছে, ঝাড়ি দিয়েছে। কিন্তু এমন নিচু কথা কখনোই বলেনি ওকে। না চাইতেও কষ্টের নোনাজল ঝরতে থাকল ওর আঁখিকোন বেয়ে।
চলবে…