প্রেমের প্রদীপ জ্বলে [১৭]
প্রভা আফরিন
হোয়াইট হাউজের পরিবেশ গতরাত থেকেই ভীষণ থমথমে। দস্তগীর সাহেব অতিশয় গম্ভীর। উনার বাড়িতে কে বেনামে চিরকুট পাঠাচ্ছে তাই এখন সকল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি রাশভারী চলনে দোতলা থেকে নেমে পত্রিকাটি তুলে নিয়ে বসলেন সোফায়। মতিন মিয়াকে চা দিতে হুকুম দিয়ে, পুরু কপালে ভাজ ফেলে পত্রিকাটিতে নজর বুলাতে গিয়েই আকস্মিক চোখ আটকে গেল একটি হেডলাইনে।
“পরকীয়া সন্দেহে বিশ বছরের সংসারে ভাঙন…”
পত্রিকা থেকে চোখ তুলে দেখলেন সুলেখা সেজেগুজে ঘরময় হাঁটাহাঁটি করছেন। বুকের ভেতরটা আবারো কুটকুট করে ওঠে উনার। মধ্য বয়সে এসে কিনা স্ত্রীকে নিয়ে অনিরাপত্তায় ভুগতে হচ্ছে! তিনি জোরে জোরে পত্রিকা পড়েন,
“পরকীয়া সন্দেহে বিশ বছরের সংসারে ভাঙন। স্বামীর হাতে স্ত্রী ও তার প্রেমিক খু’ন!”
সুলেখার পায়ের গতি রোধ হয়। সংবাদের বিষয়বস্তু কানে যাওয়ার বদলে উনার কানকে উত্যাক্ত করে উচ্চ স্বর। বিরক্ত গলায় বলেন,
“বাচ্চাদের মতো এত জোরে পড়ছো কেন? মনে মনে পড়া যায় না?”
“কী পড়ছি সেটা শুনতে পাচ্ছো না?”
জগতে কিছু মানুষ আছে যারা নিজে যতটুকু দেখে ও জানে ততটুকুকেই পৃথিবী মনে করে। সুলেখা তেমনই একজন মানুষ। নির্ঝঞ্ঝাট, সুখী জীবন উনার। সংবাদপত্রে চোখ বুলিয়ে কার জীবনে কী ঘটছে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না। কাজেই স্বামীর প্রশ্নকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“তা শুনে আমার কী কাজ?”
দস্তগীর সাহেব বিড়বিড় করেন, “ব্রেইনলেস উইমেন!”
“কী বললে তুমি?” সুলেখা ঠিক শুনতে পেলেন না।
দস্তগীর সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্ত্রীর মাথা থেকে পা অবধি স্ক্যান করে বলেন,
“বলছিলাম এত সকালে সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছো?”
“কোথায় আবার! রান্নাঘরে। তোমাদের নাশতা তৈরি করতে হবে না? দিলশান সারাদিন ফিরবে না, ওর জন্য ভারী খাবার তৈরি করতে হবে।”
দস্তগীর সাহেব চোখের চারপাশ কুঞ্চিত করে বলেন,
“রান্না করবে মতিন বাবুর্চি। তোমার সেখানে বিশাল কোনো দায়িত্ব তো দেখি না। তুমি কী আজকাল হিন্দি সিরিয়ালের বউদের ফলো করছো? নাকি জানালা দিয়ে অন্য কিছু দেখা যায়?”
সুলেখা অবাক ও একইসাথে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “তুমি আবারো সন্দেহ শুরু করেছো?”
“স্বাভাবিক মানুষের মতো কাজবাজ না করলে সন্দেহ তো হবেই। এই মতিন? শুনে যা তো।”
মতিন মিয়া রান্না করছিল। তরকারি নাড়ার খুন্তি হাতে নিয়েই উপস্থিত হলো বসার ঘরে৷ কপালের ঘাম মুছে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল মনিবের পানে। দস্তগীর সাহেব তাকে জেরা করেন,
“রান্নাঘরের জানালা দিয়ে কাউকে দেখিস? ঘন ঘন আসে বা দিলশানের মায়ের সঙ্গে কথা বলে?”
মতিন তার চিন্তাশীল মস্তিষ্কে বল প্রয়োগ করে তেল-মশলা, রন্ধনশালার বাইরে গিয়ে একটা উত্তর বের করল। কড়াইতে খুন্তি নাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বলল,
“ওই যে সামনের বাড়ির তাসনীম আপা, তার লগে ভাবিসাবের কথা হয় জানালা দিয়া। ওগো রান্ধাঘর আর এই রান্ধাঘর তো সামনাসামনি।”
দস্তগীর সাহেব চোখ ছোটো ছোটো করেন। সুলেখার মাঝে শো-অফ করার একটা প্রবণতা আছে। প্রতিবেশী ভাবির সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও যে সে সুযোগ হাতছাড়া করেন না বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। সুতরাং সন্দেহ অমূলক বুঝতে পেরে তিনি দমে গেলেন।
তবে সুলেখা দমলেন না। মতিন মিয়ার সামনে এহেন সন্দেহ প্রকাশ করাটায় গায়ে লেগে গেল। তিনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
“মিষ্টির দোকানি! আমাকে যে সন্দেহ করছো, কাগজে তো কারো নাম লেখা ছিল না। চিরকুটটা কেউ তোমাকে দিয়েছে কিনা সেটা কী আমি একবারও বলেছি? এমনও হতে পারে তুমিই এসব পকেটে নিয়ে ঘোরো। অন্য কাউকে পটাতে। আমার হাতে পড়ে যাওয়ায় পল্টি নিচ্ছো!”
দিলশান ওপর থেকে নামতে নামতে বাবা-মায়ের ঝগড়ার একাংশ শুনতে পেয়ে হতাশ হলো। দুজনের মাঝখানে গিয়ে উপস্থিত হলো সে। বলল,
“প্লিজ একটু থামবে? তোমরা চিরকুটের বিষয়বস্তু নিজেদেরই কেন ভাবছো? এটা যে আমাকে উদ্দেশ্য করে পাঠানো হয়নি তার কী নিশ্চয়তা?”
দস্তগীর সাহেব ও সুলেখা থমকে গেলেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন একমাত্র পুত্রের দিকে। দিলশান নিরবে উনাদের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
____________
সকালের সূর্যটি সুউচ্চ দালানকোঠার ফাঁক গলে পিচঢালা পথে মিঠে আলো দিচ্ছে। সেই আলোতে একটি হুডি পরা টমবয়কে একটি বিড়ালের সঙ্গে খুঁনসুটি করতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল দিলশান। শোভা পরম যত্নে বিড়ালের গা চুলকে দিচ্ছে। কে বলবে এই মেয়ে দুদিন আগেই পায়ে চোট পেয়েছে! দিলশান লম্বা লম্বা কদমে দূরত্ব মেটায়। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে শোভা তড়িৎ ফিরে তাকায়। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দর্শন পেয়ে বিস্তর হেসে বলল,
“হাই শান! গুড মর্নিং।”
“তুমি কী আদৌ আমার গুড ডে চাও?” দিলশান বুকে হাত গুজে রুষ্ট স্বরে জবাব দেয়।
শোভা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কেন নয়! শোভা পৃথিবীর কারো খারাপ চায় না।”
দিলশান ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
“কিন্তু নিজকর্মে অন্যের শান্তি নষ্ট করে দেয়।”
এরপর চিরকুটটা বের করে তর্জনী ও মধ্যমার মাঝে চেপে ধরে দেখাল,
“এটা তো তোমারই লেখা।”
শোভা ভড়কালো না। বরং লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে বলল, “কী করে বুঝলেন?”
“কারণ এ ধরনের মশকরা করার দুঃসাহস অন্য কারো দেখি না।”
“মশকরা!” শোভা আর্তনাদ করে ওঠ। অভিমানী সুরে বলে, “আমার আবেগকে আপনি মশকরা বলছেন?”
মেয়েটির অঙ্গভঙ্গির হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তন দেখে দিলশান বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এমন নিখুঁত অভিনয় তো টিভি এক্ট্রেসরাও পারে না। শক্ত গলায় বলে,
“তাহলে স্বীকার করলে এ তোমারই কাণ্ড।”
শোভা সরল ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে, “আপনি তো অসুস্থ আমিটার খবরও নিলেন না। আর আমাকেই দেখুন, কতটা রিস্ক নিয়ে রাতের বেলা আপনার কাছে মনের খবর পৌঁছে দিয়েছি।”
দিলশান ওর নির্লজ্জতায় আরেকদফা বিভ্রান্ত হয়ে বলে,
“আমি যদি এখন এটা নিয়ে তোমার বাড়িতে নালিশ জানাই?”
“আচ্ছা। চেষ্টা করে দেখুন।”
শোভার নির্বিকার জবাবে দিলশান আরো অবাক হলো, “তোমার কী ভয়-ডর নেই? নাকি শাসন করার কেউ নেই?”
শোভা মিচকে হেসে কলার ঝাঁকিয়ে বলল, “আপনার কী মনে হয় শোভা এত কাঁচা কাজ করে! তিন রকমের হ্যান্ড রাইটিং জানি আমি। এইসব চিরকুটে কিচ্ছু প্রমাণ করতে পারবেন না।”
দিলশান রাগী চোখে চায়। অসহ্য স্বরে বলে,
“ক্লেভার মনস্টার! সময় থাকতে শুধরে যাও। নয়তো ভালো হবে না।”
শোভা মিষ্টি হেসে বলল, “কবী বলেছেন, যাকে তুমি চাও তার মাঝে এতটাই মিশে যাও, যেন সে রেগে গিয়ে হলেও শুধু তোমাকেই ভাবে। মিষ্টত্বে না হোক, তিক্ততায় তুমি তার ধ্যানজ্ঞান দখল করে নাও। এরপর দখলকৃত জমিতে শুধুই তোমার বিচরণ।”
“এইসব স্টুপিড কথা কোন কবি বলেছে?”
শোভা আত্মদম্ভের সঙ্গে জবাব দিল,
“কবী শোভানন্দ আজাদ। খুব শীঘ্রই সে দেশ বিখ্যাত কবি হয়ে উঠবে। আর সে শুধু আপনার হৃদয়েই অটোগ্রাফ দেবে।”
চলবে…
শেষ করতে পারলাম না। বর্ধিত অংশ কাল-পরশু দেব।