স্রোতস্বিনী #মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা পর্ব ২৭

0
259

#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ২৭

কেবিনে এখন দু’জন ডাক্তার,লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং একজন নার্স উপস্থিত।স্রোত ডাক্তারদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে শুনছে।মেহরাদের জ্ঞান ফিরতেই স্রোত ডাক্তারকে জানায়,সবাইকে জানায়।জেনারেল স্যার শুনতেই মেহরাদকে দেখতে চলে এসেছেন।মেহরাদ এখন ঘুমাচ্ছে।মেহরাদের জ্ঞান ফেরার পরে স্রোত তার সামনে যায় নি।বনলতা বেগমকে পাঠিয়েছিলো।সে তখন মেহরাদের ফ্ল্যাটে চলে যায় ফ্রেশ হতে।মেহরাদের সামনে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় যেতে চায় না সে।ছেলেকে দেখে আদর করতে ভুললেন না বনলতা বেগম।চোখ থেকে পানি পরছে তার।মেহরাদ আস্তে আস্তে বললো,
“মা,কান্না করো না।ঠিক আছি আমি।”
“দেখতেই পাচ্ছি কেমন ঠিক আছিস।”

মেহরাদ হালকা হাসলো।সে কেবিনের চারদিকে দেখলো,স্রোত নেই।স্রোতকে দেখতে না পেয়ে মেহরাদ বুঝে নিলো স্রোতের পরীক্ষা থাকায় হয়তো নেই,সে আসে নি।এটাই তো স্বাভাবিক।পরীক্ষা তো দিতেই হবে। মেহরাদের মস্তিষ্ক বুঝলেও মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো।চুপ করে রইলো।

বনলতা বেগম হয়তো বুঝলেন ছেলের মনের কথা।তিনি নিজ থেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“স্রোতকে খুঁজছিস? ”
“ওর তো পরীক্ষা।”

বনলতা বেগম হাসলেন। বললেন,
“এতোক্ষণ তোর পাশেই বসেছিলো।জ্ঞান ফিরতেই সবাইকে জানিয়ে বাসায় গিয়েছে।নিজের এই বিধ্বস্ত অবস্থা তোকে দেখাতে চায় না।”

মেহরাদ অবাক হলো।আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলো,
“ওর পরীক্ষা!আর বিধ্বস্ত অবস্থা মানে?”
“মেয়ের কি সে খেয়াল আছে?তোর কথা শুনার ওর থেকেই তো পাগ লামী শুরু করেছে।কান্নাকাটি করে কি নাজেহাল অবস্থা।এক ফোঁটা পানিও খাওয়াতে পারিনি।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিলো।সে খেয়াল নেই তার।ওর অবস্থা দেখে তো আমি ভেবেছিলাম আমি বুঝি আমার ছেলে-মেয়ে দু’টোকেই একসাথে হারিয়ে ফেলবো।”

মায়ের কথা চুপচাপ শুনলো মেহরাদ।কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।আর কিছু বললোও না।তবে তার শান্তি লাগছে।এতো অসুস্থতা সত্ত্বেও সে ভেতরে ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করছে।নিজের জন্য প্রেয়সীর পাগ লামী,দুঃখ,আকুলতা সবই যেনো তার ভালো লাগছে।
তখনই নার্স এসে জানায় এখন আর কেউ থাকতে পারবে না।মেহরাদের বিশ্রামের প্রয়োজন।বনলতা বেগম বাহিরে চলে যান।

সবাই চলে গেলে স্রোত একাই মেহরাদের পাশে বসে থাকে।স্রোত এসে বনলতা বেগমকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়।ডাক্তাররা জানিয়েছে আরো দুইদিন আইসিইউতে রাখা হবে অবজারভেশনের জন্য।তারপর কেবিনে শিফট করা হবে।জ্বর,নির্ঘুম রাত পার করা সব মিলিয়ে স্রোত ক্লান্তিতে মেহরাদের বেডে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে। কখন চোখ লেগে যায় বুঝতেই পারে নি সে।

অনেকটা সময় পরে মেহরাদের ঘুম ভাঙ্গে।নিজের পাশে স্রোতকে এভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আর ডাকেনি।চুপচাপ স্রোতকে দেখে যাচ্ছিলো।কত জনমের দেখার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।গু লি লাগার মুহূর্তে তো মনে হয়েছিলো আর কোনোদিন নিজ প্রেয়সীকে দেখতে পাবে না,মায়ের দেখা পাবে না আর।এখন মনে হচ্ছে নতুন জন্ম নিয়েছে।সৃষ্টিকর্তার কাছে সে কৃতজ্ঞ তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে।নাহয় প্রিয়জনের তার প্রতি এতো ব্যাকূলতা, ভালোবাসার গভীরতা সে জানতে পারতো না।
ভাবনার মধ্যেই ডাক্তার আর নার্স প্রবেশ করে।মেহরাদ ইশারায় না করে স্রোতকে ডাকতে।ডাক্তার মেহরাদের ভালোমন্দ খোঁজ নিয়ে চলে যায়।

নিজের মুখে কারো আঙ্গুলের আনাগোনা টের পেয়ে চমকে উঠে স্রোত।উঠে দেখলো মেহরাদ তার দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে।হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গায় নিজের অবস্থান বুঝতে একটু সময় লাগলো স্রোতের।নিজেকে ধাতস্থ করে মেহরাদকে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কখন উঠেছেন আপনি?”
“অনেক্ষণ।”
ধীর স্বরে বললো মেহরাদ।
“ডাকেন নি কেনো?”
“ঘুমোচ্ছিলে। তাই ইচ্ছে করে নি।”
“আপনি অসুস্থ। আমাকে ডাকা উচিত ছিলো।” কপট রাগ দেখিয়ে বললো স্রোত।
“তুমিও অসুস্থ। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।”
“আপনার সাথে আমি কখনোই কথায় পেরে উঠবো না।ডাক্তারকে ডাকছি আপনার চেক্ আপ করার জন্যে।”
“চেক্ আপ করে গিয়েছেন।”স্বাভাবিকভাবে বললো মেহরাদ।

স্রোত যেনো অবাক হতেও ভুলে গেলো।ডাক্তার এসে চেক্ আপ করে গিয়েছেন।আর সে ঘুমোচ্ছিলো।কি বিশ্রী লজ্জাজনক ব্যাপার।ডাক্তার জানি কি ভাবছে।সেটা পরে দেখা যাবে।এবার মেহরাদের দিকে পূর্ণ নজর দিলো স্রোত।
নরম সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন কেমন লাগছে?কোথাও অসুবিধা হচ্ছে?”
ছোট্ট করে “না” বললো মেহরাদ।
তখন স্রোত বললো,
“অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন।আর একটাও কথা বলবেন না।কথা বলা নিষেধ এখন।আপনি এখনো বিপদমুক্ত নন।আমি আছি এখানে।

মেহরাদও ভদ্র ছেলের মতো আর কথা বলে নি।সত্যি বলতে কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছিলো।বুকে ব্যাথা হচ্ছিলো।একটু সময় পর স্রোত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

সন্ধ্যার দিকে সবাই আসে মেহরাদের সাথে দেখা করতে।তাদের বিকেলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা যায় নি।মেহরাদের সাথে দেখা করে তারপর যাবে।কিন্ত ডাক্তার জানায় ভেতরে যাওয়া যাবে না।গেলেই রোগী কথা বলার চেষ্টা করবে,যা তার অবস্থা আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।দরজার বাহির থেকে দেখেই ওরা চলে যায় ঢাকায়।শুধু মাহিরা বনলতা বেগম আর স্রোত থেকে যায়।

দু’দিন পর মেহরাদকে কেবিনে শিফট করা হয়।এখন সে বিপদমুক্ত। এই দুই দিন একজন নার্স যা যা করে স্রোত সব করেছে।খাবার খাওয়ানো,ওষুধ খাওয়ানো,কাপড় পরিবর্তন করা আরো আনুষাঙ্গিক যা যা আছে সব।দু’দিন মেহরাদকে একটা কথাও বলতে দেয় নি সে। নিজে নিজেই কথা বলেছে মেহরাদের সাথে।মেহরাদ কথা বলতে চেয়েছিলো।স্রোত জানায়,
” আপনি যদি কথা বলেন তাহলে আপনি যতদিন বিপদমুক্ত না হচ্ছেন ততদিন আমি আপনার সামনে আসবো না।আপনার সাথে কথা বলার চেয়ে গোটা আপনিটাই আমার জন্য অনেক ইম্পোর্টেন্ট।”

বেচারা মেহরাদ এতোদিন বউকে না দেখে থাকতে পারবে না বলে বউয়ের হুকুম মেনে নেয়।একদম প্রয়োজন ছাড়া একটা টু শব্দও করে নি সে।

স্রোত সারাদিন রাত হাসপাতালে মেহরাদের সাথে থাকে,দেখাশোনা করে।শুধু বিকালের দিকে বনলতা বেগম বা মাহিরা কে দিয়ে সে বাসায় যায় গোসল করার জন্যে।

দিনগুলো যেনো আলোর বেগে ছুটছে।দশদিন হয়ে গেছে মেহরাদকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে।স্রোত মেহরাদের জন্য ফল কাটছিলো।মেহরাদ বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে।এই ভাঙ্গা হাত-পা, অচল জীবন এই কয়েকদিনে তার কাছে বিরক্তের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।প্রথম প্রথম তার প্রতি স্রোতের আকুলতা দেখতে ভালো লাগলেও এখন আর ভালো লাগছে না।বিরক্ত লাগছে নিজেকে।ওর জন্য স্রোতের একটা বছর নষ্ট হলো।স্রোতকে পরীক্ষার কথা সে বলেছিলো।কিন্তু স্রোত না করে দিয়েছে।সে এই ব্যাচে আর পরীক্ষা দিবে না।বাড়ির সবাই জোর করেছে তবুও শোনে নি।এই তো সেদিনের কথা।মেহরাদ স্রোতকে বললো,
“স্রোত তুমি ঢাকায় চলে যাও।পরীক্ষা শেষ করে আসবে আবার।”
“পরীক্ষা শেষ হতে আরো এক মাসের বেশি সময় লাগবে।”
ভণিতা ছাড়াই উত্তর স্রোতের।
“তো?আমি ঠিক আছি এখন।এক মাস দেখতে দেখতে চলে যাবে।”
স্রোত পূর্ণ নজর দেয় মেহরাদের দিকে। স্পষ্ট করে চোখে চোখ রেখে বলে,
“একটামাস আমার জন্য অনেকটা সময় মেহরাদ।আপনার মৃত্যুর ভুল খবর যখন শুনেছিলাম তখন আমার পৃথিবী উলট পালট হয়ে গিয়েছিলো।আপনাকে ছাড়া একটা মুহুর্ত আমার জন্য হাজার দিনের সমান।আমার ক্যারিয়ার দিয়ে কি হবে?যেখানে আপনি থাকবেন না?আমি আপনাতে মিশে গেছি মেহরাদ।”

স্রোতের ঐ কথার বিপরীতে সেদিন আর কিছু বলতে পারে নি মেহরাদ।

“কই হারিয়ে গেলেন?মেজর সাহেব?
স্রোতের ডাকে ভাবনা থেকে বের হয় মেহরাদ।

“কিছু না।” বিরক্তি নিয়ে বলে মেহরাদ।
“বিরক্ত হয়ে আছেন কেনো?কি হয়েছে?কোথায় অসুবিধে হচ্ছে? ”
“বললাম তো কিছু হয় নি।” রাগী স্বরে বলে মেহরাদ।
“রাগ করছেন কেনো?কিছু করেছি আমি?” করুণ স্বরে বলে স্রোত।
“তুমি কিছু করো নি।আমার নিজের উপর নিজের বিরক্ত লাগছে।হাত নাড়াতে পারছি না,পা নাড়াতে পারছি না।আমার জন্য তোমার ক্যারিয়ার শেষ।আমি তোমার উপর বোজা হয়ে আছি।” শান্তস্বরে এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো মেহরাদ।

স্রোত বুঝলো।সে আরেকটু এগিয়ে গেলো মেহরাদের দিকে।
মেহরাদের হাত ধরে বললো,
“চিন্তা করবেন না।দেড়-দুই মাসেই হাত পা ঠিক হয়ে যাবে।সাধারণ হাড় ভেঙ্গেছে গড়িয়ে পরার কারণে একটু ড্যামেজ যাকে বলে।জটিল কিছু হয় নি।দুই মাস কষ্ট করুন।দেখতে দেখতে চলে যাবে।”
আবার বললো,
“আমার এই অবস্থা হলে আপনি আমাকে ছেড়ে যেতে পারতেন?”

এই প্রশ্ন শুনে মেহরাদ তাকায় স্রোতের দিকে।স্রোত বললো,
“কি হলো বলুন?পারতেন?”
মেহরাদ চোখ ফিরিয়ে নেয়। স্রোত স্মিত হেঁসে বললো,
“পারতেন না।তাহলে আমি কিভাবে যাই আপনাকে ছেড়ে?”

মেহরাদ চুপ করে আছে।স্রোত মেহরাদের হাত ছেড়ে দেয়।দু’হাতের আজলে মেহরাদের মুখটা নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,

“ভালোবাসি মুখে বললেই হয় না,মেজর সাহেব।কাজে কর্মে বুঝাতে হয়।ভালোবাসা শব্দটা অনেক গভীর।সেখানে যদি আত্মত্যাগ না থাকে,স্যাক্রিফাইজ না থাকে তাহলে তাকে ভালোবাসা বলে না।এক ফোঁটা আত্মত্যাগ,একটু বিশ্বাস,এক টুকরো ভরসা মিলিয়েই তো ভালোবাসা।প্রিয়জনের জন্য সব ছেড়ে দেওয়ার নামই ভালোবাসা।সেখানে আমি তো মাত্র ছয় মাস গ্যাপ দিলাম।”

এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো মেহরাদের মুখে।মেহরাদের সব রাগ,বিরক্তি নিমিষেই উবে গেলো।তার স্রোতস্বিনী তাকে ভালোবাসে।স্রোত ছেড়ে দিলো মেহরাদকে।চোখের জল মুছে টেবিলের উপর থেকে ফলের প্লেটটা নিয়ে একটা টুকরো আপেল এগিয়ে দিলো।মেহরাদ তাকিয়ে আছে স্রোতের দিকে।
সে ঐভাবেই বললো,
“ভালোবাসি স্রোত।”
স্রোত হেঁসে ফেললো।টলমলে চোখে হেঁসেই বললো,
“স্রোতও ভালোবাসে তার মেজর সাহেবকে।খেয়ে নিন এবার।”

#চলবে…

[খুশি????]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here