প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [১১] প্রভা আফরিন

0
536

প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [১১]
প্রভা আফরিন

“তেরে সামনে আজা নেসে ইয়ে দিল মেরা ধারকা হ্যায়
ইয়ে গালতি নেহি হে তেরি, কছুর নজরকা হ্যায়
জিস বাত কা তুঝকো ডার হ্যায়
ও কারকে দিখা দুঙ্গাআআ…”

সিটে হেলান দিয়ে গান গাইছে শোভা। যেন হাসপাতালে নয়, পিকনিকে যাচ্ছে। এদিকে ওর গান শুনে পাশে বসে থাকা দিলশানের কান গরম হয়ে উঠেছে। চোখ শক্ত করে পথে নিবদ্ধ রেখে নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করছে। তবুও ভারিক্কি মুখশ্রীর বিব্রতভাব লুকানো যাচ্ছে না মোটেও। দৃষ্টির শেষাংশ, যেখানে স্পষ্টতা লোপ পায়, সেই চোরা কোণ দিয়ে শোভা উপভোগ করছে লোকটির অস্বস্তি। ঠোঁটের মিটিমিটি হাসি জোড়ালোভাবে প্রকাশ পেতে উসখুস করছে।

দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাঝে নির্জনে, একাকী এরূপ লিরিক অস্বস্তিরই বটে। তারওপর গানটা কোনো বন্ধু বা প্রেমিকযুগল নয়, একজন সিনিয়রের সামনে জুনিয়র গাইছে। দিলশান সহ্য করতে না পেরে বলেই বসল,
“স্টপ ইট, প্লিজ! দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছো। আমি তোমার বাড়িতে বিচার দেব।”

শোভা প্রবল ঝড়ে আসমান হতে ধরনীতে পদার্পণ করল যেন৷ দেহটিকে ষাট ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিলশানের মুখের দিকে চেয়ে বলল,
“আই হেইট ইয়োর মাইন্ড। ইটস জাস্ট আ লিরিক, ম্যান।”

“এন্ড ইউ উইমেন, তোমার মাইন্ড খুবই পবিত্র? নিজেকে চালাক ভাবা হচ্ছে!”

“চালাক তো আমি এমনিতেই। নতুন করে আর কী ভাবব? যারা হুট করে বোকা থেকে চালাক হয় তারা ভাবতে পারে।”

“মিনি মনস্টার!” বিরক্তিভরে বিড়বিড় করে দিলশান। সন্ধ্যার একটু আগে চেম্বার ত্যাগ করে বাড়িতে ফিরছিল সে। ছুটির দিনে আধবেলা চেম্বার খোলা রাখে৷ শোভা ও তার বাড়ি ফেরার রোড একটাই ছিল বলে দুর্ভাগ্যবশত মেয়েটির এক্সিডেন্ট দিলশান নিজের চোখেই দেখেছে। ঠিক এক্সিডেন্ট বলা যায় না। ইচ্ছাকৃত অপর বাইক থেকে অ্যাটাক করা হয়েছে। বেপরোয়া গতি থাকায় বাইক ও স্কুটিটা পলক সমান ক্ষণের মতোই নিকটে এসেছিল৷ আর পলক ফেলতেই শোভা ছিঁটকে পড়েছে রাস্তায়। সঙ্গে সঙ্গে দিলশান গাড়িতে ব্রেক কষে ওকে গিয়ে ধরে। সেন্সলেস হয়েছে বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে পানির বোতল এনে ঝুপ করে পুরোটাই মুখের ওপর ঢেলে দিয়েছে। আচমকা পানির ধাক্কায় শোভা চৈতন্য লাভ করে। গায়ের জামা ভিজে গেছে ওর। ভিজেছে দিলশানের প্যান্টও। গায়েই আধশুকনো হয়ে গেছে। কপালে, হাতে, পায়ে চোট পেয়েও দিব্যি ফাজলামো করে চলেছে মেয়েটি। হাসপাতালের সামনে নেমেও তার আরেক বাহানা। পায়ে ব্যথা তাই কোলে করে নিতে হবে। দিলশানের তখন মনে হলো অন্যের বিপদে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের ঘাড়ে বিপদ এনে ফেলেছে। গম্ভীর মুখ করে বলল,
“পাবলিক প্লেসে তুমি এমন করতে পারো না, শোভা।”

“আড়ালে করতে পারি তবে?” শোভা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসে।

দিলশান থতমত খেয়ে এদিক ওদিক চায়। হসপিটালে রোগীর ভিড়। সে একজন সম্মানিত ডাক্তার। কেউ এসব শুনে বা দেখে ফেললে ইমেজ ডাউন হবে। এইটুকু মেয়ের জন্য তা সে করতে পারে না। দিলশান এবার রেগেই বলল,
“তুমি বাড়াবাড়ি করছ।”

শোভা সরল চোখে চেয়ে বলল, “আমি তো করছি না। একজন অসুস্থ রোগী করছে। আপনি ডাক্তার হয়ে রোগীর সুবিধাটাই তো আগে দেখবেন নাকি! আমি সত্যিই হাঁটুর ব্যথায় নড়তে পারছি না। আমার ওজন বেশি না বিশ্বাস করুন। আপনার বহন করতে একটুও কষ্ট হবে না।”

দিলশান কিছুক্ষণ নিরবে চেয়ে থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে একটা হুইলচেয়ার সমেত হাজির হলো। ইশারায় বলল,
“আই থিংক এটাতে তুমি বেটার ফিল করবে। হাঁটতে হবে না।”

শোভা ক্রুদ্ধ চোখে চায়। উপায়ান্তর না পেয়ে কোল ছেড়ে হুইল চেয়ারেই গা এলিয়ে দেয় ও। চেকআপ, টেস্ট করিয়ে, মেডিসিন নিয়ে ফিরতি পথ ধরতে ওদের রাত আটটা বেজে গেল। শোভার ফোন ভেঙেছে। বাড়িতে কিছু জানানো হয়নি। তবে দিলশানই একফাঁকে মাকে কল করে জানিয়েছে দ্বীপশিখায় খবরটা দিয়ে আসতে। মেয়ে নিরুদ্দেশ ভেবে তারা চিন্তিত হতে পারে। বাড়ির গলিতে গাড়ি ঢুকতেই শোভা লাজুক স্বরে বলল,
“মাঝরাতে যদি ক্ষতগুলোয় খুব বেশি পেইন করে আমি কি আপনাকে কল করতে পারি, দিলশান?”

“ওষুধে সিডেটিভ আছে। খেলে এক ঘুমেই রাত পেরিয়ে যাবে। সকালে টেস্টের রিপোর্ট এনে আবার ডাক্তারের কাছে যাবে।”

“ধরুন সিডেটিভ কাজ করল না, তখন?”

“আমি চোখের ডাক্তার, শোভা। তারচেয়ে তোমাকে আমার বন্ধুর নম্বর দিচ্ছি। কোনোরকম প্রবলেম হলে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবে।”

শোভা ক্রুদ্ধ মেজাজে বলল,
“তো আমি কোথায় শরীরের হাড়গোড় জোড়া লাগাতে আপনাকে কল করতে চাইছি বললাম? অসুস্থতার সময় ডাক্তারদের কণ্ঠ শুনলে আরাম লাগে, বুঝলেন?”

রাত্রির ব্যস্ত নগরীর পথের ধারে হরেক রঙের আলোর মেলা বসেছে। সেইসব রঙিন আলো ছিঁটকে পড়ছে দিলশানের চলন্ত গাড়ির উইন্ড শিল্ডে। যা কাচ ভেদ করে ওদের অবয়বে আলেয়া তৈরি করছে। দিলশান ঠোঁটের ভাজে হাসি লুকায়। মেয়েটির কাণ্ডে ওর মাঝে মাঝে যেমন ভীষণ রাগ হয়, আবার কিছু অহেতুক কথায় হাসিও পায়। দিলশান ওর আশাভঙ্গ করে বলে,
“বুঝলাম না। এমন কোনো সাইন্স আমি শুনিনি।”

“আপনি কীসের চোখের ডাক্তার যে আমার চোখের ভাষাই বোঝেন না? আপনি আসলে একটা সানগ্লাস ডাক্তার। আমাকে দেখার বেলায় আপনার চোখে রঙিন সানগ্লাসের পর্দা থাকে।” শোভার কণ্ঠে তীব্র অভিমানের উত্তাপ। পাশে বসে দিলশান কী তার আঁচ পাচ্ছে না!

দিলশান জবাব দিল, “আমি রোগী দেখি, গুণ্ডা-বদমাশ দেখি না। হেয়ালি রেখে এবার সিরিয়াস কথা শোনো। এটা মোটেও এক্সিডেন্ট ছিল না। তোমার ওপর ইচ্ছাকৃত অ্যাটাক করা হয়েছে। কোথায় কোথায় দাদাগিরি করে বেড়াও যে শত্রু বানিয়ে ফেলেছো?”

শোভা ভাবুক হলো ক্ষণিকের জন্য। বলল,
“আপনারও এক্সিডেন্ট মনে হচ্ছে না তাই না? আমারও হচ্ছে না।”

“মনে না হওয়ার কারণ আমি নিজের চোখেই ঘটনাটা দেখেছি।”

“সেকি! আপনি মুখ দেখেছেন কারো?”

“উহুম, হেলমেটে ঢাকা ছিল। সম্ভব হয়নি।”

“গাড়ির নেমপ্লেট?”

“গাড়ি পার্ক করার আগেই তারা অদৃশ্য হয়ে যায়।”

শোভার আপাতত একজনের নামই মনে এলো। তবে মুখে বলল না। বাড়িতে জানলে ঝামেলা বাড়বে ভেবে ও দিলশানকে বলল,
“আরে এসব উগ্র বাইকারদের কাজ। দেখেছে একটা মেয়ে স্কুটি দিয়ে রাজপথ কাঁপাচ্ছে তাই সহ্য হয়নি। শোভা শত্রু বানায় না।”

দিলশান তেরছা স্বরে বলল,
“ও আচ্ছা! তুমি যদি আমার সঙ্গে এমন বেপরোয়া, অসভ্য আচরণ অব্যাহত রাখো, তবে আমার শত্রু হয়ে যাবে নিশ্চিত থাকো।”

শোভা ব্যান্ডেজ করা হাতটা বুকের বা পাশের পাজরে স্থাপন করে জবাব দিল,
“হায়! শত্রু এত কিউট হলেতো শত্রুতাটাও আদরের সাথে করতে হবে। শত্রুর কী তা সহ্য হবে?”
____________

শান্ত, শীতল, নিরবে প্রবাহিত জলধারার ওপর নির্মিত লৌহ ব্রিজের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নবদম্পতি। শাওন রেলিংয়ে কনুই ঠেকিয়ে দেহের অর্ধভাগের ভারটুকু স্থাপন করেছে। দৃষ্টি আঁধারী কালচে জলের বুকে। মৃদু প্রবাহিত স্রোতের ওপর টলটল করছে ভরা জোছনায় উদ্ভাসিত চন্দ্র। তার ক্ষীণ রুপালি দ্যুতি শাওনের মুখশ্রীতেও পড়েছে। মিষ্টি মুখখানিতে মৃদু হাসি লেপ্টে আছে। লেপ্টে আছে স্বামীর মুগ্ধ দৃষ্টি। জাওয়াদের একটি হাত শাওনের চুল নিয়ে খুঁনসুটিতে মত্ত। মৌন বাতাসের সঙ্গে উড়ছে শাওনের চুলের গন্ধ। সেই ঘ্রাণ জাওয়াদের সম্পূর্ণ মনোযোগ ধরে রেখেছে। বুকের ভেতর বুদবুদ করে বাষ্প উঠছে। নিরিবিলি স্থানে, চাঁদোয়া মায়াবী ক্ষণে ব্রিজের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ওদের মনে উষ্ণতা জেগেছে। কেউ কোনো কথা বলছে না, বলতে ইচ্ছেও করছে না। নিভৃতে নিমজ্জিত মন সঙ্গতেই তৃপ্ত। জাওয়াদ আজ লং ড্রাইভে বেরিয়েছিল। শাওনকে নিয়ে হাইওয়ে ধরে ছুটেছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। হেসেছে, গল্প করেছে, একে অপরের আরো কিছু আচরণ আবিষ্কার করেছে। রাত নামার পর নেমে এসেছে মৌনতা। কথা ফুরিয়েছে। জেগেছে হৃদয়াবেগ। মনে হচ্ছে এভাবেই অনন্তকাল বয়ে যাক। এভাবেই তারাভরা আকাশের আলোছড়ানো চাঁদটি ওদের জড়িয়ে রাখুক। ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনিয়ে যাক না বলা অনুভূতিগুলো। বাতাসে মেখে থাকুক প্রিয় মানুষের সুবাস। ওদের মাঝে এখনো গভীর কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। জাওয়াদ সময় দিচ্ছে শাওনকে। প্রস্তুত করছে অদূর ভবিষ্যতের প্রণয়ের অনন্তযাত্রায় পাড়ি দিতে। ছোটো ছোটো যত্ন, আহ্লাদ, আদরে দখল করছে স্ত্রীর অনুভূতিক্ষম মনোভূমি। শাওনও নির্লিপ্ত নেই৷ সমানভাবে চেষ্টা করছে মন-প্রাণ দিয়ে স্বামীকে নিজের মাঝে ধারণ করতে। দুজন দুজনকে খুব ভালো বুঝতে পারছে বলেই ওদের মাঝে একে অপরকে বুঝতে জটিল লাগছে না।

কিন্তু এই মায়াবী ক্ষণে হুট করেই যেন এক বেসামাল হাওয়া বয়ে গেল দুজনের মাঝে। জাওয়াদের সান্নিধ্য ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছিল। নিশ্বাসের উত্তাপ বাড়ছিল। হৃৎপিণ্ডের লাগামহীনতা টের পাচ্ছিল শাওন। অচেনা, অস্পর্শী এক উন্মাদনা জেগে উঠছিল মনে। রেলিংয়ের সঙ্গে লেপ্টে দাড়িয়েছে সে। আটকা পড়েছে জাওয়াদের বাহুতে। মুখ আনত, চোখে একরাশ লজ্জার আবির। দুটি নিশ্বাসের দূরত্ব যখন প্রায় মিলিয়ে আসে শাওন চোখ বুজে মিনমিন করে বলল,
“এবার ফেরা উচিত। সবাই অপেক্ষা করছে।”

জাওয়াদ একটুও সরল না। গাঢ়তর স্বরে বলল,
“আর আমার অপেক্ষা? সেই অপেক্ষা কখন ফুরাবে?”

শাওন দাঁতে ঠোঁটের কোণা চেপে ধরে। মুখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে জবাব দেয়,
“তুমি চাইলেই।”

“উহু, তোমাকেও চাইতে হবে। আমাকে নিশ্চয়তা দিতে হবে তুমিও একই রোগে আক্রান্ত হয়েছ। তোমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসে, দুই চোখে আমার জন্য ব্যাকুলতা দেখার অসীম অপেক্ষায় আছি আমি। অনুরোধ, অপেক্ষাটা খুব বেশি দীর্ঘ কোরো না।”

জাওয়াদ হৃদয়ে উথলে ওঠা প্রণয়ের ঢেউয়ে বাধ টেনে সরে গেল। পুনরায় হেসে চনমনে সুরে বলল,
“চলো ফিরে যাই। নতুন জামাইয়ের আপ্যায়ন মিস করা যাবে না।”

শাওনের মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবল হুট করে বাধা পড়ায় জাওয়াদ মনঃক্ষুণ্ন হলো কিনা! বাহু আঁকড়ে ধরে আটকাল ওকে। জাওয়াদ ফিরে চাইল। এক পলক ওর চোখে চেয়েই মনের কথা অনুধাবন করে ফেলল। এগিয়ে এসে আলতো হাতে ওর মুখখানি ধরে একটি আবেগঘন, নির্মলতম, পবিত্রতম চুম্বন করল কপালে। কানের কাছে মুখ নামিয়ে দুষ্টু স্বরে বলল,
“ভেবো না, আমি সাধু-সন্ন্যাসী নই। তোমাকে আমার চাই। একটু একটু করে নয়, শরীর ও মনে পূর্ণাঙ্গরূপে চাই।”

শাওন ফুঁপিয়ে উঠল হঠাৎ। জড়িয়ে ধরল জাওয়াদের পিঠ। আকস্মিক আক্রমণে জাওয়াদ টলে গেলেও সামলে নিল। নিজেও আঁকড়ে ধরল শাওনকে। শাওন কাঁপা কান্নাসুরে বলল,
“তুমি এত ভালোবাসো কেন? আমার যে ভয় করে। যদি তোমার মতো করে ভালোবাসতে না পারি!”

জাওয়াদ হেসে বলল,
“তুমি ভালোবাসায় গা ডোবাও, সাঁতার শেখানোর দায়িত্ব আমার, মাই ডিয়ার।”
__________

দিন দুই পরের কথা। হাসি মজায় দ্বীপশিখায় বেশ আমোদেই সময় অতিবাহিত হয়েছে মেহযাবীনের। শাওন, অনন্তের সঙ্গে ভার্সিটি গেছে। ফিরে সকলের সঙ্গে আড্ডাবাজি, মুভি দেখায় ওদের সময়টা হৈ হৈ করেই কেটেছে একপ্রকার। অসুস্থ শোভার হাত-পায়ের চঞ্চলতা কমায় মুখের বাচালতা বেড়েছে। তার সঙ্গেও ভালো সময় কাটছিল। এমনই সুখময় মুহূর্তে আচমকা একটি বিব্রতকর ঘটনা ঘটে গেল। পড়ন্ত বিকেলে একটা লম্বা, বাঁধাই করা ছবি নিয়ে বাড়ি ফিরল নিশান্ত। তার বেশভূষা আজ ভীষণরকমের আকর্ষণীয়। কালো ফর্মাল প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট, হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রাখা। হাতে রোলেক্সের নতুন মডেলের ঘড়িটা চকচক করছে। গা হতে ভুরভুর করে পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে। দৃষ্টির প্রজ্জ্বলতা, ক্ষুরধার ব্যক্তিত্বের ঝলক যেন রমনীদের দৃষ্টিকে ফালা ফালা করে দেয়।
যাবীন দেখে হুট করেই চোখ ফেরাতে পারল না। উলটে ভ্রুকুটি করে ভাবল, এমন মাঞ্জা মারার কারণ কী? একই প্রশ্ন দাদিরও ছিল। নিশান্ত অত্যন্ত ফুরফুরে মেজাজে আছে আজ। যাবীনের দিকে একপলক চেয়ে কেমন যেন একটা ব্যাঙ্গের হাসি দিয়ে দাদিকে বলল,
“শিলা প্রপোজড মি, দাদি।”

চাঁদনি বেগমের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশান্তের বাবার সঙ্গে এক সামরিক বাহিনীর প্রোগ্রামে গিয়ে পারিবারিক সূত্রে শিলার সঙ্গে পরিচয়। মেয়েটি এখন সামরিক নারী বৈমানিক হিসেবে নিযুক্ত। অসম্ভব পরিশ্রমী ও মেধাবী এই মেয়েটির চাঁদনি বেগমের বড়ো নাতির প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। তিনি খুশিই হলেন। বললেন,
“অবশেষে মনের কথা বলেছে মেয়েটা! আমি তো আগেই জানতাম। তুই কী বললি?”

“কিছু বলা হয়নি এখনো।”

“বলা হয়নি মানে! তুই মেয়েদের মতো ঝুলিয়ে রেখেছিস কেন? শিলাকে তোর পছন্দ নয়?”

নিশান্ত দাদির কাছে বসে বলল,
“পছন্দ অবশ্যই। তবে আমি এখনো মনের দিক থেকে নিশ্চিত নই স্বাভাবিক পছন্দটাকে হৃদয়গতভাবে আশকারা দেওয়া উচিত কিনা। মিথ্যা বলিনি ওকে। শিলা বুঝদার। বুঝেছে আমায়। আমরা সমঝোতা করে নেব।”

চাঁদনি বেগম নাখোশ হলেন। আজকালকার ছেলে-মেয়েদের কত যে মনের সমস্যা! উনার দৃষ্টি গেল নিশান্তের হাতের মোড়ানো ছবিটার দিকে। তিনি বললেন,
“এটা কী?”

নিশান্ত কোনো জবাব না দিয়ে খুলে দেখাল সেটা। যাবীনের আত্মা কেঁপে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। এ যে তারই করা পেইন্টিং! তবে কী ওর ক্লায়েন্টই সেই শিলা! সেদিনের মিথ্যাটা ধরে ফেলার জন্যই কি নিশান্ত এমন ব্যাঙ্গের হাসি হাসছে ওকে দেখে! হায় আল্লাহ! ধরণী দ্বিধা হচ্ছে না কেন? যাবীন মুখ লুকাবে কই?

‘প্রেমনগরের প্রণয়কুমার’ লেখাটা দেখে চাঁদনি বেগম বললেন, “এটা নিশ্চয়ই শিলা দিয়েছে! একদম তোরই মতো দেহাবয়ব। নামটাও কি মিষ্টি! মেয়েটা তো ভারী রোমান্টিক! আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে।”

নিশান্ত তেরছা স্বরে বলল, “এতটা বিগলিতভাব শিলার মাঝে নেই, দাদি। ও খুবই সিরিয়াস ও বাস্তববাদী মেয়ে তুমি জানো। এইসব টিপিক্যাল প্রেমিকার মতো কথা ওর মাথা থেকে বের হয় না।”

দাদি দ্বিধান্বিত হন। তবে কী এটা শিলার দেওয়া নয়! অন্যদিকে লজ্জিত, বিব্রত যাবীন এবার অপমানিত বোধ করল। তাকে ইঙ্গিতে টিপিক্যাল বলা হচ্ছে! মানুষটা এই লোক জানলে ও নিশ্চয়ই এমন কিছু লিখত না। জঘন্য কিছু লিখে দিতো।

এমন সময় শোভা উপস্থিত হলো সেখানে। ছবিটায় চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠে বলল,
“আরে এটা তো যাবীন আপুর করা। ভাইয়াকে দিল নাকি!”

মেহযাবীন হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে ঠাহর করতে পারার আগেই জাওয়াদও এসে হাজির সভায়। শিলার কথা সে শোনেনি। তবে বোনের আঁকা বিশেষ ছবিটা নিশান্তের দখলে দেখে ও গম্ভীর হয়ে দুজনকে পরখ করতে লাগল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here