প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২৫] প্রভা আফরিন

0
486

প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২৫]
প্রভা আফরিন

দিলশানের চেম্বার ও ডিউটি মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। অবসরের জন্য খুব কম সময়ই মেলে তার। বিনোদনের জন্য তো নয়ই। রাতের বেলা ঘুমের মাঝেও রোগীদের ফোন আসতে থাকে। দিলশান কখনোই এ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয় না। ফোন সাইলেন্ট বা বন্ধ করে রাখে না। মাঝরাতে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেলে স্বভাবসুলভ বিরক্ত লাগলেও সে বিনয় ও নম্রতা দেখিয়েই কথা বলে। জরুরি প্রয়োজনে তাকে ফোন করে কেউ নিরাশ হয় না। অসুস্থ রোগীরা ডাক্তারকে অনেক বেশিই ভরসা করে। ডাক্তারের কথা তাদের মনের জোর ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাই দিলশান ওদের সেই ভরসার স্থানটুকু দায়িত্বের সঙ্গেই দখল করে রেখেছে। ডিউটি ও চেম্বারের মাঝে কিছুটা সময় অবসর মেলে তার৷ নিজের বরাদ্দকৃত চেম্বারে লাঞ্চ করে বিশ্রাম নেবার বদলে দিলশান অভুক্ত অবস্থায় বেরিয়ে পড়ল হাসপাতাল ছেড়ে। সকালে খেতে বসে মায়ের সঙ্গে একটু ঠোকাঠুকি হয়ে গেছে। ছেলে উনার এক্সপেরিমেন্টাল ডিশকে খারাপ বলে অহেতুক অপচয়ের জ্ঞান দেওয়ায় সুলেখা অভিমান করে সকালে খাননি। এখন সেটার খেসারত দিতে ও অন্তরের অস্থিরতা কমাতে মায়ের সঙ্গে দুপুরের লাঞ্চটা করবে বলে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তার দেখা জগতের সবচেয়ে সরল ও অভিমানী মানুষটা মা। কিছু মানুষের মনের বয়স কখনো বাড়ে না। সুলেখাও তেমনই। দস্তগীর সাহেব বিশাল ধৈর্যবান বলেই স্ত্রীকে সামলে রাখতে পেরেছেন এতগুলো বছর। বড়ো হবার পর দিলশানও মায়ের ছেলে হবার বদলে সুলেখার বাবা হয়ে গেছে। আর পিতার থেকে পাওয়া ধৈর্যের গুণ তো আছেই। যদিও আজকাল এই গুণের সদ্ব্যবহার আরেকজনও করছে।

দিলশান এখন বাবা হয়ে তার জেদি মেয়ের রাগ ভাঙাতে যাচ্ছে। পথিমধ্যে রেস্তোরাঁ থেকে মেয়ের পছন্দের সুশি, ফ্রাইড চিকেন ডাম্পলিং আর নিজের জন্য বারবিকিউ স্টেক পার্সেল করে নেয়।
সময়টা দুপুর দুটো। হোয়াইট হাউজের ড্রাইভওয়েতে সাদা গাড়িটা ঢুকতেই হঠাৎ শরতের বাতাসে উড়ে আসা কাশফুলের মতো শোভার আগমন ঘটল গাড়ির সামনে। দুইহাত দুই দিকে প্রসারিত করে সে গাড়ি থামানোর নির্দেশ প্রদান করছে। দিলশানের ধীরগতির গাড়িটা সজোরে ব্রেক কষে থেমে গেছে ততক্ষণে। গাল ফুলিয়ে লম্বা একটি শ্বাস নিয়ে ক্ষীপ্ত মেজাজে গাড়ি থেকে বের হলো সে। চোখ গরম করে বলল,
“এসব কী ধরনের ফাজলামি, শোভা? একবার এক্সিডেন্ট করে সাধ মেটেনি?”

সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরুয়া সুপুরুষ ছেলেটির গরম চোখ দেখে শোভার বিকার হলো না। বরং কাঁধে ছড়ানো খোলা চুলগুলো নেড়ে দিলো হালকা হাতে। সারাটাদিন পরিবারের সবার সামনে বিশাল ভালোমানুষি দেখিয়ে অতঃপর বাইরে বের হবার অনুমতি পেয়েছে সে। গোসল করে ভেজা চুলেই বেরিয়ে এসেছে। পুরুষটির প্রশ্নোক্ত চোখের জবাবে ড্যামকেয়ার হাসি ছুঁড়ল শোভা। দিলশানের হাতে স্মার্টফোনটা ধরিয়ে দিয়ে ললিত সুরে বলল, ” নতুন জামা পরেছি। দাগ লেগে ময়লা হবার আগে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে দিন দেখি।”

দিলশান ফোন হাতে কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। শোভার পরনে কালো জাম্পস্যুট, তারওপর সাদা ফুলস্লিভ কোটি স্টাইলের শার্ট। সেই শার্টের আস্তিন আবার ফোল্ড করে কনুই অবধি তুলে রাখা। পায়ে সাদা কেডস। দেখে মনে হচ্ছে বারো-তেরো বছরের একটি মেয়ে নতুন জামা পরার খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ছবি তুলতে আবদার করছে। শোভা ততক্ষণে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে পোজ নিয়ে দাঁড়িয়েছে। দিলশান বিবাদ বাধাতে চাইল না। বুঝতে বাকি নেই মেয়েটি তার এটেনশন পেতেই একটা বাহানা নিয়ে এসেছে মাত্র। তাই ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে দিলো। শোভা টফিকে টেনে এনে তার সঙ্গেও কিছু পোজ দিলো। এরপর আরেকটু আবদারের সুরে বলল, “আসুন সেলফি তুলি।”

দিলশান শাণিত চোখে চেয়ে বলল, “আমি তো নতুন জামা পরিনি। কোন খুশিতে তুলব?”

শোভা হেসে বলল, “আমাদের ড্রেসের কালার আজকে সেম সেম৷ সেই সুবাদেই একটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট কাপল পিক হয়ে যাক।”

“কাপল পিক?”

“হু।” লাজুক হাসল শোভা। দিলশানের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ওর সামনে এসে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু ক্যামেরায় দুজন আঁটল না। উচ্চতায় দিলশান লম্বা বলে দুজন একসাথে আঁটছিল না। শোভা অধৈর্য হয়ে বলল,
“একটু ঝুঁকুন না!”

দিলশান ত্যারচা হেসে ঘাড়টা আরো টানটান করল। অস্থিরমতি তখন বিরক্তিভরে বলল,
“একটা সামান্য ছবি তুলতে ছেলেদের এত নকশা করতে হয় জানা ছিল না। গার্লফ্রেন্ড জানলে মাইন্ড করবে? নাকি ভাবছেন আপনার ছবি ফটোশপ দিয়ে ন্যুড বানিয়ে ভাইরাল করব?”

দিলশান ত্যাক্ত শ্বাস ফেলল। মেয়েটি চরম মাত্রার ঠোঁটকাটা। অনাগ্রহে বলল, “বড্ড বাজে বকো তুমি।”

“আমি তো মধুর কথাই বলতে চাই। আপনিই তো শুনতে চান না। খালি ত্যাড়ামো করেন।”

“আর তুমি বড্ড সরল!”

“হু, একদম পানির মতো।”

“অ্যালকোহলযুক্ত পানি!” বিড়বিড় করল দিলশান।

শোভা শুনে ফেলল কথাটা। চওড়া হেসে বলল, “খেয়ে মাতাল হয়ে যান।”

“তুমি ভীষণ ডার্টি মাইন্ডের।”

“তো আপনি সার্ফ এক্সেল হয়ে যান না। সব ডার্ট ধুয়ে দেবেন।”

“আমি ডাক্তার। ধোপা নই যে ধুয়ে দেব।”

“আমি শোভা। পচা ডোবা নই যে ডার্টি হবো। আপনার মন পচা। আমার সরল কথার অন্য মানে বের করেন শুধু শুধু।”

মৌন হলো দিলশান। এই বাচাল, কূটবুদ্ধিতে ভরা মেয়ের সঙ্গে পারা তার কর্ম নয়। পাশ কাটিয়ে ভেতরে যেতে চাইলে শোভা আর্তনাদ করে উঠল। ছবি না তুললে যেন তার প্রাণটা এখনই পিঞ্জর ছাড়বে। দিলশান ঝুঁকে এসে ক্যামেরায় নিজের মুখ দেখাতেই শোভা মুহূর্তেই মিষ্টি হেসে ফটাফট বিভিন্ন এক্সপ্রেশন দিয়ে ছবি তুলে নিল। এরপর সফলতার হাসি দিয়ে বলল,
“ওকে ডান। ভবিষ্যতে অন্য মেয়ের দিকে নজর দিলে তাকে এই ছবি দেখিয়ে ভেস্তে দেব। বলব আমার সঙ্গে চিট করেছেন।”

দিলশানের মুখটা হা হয়ে গেল৷ এমন ধড়িবাজ মেয়ে সে জন্মে না দুটো দেখেছে আর না দেখার ইচ্ছে আছে। হাত তালি দিয়ে বলল, “তুমি প্লিজ গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড টিমকে ইনফর্ম করো। আই হোপ বিশ্বের ধড়িবাজ মেয়ে হিসেবে একটা স্বীকৃতি পেয়ে যাবে।”

দিলশান গাড়ি থেকে খাবারের প্যাকেট নামাতেই সুলেখা বাইরে বের হলেন। দিলশান খাবার নিয়ে উনার সামনে গিয়ে বলল,
“সারাদিন খাইনি। তোমার সঙ্গে খাব বলে পছন্দের খাবার কিনে আনলাম। এখন বলো, রাগ করে থাকবে?”

মমতার উত্তাপে সুলেখার মন মোমের ন্যায় গলে গেল। গলা উঁচিয়ে মতিন মিয়াঁকে ডেকে বললেন, “খাবারগুলো টেবিলে দাও।”

শোভা মা-ছেলের ব্যাপারটা ধরতে পারল চট করে। দিলশান ভেতরে চলে যেতেই সুলেখা ওর দিকে মনোযোগ দিলেন। শোভা দুঃখী মুখ করে বলল, “ইংলিশ আন্টি, জানো আমি দুপুরে খাইনি।”

“ওমা! কেন?”

“জানোই তো দাদি আর মা কত্ত বকে আমাকে। তাই না খেয়ে চলে এসেছি।”

সুলেখা আফসোস করে বললেন, “নাহ, চাচি এটা ঠিক করেননি। এত বড়ো মেয়েকে এভাবে শাসন করে কেউ! এসো আমাদের সঙ্গে খাবে। খালি পেটে পশুসেবা করতে পারবে না। আবার ইভেন্ট আছে না পরশু? এখন না খেয়ে দুর্বল হওয়া যাবে না।”
____________

ফ্রেস হয়ে এসে দিলশান ভিরমি খেল। শোভা টেবিলের একটি আসন গ্রহণ করে মনের আয়েশে সস মাখিয়ে ডাম্পলিং মুখে পুরছে। নিশ্চয়ই তার বোকা মায়ের সঙ্গে আবার কোনো কারসাজি করেছে। নাহ! নিজের ঘরেও আজকাল শান্তি নেই ওর। দিলশানের মুখের অবস্থা দেখে শোভা সরল কণ্ঠে বলে উঠল,
“আপনাদের খাবার খাচ্ছি বলে বোধহয় রাগ করলেন, দিলশান ভা-ই-য়া?”

ভাইয়া শব্দটা টেনে টেনে বলল সে। সুলেখা কপাল কুচকে বললেন, “ও রাগ করবে কেন?”

“ভা-ই-য়া আমার দিকে অসন্তোষ নিয়ে তাকাচ্ছে দেখুন। আমি কি চলে যাব?”

সুলেখা ওর হাত চেপে ধরলেন। ছেলেকে ইশারা করলেন বিরক্তি না দেখাতে। দিলশান পাশে বসে মেকি হেসে বলল,
“তোমার কারো রাগ গায়ে লাগে, শোভা? আমি তো জানতাম তোমার স্কিন ইনসাল্টপ্রুফ।”

শোভা মাথা দুলিয়ে বলল, “ছোট্ট একটা জীবন, এই জীবনে এত ইগো ধরে রেখে কী হবে? তাই কারো কথা গায়ে নেই না। আমি কি আর খাব না?”
বলে শোভা সুশিটা মুখে তুলল। দিলশান মাথা নত করে কপাল ঘষে। বলাবাহুল্য তার মুখ নত করার পেছনে আরেকটা কারণ শোভার এইসব আজগুবি কাজবাজ মাঝে মাঝে তাকে সত্যিই বিনোদিত করে। ঠোঁটের কোণে হাসিটা চেপে রাখতে হয় যেন আশকারা না পেয়ে বসে। সুলেখাই জবাব দিলেন,
“অবশ্যই খাবে। এখানে ঢের খাবার আছে। তিনজনের অনায়াসে হয়ে যাবে।”

দিলশান স্টেকের প্লেটটা টেনে নিয়ে মাকে বলল, “তোমার সকালের সেই এক্সপেরিমেন্টাল খাবারটা কই, আম্মু? নিয়ে এসো খেয়ে দেখি।”

চলবে…
বুঝতেই পারছেন নতুন বই, বইমেলা নিয়ে একটু এলোমেলো সময় যাচ্ছে। এই দেরিটুকু আন্তরিক দৃষ্টিতে দেখবেন। বইমেলার ৬১৩ নং স্টলে কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ‘নিশাবসান’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here