যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_১৮ জাওয়াদ জামী জামী

0
298

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী জামী

কেটে গেছে পনেরদিন। এই পনেরদিনে আরমান, মাশিয়ার সম্পর্কে কোন উন্নতিই হয়নি। বরং অবনতিই হয়েছে বলা যায়। এই কয়দিন আরমান নিয়মকরে মাশিয়াকে পড়িয়েছে। মাশিয়া ফাঁকিবাজি করতে গেলেই ধমকে ওকে দাবিয়ে রেখেছে আরমান। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে না চাইলেও মাশিয়ার কপালে ধমক জুটেছে। মোটকথা একটা সম্পর্কের অবনতি হতে যা যা লাগে, তার সবই এ কয়দিনে ঘটেছে।

মাশিয়াও এই পনের দিনে ওর বাবা-মা’ র সাথে একবারও কথা বলেনি। মিরাজ মোর্তাজা, কল্পনা মোর্তাজা, মাহিন প্রতিদিনই আরমানের কাছে ফোন দিয়ে মাশিয়ার সাথে কথা বলতে চায়। আরমান নিজের ফোন মাশিয়াকে দিলেও মাশিয়া কারও সাথে কথা বলেনা। আরমান মাশিয়াকে বারবার ফোন অন করতে বলেছে, কিন্তু মাশিয়াকে এই কথা শোনাতে পারেনি। আরমান অনেক চেষ্টা করেও মাশিয়ার ফোন খুঁজে পায়নি।

মিরাজ মোর্তাজা ফোন করে জানিয়েছেন, আগামীকাল তিনি স্ত্রী’কে নিয়ে আরমানদের বাড়িতে আসবেন। আরমান সেকথা আয়েশা খানমকে জানালে, আয়েশা খানম অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। কথাটা মাশিয়ার কানে গেলেও সে নিরুত্তাপ ভাব দেখায়।

পরদিন খুব ভোরে মিরাজ মোর্তাজার গাড়ি আরমানের উঠানে এসে দাঁড়ায়। তারা রাত এগারোটার দিকে রওনা দিয়েছিলেন। গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেয়ে আরমান বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ওর পিছুপিছু আয়েশা খানমও গেলেন।

মাশিয়াকে দেখে কল্পনা মোর্তাজা দৌড়ে আসলেন। জড়িয়ে ধরলেন বুকের ভেতর। কিন্তু মাশিয়া কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়না।

” মাশিয়া, এখানে কেমন লাগছে তোমার? বেয়াইন অনেক ভালো মানুষ। সে তোমাকে অনেক আদর করে দেখছি। ” মিরাজ মোর্তাজা মাশিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। তারা নাস্তা করে মাশিয়ার ঘরে এসে বসেছেন।

” যখন দেখতেই পাচ্ছ ভালো আছি। তখন আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করার দরকার কি। ” মাশিয়া অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল।

মিরাজ মোর্তাজা বুঝতে পারছেন তার মেয়ের রাগ এখনও কমেনি। তিনি মেয়েকে বোঝাতে চাইলেন।

” এভাবে বলতে নেই, মা। এটা এখন তোমার নিজের বাড়ি। তুমি একটু মানিয়ে চল, দেখবে এরা তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে। প্রথম প্রথম হয়তো একটু খারাপ লাগবে। কিন্তু একসময় দেখবে এদেরকে ছাড়া তুমি থাকতেই পারবেনা। ” মিরাজ মোর্তাজা মেয়ের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন।

” পরাজিত কারও সামনে বসে এমন উপদেশ দেয়াই যায়, পাপা। যখন সেই পরাজিত মেয়েটা তার বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে একটা সাধারণ বাড়িতে এসে নিজের সাথে যুদ্ধ করছে। একবার নিজেকে আমার জায়গায় বসিয়ে দেখ, যতটা সহজে কথাগুলো বলতে পারছ, কাজের বেলায় ঠিক ততটাই কঠিন। যে মেয়ে কখনো এসি রুম ছাড়া রাত কাটায়নি, যার বেডরুম ফাইভ স্টার হোটেলের রুমের মত আরামদায়ক ছিল, তাকে এখন একটা মাটির ঘরে দিনরাত কাটিয়ে দিতে হচ্ছে। ঝকঝকে তকতকে ওয়াশরুমের বদলে তাকে গ্রামের একটা সাধারণ গোসলঘরে শাওয়ার নিতে হচ্ছে। সারাদিন যার প্রঢোজন মেটাতে আশেপাশে কয়েকজন কাজের মানুষ ঘুরঘুর করত, আজ তাকেই কপর্দকশূন্য অবস্থায় অজপাড়াগাঁয়ের এক অতিসাধারণ বাড়িতে দিন কাটাতে হচ্ছে। একমাত্র ছেলেকে তো ঠিকই লাখপতির ঘরে বিয়ে দিয়েছ, কিন্তু নিজের মেয়ের বেলায় কেন এত তাড়াহুড়ো বলতে পারো? বোঝা হয়েছিলাম তোমাদের? তাই বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে বাছ-বিচার না করেই একটা সাধারণ বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে? ” মাশিয়া ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ঘরের পেছনে স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরমান। ও একজনকে দিয়ে গাছ থেকে ডাব নামিয়ে বাড়ির ভেতর আসছিল। ঠিক তখনই মাশিয়ার কথাগুলো ওর কানে যায়। স্বম্বিৎ ফিরতেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে পা বাড়ায় বাড়ির ভেতরে।

” মাশিয়া, তুমি পাগল হয়েছ! তুমি বোঝা হতে যাবে কেন? তুমি আমাদের সন্তান। আমাদের আদরের সন্তান। তোমাকে আরমানের সাথে বিয়ে দিয়েছি তারমানে এই নয় যে, ও অযোগ্য কেউ। তোমাকে আমরা যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিয়েছি। এক হিসেবে দেখতে গেলে মাহিনের শ্বশুর বাড়ির থেকেও তোমার শ্বশুরের পরিবার সম্ভ্রান্ত। যেটা তুমি আজ বুঝতে পারছনা, কিন্তু একদিন ঠিকই বুঝতে পারবে। ” কল্পনা মোর্তাজা মাশিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

” প্লিজ মম, এসব শুনতে আমার ভালো লাগছেনা। তোমরা হঠাৎ এখানে কেন আসলে? দেখতে এসেছ, তোমাদের বেয়াদব মেয়ে কেমন ভুগছে? আমিতো তোমাদের কাছে বিচার দেইনি। তবে কেন এসেছ? ”

” মাশিয়া, দশদিন হয়েছে তোমার বিয়ের। তোমাকে দেখতে মন চায়না আমাদের! তুমি এই কয়দিন আমাদের সাথে কথা বলোনি, কত কষ্ট হয়েছে আমাদের, সেই ধারনা তোমার আছে? তুমি কেন বুঝতে পারছনা, আমরা তোমার ভালো চাই। ” কল্পনা মোর্তাজা হাল ছাড়লেননা।

” আমি কি একবারও বলেছি, আমি খারাপ আছি? আমি যখন ভালোই আছি, তখন আমাকে দেখতে আসার দরকার কি! আর কখনো আমাকে দেখতেও আসবেনা, আর ফোনও করবেনা। ” মাশিয়া এই কয়দিনের রাগ বাবা-মা’কে উগড়ে দিচ্ছে।

মিরাজ মোর্তাজা ও কল্পনা মোর্তাজা স্তব্ধ হয়ে দু’জন দু’জনের মুখপানে তাকিয়ে থাকলেন।

সেদিন রাতের খাবার পর মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে নিয়ে বিদায় নিলেন। বিদায় বেলায় কল্পনা মোর্তাজা কান্নার দমকে ঠিকমত কথা বলতে পারলেননা। মিরাজ মোর্তাজাও কাঁদলেন। একমাত্র মাশিয়া পাথরের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকল। কোন কথাই বললনা।

আরও সাতদিন পেরিয়ে গেছে। এই সাতদিনে আরমান সেদিনের কথপোকথনের বিষয়ে মাশিয়ার সাথে কোন কথাই বলেনি। সে সম্পূর্ণরূপে মাশিয়াকে এড়িয়ে চলেছে। তবে ওর পড়াশোনার ব্যাপারে নজর ঠিকই রেখেছে। নিয়মকরে শশী আর সুধার সাথে পড়তে বসিয়েছে। মাশিয়াও কোন ঝামেলা করেনি। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। আর কয়েকদিন পর শশীর এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। শশী কোমড় বেঁধে পড়াশোনা করছে।

” শশীবালা, আর কত পড়বে? এবার একটু ওঠ। চল বাগানে যাই। গাছে অনেকগুলো বরই পেকে আছে দেখলাম। আমি একা গেলে ঐ হিটলার যদি ধমক দেয়। তুমিও চলোনা। সুধা বাড়িতে থাকলে তোমাকে ডাকতামনা। ” শশীর পড়ার ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলল মাশিয়া। মাশিয়ার অনুনয়ে শশী হেসে বই বন্ধ করল।

” চল যাই। তবে তোমার হিটলার যদি আমাকে ধমক দেয়, তবে সেই দায় কিন্তু তোমার। ”

” শোন, হিটলার যদি ধমক দেয় তবে তুমি বলবে, পড়তে পড়তে মাথায় জ্যাম লেগেছে। তাই জ্যাম ছাড়াতে বাগানে এসেছ। সিম্পল, হিটলাও রাগলোনা। আমাদের বরই খাওয়াও হলো। ”

” তোমার যা বুদ্ধি, ভাবি। এজন্যই মনে হয় ভাইয়া তোমার সাথে পেরে ওঠেনা। চল যাই। ”

ওরা বাগানে এসে মনের সুখে বরই খাচ্ছে। তবে খাচ্ছে কম, খিলখিল করছে বেশি। এক ঘন্টার বেশি হয়েছে বাগানে এসেছে। এরইমধ্যে আরমান বাড়িতে এসেছে। ও আসার পর শশী আর মাশিয়াকে না দেখে আয়েশা খানমকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, ওরা বাগানে গেছে।

একঘন্টা পরও যখন ওরা বাড়িতে আসলনা তখন আরমান বাগানে যায়।

” একঘন্টায় শুধু পুরো গাছের বরই নয়, পুরো গাছটাই খাওয়া যাবে। বরইয়ের সাথে সাথে গাছও খেতে চাস নাকি ? ব্যবস্থা করব? ”

মাশিয়া আর শশী মনের সুখে বরই খাচ্ছিল, তখনই আরমানের গলা শুনে চমকে উঠল। শশী ভয়ে ভয়ে মাশিয়ার দিকে তাকায়। মাশিয়া ঢোক গিলে আরমানের দিকে তাকায়।

” ও সেই সকাল থেকে পড়ছে। পড়ার চাপে শ্বাস আটকে আসছিল, তাই আমি ওকে ফ্রেশ বাতাস সেবন করাতে বাগানে নিয়ে এসেছি। তাইনা শশী? এখন তোমার শ্বাস ঠিক আছেনা? মাথার জ্যামও তো ছুটেছে তাইনা? ” হঠাৎই আরমানের গলা শুনে মাশিয়াও চমকে গেছে। তাই শশীর দিকে তাকিয়ে আরমানকে সাফাই দেয়ার চেষ্টা করছে। আর সেই সাথে শশীকে চোখ টিপে নিজের কথায় সায় দিতে বলছে।

” ভাবি ঠিক বলেছে, ভাইয়া। পড়তে পড়তে মাথায় জ্যাম ধরেছিল। তবে এখন ঠিক আছি। ভাবি, চল বাড়িতে যাই। ”

আরমানকে পাশ কাটিয়ে ওরা বাড়িতে ঢুকতেই আরমানের কথা শুনে থমকায়।

” মনে রাখিস, রেজাল্ট খারাপ হলে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। আর আমি যে ফাঁকা আওয়াজ দেইনা এটা তুই ভালো করেই জানিস। ”

” আমি মন দিয়েই পড়ছি, ভাইয়া। রেজাল্টও ভালো হবে দেখে নিও। শুধু শুধু ভয় দেখিওনা। ”

” বাদ দাওতো, শশীবালা। এই হিটলারকে ভয় পাওয়ার কি আছে? তোমার রেজাল্ট খারাপ হলে না-হয় বিয়ে দেবে। তা দিক। কিন্তু সে কি করেছে! সে তো চাকরি ছেড়ে তবে বিয়ে করেছে। সে চাকরি ছেড়ে যদি আমার মত একটা সুশীলা, সুন্দরী, ট্যালেন্ট মেয়ে পায়, তবে তুমিও রেজাল্ট খারাপ করে হ্যান্ডু একটা জামাই পাবে। মিলিয়ে নিও আমার কথা। ”

আরমান রাগে গজগজ করে তাকায় মাশিয়ার দিকে। কিন্তু মাশিয়া ওর রাগ দেখলেতো। ও আরমানকে ভেংচি কেটে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়।

বাড়ির উঠান ভর্তি পেঁয়াজ দেখে মাশিয়ার চোখ কপালে উঠল। এত পেঁয়াজ একসাথে ও আগে কখনোই দেখেনি। বাহিরের উঠানে তখনও কয়েক ভ্যান ভর্তি পেঁয়াজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মজদুর।

” আম্মা, এত পেঁয়াজ কোথায় থেকে আসল! এত পেঁয়াজ দিয়ে কি করবেন? কতদিনে খাবেন? ” মাশিয়ার কথা শুনে আয়েশা খানম জোরে হেসে উঠলেন।

” পা’গ’লী মেয়ে, এইগুলা বিক্রি করবার জন্য। আম্গোর জমির পেঁয়াজ এডি। এত পেঁয়াজ খাওন যায়? তুমি এই বাড়িতে আওনের পর প্রথম ফসল এডি। মাগো, তুমি খুবই সুলক্ষণা। এত বছর ধইরা পেঁয়াজের চাষ করি, এত পেঁয়াজ কোন বারই হয়নাই। এইবার আল্লাহ রহমত দিছে। ”

আয়েশা খানমের কথার জবাবে মাশিয়া কিছু না বলে অবাক চোখে উঠান ভর্তি পেঁয়াজের দিকে তাকিয়ে থাকল।

” এই যে অসভ্য মাস্টার, পেঁয়াজের কাছ থেকে দূরে থাকুন। এমনিতেই আপনার যত ঝাঁঝ। এই ঝাঁঝের সাথে পেঁয়াজের ঝাঁঝ মিশলে নির্ঘাত নিউক্লিয়ার বো’মে’র ন্যায় তেজ হবে আপনার মেজাজের। যা পরিবার এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সেই সাথে আমার জন্যও। ”

আরমান দেখল ওর চাচাতো ভাইয়ের বউ মাশিয়ার কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসছে। আয়েশা খানমও হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। শশীতো হো হো করে হেসে উঠল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here