#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৪
জাওয়াদ জামী জামী
সুধার পরীক্ষা শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগেই। এবার মাশিয়ার পরীক্ষা শুরু হবে। আরমান ওর বন্ধুকে এক রুমের একটা ফ্লাটের ব্যবস্থা করতে বলেছে। কিন্তু মিরাজ মোর্তাজা চাইছেন তার মেয়ে জামাই তার বাড়িতে এসে উঠুক। তবে আরমান সেই কথায় রাজি হয়না। ও মাশিয়াকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটেই উঠবে। পরীক্ষা শেষ হওয়া অব্দি সেখানেই থাকবে।
আয়েশা খানম গোছগাছ শুরু করেছেন। তিনি ঘানি ভাঙ্গানো সরিষার তেল, আটা-ময়দা, আতপ চাল, পোলাওর চাল, মসুর ডাল, ধনে কাঁচা আমসহ নিজেদের জমির অনেক কিছুই প্যাক করেছেন। এত কিছু প্যাক করতে দেখে অবাক হয় মাশিয়া।
” আম্মা, এসব কি করছেন? এত কিছু নিয়ে কিভাবে যাব? এ কিছুর দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিলনা। ”
” তোমার কোন চিন্তা নাই, মা। আমার বাপ মাইক্রো ভাড়া করছে। তোমরা শুধু জিনিসগুলান দেইখা নিবা। আর ঢাকায় পৌঁছায়ই বেয়াইকে ফোন দিবা। বেয়াই নিয়া যাইব। মেয়ের বাড়ির জিনিস দেইখা তিনি খুশি হইব দেইখা নিও। ”
মাশিয়া বুঝল তার শ্বাশুড়িকে মানানো যাবেনা। তাই ও আর কথা বাড়ায়না।
রাতে ব্যাগ গোছাচ্ছে মাশিয়া। দেখে দেখে কাপড় তুলছে ব্যাগে।
” কাপড় নিতে গিয়ে বই নেয়ার কথা ভুলে যেওনা। বই, নোটস সব দেখেশুনে তুলে নাও। আমাকে তোমার জন্য যেন দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়। ”
” নিজের চরকায় তেল দিন। আমার যা যা প্রয়োজন সবই নিব। ”
আরমান কিছু না বলে নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করল।
পরদিন সকালে ওরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বিকেলেই পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। সেখানে আরমানের বন্ধু ওদের অপেক্ষায় ছিল। তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে ওরা ফ্ল্যাটে আসে।
প্রায় আধাঘন্টা পর মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে নিয়ে আরমানের ফ্ল্যাটে আসলেন। কল্পনা মোর্তাজা সাথে করে খাবার নিয়ে এসেছেন। মাশিয়া বাবা-মা’কে দেখে উচ্ছ্বসিত হলোনা। বাবা-মা’র প্রশ্নের দায়সারা উত্তর দিয়ে নিশ্চুপ থাকল। কল্পনা মোর্তাজা আরমানকে খাবার কিনতে কিংবা বাসায় রান্না করতে নিষেধ করে দিলেন। আরমানরা যতদিন ঢাকায় আছে, তিনি ততদিনই খাবার পাঠিয়ে দেয়ার কথা বললেন। আরমান তার প্রস্তাবে রাজি হয়না। কিন্তু শ্বশুর-শ্বাশুড়ির জেদের কাছে হার মানতে হয় ওকে। তাদের অনুরোধ আরমান ফেলতে পারলনা।
আরমান বাড়ি থেকে নিয়ে আসা জিনিসপত্র কল্পনা মোর্তাজাকে দিলে তিনি ভিষন খুশি হলেন। রাত দশটার দিকে তারা বিদায় নিলেন।
অনেক দিন পর ভার্সিটিতে পা রেখে আবেগে কেঁদে ফেলল মাশিয়া। যেন কতকাল দূরে ছিল ওর প্রিয় এই অঙ্গন থেকে। এই কয়মাসে ঢাকা শহর অনেকটাই বদলে গেছে। তেমনি বদলেছে ওর প্রিয় এই ক্যাম্পাস। এতদিন পর ওকে দেখে ভয়ে অন্যরা রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ালোনা কিংবা কেউ কোন প্রকার সম্ভাষণও করলনা। যেন ওর কোন অস্তিত্বই ভার্সিটিতে নেই।
” দোস্ত তুই এসেছিস! কতদিন পর তোকে দেখছি! কেমন আছিস তুই? ” কোথায় থেকে তৃষা দৌড়ে এসে মাশিয়াকে জড়িয়ে ধরল। ওর চোখ ছলছল করছে।
” বেইব, তুমি এসেছ? তোমাকে কত্ত মিস করেছি জানো? তুমি নাকি আমার ক্রাশকে বিয়ে করে তার সংসার করছ! কিভাবে পারলে, বেইব! তুমিতো জানতে আমি আমার আরু বেইবিকে কত ভালোবাসি? ” তৃষার পেছনে এসে দাঁড়ায় মিতুল। ও হাঁপাচ্ছে। দোতলা থেকে মাশিয়াকে দেখে ওরা দৌড়ে নিচে এসেছে।
আজ মাশিয়ার মিতুলের ওপর মোটেও রাগ হয়না। এতদিন পর বন্ধুদের দেখে ওর মুখে হাসি ফুটেছে।
” বেইব, তুমি চিন্তা করোনা, তোমার আরু বেইবি তোমারই আছে। সে ভার্সিটির বাহিরে আছে প্রয়োজনে তার সাথে গিয়ে কথা বলে সবকিছু ফিটিং করতে পার। এতে তারও সুবিধা আর তুমিও পথে আসতে পারবে। ”
” তুমি একথা বলছ কেন, বেইব? আমি আমার আরু বেইবির সাথে কথা বললে তার কিসের সুবিধা? ” মিতুল বুঝতে না পেরে বলল।
” তুমি যেমন ন্যাকু, সে-ও তেমনি অসভ্য মাস্টার। নিয়মকরে তিনবেলা থাপড়ে সে তোমার ন্যাকামি ছুটিয়ে দেবে। তখন জীবনেও তুমি আর তোমার আরু বেইবির নাম মুখে আনবেনা। আর তাকে অযথাই আরু বেইবি আরু বেইবি বলে ডেকে নিজের এনার্জি লস করোনা। সে রোমান্টিক মেটেরিয়াল নয়। জন্মের পর তার আম্মা তার মুখে মধু না দিয়ে নিম পাতার রস দিয়েছিলেন। তাই তার আপ টু বটম তিতা। বাই দ্য ওয়ে, জয় কোথায়? এই ন্যাকু এখানে আছে, কিন্তু জয় ওর আশেপাশে নেই এটা মানা যাচ্ছেনা। ”
” বেইব, জয়কে একটু ক্যান্টিনে পাঠিয়েছি। ও এক্ষুণি চলে আসবে। চল আমরা রুমে গিয়ে বসি। ”
” দোস্ত, তুইতো ভার্সিটির রাস্তা চিনিস, তবুও স্যার কেন তোর সাথে এসেছে? কেমিস্ট্রি বুঝলামনা। ”
” এই কেমিস্ট্রি বোঝার মত বয়স, বুদ্ধি কোনটাই তোর হয়নি। আর আমিও এই বিষয়ে নাদান। তাই কথা না বাড়িয়ে রুমে চল। ” তিন বান্ধবী মিলে দোতলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
আরমান ভার্সিটির সামনের একটা দোকানে বসে আছে। সেখানে পরিচিত কয়েকজনের সাথে দেখা হলে তাদের সাথে গল্প করে বেশ কিছু সময় কাটায়। এরপর মাশিয়া পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসলে ওকে নিয়ে ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দেয়।
মাশিয়ার পরীক্ষা বেশ ভালোই হচ্ছে। আরমান ওকে নিয়মিত পড়াচ্ছে। যেহেতু রান্নার ঝামেলা নেই তাই আরও পড়ানোর সময় পাচ্ছে। বাসা পরিষ্কার পর্যন্ত মাশিয়াকে করতে দিচ্ছেনা। মাশিয়াকে দিনরাত বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে হচ্ছে। অবশ্য এতে ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আগেরমত ফাঁকিবাজি করেনা। মন দিয়ে পড়াশোনা করে।
ওরা পনের দিন হয় ঢাকায় এসেছে। কল্পনা মোর্তাজা অনেকবার আরমানকে তাদের বাসায় যেতে বললেও আরমান রাজি হয়নি। ওর একটাই কথা মাশিয়াকে ঠিক না করে ও কিছুতেই সেখানে যাবেনা। এদিকে মাশিয়াও একবারও ঐ বাড়িতে যাওয়ার কথা বলেনি। মাশিয়ার ভাই তার স্ত্রী’কে নিয়ে দুইদিন এসেছিল আরমানের ফ্ল্যাটে।
” বই রেখে খেয়ে নাও। আজ রাত এগারোটার মধ্যে যতটুকু সম্ভব পড়ে নিও। কালকে পরীক্ষা তাই আজকে আর রাত জাগতে হবেনা। কাল ভোরে উঠে যতটুকু বাকি থাকবে পড়ে নিও। ”
আরমান প্লেটে করে খাবার এনে মাশিয়াকে ডাক দেয়। আজকে ও বাহিরে থেকে খাবার এনেছে। বিকেলেই কল্পনা মোর্তাজাকে ফোন দিয়ে খাবার পাঠাতে নিষেধ করেছিল। মাশিয়া কথা না বলে বই বন্ধ করে উঠে পরল।
” হেই সুইটি, হোয়াট আ সারপ্রাইজ! তুমি ঢাকায় আছ, অথচ আমি জানিনা! কেমন আছো ডার্লিং? বড্ড মিস করেছি তোমাকে। আজকে তোমাকে ছাড়ছিনা। তোমাকে নিয়ে আজ লং ড্রাইভে যাব। পার্টি হবে আজ তোমার সৌজন্যে। আজ শুধু চিল করার দিন। চল এখনই বেরিয়ে পরি। ” রিশাদ যেন আরমানকে দেখেও দেখলনা।
ভার্সিটিতে ঢুকতেই রিশাদের সাথে দেখা হয় মাশিয়ার। হঠাৎ রিশাদ সামনে আসায় মাশিয়া চমকে উঠল। আরমান রিশাদকে দেখে চোয়াল শক্ত করে।
” মাশিয়া, তোমার পরীক্ষা শুরু হতে আর দেরি নেই। এখনই পরীক্ষার হলে না গেলে তুমি অনেক বড় ভুল করবে। ”
মাশিয়া আরমানের কথা শুনে রিশাদকে কিছু বলার সাহস করে উঠলনা। ও আরমানের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছে আরমান ভিষণ রেগে গেছে।
” সরি রিশাদ, আজ আমি কোথাও যেতে পারবনা। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পরীক্ষা শুরু হবে। আজ এমনিতেও বাসা থেকে বের হতে দেরি হয়েছে। তোমার সাথে পরে কথা বলব। এখন আমি যাই। ”
মাশিয়া রিশাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌড়ে ভার্সিটিতে ঢুকে যায়। আরমান ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এরপর সামনের দোকানে গিয়ে বসল।
সেদিনের পর থেকে প্রতিটি পরীক্ষার দিনই রিশাদ ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রতিবারই সে মাশিয়াকে নিয়ে বাহিরে যেতে চায়। কিন্তু মাশিয়া একবারও রিশাদের প্রস্তাবে রাজি হয়না। আরমান ওদেরকে কিছু না বলে সবটা চুপচাপ দেখে যায়।
” মাশিয়া, তুমি মমের ওপর এত রাগ করেছ? কতদিন ধরে আমাকে মম বলে ডাকোনি তুমি। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি, সোনা। তুমি আমাদের ওপর আর রাগ করে থেকোনা। একটিবার বাসায় চল। তুমি আরমানকে বললে ও না করতে পারবেনা। ” কল্পনা মোর্তাজা মাশিয়ার দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। মা’য়ের চোখে পানি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায় মাশিয়া।
” মম, প্লিজ কেঁদোনা। কান্নাকাটি আমার মোটেও ভালো লাগেনা। তুমি বাসায় যাও। আমার সব গোছগাছ করতে হবে। কাল সকালেই গাড়ি আসবে। রাতেই সবকিছু গুছিয়ে ফেলতে হবে। এখন কোথাও যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া ঐটা আমার নিজের বাড়ি নয়। আমি ঐ বাড়িতে কয়েক বছরের অতিথি ছিলাম মাত্র। তাই এখন সেখানে গিয়ে তোমাদের বিরক্ত করতে চাইছিনা। ”
মাশিয়ার এহেন রূঢ় আচরণে কল্পনা মোর্তাজা এবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। ভাগ্যিস আরমান বাসায় নেই। নয়তো আজ তাকে আরমানের সামনে লজ্জায় পরতে হত। কল্পনা মোর্তাজা অনেক বুঝিয়েও মাশিয়াকে রাজি করতে পারলেননা। আরমান বাসায় আসলে তিনি বিদায় নিলেন।
পরদিন খুব সকালে মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে নিয়ে আবার আসলেন মেয়ের কাছে। মাহিন আর দোলনও এসেছে তাদের সাথে। ততক্ষণে মাশিয়া সব গুছিয়ে নিয়েছে। তারা তৈরী হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে।
মিরাজ মোর্তাজা বাসায় ঢুকেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি মাশিয়াকে অনেক কথাই বললেন। কিন্তু মাশিয়া বাবার কথায় তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়না। আরমান দূর থেকে সবকিছুই লক্ষ্য করল। মাশিয়া ওর ভাই-ভাবীর সাথেও তেমন একটা কথা বললনা। আরমান খুব ভালো করেই বুঝল মাশিয়ার রাগ এখনও কমেনি।
চলবে…