যেখানে_দিগন্ত_হারায় #পার্ট_৩০ জাওয়াদ জামী জামী

0
323

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী জামী

” এই টাকাগুলো রাখ। আমি না আসা পর্যন্ত আম্মার সাথে ঘুমাবে। কোন সমস্যা কিংবা কোনকিছু প্রয়োজন হলে আম্মাকে বলবে। ” আরমান মাশিয়াকে কিছু টাকা দিয়ে কথাগুলো বলল।

মাশিয়া ওর হাতে থাকা টাকাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর ও একটু হেসে বলল,

” মেয়েদের থেকে দূরে থাকবেন। প্রয়োজন হলেও কোন মেয়ের সাথে কথা বলবেননা বলে দিলাম। আমি কিন্তু সুধার কাছ থেকে সবকিছু শুনব। যদি তেমন কিছু শুনি, তখন আপনার খবর আছে। ”

মাশিয়ার কথা শুনে আরমান হাসল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর সময় বেশি নেই, এখনই বেরোতে হবে। তবুও সে মাশিয়াকে টেনে নিজের কাছে নেয়। মাশিয়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,

” বলললামনা আমার সাথে চল? তাহলে নিজের চোখেই সব দেখতে পেতে, আমি কি করছি না করছি। সুধার কাছ থেকে কিছুই শোনার প্রয়োজন হতোনা। এখনও সময় আছে, চল যাই। ”

মাশিয়া আরমানের শার্টের বোতাম খুলে আবারও লাগিয়ে দিল। এরপর আরমানের ঘাড়ে হাত রাখল।

” উঁহু, এখন কোথাও যাবনা। কিন্তু আমি যাচ্ছিনা বলে নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গ মনে করে যত্রতত্র উড়বেননা বলে দিচ্ছি। যদি এমন কিছু শুনি তখন আপনার ঠ্যাং ভেঙে দেব। ” মাশিয়ার গলায় শাসনের সুর।

” পারবে ভাঙতে? কষ্ট হবেনা? কিন্তু হঠাৎ করেই সিংহীর বিড়ালে রুপান্তরীত হওয়ার কাহিনী এখনও বুঝলামনা। ”

” এতদিন আপনার সাথে বাস করে কি শিখলাম তাহলে! আপনার অস্ত্র দিয়ে আপনাকেই ঘায়েল করব। বুঝেছেন, অসভ্য মাস্টার? আশার করছি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন? ” মাশিয়া আরমানের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দেয়।

” সত্যিই তোমার কথার মানে বুঝিনি। একটু বুঝিয়ে দেবে? ” আরমান মাশিয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারলনা। তাই ও মাশিয়ার কাছে জানতে চাইল।

” যাওয়ার সময় এসব শুনতে নেই। এই আপনার দেরি হচ্ছেনা? ”

” হচ্ছে তো। কিন্তু তুমি আমাকে ধরে রেখেছ। আর এই মূহুর্তে তোমার বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করছেনা। ”

আরমানের কথা শোনামাত্রই মাশিয়া ঝট করে আরমানের ঘাড় থেকে হাত নামায়।

” এবার না গেলে বাস মিস করবেন। আমি কি কি বলেছি সব মনে রাখবেন কিন্তু। ”

” মনে থাকবে। ” আরমান হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

তিনদিন হচ্ছে আরমান ঢাকা গেছে। মাশিয়া মনে আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও আর শশী বেশিরভাগ সময়ই বাগানে বসে আড্ডা দেয়। যেহেতু খরমান নেই তাই ওদের আপাতত পড়ার জন্য কোন ধমকও খেতে হচ্ছেনা। আয়েশা খানমও ছেলের বউকে কিছুই বলেননা। তাই মাশিয়া নিজের মতই চলছে।

মাশিয়া আর শশী বারান্দায় বসে আমড়া মাখা খাচ্ছে। আয়েশা খানম গেছেন পুকুরে। ঘরে আয়েশা খানমের ফোন বাজছে। কি মনে করে মাশিয়াই যায় ফোনের কাছে। মাশিয়া ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরমানের নাম। ও ফোন রিসিভ করে চুপ থাকল।

” কেমন আছো, আম্মা? ”

” আমি আম্মার ছেলের বউ বলছিলাম। আম্মা পুকুরে গেছে। তাকে ডাকব? ”

” ওহ, তাহলে আমি আম্মার ছেলে বলছি। আপাতত আম্মার ছেলের বউ কথা বললেই চলবে। তার কি এখন সময় হবে কথা বলার? ”

” আমার কাছে অফুরন্ত সময় আছে। চাইলে আপনাকেও ধার দিতে পারি। কি করছেন আপনি? ”

” সুধাকে নিয়ে কোচিং-এ এসেছি। এবার বল তোমরা কেমন আছো? শশী কোথায়? ”

” আরে রাখেন আপনার প্রশ্ন। আপনি এখনই শশীর ফোনে ভিডিও কল দিবেন। আমি ফোন রাখছি। আপনি শশীর ফোনে ফোন দিন জলদি। ” মাশিয়া ফোন কেটে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় শশীর কাছে।

” শশী তোমার ফোন কোথায়? ডাটা অন আছে ফোনে? না থাকলে জলদি অন করো। হারি আপ। ওঠ ফোন কোথায় দেখ। ”

মাশিয়া শশীকে প্রায় টেনে তোলে। হতবাক শশী মাশিয়ার কথামত কাজ করে।

কয়েক মিনিট পরই শশীর ফোন বেজে উঠল। শশী ফোনে আরমানের নাম দেখেই মাশিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়।

” হ্যাল্লো, লুচু মাস্টার। ”

মাশিয়ার কথার প্রত্তুত্যরে কোন কথা না বলে তাকিয়ে থাকল আরমান। আরমানকে চুপ থাকতে দেখে মাশিয়া আবারও কথা বলল।

” কি দেখছেন এভাবে? দেখি ফোনের ক্যামেরা আপনার দুইপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে আসেনতো। এরপর সামনে পেছনেও নিয়ে যাবেন। ” মাশিয়া যেন কিছু একটা দেখতে চাইছে।

মাশিয়ার কথা শুনে এবার আর আরমান চুপ থাকতে পারলনা।

” হোয়াট! ক্যামেরা সামনে-পেছনে ডানে-বামে ঘোরাবো মানে? কি বলতে চাইছো তুমি? ” আরমান অবাক হয়ে জানতে চায়।

” দেখবো আপনার সামনে-পেছনে, ডানে-বামে কোন রমনী আছে নাকি। ও হ্যাঁ, নিচের দিকেও ক্যামেরা ধরবেন। বলাতো যায়না, নিচে হয়তো কাউকে লুকিয়ে রাখলেন। তারাতারি করুন। ” মাশিয়া ফোনেই এদিকওদিক তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে।

” এবার বুঝেছি কেন তুমি ভিডিও কলে আসতে বললে। আমিও পা গ ল তোমার কথা শুনে কি না কি ভাবলাম। ”

” বেশি কথা বলে টপিক পাল্টানোর চেষ্টা করবেননা। তারাতারি করুন। বেশি দেরি হলে রমনীরা আবার লুকিয়ে যেতে পারে। ”

মাশিয়ার এমন উদ্ভট কথায় আরমান রেগে গেলেও আশেপাশে লোকজন আছে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। ও দাঁতে দাঁত চেপে ফোন চারপাশে ঘুরিয়ে মাশিয়াকে দেখিয়ে দেয়।

” এবার কি আকাশও দেখাব? বলাতো যায়না সেখানেও কেউ হাওয়ায় ভেসে থাকতে পারে। ” আরমান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

” ভালো কথা মনে করেছেন। দেখান দেখি আকাশে কেউ আছে নাকি। আশেপাশের সব টেরেসে ক্যামেরা নিয়ে যাবেন। ”

মাশিয়ার কথা শুনে আরমান কপাল চাপড়ায়। রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

” বাড়িতে একবার আসতে দাও। তোমার সন্দেহের ভূত যদি ঘাড় থেকে না নামাই তবে আমার নাম আরমান নয়। ”

” বকবকানি বাদ দিয়ে চুল এলোমেলো করুন। চুল এত পরিপাটি করে রেখেছেন কেন? চুল এলোমেলো করে, টি-শার্টের কলারের বোতাম লাগান। ” আরমানের রাগকে মোটেও পাত্তা দিলনা মাশিয়া।

” আমি ফোন রাখছি। ”

” এই খবরদার ফোন রাখবেননা। আপনি ফোন রাখার সাথে সাথেই আমি এমন এক চিল্লানী দেব, পাড়ার লোকজন জড়ো হবে কিন্তু। তারা জিজ্ঞেস করলে বলল, আপনি ঢাকায় গিয়ে অন্য এক মেয়ের সাথে প্রেম করছেন। পুরুষ মানুষ থাকবে অগোছালো হয়ে। সেই রুলস না মেনেই তিনি ফুলবাবু সেজে ঢাকার অলিগলিতে ঘুরছেন। আর এদিকে আমি চিন্তায় ম র ছি। যচ করতে বলেছি করুন। ” মাশিয়া আজ আরমানকে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা।

আরমান মুখ কালো করে নিজের চুল এলোমেলো করল। এরপর কলারের বোতাম লাগালো।

” হয়েছে? এবার খুশি তুমি? ” আরও কিছু করতে হবে? ” রাগে আরমানের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।

” না। আজকের মত এটাই ঠিক আছে। এরপর থেকে বাহিরে গেলে বেশি সাজুগুজু করার দরকার নেই। মনে রাখবেন আপনার একটা বউ আছে। তাই অন্য মেয়েদের কাছে নিজেকে কুরবানির গরু হিসেবে প্রকাশ করার কোন মানেই হয়না। ” মাশিয়া নিজেকে জ্ঞানী প্রমান করতে চাইল।

” আর কিছু? ”

” উঁহু। এবার রাখতে পারেন। ” মাশিয়া আরমানের উদ্দেশ্য ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল। সেই সাথে চোখও মারল। আর নিমেষেই আরমানের রাগও হাওয়ায় মিশে গেল। ও হেসে ফোনের লাইন কেটে দিল।

মাশিয়া বারান্দায় বসেই কথা বলছিল। এতক্ষণ শশী উঠানে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর হাতে আমড়া মাখার বাটি। কিন্তু বেচারী খাওয়া ভুলে মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা ভাইয়াকে ভাবী এভাবে নাকানিচুবানি খাওয়ালো। মাশিয়া ফোন চৌকিতে রেখে শশীর দিকে তাকায়।

” কি দেখছো এভাবে ভাইয়ের চন্দ্র? ”

” ভাইয়া আমার। তুমি ভাই বলছ কেন? ”

” তোমার ভাই-ই বলেছি। তাকে ভাই বলতে যাব কোন দুঃখে! সে-তো আমার অসভ্য মাস্টার। ”

” তুমি আমার ভাইয়াকে এভাবে নাকানিচুবানি খাওয়ালে, ভাবি? এটা তুমি করতে পারলে! ভাইয়া না তোমার একমাত্র জামাই? ” শশী ভিষণই অবাক হয়েছে।

” একমাত্র জামাই জন্যই তো তার পেছনে লাগতে পারি। এতে যে কি মজা সেটা যদি তুমি জানতে। অবশ্য বিয়ের আগে এসব বোঝার কোন ওয়ে তোমার নেই। তাই বিয়ের আগ পর্যন্ত আমার নওটানকি দেখেই চোখকে স্বার্থক কর। ”

” মাফ চাই, ভাবী। ভাইয়াকে পরাস্ত দেখতে অভ্যস্ত নই আমরা। আমার কষ্ট হচ্ছে ভাইয়ার জন্য। পাগলের বেশে ভাইয়াকে দেখে না জানি মানুষজন কত হাসছে। ” শশী পারলে আরমানের জন্য কাঁদে।

শশীর মুখের দিকে তাকিয়ে মাশিয়া হো হো করে হেসে উঠল। ভাইবোনের মধ্যে এত মিল আর ভালোবাসা ও আগে কাউকেই দেখেনি।

দশদিন পর আরমান গ্রামে এসেছে। ও সুধাকে মোটামুটি ফ্ল্যাট থেকে কোচিং-এর রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছে। ওরা ঢাকায় যাওয়ার পর মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে নিয়ে ওদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। কল্পনা মোর্তাজা প্রতিদিন একবার করে এসে সুধাকে দেখে যান। তিনি সুধাকে রান্না করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি প্রতিদিন তিনবেলা খাবার পাঠান। একটা গাড়ী তিনি পাঠাচ্ছেন সুধাকে কোচিং-এ নিয়ে যেতে আসতে। মোটকথা, সুধাকে পড়াশোনা আর ফ্ল্যাট পরিষ্কার ছাড়া কিছুই করতে হয়না। কল্পনা মোর্তাজা চেয়েছিলেন সুধা তাদের বাসাতেই থাকুক। কিন্তু আরমান রাজি হয়নি। আরমান চলে আসার পর কল্পনা মোর্তাজা তার বাসার একজন মেইডকে পাঠিয়েছেন সুধার কাছে। গ্রাম থেকে কেউ না যাওয়া পর্যন্ত মেইড সুধার কাছেই থাকবে। আরমানও নিশ্চিত থাকতে পারছে কল্পনা মোর্তাজার এমন সহযোগিতার জন্য। আয়েশা খানম কিছু জিনিসপত্র পাঠিয়েছিলেন কল্পনা মোর্তাজার জন্য। সেগুলো প্রথম দিনই সুধা তাকে দিয়েছে। তিনি ভিষণ খুশি এমন একটা পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারায়।

আরমান বাড়িতে আসলে মাশিয়া ওর থেকে দূরে দূরে থাকছে। এই দশদিন ও আরমানকে খুব বিরক্ত করেছে। আরমান রেগেও আছে মাশিয়ার ওপর। ও সুযোগ পেলেই মাশিয়াকে শায়েস্তা করবে। মাশিয়া তাই আয়েশা খানমের আশেপাশেই থাকছে বেশিরভাগ সময়।

আরমান খুব ভোরে বাড়িতে এসেছে। এখন বিকেল। এত সময়ের মধ্যে মাশিয়া ওর কাছে একবারও আসেনি। এই মুহূর্তে মাশিয়া আয়েশা খানমের কাছে বসে আছে। আরমানও ওর মা’য়ের কাছেই বসে গল্প করছে। ঠিক তখনই বাহিরে থেকে কেউ আরমানের নাম ধরে ডাক দিল। ডাক শুনে আরমান বাহিরে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর ও যখন ভেতরে আসল তখন ওর হাতে একটা খাম দেখতে পায় সবাই। আরমাস বারান্দায় এসে খাম খুলে কয়েকটা কাগজ দেখতে পায়। এরমধ্যে সে একটা চিঠিও পায়। তাই আগে চিঠিটা পড়তে শুরু করল।

” কিয়ের চিঠি আইছে, বাপ? ” আয়েশা খানম চিন্তিত বদনে জানতে চাইলেন।

আরমান সময় নিয়ে চিঠি পড়ে হাসিমুখে তাকায় আয়েশা খানমের দিকে।

” একটা কোর্সের জন্য মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটিতে এ্যাপ্লাই করেছিলাম, আম্মা। সেখান থেকেই উত্তর এসেছে। তারা ধাপে ধাপে পঞ্চাশজনকে নিচ্ছে। চারমাসের কোর্স। আমাকে চতুর্থ ধাপের জন্য সিলেক্ট করেছে অথরিটি। আগামী পনের দিনের মধ্যেই মালয়েশিয়া যেতে হবে আমাকে। ”

আরমানের এমন সুযোগ আসায় সবাই খুশি। আয়েশা খানমতো খুশিতে কেঁদেই ফেললেন। শশীও খুশিতে লাফাতে শুরু করেছে।

” আমাকে আবারও ঢাকা যেতে হবে, আম্মা। ডিপার্টমেন্ট থেকে কয়েকটা পেপার সংগ্রহ করতে হবে। এছাড়া পাসপোর্টও রিনিউ করাতে হবে। আরও কিছু কাজ আছে। ”

” কবে যাইবা, বাপ? আজকেই কেবল আসলা। ” কালকেই যাব, আম্মা। পনের দিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করতে হবে। ”

আরমান ব্যস্ত হয়ে যায় কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here