প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২৬]
প্রভা আফরিন
আধঘণ্টা দৌড়ে একটি নির্জন পথের ধারে এসে থামল সে। হাঁটুতে ভর দিয়ে উবু হয়ে পরিশ্রান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস টানল কয়েকবার। সারা দেহ ঘামে জবজব করছে। আর্মি ছাট চুলের গোড়া বেয়ে গড়াচ্ছে নোনা, স্বেদজলের চিকন ধারা। বুড়ো আঙুলের সাহায্যে ভ্রুর ওপরে পুঞ্জিভূত ঘামটুকু মুছে নিল। ভোরের সূর্যটি মেঘেদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে বিধায় রোদের আলো বিস্তার লাভ করতে পারেনি। দূষণহীন সতেজ সকাল একরাশ মুগ্ধতা লেপটে দিয়েছে উঁচু দালানের ফাঁকে ফাঁকে।
পুরুষটি আজ হঠাৎ ছুটতে ছুটতে শেখ বাড়ির দিকে চলে এসেছে। এই আসাটা ইচ্ছাকৃত নাকি আনমোনে বোঝা মুশকিল। রুক্ষ ব্যক্তিত্বের মাঝে তার স্বতঃস্ফূর্ততা চাপা পড়ে থাকে বলে সহসাই কেউ তার মনের কথা ভেদ করতে পারে না। চোখ তুলে চাইতেই একটি অদ্ভুত, অযাচিত দৃশ্য চোখের মণিতে আটকে গেল। শেখ বাড়ির বাউন্ডারির কিছুটা দূরত্বে দুটি অল্পবয়স্ক ছেলে কিছু একটা নিয়ে চাপা সুরে তর্ক করছে। তাদের আলাপের কেন্দ্রবিন্দু যে বাড়িটাকে ঘিরেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কেননা তারা কথার মাঝে চোখের ইশারায় ও আঙুলে বারবার শেখ বাড়ির উঁচু পাঁচিলটাকে দেখাচ্ছে। আট ফুট উঁচু পাঁচিলের ওপর কাচ গাঁথা আছে। কারো পক্ষে ডিঙানো সম্ভব নয়। ছেলেদুটোকে দেখে ছিঁচকে চোর বা নেশাখোরের মতোই লাগছে। চোখদুটি লালচে। শরীরে ক্লান্তির ভাব। দূর থেকে চিলের দৃষ্টিতে একজন এই দুজনকেই দেখছিল। হঠাৎ আবিষ্কার করল একটি ছেলে পকেট থেকে কিছু একটা বের করেছে। আর্টিলারি কোরে বিভিন্ন এক্সপ্লোসিভ নিয়ে নড়াচড়া করার সুবাদে অভিজ্ঞ পুরুষটি সহজেই বুঝে ফেলল বস্তুটির ক্ষমতা। ঢিল ছুঁড়লে বিকট শব্দে সবাইকে আতঙ্কিত করে দেওয়া যাবে। তবে বিস্ফোরণ ক্ষমতা দুর্বল। ধোঁয়া সৃষ্টি করে, কিন্তু ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অনেকটা আতশ বাজির মতোই। শত্রুপক্ষকে আতঙ্কিত করতে এসব পন্থা অনুসরণ করা যায়। ছেলেগুলোর উদ্দেশ্য যে অসৎ বুঝতে আর বাকি রইল না। শেখ বাড়ির কর্তা এমনিতেই অসুস্থ। স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়েছে। এমন সময় এরূপ একটি বিস্ফোরক শব্দ তৈরি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করার অর্থ যে সুখকর নয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরুষটি নিজের ক্লান্তিকে ইস্তফা দিয়ে ক্ষীপ্র গতিতে দৌড় দিলো। হাড় জিরজিরে ছেলেটি সবেই বিস্ফোরকটি সীমানাপ্রাচীরের ভেতর ছুঁড়তে উদ্যত হয়েছিল। একটি পুরুষকে আগ্রাসী ভঙ্গিতে তেড়ে আসতে দেখে ওরা ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে পালাতে নিয়েও পেশীবহুল হাতের বন্ধনে আটকে পড়ে যায় অনায়াসে। একজনের গলা ও অন্যজনের নিম্নাঙ্গের বসন চেপে ধরে আটকালো নিশান্ত। শক্ত থাবায় ছটফটিয়ে উঠল দুজনে। পালানোর প্রচেষ্টায় নখের আঁচড় বিঁধিয়ে দিলো তামাটে ত্বকে। নিশান্তের ভাবনা সঠিক। এরা নেশাক্ত। গা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। হয়তো সারারাত কোনো আখড়ায় নেশাদ্রব্যে বুদ হয়ে ছিল। দাঁতে দাঁত চিপে বলল,
“কে পাঠিয়েছে তোদের? কার হুকুমের গোলামি করতে এসেছিস?”
তারা যে কারো হুকুমের গোলামি করতেই এসেছে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। নতুবা একটি অভিজাত এলাকায় এরূপ সামাজিক অবস্থার একটি পরিবারের সঙ্গে এই শ্রেণির মানুষের কোনো ব্যক্তিগত বিবাদ থাকার কথা নয়। পেশিতে গলা আটকে যাওয়া ব্যক্তিটি নিশ্বাস নিতে হাঁসফাঁস করছে। ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলল,
“আমরা কিছু করি নাই। কিছু জানি না। আপনে এমনে ধরতাছেন ক্যান?”
“কিছু না জানলে পালাতে চাইলি কেন? তোর হাতের জিনিসটা এখানে কোন কাজে লাগাতে এসেছিস? এটা কী কোনো উৎসবের দিন যে বাজি-পটকা ফাটাবি?”
ছেলেগুলো কোনো জবাব দিলো না। আতঙ্কে তাদের চোখ-মুখ ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে। দেহের তাপমাত্রা নেমে শীতল হয়ে গেছে। নিশান্ত বুঝল এভাবে কাজ হবে না। এদের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নিশ্চয়ই আগের ঘটনাগুলোর সঙ্গে এর যোগসূত্র পাওয়া যাবে। উদ্ধার হবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। শেখ বাড়ির দারোয়ানসহ পথের কিছু মানুষও তিন পুরুষের ধস্তাধস্তির দৃশ্যটি দেখে ততক্ষণে থমকে গেছে। নিশান্ত চোখের ইশারায় শেখ বাড়ির দারোয়ানকে ডাকল। দারোয়ান দড়ি এনে সঙ্গে সঙ্গে একটার হাত-পা বেধে ফেলল। অপরজন নিশান্তের বাহুতে তরপাচ্ছে। নিশান্ত একহাতে ট্রাউজারের পকেট হতে ফোন বের করে কাউকে কল দিলো। স্বল্প বাক্যে ঠিকানা দিয়ে বলল,
“উইথইন টুয়েন্টি মিনিট, গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হবেন।”
“ফোর্স লাগবে?”
“ওয়েল…আনঅফিশিয়ালি আমিই যথেষ্ট।”
ফোন রেখে নিশান্ত দারোয়ানকে সতর্ক করে বলল, “এ ঘটনা জাওয়াদ ব্যতীত বাড়ির আর কেউ যেন না জানে। আপনার মালিক অসুস্থ। আশাকরি কথাটা মনে রাখবেন।”
নিশান্তের উদ্দেশ্য সফল হলো না। কাউকে না জানালেও রোজ সকালে ছাদে ওঠা মিসেস সুমা ঘটনাটি দেখে ফেললেন।
______________
সকাল দশটা। সূর্যতাপে তাতিয়ে উঠেছে প্রকৃতি। নিশান্ত জুতোর ফিতে খুলে ভেতরে ঢুকতেই আফিয়া তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন।
“এত দেরি হলো যে আজ?”
“একটু কাজ ছিল।”
সংক্ষেপে জবাব দিয়ে নিশান্ত তিন চুমুকে গ্লাস ফাঁকা করল। খেয়াল করল মায়ের মুখ থমথমে। গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“কাজের প্রেশার বেশি হয়ে গেছে? দুজন লোক বাড়িয়ে নাও। সামনে তো আরো লোক আসবে। আত্মীয়দের কাজ ধরতে না দিয়ে মাথায় তুলো না। সবাই হাতে হাতে করলে দ্রুত হবে, রিলিফও পাবে।”
আফিয়ার মুখের পেশির কাঠিন্য টলল না। উনার রান্নাবান্না নিয়ে ওসিডি আছে। ফলে রান্নাঘরে কাউকে সহজেই ঢুকতে দেন না। এতে নিজের ভোগান্তিই বাড়ে। বিয়ের এ কয়দিন বাবুর্চি দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটা তিনি বললেন না। বরং ঘুরিয়ে বললেন,
“নিজের ছেলে দুঃখ না বুঝলে পরের লোকে বুঝবে কেন? দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে দুটো বউ আনলে আমার এত দুঃখ থাকে! বড়োটাই রাজি হয় না, ছোটোটার কথা তো ভাবতেও পারি না।”
মাই লাইফ, মাই রুলস এর অধিপতি অনন্তের জীবনে চরম অশান্তি নেমে এসেছে। বাড়িতে অতিথি এসে জড়ো হতে শুরু করেছে। ফলে সে সকালে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারছে না। জায়গা বদল করে বিছানা থেকে নেমে এসে সোফায় শুয়েছে। মায়ের কথা শুনে ওর ছাড়াছাড়া ঘুমটা যেন ছুটি নিল। লাফিয়ে উঠে বলল,
“ভাববে না কেন? ভাইয়া চিরকুমার হলে কি আমিও তাই হবো? বাংলাদেশ আইনে আমি বিয়ের যোগ্য হয়ে গেছি কবেই। এখন একটা করে দিন যাওয়া মানে যৌবনের একটা দিন লস।”
শোভা অতি ভদ্র হয়ে পড়তে বসেছিল। কিংবা বলা ভালো সে যে বই নিয়ে বসেছে সেটা সবাইকে দেখাতেই নিচতলায় সর্বসমক্ষে এসে বসেছে। কদিন আগেই ওর ইভেন্ট সফলভাবে মিটে গেছে। ইংলিশ আন্টি সেখানে স্পেশাল গেস্ট ছিলেন। ইভেন্টের পরই চাঁদনি বেগম জেনে যান শোভা সুলেখার থেকে টাকা হাতিয়েছে৷ আবার উনার কাছেও কাঁদুনি গেয়ে টাকা নিয়েছে। এরপর থেকেই শোভার প্রতি উনার মেজাজ নিমের মতো তেতো। তাই শোভাও গুড গার্ল পারসোনালিটি মেইনটেইন করছে। অনন্তের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ও বলল,
“তাহলে ভাইয়া, আমারও তো বাংলাদেশ আইনে বিয়ের বয়স হয়ে গেছে গতবছর। মানে উপরি এক বছর লসও হয়ে গেল!”
আফিয়ার রোষ দৃষ্টি ও নিশান্তের হিম চাউনির সামনে দুই ভাই-বোনের বেফাস আলাপ মূর্ছা গেল। শোভা ফ্যাকাশে হেসে পুনরায় বইয়ে মুখ ডোবাল। অন্যদিকে অনন্তের মাঝে বিশেষ প্রভাব পড়ল না। ভাইয়া বিয়ে না করলে তার বিয়েও যে আটকে যাবে এটাই চিন্তার মূলে জেঁকে বসেছে।
বিয়ের আবহে ঝলমলিয়ে উঠেছে দীপশিখা। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই এলাকার প্রবেশপথ থেকে শুরু করে বাড়ি অবধি লাইটিং করা হয়েছে। কথা ছিল শেখ বাড়ি থেকে কমিউনিটি সেন্টারে রিসেপশনের আয়োজন করা হবে। কিন্তু দুই পরিবারের তরুণদের উচ্ছ্বাস ও শখকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে রিসেপশনের আগে কনের বাড়িতে গায়ে হলুদ ও কনে বিদায়ের আয়োজনও হবে। সেই সুবাদে শাওনকে পুনরায় নিজ গৃহে ফিরতে হয়েছে। তার মামা, মামী ও কাজিনরা এসে উঠেছে বাড়িতে। দূর-দূরান্তের আত্মীয়রা ধীরে ধীরে বাড়ি এসে ভিড় করতে শুরু করেছে। জমজমাট আবহ। এরই মাঝে আফিয়ার ঘ্যানঘ্যানানি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। প্রতিবেলা খাবার পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে বড়ো ছেলের কানের কাছে তিনি বিয়ের মন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছেন। শিলা শুরু থেকেই নিশান্তের পরিবারের প্রথম চয়েস। নারী বৈমানিক হিসেবে তার গৌরব নেহাৎ কম নয়। শোনা যাচ্ছে আগামী বছরেই সে ইউএস যাচ্ছে স্পেশাল ট্রেনিংয়ের জন্য। নিশান্তও টাইট শিডিউলে আটকা পড়বে। প্রতিরক্ষার স্পেশাল টিমে ডাক পাওয়ার সাথে সাথে মেজর র্যাঙ্কে ওঠার বিশাল সুযোগ সামনে। সুতরাং দুজনের ব্যস্ত ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত সামনে। তাই এটাই সঠিক সময় বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবার। ক্যারিয়ার হোক, পাশাপাশি সংসারটাও গড়ে উঠুক, এমনটাই চান বাড়ির প্রতিটি সদস্য।
নিশান্ত মায়ের অবোধ অভিযোগের বিপরীতে বলল,
“আমার বউ দিয়ে কাজ করিয়ে খাওয়ার মতো দৈন্যদশা নিশ্চয়ই তোমার হয়নি?”
আফিয়া জানেন এই ছেলের সঙ্গে যুক্তিতর্ক দিয়ে লাগা যাবে না। বাবার মতোই চৌকস তার মস্তিষ্ক। নরম গলায় আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন,
“তাই বলে ছেলের সংসার দেখার সাধ করব না?”
অনন্ত বলল, “অবশ্যই দেখবে। শিলাপাথরের সঙ্গে বিয়ের কথা ফাইনাল করো। ভাইয়া না করলেও আমি তো আছিই।”
আফিয়া রান্নাঘরে যেতে যেতে সরোষে গজগজ করেন,
“রাজকপাল আমার! এক ছেলে বিয়ে করতে চায় না, আরেক ছেলে পরিণতমনষ্ক হবার আগেই লাফায়। নির্লজ্জ, বেহায়া!”
শোভার মামাতো ভাই-বোন দুইজন। ভাই বয়সে নিশান্তের চেয়েও সিনিয়র, এক বাচ্চার বাবা। আর বোনটা শোভারই বয়সী। তার ডাকনাম মিষ্টি। শোভার মতো ছোটোছুটি কিংবা আজগুবি কথাপাগল না হলেও বাড়ির সব বিষয়েই তার যেন খুব বেশি আগ্রহ। মিষ্টি নিশান্তকে দেখেই দোতলা থেকে নেমে এলো। বলল, “ভাইয়া, আপনার রুমের দেয়ালে আপনার একটা পেইন্টিং দেখলাম। খুব সুন্দর হয়েছে। ওটা কী আপনিই এঁকেছেন?”
মিষ্টি মুচকি হাসে। যেন নিশান্ত আঁকতে জানে শুনলে অনুরোধ করে নিজেরও একটা পেইন্টিং সে করাবে। নিশান্ত ঠান্ডা চোখে চাইল। তার অনুপস্থিতিতে মিষ্টি তার বেডরুমে ঢুকেছে। চোখ ফিরিয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করল নিশান্ত। আফিয়া বুঝে গেলেন সেই দৃষ্টির মানে। ইশারায় বললেন মেয়েটিকে যেন কিছু না বলে। ওরা দুদিনের অতিথি। বিয়ে উপলক্ষে এসেছে। কারো মনে কষ্ট দেওয়া যাবে না। নিশান্ত নিজেও তা ভালো করেই জানে। মিষ্টিকে ছোটো করে জবাব দিলো,
“ওটা একজন শিল্পীর রঙ-তুলির দক্ষতা। আমি শিল্পী নই। শুধু শিল্পীর গুণকে কদর করতে জানা একজন গুণমুগ্ধ মাত্র।”
চাঁদনি বেগম বাগানের গাছে পানি দেওয়া শেষে সবে ঘরে এসে বসেছেন। নিশান্তের জবাব শুনে তিনি ভ্রুকুটি করলেন। সে চাইলেই বলতে পারত উপহার পেয়েছে। তা না করে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কী জবাব দিলো মিষ্টি নিজেও বুঝল না। অনন্তই বলল,
“ওটা ভাইয়ার একজন কঠিন মেয়েভক্ত ভাইয়াকে উপহার দিয়েছে। কিন্তু আঁকিয়েছে আমার বন্ধুকে দিয়ে। মেহযাবীনকে চেনো? বিকালে সবাই যখন শপিংয়ে যাব, ওরাও আসবে। তখন পরিচয় করিয়ে দেব।”
নিশান্ত কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনে ওপরে চলে গেল। তার এখন গোসল নিতে হবে। আফিয়া শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করে বললেন,
“আপনার এই নাতি আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। এবার আপনিই কিছু করে রাজি করান। আর ভাল্লাগে না।”
চাঁদনি বেগম নাতির যাওয়ার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললেন,
“বড়ো বউ, ভুল নিশানায় তীর ছুঁড়ছো। বিয়ে সে করবে। শুধু সঠিক জায়গায় তীরটা ছুঁড়তে হবে।”
_____________
বসুন্ধরায় এসে মিলিত হয়েছে শেখ ও আজাদ বাড়ির সদস্যরা। উদ্দেশ্য, শেষ মুহূর্তের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ও একসাথে খাওয়া-দাওয়া করা। জাওয়াদদের গাড়িটা আগেই এসে পৌঁছেছিল। শাওনের গাড়ি থামতেই জাওয়াদ নিজেই দরজা খুলে সবাইকে নামালো। বিশেষভাবে হাত ধরে নামানো হলো মূল আকর্ষণ অর্থাৎ বউকে। গাড়ি থেকে নামিয়ে জামার সঙ্গের ওড়নাটা গুছিয়ে দিতে দিতে জাওয়াদ ক্ষীণ স্বরে বলল,
“তোমায় খুব মিস করেছি, শানু।”
শাওন প্রশান্তিতে হাসে। আলতো করে পুরুষটির হাতের ভাজে হাত রেখে জানান দেয় সেও ভীষণ মিস করেছে স্বামীকে। ওদের দুজনের কিছু একান্ত গোপন কথা আছে। একলা সময়ে জাওয়াদ স্ত্রীকে আদর করে শানু বলে ডাকে। শাওনও ছোটো করে ডাকে জাদ বলে। এই শব্দের বিনিময় হয় শুধু নিজেদের সঙ্গে সময়যাপনের সময়। অন্য কেউ জানে না। জানানোর প্রয়োজনীয়তা নেই।
নবদম্পতির এইটুকু যত্নশীলতা দেখেই ছেলে-মেয়েরা হৈ হৈ করে উঠল। বড়োরা কেউ ওদের হাসি-মজায় ঢুকলেন না। উনারা আগেই শপিংমলে ঢুকে গেলেন।
অনন্ত মিষ্টির সঙ্গে মেহযাবীনের পরিচয় করালো।
“এই সেই রাজকুমারী, তুমি যার পেইন্টিংয়ে মুগ্ধ হয়েছো। মেহযাবীন শেখ।”
মিষ্টি গদগদ হয়ে বলল, “তুমি কী আমার একটা ছবি এঁকে দিতে পারবে? আমার ইচ্ছে নিজের আঁকা ছবি রাখব।”
মেহযাবীন স্মিত হেসে সম্মতি দিলো, বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে সে এঁকে দেবে একসময়। অনন্ত বলল,
“তারচেয়ে বিয়েতে যাবীনকে একটা স্টল করে দেই। অতিথিদের যাদের ইচ্ছে হবে এসে তোর থেকে আঁকিয়ে নিয়ে যাবে। পার আর্টপিস মূল্য পাঁচ হাজার। বিয়ে খাওয়াও হবে, টাকা কামানোও হবে। আমি হবো ম্যানেজার তাই আমার পার্সেন্টেজ থাকবে ফিফটি পার্সেন্ট। ডিল?”
অনন্ত হাত বাড়িয়ে দিলো যাবীনের দিকে। মেহযাবীন দাঁত বের করে হেসে ওর হাতের তালুতে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের প্রহার করে বলল, “কিল!”
ছেলেদের কেনাকাটা করতে খুব একটা সময় লাগল না। মেয়েদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে পায়ে ব্যথা হবার দশা। তবুও তাদের মনের মতো জামা মিললে জুতো হয় না, জুতো হলে ব্যাগ হয় না। মেহযাবীনের অবশ্য চিন্তা নেই। তাদের কেনাকাটা আগেই হয়ে গেছে। সে এসেছে কিছু জুয়েলারি কিনতে। তবুও সকলের দেখাদেখি শাড়ি কেনা হয়ে গেল। মেহযাবীনের রুচিবোধ নিয়ে সকলের উচ্চধারণা আছে বলেই তাকে দিয়ে অনেকের জন্য উপহারের পোশাক কেনানো হলো। জুয়েলারি শপে গিয়ে হালকা ও ফ্যাশেনেবল একটা গলার হার কিনতে গিয়ে মেহযাবীন বিড়ম্বনায় পড়ল। তার ও মিষ্টির একই সেট পছন্দ হয়েছে। মিষ্টির মাঝে নমনীয়তার বৈশিষ্ট্য না দেখে মেহযাবীনই সেটা নেওয়ার ইচ্ছে থেকে অব্যাহতি জানাবে ভাবল।
নিশান্ত শপিংমলে এসেছে মেয়েরা যখন গহনার দোকানে ঢুকেছে। মেহযাবীনের পছন্দকৃত সেটটি মিষ্টির হস্তগত হতে দেখেছে নীরবে। এক দোকানেই পছন্দের জিনিস পেয়ে যাওয়ায় ওরা আর অন্যদিকে যায়নি। আকস্মিক সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিশান্ত ডাকল,
“মেহযাবীন, কাম হেয়ার!”
যাবীন চকিতে পাশ ফিরতেই নিশান্ত ইশারায় ডাকল। মেহযাবীন বুঝতে না পেরে আদেশটা পালন করল। নিশান্ত তাকে মুখোমুখি দোকানটায় নিয়ে গিয়ে সেলসম্যানকে হাতের ইশারায় একটা নীল পাথরের পাতলা ও ছোটো হার নামাতে বলল। মেহযাবীনের দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আই থিংক এটা মানাবে তোমাকে।”
মেহযাবীন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হারটা গলায় পরল। মানতে বাধ্য হলো নিশান্তের পছন্দ তার দৃষ্টির মতোই শাণিত।
মিষ্টি হামলে পড়ে বলল, “এটাই তো বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে।”
শোভা চোখ গরম করে বলল,
“বুঝে নিয়েছিস না নিজেরটা। অন্যেরটায় নজর দেওয়া ব্যাড ম্যানার্স।”
মেহযাবীন মুচকি হেসে নিশান্তকের দিকে ফিরতেই নজর গেল গোটানো হাতার কাছে উঁকি দেওয়া লম্বা আঁচড়ে। জিজ্ঞেস করল, “আপনার হাতে কী হয়েছে?”
নিশান্ত অগ্রাহ্য দৃষ্টিতে দেখে শার্টের হাতা নামাতে নামাতে বলল, “নাথিং। ইনজয় ইয়োর টাইম।”
এরপর যে উদ্দেশ্যে তার শপিংমলে আসা সেটা পূরণ করতেই জাওয়াদকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গেল।
সকলেই শখের টুকটাক কেনাকাটা করলেও শোভাকে দেখা গেল মেয়েলি জিনিসপত্র থেকে অনেকটা দূরে। ওর মামা ওকে কিছু দিতে চাওয়ার নিমিত্তেই বললেন নিজের জন্য কিছু পছন্দ করতে। শোভা অনাগ্রহে বলল, “ওসব মেটালের দড়ি আমি পরি না। অন্যের গলায় পরাই। হুহ!”
সেলসম্যান অবাক হয়ে বলল,
“কী মেয়েরা বাবা! গহনাকে দড়ি বলে অপমান করে দিলো!”
চলবে…