প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২১]
প্রভা আফরিন
দিলশান বাড়ি ফিরতেই সুলেখা টফির হারিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে শোভার তাকে উদ্ধার করে আনা পর্যন্ত ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করলেন। মেয়েটি কতটা সাহায্য পরায়ণ ও প্রাণীপ্রেমী তার প্রশংসা করলেন। শোভা নিজের গুণগান শুনে কপট লাজুক হয়ে উঠছিল। সুলেখা যখন ডোনেশনের গল্পে আসতে নিলেন তখনই শোভা লাফিয়ে উঠল। উনাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে চাপা কণ্ঠে বলল,
“আপনার ডান হাত দান করলে বাম হাত যেন সেটা না জানতে পারে সেভাবেই করা উচিত। এটাই বড়ো মনের পরিচয়। আপনি তো ভীষণ বড়ো মনের মানুষ, তাই না!”
সুলেখা হকচকিয়ে গেলেন। তিনি নিজেকে বড়ো মনের মানুষ ভাবেন এবং একইসাথে সেটা ফলাও করে জানাতেও ভালোবাসেন। কিন্তু শোভার কথায় দ্বিধাভরে বললেন, “তাহলে তুমি যে বললে আমায় সভাপতি বানাবে! আমি যে ডোনেশন দিয়েছি এটা কেউ না জানলে সভাপতি হবো কী করে?”
“সেটা তো আমরা সবাইকে জানাব যে আপনি কত বড়ো এমাউন্ট ডোনেট করেছেন। আপনি কতটা উদার সেটা প্রচার করার দায়িত্ব আপনার আশেপাশের মানুষগুলোর। আপনার নয়। দশজন আপনার সুনাম করলে সম্মানটা আরো বেড়ে যায় কিনা! একদম সভাপতি বানিয়ে চমকে দেব সবাইকে। এর আগে সারপ্রাইজ হিসেবে থাকুক।”
যুক্তিপূর্ণ কথা। সুলেখার ভীষণ ইচ্ছে করলেও আর বললেন না। দিলশান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “আশ্চর্য! একজন মানুষের সামনে বসে তোমরা ফিসফিস করছো কেন? আর কী ঘটেছে?”
শোভা বিগলিত কণ্ঠে বলল, “আর যা ঘটেছে তা আপনার চোখের সামনে। টফিকে উদ্ধার করার পুরষ্কার স্বরূপ ইংলিশ আন্টি আমাকে আদর করে খায়িয়ে দিয়েছেন। শেষপাতে মিষ্টি পেলে আরো খুশি হতাম।”
সুলেখা বললেন, “মিষ্টি আছে তো। একটু বসো, আমি নিয়ে আসছি।”
সুলেখা প্রস্থান করলেন। দিলশান সরু চোখে সামনের ধুরন্ধর মেয়েটির দিকে চেয়ে আছে। শোভার কোনো কথাই ওর বিশ্বাস হতে চায় না। তাছাড়া টফির হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার আর শোভার খুঁজে আনা নিয়েও ভীষণ সংশয় আছে। শোভাও সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল। ও যে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে এসেছিল সেটা যেন প্রকাশ্যে না চলে আসে তাই দিলশানের মনোযোগ ঘোরানোর চেষ্টা করল। দিলশানের তীব্র চাহনি দেখে ও চোখ পিটপিট করে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে গান ধরল,
“পড়ে না চোখের পলক।
কী আমার রূপের ঝলক।
দোহাই লাগে মুখটি আমার
একটু আঁচলে ঢাকি।
আপনি জ্ঞান হারাবেন,
প্রেমে পড়ে যাবেন,
বাঁচাতে পারবে না কেউ।”
গানের লিরিক শুনে দিলশান খুকখুক করে কেশে উঠল। ঘাড় ডলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ শুনে ফেলেছে কিনা। চোখের চশমা খুলে রেখে বিস্ময় ও বিরক্তির সঙ্গে বলল, “তোমার মনে সামান্যতম ভয়-ডর নেই? আমার বাড়িতে বসে আমায় টিজ করছো!”
“আমার সাহস নিয়ে আপনার এখনো সন্দেহ আছে?”
“তোমার সাহস আমাকে বিরক্ত করছে, শোভা।”
“বিরক্ত হওয়া ভালো। কারণ কবি বলেছে…”
দিলশান কটমট করে বলল, “তোমার কবিকে আমি জোয়ারের জলে ভাসিয়ে দেব।”
“সেই জোয়ারটা যেন প্রেম জোয়ার হয় প্লিজ!” শোভা মিটমিট করে হাসে।
দিলশান হতাশ হয়ে গেল। ওর চেয়ে সাত-আট বছরের ছোটো একটি মেয়ে কিনা তাকে নাস্তানাবুদ করে! এ কথা কাউকে বলবে ভাবতেও কেমন লজ্জা হয় দিলশানের। তাছাড়া শোভা অতিশয় ধুরন্ধর মেয়ে। দিলশানকে সে সরাসরি প্রেম নিবেদন করেনি। ‘অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ পন্থা অবলম্বন করছে। তাই দিলশানের জন্য মেয়েটাকে হ্যান্ডেল করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
সুলেখা ছোটো পেয়ালায় করে মিষ্টি এনে বসলেন সোফায়। বললেন, “জানো শোভা, কোন মেয়ে যেন দিলশানকে চিঠি লেখে। কি দিনকাল পড়েছে দেখেছো! ছেলেরা আজকাল বাড়িতেও নিরাপদ না।”
দিলশান নিজের ঘরে যেতে উদ্যত হয়ে হতাশ গলায় বলল, “বোকা মা আমার! চোরকে সিন্দুকের চাবি দিয়ে বলছো চুরি কেন হয়!”
শোভা হোয়াইট হাউজ থেকে পেট ভরে খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার পর। দ্বীপশিখায় ততক্ষণে শাশুড়ি বউতে কয়েক দফা বাকযুদ্ধ হয়ে গেছে। শোভা ভীতপায়ে বাড়িতে ঢুকতে নিলেই দরজায় পাকড়াও হলো। চাঁদনি বেগম সম্ভাষণ জানানোর ভঙ্গিতে বললেন,
“আসুন মহারানি, আসুন। আপনার রাজ্য পরিভ্রমণ শেষ হয়েছে?”
শোভাও একই স্বরে বলল, “জি, মাতামহি। কার্যসিদ্ধি করেই আপন গৃহে নিদ্রাযাপন করতে ফিরেছি। আমার বিশ্রামের ব্যবস্থা করুন।”
“কেন? আপনার রাজ্যে বিশ্রামের ঠাঁই হয়নি? কষ্ট করে এ বাড়িতে আসতে গেলেন কেন?”
শোভা সরল গলায় বলল, “রাজ্য আর পরিবার কী এক? আমি আমার পরিবারকে ছাড়া থাকতেই পারব না।”
শিরীন মেয়ের বাহু টেনে ধরে বাড়ির ভেতরে আনলেন। ধমকে বললেন, “কোথায় গিয়েছিলি?”
“ইংলিশ আন্টির বাড়িতে। বিশ্বাস না হলে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। সারাদিন বাড়িতে থেকে বোরিং ফিল করছিলাম তাই একটু হেঁটে এলাম।”
শিরীনের রাগ কমল না তাতে, “না বলে কেন গিয়েছিস? তোর জন্য কাজ ফেলে, ছুটি নিয়ে বাড়িতে আছি আমি। এক্সিডেন্ট-এর আঘাত এখনো সারেনি। আর তুই আমাদের সবার সব যত্নকে পায়ে ঠেলে বাইরে বাইরে ঘুরছিস? বাড়িতে যে চিন্তা করবে সে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই? মরার আগে আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিবি না?”
শোভা মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রাগ করে বলল, “এভাবে বকতে পারলে! আমি আজ রাতে খাবই না। ওষুধও খাব না।”
ভরপেট খেয়ে আসা শোভা দুই দিনের অনাহারীর মতো করে দুর্বলপায়ে হেঁটে নিজঘরে চলে গেল।
চলবে…