প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [১২]
প্রভা আফরিন
এক্সিডেন্টের পর শোভাকে ঘরবন্দি রাখা হয়েছে এই দুটো দিন। বনের সুখী পাখিটাকে হঠাৎ বন্দি করে খাঁচায় ভরলে যেমন ছটফট করে, ডানা ঝাপটে উড়ে যেতে চায় তেমনই অসহিষ্ণু হয়ে আছে সে। বেডরেস্ট বলে কোনো শব্দ শোভার ডিকশনারিতে নেই। আলস্যের সঙ্গে ঘোর শত্রুতা। সেই তারই কিনা এমন দুর্দিন নেমে এলো! হাঁটুতে বেজায় চোট লেগেছে। পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ডাক্তার তাকে একমাসের জন্য জাগতিক চঞ্চলতা থেকে ছুটি দিয়েছে। এ নিশ্চয়ই ডাক্তারের ষড়যন্ত্র। চেকাপের নামে একগাদা ওষুধ প্রেসক্রাইব করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্ধা! নয়তো শোভা যেখানে শরীরের চেয়েও মনের জোরে সম্পূর্ণ সুস্থ সেখানে ডাক্তার কেন মেডিকেলের হাবিজাবি সব অসুখের বাহানায় তাকে আটকে রাখতে চাইবে! শোভার সব কূটসন্দেহ গিয়ে পড়ে ইংলিশ আন্টির ইংলিশ বয়ের ওপর। ওই লোক ইচ্ছে করে ওকে ঘরে বেধে রেখে নিস্তার পেয়ে যাবে ভাবছে? কাভি নেহি!
হাত-পায়ের চঞ্চলতা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে শোভার মুখ হয়েছে বাচাল এবং মস্তিষ্ক অতিরিক্ত ভাবনা পরায়ণ। এই যেমন এখন সে ভাবছে দিলশানের নিশ্চয়ই কোনো এফেয়ার আছে। নয়তো শোভা কি দেখতে অসুন্দর নাকি! আগের চেয়ে চুল বড়ো হয়েছে। শার্ট-প্যান্ট পরাটাও কমিয়ে দিয়েছে। ছেলে ছেলে ভাবটা গিয়ে মেয়েসুলভ একটু কমনীয়তা এসেছে না! দাদি প্রতি সপ্তাহে ওর চুলে-মুখে কীসব মেখে দেয়। উপটান বলে তাকে। শোভার ত্বক ও চুল নতুন কেনা পুতুলের মতো চকচক করে তখন। ওর ড্রেসিং টেবিল ভরে আছে সব ব্র্যাণ্ডেড প্রসাধনীতে। বাড়ির লোকেরা সাজগোছ, পোশাক বা গহনাদি কিছু কিনলে সব সময় দুই বোনের জন্য দুটো করে কিনত। শোভা নিজেরটা ব্যবহার করত না। ফলে শাওনই অঘোষিতভাবে সব ভোগ করেছে। সাজগোজে কোনোকালে মন না লাগলেও ছন্নছাড়া ভাবটা কমিয়ে আনছে না কি শোভা! আজকাল আয়নার সামনে অনেকটা সময় ব্যয় হচ্ছে তার৷ সেসব কার জন্য! ন্যাকা পুরুষ কী তা বোঝে না! নিশ্চয়ই বোঝে। তাই তো অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না৷ তবে শোভাকে অহংকার দেখানো মানে ক্ষেপিয়ে তোলা। কেউ তার দ্বারা বিরক্ত হলে তাকে আরেকটু বিরক্ত করাতে কী যে আনন্দ! এটাকে ফাজলামি, বিটলামি, শয়তানি কত নাম দেয় সবাই। কিন্তু শোভা বলে,
“আমি এমনই।”
যার অর্থ হলো সে ঘাড়ত্যাড়া। যাতে বাঁধা পাবে তাতেই তীব্র আকর্ষণ। যা সহজে পাওয়া যায় সেটা ওকে টানে না। যেটা হাসিল করে নিতে হয় তাতেই ওর দুর্বার আকর্ষণ। সব ক্ষেত্রেই সে রোমাঞ্চ খোঁজে। দিলশানও ওর ঘাড়ত্যাড়া মনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোমল নারীমনের জন্য একটা রোমাঞ্চকর যাত্রা।
সব ভাইবোনের মাঝে দুটো দিন শোভা একটু শান্তই ছিল। তারওপর জাওয়াদকে দুলাভাই হিসেবে পাওয়ার পর ওর দুষ্টুমির মাত্রাটাও বেড়েছে। আর যাবীন ওর প্রিয় একজন মানুষ। যাবীনের রূপমুগ্ধদের মধ্যে একজন হলো শোভা।
এক্সিডেন্টে ওর স্কুটিটাও বেশ আহত হয়েছে। মেরামতে পাঠানো হয়েছে। সেটার চাবি আপাতত দাদির কাছে বাজেয়াপ্ত। সহসাই আর স্কুটি চালানোর অনুমোদন পাবে বলে মনে হচ্ছে না। সবমিলিয়ে ওর দিনগুলো মিষ্টি-তেতো মিলিয়েই কাটছে। এরই মাঝে ইংলিশ আন্টির আদর তো আছেই। প্রতিদিন একবার করে নিজের হাতে তৈরি এক্সপেরিমেন্টাল রান্না নিয়ে আসছেন সুলেখা। সেদিনের শাপলার ডেজার্টটাও ফ্রিজে রেখে পরদিন খাইয়েছিলেন। অখাদ্য না হলেও সুখাদ্যের তালিকায় অবহেলিত। গতকাল এনেছিলেন মিক্সফ্রুট দিয়ে তৈরি পুলিপিঠা। যার নামকরণ করেছেন ফ্রুটপুলি। শোভা খেয়ে এমনই ভূয়সী প্রশংসা করেছে যে একদিন যেতে না যেতেই তিনি অনলাইন ঘেটে পাওয়া নতুন একটা রেসিপি, কাচা মরিচের মিষ্টি বানিয়ে এনেছেন। শোভা দেখেই মুখশ্রী করুণ করে ফেলল। সুলেখা বললেন,
“দেখেছো কালারটা কী এসেছে! ভাবছি আমাদের আউটলেটে এই মিষ্টিটা তুলতে বলব।”
“তাহলেই হয়েছে! আঙ্কেলের তিলে তিলে গড়া মতিচুরের সুনাম একেবারে শেষ হয়ে যাবে।” শোভা বিড়বিড় করে। সুলেখা না বুঝে বললেন,
“কিছু বললে? খেতে ইচ্ছে করছে না?”
“করছে তো৷ এসব না এনে আপনার গর্ভজাত একমাত্র মতিচুরের মাথাটা এনে দিলেও তো পারতেন। সেটা আরো বেশি সুস্বাদু।”
“হ্যাঁ?”
শোভা হে হে করে ফোকলা হেসে বলে, “না মানে অনেকদিন মতিচুরের মিষ্টি খাই না। তাই বললাম।”
_______________
স্বচ্ছ নীলিমায় শুভ্র মেঘের ভেলা ভাসিয়ে সকালটি যেন খিলখিল করে হাসছে। সূর্যরশ্মির তেরছা আলোয় পূর্বাকাশ ঝলমল করছে। শাওনকে রেখে জাওয়াদ ও যাবীন আজ বাড়ি ফিরবে। দুটো দিন আনন্দেই কেটেছে তাদের৷ এবার কাজে মন দিতে হবে৷ সকাল সকাল ওরা তৈরি রওনা হতে। জাওয়াদ ও শাওনের মাঝে একটা বিষাদঘন ছায়া নামল সেসময়। জাওয়াদ বের হওয়ার আগে স্ত্রীর হাত ধরল পরম যত্নে। শাওন বিষন্ন মুখে ক্ষীণ স্বরে বলে,
“কবে আসবে আবার?”
জাওয়াদ হাসল। শাওনের পাঞ্চক্লিপ হতে ছুটে এসে কপালে আছড়ে পড়া কিছু ছন্নছাড়া চুল কানের পিঠে গুজে দিয়ে ভারী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“মিস করবে?”
“অপেক্ষায় থাকব।”
শাওন জবাব দিতে গিয়ে লজ্জাবনত হলো। ঠোঁট চেপে হাসি লুকাতে চায়। আরক্ত মুখখানিতে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে জাওয়াদ। বোঝে জড়তা ভাঙছে। জাওয়াদ পারছে তার হৃদয়টাকে নতুন করে মায়া দিয়ে গড়তে। বিদায়ের আগে এক টুকরো উষ্ণ আলিঙ্গনের ঘোর পেয়েছিল তাদের৷ জাওয়াদের প্রশস্ত বুকের ওমে পুরোপুরি ডুবে গেল শাওন।
যাবীন দ্বীপশিখা ছাড়ার জন্য রীতিমতো ছটফট করছে। বিশেষ করে গতকাল বিকেলে যে অস্বস্তির শিকার সে হয়েছে এরপর সকলের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলেই যেন ওর স্বস্তি। গতকাল যখন নিশান্তের অল্পস্বল্প বলার কারণে সবদিক থেকে যাবীন কোণঠাসা, ঠিক তখনই ইমার্জেন্সি ফোনকল পেয়ে নিশান্ত ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল। এদিকে মুখচোরা যাবীন সম্পূর্ণভাবে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। কারণ পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিল না। তার আঁকা প্রেম নগরের প্রণয়কুমারের ছবি কী করে নিশান্তের হাতে পৌঁছাল সেই নিয়ে সকলের কৌতুহলী দৃষ্টি তার দিকে ঘোরাফেরা করছে।
কিন্তু তা নিয়ে যাবীনের ভয় নয়। ভয় হলো জাওয়াদের উপস্থিতিতে। কেননা ভাইয়া আগেই শুনে ফেলেছে যাবীন কোনো আর্মি অফিসারের প্রতি দুর্বল। আবার নিশান্তের হাতে তার আঁকা ছবি পড়ায় পরিস্থিতি বিগড়ে গেল। তবে ওকে অবাক করে দিয়ে জাওয়াদ এবারও কোনো প্রশ্নে গেল না। যাবীনের মনে হলো ভাইয়া কিছু বললেই ভালো হতো। তাহলে সকলের সামনেই দুধ কা দুধ পানি কা পানি হয়ে যেতো। এখন বাড়ির লোক ওকে দেখলেই কেমন মিটিমিটি হাসছে।
যাবীন ঠিক করেছে আজ গাড়িতে ভাইয়ার সঙ্গে যাওয়ার সময় সব বলে দেবে। ভাইয়া বুঝলেই হবে। আর কাউকে নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই। জাওয়াদের আসতে দেরি হচ্ছিল বলে যাবীন আগেই গাড়িবারান্দায় নেমে গেছিল। নিশান্ত তখন ঘর্মাক্ত দেহে বাড়ি ফিরছে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় যাবীন ওকে থামাল,
“শুনুন।”
নিশান্ত থামল। প্রশ্নোক্ত চোখে চাইতেই যাবীন কালক্ষেপণ না করে বলল,
“শিলা নাকি মিলা, কী যেন নাম মেয়েটার?”
নিশান্ত এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে, “শিলা। কেন?”
“হু, শিলা যে আপনাকে ওই পেইন্টিংটা গিফট করেছে সেটা দয়া করে বাড়িতে বলে দেবেন। নয়তো ব্যাপারটা উলটোপালটা হয়ে যাচ্ছে।”
“আসলেই উলটোপালটা লাগছে। তোমার বয়ফ্রেন্ডের জন্য আঁকা ছবি শিলার কাছে গেল কেমন করে?”
নিশান্ত কিঞ্চিৎ ঝুঁকে এসে কৌতুকপূর্ণ চোখে চায়৷ যাবীনের নাক ফুলে ওঠে। দাম্ভিক, নাকউঁচু লোক এখন তাকে নিয়ে মজা নিচ্ছে! লজ্জিত, বিব্রত যাবীন ধরা পড়েও নত হতে চাইল না। বলল,
“কে বলেছে ওটা আমার বয়ফ্রেন্ডের ছবি?”
“তেমনটাই তো শুনলাম।”
“অন্যের ঘরে কান পাতা খুবই বাজে স্বভাব।”
এতটা হীন স্বভাব নিশান্তের নয়। ও বুকে হাত গুজে মেজাজি স্বরে বলল,
“তুমি মাইকে গান বাজাবে আমি শুনলেই দোষ! গোপন কথা উচ্চস্বরে বলাও বাজে স্বভাব।”
“তখন কী আর জানতাম নাকি এভাবে ফাঁসব!” মনে মনে যাবীন। মুখে বলল,
“একটা নমুনা ছবি এঁকেছি মাত্র। আপনার শিলার সেটা পছন্দ হওয়ায় কিনে নিয়েছে। দ্যটস ইট। আর আমার বয়ফ্রেন্ড থাকলেও বা। এখন তো আর চড় মারতে পারবেন না। আমি এখন এডাল্ট। প্রেম করলে বাবা-মা অনায়াসে মেনে নেবে।”
অনেকগুলো কথা বলে ফেলে যাবীন আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে চাইল না। ছুটে গিয়ে গাড়ির পেছনের দরজা খুলতেই চমকে উঠল ও। কণ্ঠ হতে ছিঁটকে বের হলো আর্তনাদ। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখল ছোপছোপ র’ক্তে ভরে আছে গাড়ির ভেতরটা। মিহি বাতাসের তোরে গাছের পাতা যেভাবে তিরতির করে কাঁপে তেমনই করে যাবীনের সর্বাঙ্গ প্রকম্পিত হয়। নিশ্বাসের বেগ ঘন হয়। নিশান্ত দূর থেকে ওর হাবভাব লক্ষ্য করছিল। কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
“কী হলো, মেহযাবীন?”
যাবীন সংজ্ঞা হারিয়ে দেহভার ছেড়ে দিল শূন্যে। ক্ষীপ্র গতিতে দেহটিকে নিজের বাহুতে টেনে নিল নিশান্ত। তখনই খেয়াল করল জাওয়াদের গাড়ির ভেতরকার দৃশ্যটি। তাজা র’ক্ত তখনও টিপটিপ করে গাড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সবুজ ঘাসে।
চলবে…
ভুলত্রুটি পেলে জানাবেন।