প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২৯]
প্রভা আফরিন
মেহযাবীন ভাবত, অবশ্যই ভেবে দেখত, যদি মানুষটা ক্যাপ্টেন নাফিউন আজাদ নিশান্ত না হয়ে অন্য কেউ হতো। পাত্রের নাম শুনেই তার সর্বাঙ্গে আটশো আশি ভোল্টের ঝটকা লেগেছে। শেষে ওই নাকউঁচু মিলিটারি! বাবা আর কাউকে পেল না মেয়ের জামাই করার জন্য! কপালে হাত দিয়ে খাটে পা তুলে বসে পড়ল সে, “জগতে পাত্রের এতই অভাব! নাকি আমি এতটাই বোঝা হয়ে গেলাম সবার কাছে!”
শাওন ওর কাঁদো কাঁদো মুখশ্রী দেখে ব্যথিত হলো। কৈশোরবেলা থেকেই শাওনের বান্ধবীরা নোট কালেক্ট করার বাহানায় বাড়ি আসত। ইনিয়েবিনিয়ে নিশান্তের কথা জানতে চাইত। ভাইয়ের চোখের সামনে ঘুরঘুর করে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করত। চাঁদনি বেগম সেসব বুঝে একদিন কড়া গলায় নিষেধ করলেন নিশান্ত বাড়িতে থাকা অবস্থায় শাওনের বান্ধবীদের বাড়িতে আনা নিষেধ। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের নিশান্ত এখন পরিশ্রমের তেজে ঝলসে তামাটে বর্ণের হয়েছে। ধারালো চোয়ালের আকর্ষণ ও ব্যক্তিত্বের জৌলুশ দুই-ই আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গম্ভীরতাও হয়তো বেশি। তাই বলে সে কারো পাত্র হিসেবে অপছন্দের হবে শাওন মানতে পারে না। যাবীনের কাছে তার ভাই যেমন পৃথিবীর সেরা পুরুষ, শাওনের কাছেও তার ভাই সেরা। হয়তো জাওয়াদের মতো শীতল ব্যক্তিত্ব নয় তার। উষ্ণতাতেও কী কম সৌন্দর্য নিহিত!
তাছাড়া যাবীন শেখ পরিবারের বোঝা নয়, বরং তার সুরক্ষার জন্য পরিবারের প্রতিটি মানুষ নির্ঘুম রাত পার করছে শাওন সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। এই মেয়ে এমনই জেদে ডুবে আছে যে কিছুই দেখছে না! শাওন বিরক্ত হয়ে বলল,
“তোর কী রকম ছেলে পছন্দ বল দেখি। তোর ভাইকে বলব তেমনই কাউকে খুঁজে আনতে। তবুও এটা বলিস না মানুষগুলো তোকে বোঝা ভাবে।”
নাহ, বোঝা যে ভাবে না সেটা যাবীনের মনও বেশ ভালো জানে। কিন্তু রাগের বশে সব নেতিবাচক ভাবনাই মনে আসছে। উত্তেজনার সাময়িক বিরতি দিলো সে। ঠোঁট টিপে নিবিষ্ট মনে ভাবার চেষ্টা করল কেমন পাত্র তার পছন্দ। মস্তিষ্ক কোনো রেফারেন্স দাড় করাতে পারল না। মেহযাবীন এতদিন একটা কথা খুব মানত। ধর্মীয় আস্থার স্থান থেকে সে এটুকু অবগত তার জোড়া আগে থেকেই নির্ধারিত। শুধু সাক্ষাতের সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। তাই সে কখনো কোনো রেফারেন্স দাড় করাতে চায়নি ভবিষ্যত স্বামীর জন্য। এরপর যদি আশানুরূপ না মিলে তখন দেখা যাবে সে-ই দুঃখ ও অশান্তিতে ভুগবে এই ভেবে যে, স্বামী কেন মনের মতো হলো না? তারচেয়ে তার শূন্য চাওয়ায় এমন একজন আসুক যে কিনা ওর মনে আকাঙ্ক্ষা তৈরি করবে, অনুভূতি সঞ্চার করবে। হৃদয়ে জ্বালবে প্রেমের প্রদীপ। তাই শাওনের প্রশ্নের আশানুরূপ উত্তর যাবীন দিতে ব্যর্থ হলো।
“জানা নেই আমার। শুধু এটুকু জানি যাকে দেখলে আপন আপন লাগবে, যার সান্নিধ্যে হৃদয় শীতল হবে সেই মানুষটা আমার ব্যক্তিগত পুরুষ হবে। আর তোর ভাইকে দেখলেই আমার ডাকাত ডাকাত ফিল হয়, হৃদয় শীতল হওয়া তো দূর উলটে গনগনে হয়ে যায়। মেজাজ নষ্ট হয় খোঁচামারা বাক্যে। তার সঙ্গে সংসার করব নাকি যুদ্ধ?”
শাওন হেসে ফেলল, “ডাকাত যে তোর মনটা ডাকাতি করতে পারবে না তার কী গ্যারান্টি? আর ডাকাত যদি এমন চার্মিং হয় তাহলে যুদ্ধ কিংবা সংসার দুইয়েই কিন্তু আনন্দ।”
মেহযাবীন কোনো জবাব দিলো না। মাথার চুল খামচে ধরে বসে রইল। শাওন হাল ছাড়ল না। মানুষ হিসেবে সে স্বামীর মতোই অগাধ ধৈর্য ও সংযমের অধিকারী। সহজে রাগেও না, হালও ছাড়ে না। ও আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলল,
“শোন যাবীন, প্রতিটি মানুষের মাঝেই একাধিক সত্তা আছে। উদাহরণস্বরূপ তোর ভাইয়ের কথাই বলি। সে তোর ভাই হিসেবে এক রূপ, আমার স্বামী হিসেবে আরেক। কিন্তু উভয় রূপেই সে ভীষণ যত্নশীল, দায়িত্বশীল একজন মানুষ। অন্যদিকে কর্মস্থলে এই লোকটাই চৌকস, গম্ভীর, নীরস একজন ব্যবসায়ী। সে আমাকে যেভাবে আগলে রাখে বাইরের কোনো মেয়েকে সেভাবে রাখবে না। উচিতও নয়। বিয়ের আগেও কিন্তু জাওয়াদের সঙ্গে আমার কোনো মাখোমাখো সম্পর্ক ছিল না। আর পাঁচটা সাধারণ ফ্যামিলি গ্যাদারিংয়ে কাজিনের মতো আচরণ ছিল আমাদের। সেই মানুষটাই যখন স্বামী হলো তখন বুঝলাম আমাকে সে কতটা ভালোবাসে। সামনে থাকলে চোখে হারায়। ঘুমের ঘোরেও একটা হাত বাড়িয়ে আমাকে খুঁজে নেয়। আমি যে মানুষটাকে নিয়ে কোনোদিন কিছুই ভাবতাম না তার বুকে মাথা রেখে এখন পৃথিবীর সমস্ত সুখ খুঁজে পাই। বিয়ে জিনিসটাই এমন। পাষাণের হৃদয়েও প্লাবন আনতে পারে। তুই বড়ো ভাইয়ার স্বামী সত্তাটাকে তো চিনিস না। তেমনই বউ হিসেবে কেমন হবি সেটাও জানিস না। পুরুষ কিন্তু কোনো না কোনো স্থানে দুর্বল। হতে পারে তুই-ই ভাইয়ার দুর্বলতা হয়ে গেলি। আর সে হয়ে গেল বউপাগল। আচ্ছা… ভাইয়াকে নিয়ে কখনোও আলাদা করে ভাবিসনি? আগুন আর বারুদ কাছাকাছি থাকলে কিছু তো বিক্রিয়া হবার কথা।”
নিশান্তকে যাবীন ঠিক কেমন মানুষ ভাবে তা ব্যাখ্যা করা জটিল। সেই অতীতের একটা চড়। একটা চড়েই তার সমস্ত ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার। এরপর এই লোকটাকে সে সুনজরে দেখেনি। ইচ্ছেও করেনি। এতগুলো বছর লজ্জায়, সংকোচে, ক্ষোভে শুধু এড়িয়েই চলেছে। ভাইয়ের বিয়েতে বিভিন্ন ঘটনায় আবারো কাছাকাছি এসেছে, কিন্তু আজও প্রতিটি অনু-পরমাণুতে সেই থাপ্পড়ের শব্দ বাজে। নিশান্ত কখনো পারবে সেই অপমান ভোলাতে?
_____________
রাতের খাবারের সময় সুলতান শেখ নিজেই মেয়ের ঘরে এলেন ডাকতে। মেহযাবীন তখন বিষন্ন, বিবর্ণ মুখ নিয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়। দরজায় ঠকঠক শব্দ হলে অভিমানী চোখ তুলে তাকাল। বাবাকে দেখে নম্র হয়ে উঠে বসল। বলল, “ভেতরে এসো, বাবা।”
সুলতান শেখ ভেতরে প্রবেশ করে দরজা ভিড়িয়ে দিলেন। মেহযাবীন বুঝে ফেলল বাবা তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ও কিছু বলল না। সুলতান শেখ মেয়ের পাশে বসে ওর গালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কানে গুজে দিয়ে বললেন, “শরীর খারাপ? নাকি মন?”
মেহযাবীনের মন সকাল থেকে একের পর এক চিন্তায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছিল। বাবার একটু স্নেহ পেতেই তার কী যে হলো! ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল বাবাকে জড়িয়ে ধরে। অভিযোগ জানাতে কার্পণ্য করল না একটুও,
“তোমরা আমায় ভালো থাকতে দিচ্ছো না, বাবা। আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো।”
শেখ সাহেবের বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়। সন্তান এভাবে বুকের ওপর কাঁদলে কোন বাবা সইতে পারে! তিনি চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, “ছোটো থেকে এখনো পর্যন্ত তোর জীবনের যতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবা কী তোর খারাপ চেয়েছি কখনো? তোর তাই বিশ্বাস?”
মেহযাবীন না বোধক মাথা নাড়ে। সুলতান শেখ পুনরায় বললেন, “তাহলে এবার কেন আমার মা আমার ওপর আস্থা হারাচ্ছে? বাবা অসুস্থ বলে কী মেয়ের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে ধারণা করছে?”
“তোমরা আমাকে ধোঁয়াশায় রেখেছো। হুট করে কেন বিয়ের কথা উঠল, কেন এত জলদি বিয়ের ব্যবস্থা করছো তোমরা?”
সুলতান শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
“বাবার অবস্থাটা দেখেছিস! হুট করেই পৃথিবীটা দুলে উঠল, ভাবলাম আমার দিন বুঝি ফুরিয়ে গেল। ছেলে, মেয়ে, বউ আর কাউকে দেখতে পাব না। অসমাপ্ত দায়িত্ব ফেলে চলে যেতে হবে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ নেয়ামতে আমি তোদের সবাইকে আবারো কাছে পেয়েছি। জানি না কতদিন এর স্থায়িত্ব। সব অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে যেতে হবে। আমার মেয়েটার একটা নিরাপদ ব্যবস্থা না করে কি আমি শান্তির শ্বাস নিতে পারব? তোর যুক্তিতে, বুদ্ধিতে হয়তো আমার এই ভাবনাকে সেকেলে লাগছে। এখন ছেলে-মেয়েদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য থাকে। বিয়েই তাদের জীবনের সব না। কিন্তু জীবনে যদি নিরাপত্তাই না থাকে তাহলে বাকিসব লক্ষ্য অমূলক নয় কি?”
যাবীন ভ্রু কুচকে চাইল। সুলতান শেখ জানেন মেয়েটি বুদ্ধিমতি একই সঙ্গে কোমলমতিও। তাকে বোঝাতে বুদ্ধির সঙ্গে আবেগটাকেও কাজে লাগানো যাবে। ওর মাথার হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,
“আমার কাছে আমার সন্তানের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যত নিশ্চয়তাই সব। ধরে নে বিয়েটা তোর নিরাপত্তার একটি কারণ। দুদিন বাদে জাওয়াদ দেশ ছাড়বে। লম্বা সফর। ফিরেও সে ব্যস্তই থাকবে। আমি অসুস্থতায় দুর্বল হয়ে গেছি। আর জানিসই তো আমাদের কত বিজনেস রাইভাল আছে। কেউ চাইলেই আমাদের ক্ষতি করতে পারবে। এ পৃথিবীটা বড্ড জটিল, মা। এখানে স্বার্থের কাছে আপনজনও তুচ্ছ। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। আমার পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। একজন দায়িত্ববান মানুষের কাছেই আমার প্রাণভোমরাকে তুলে দিতে চাই। আজ নাহয় কাল বিয়ে তো তোকে দেবই। তোর নিজের কোনো পছন্দ থাকলে বল, আমি অবশ্যই বিবেচনা করে দেখব।”
.
“আমার কোনো পছন্দ নেই।” গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো সে।
শেখ সাহেব যেন উত্তর জানতেনই। মুচকি হেসে বললেন, “তাহলে বাবার সিদ্ধান্তকে বিবেচনা করে দেখিস। নিশান্তকে আমরা ছোটোবেলা থেকে দেখেছি। ওর প্রফেশনাল ফিল্ডেও খোঁজ চালিয়েছি আমি। ছেলেটা সৎ, চৌকস। চারিত্রিক কোনো ব্যাড রেকর্ড নেই। আমার একমাত্র মেয়ের জন্য তাকে সব দিক দিয়েই সেরা মনে হয়েছে। আমার মেয়ে তার কাছে নিরাপদে থাকবে এটাই আমি বিশ্বাস করি। দীপশিখা তোর চেনা গণ্ডি, আমারও চেনা বলেই এভাবে ভরসা করছি। সেই গণ্ডিতে মিশে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। মেয়ের বাবার একটা দুঃখ কী জানিস? মেয়ে কবুল বলে ফেলার পর তার জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত বাবা আর একচেটিয়াভাবে নিতে পারে না। তখন মেয়ের গণ্ডিটায় আরো একটা পৃথিবী যুক্ত হয়। তাই বিয়ের সিদ্ধান্তটাই বোধহয় আমার শেষ সিদ্ধান্ত হতে চলেছে। আমার মেয়ে আমার শেষ সিদ্ধান্তটা মেনে নেবে কিনা সেটা আমি তার বিবেচনাতেই ফেলে দিলাম। এখন অভিমান ফেলে খেতে আয়। সুষ্ঠু বিবেচনা করতেও শরীরে বল থাকা প্রয়োজন। কোনোদিন খাবারের সঙ্গে অভিমান করবি না। নিত্য প্রয়োজনের সঙ্গে অভিমান করা মানে নিজেকে ঠকানো।”
সুলতান শেখ যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। যাবীন স্থবির হয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ বাদে মিসেস সুমা ঢুকলেন ওর ঘরে। মা-মেয়ে অনেকক্ষণ বন্ধ ঘরে কী নিয়ে কথা বলল কেউ জানে না। তবে সেই বৈঠকের পরেই আশ্চর্যজনকভাবে যাবীনের মাঝে কিঞ্চিৎ স্থিরতা দেখা গেল। যেই স্থিরতাকে সম্মতির লক্ষণও বলা যায়। যাবীন শান্তমুখে সবার সঙ্গে বসে খাবার খেল। বাবা, ভাই, তানি খালা, জরি খালার কনে বিদায়সুলভ অতিরিক্ত আদরও গায়ে মাখল। এরপর ভদ্র মেয়ের মতো রুমে এসে দরজা আটকে দিলো। চোয়াল শক্ত করে ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল। ম্যাসেজ করল,
“আমি আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই।”
______________
নিশান্তের বিয়ের সিদ্ধান্তে দীপশিখায় যেন বোমা ফেটেছে। দুজন মানুষ ব্যতীত বাড়ির সবাই তাতে বিস্ফোরিত হয়েছেন। যেই দুজনের গায়েই লাগেনি তারা হলো চাঁদের বুড়ি এবং শোভা। তাদের ভাবখানা এমন যেন, এ তো হওয়ারই ছিল। আর সবচেয়ে বেশি আহত হলেন আফিয়া। ছেলের সিদ্ধান্ত তিনি কিছুতেই মানতে পারলেন না। শিলার পরিবারের সঙ্গে কী দারুণ এক সম্পর্ক উনাদের। দুই পরিবারের ভাবটাই এমন ছিল যে ইশারা পেলেই নিশান্ত-শিলার চার হাত এক করবেন। সেখানে নিশান্তের ইশারা যে এমন কিছু হবে তা উনারা কস্মিনকালেও ভাবেননি। আফিয়া রাগের বশে বলেই ফেললেন,
“শিলার চেয়ে যাবীনকে কোন দিক দিয়ে যোগ্য মনে হলো তোর?”
নিশান্ত বিস্ময়ের সঙ্গে মায়ের দিকে চাইল,
‘তোমার কাছে যোগ্যতার মানে কী? শুধু স্বনামধন্য চাকরি পাওয়া? অর্থ, বিত্ত, যোগ্যতায় শেখ বাড়ি আমাদের চেয়েও এগিয়ে বলা যায়। তা ভুলে যেও না।”
আফিয়া ভোলেননি। ভোলেননি বলেই উনার দ্বিধাটাও এখানেই। মেয়ের বিয়ে উঁচু পরিবারে দেওয়াটা সব বাড়িরই বোধহয় ইচ্ছে। কিন্তু ছেলের জন্য সমানে কিংবা তার চেয়ে একটু কম হলেও অসুবিধা নেই। বেশি হলেই বরং আশঙ্কা থাকে মেয়েকে শাসন করব যাবে না, মেয়ে বাপের বাড়ির দাপট দেখাবে। আফিয়া তা সহ্য করতে পারবেন না। শিলার পরিবার সেদিক দিয়ে মনের মতো। শিলার মা তো সারাক্ষণ উনারই গুণগান করেন। এত বড়ো বাড়ির বউ হয়েও আফিয়া নিজের হাতে সংসার সামলান। সেসব শুনতেও আরাম। অন্যদিকে যাবীনের মা তো নিজেই একজন ব্যবসায়ী। উনার সঙ্গে আফিয়ার সাংসারিক আলাপটা ঠিক জমে না। শিরীন যেহেতু চাকরিজীবী তাই তার সঙ্গে সুমার আলাপ জমে। তিনি প্রতিবাদ করে বললেন, “শুধু চাকরিই নয়, মেয়েটা সব দিক দিয়েই ভালো। আমার আস্থা তৈরি হয়েছে ওর ওপর।”
“তুমি যে মেয়েটাকে ছোটোবেলা থেকে দেখেছো তার চেয়ে যে মেয়েটাকে বছরে একবার দেখো তাকে বেশি আস্থাশীল মনে হলো?”
“শিলা খুবই ভালো একজন মেয়ে।”
চাঁদনি বেগম গম্ভীর গলায় বললেন, “যার বিয়ে, যার সংসার তাকেই পছন্দ করে করতে দাও না, বড়ো বউ। জেদ করছো কেন? তোমার স্বামী কথা দিয়ে এসেছে, তোমার ছেলের মত আছে। এখানে আর কারো কিছু বলার থাকতে পারে না।”
তবুও আফিয়ার চোখে-মুখে কী যেন হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা। নিশান্ত একটি ছবি ধরল উনার চোখে সামনে। যেখানে দেখা যাচ্ছে শিলা ওয়েস্টার্ন আউটফিটে সেজে আছে। ককটেল পার্টিতে বন্ধুদের সঙ্গে মজে আছে। হাতে ওয়াইনের গ্লাসও দেখা গেল। চাঁদনি বেগম তা দেখা মাত্রই আভিজাত্যে টনটন করে উঠলেন,
“আমার আধুনিক যুগের দীপশিখা এতটাও আধুনিক হয়নি যে ওয়াইন হাতে পার্টি করাকে এপ্রুভাল দেব। বাড়ির ছেলে-মেয়েদের এমন শিক্ষা দেইনি আমি। কেউ করলে তাকে ঘাড় ধরে বের করে দেব। সেখানে বউ আনা তো অসম্ভব।”
নিশান্ত ধীরস্বরে বলল,
“শুধু এটার জন্য আমি ওকে খারাপ বলতে পারব না, দাদি। শিলা ভালো মেয়ে এ নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই৷ বাট নট মাই টাইপ। এতটা স্বাধীনচেতা আমি হতে পারিনি। পারবও না। বিয়ে, সংসার নিয়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত চাওয়া আছে যেগুলোর সঙ্গে শিলা ম্যাচ করবে না। বিয়ে যদি করি সংসারটা আমি মন দিয়েই করব। তবুও তোমাদের যদি আপত্তি থাকে তাহলে আমি মেনে নেব। সেক্ষেত্রে পুনরায় মনস্থির করতে আমার সময় লাগবে। কাজের ব্যস্ততাও বাড়বে। কবে বাড়ি ফিরব তার গ্যারান্টি দিতে পারব না।”
কথাটার সুক্ষ্ম ইঙ্গিত ধরতে পেরে আফিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলেন। এ বিয়ে না মানলে নিশান্ত বাড়িতে আসবে না! নিজের সিদ্ধান্ত তার কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ! নিশান্তের বাবা ও দাদি দুজনই সমস্তটা জানেন। আফিয়া এতটাই অগুরুত্বপূর্ণ যে উনাকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার পর জানানো হলো! তিনি এটা মানতে পারলেন না। কোনোরূপ বাক্যব্যয় না করে ঘরে চলে গেলেন। নিশান্ত হতাশ চোখে দাদির দিকে চাইল। মাকে এতটা অবুঝ ভাবেনি সে। চাঁদনি বেগম বললেন, “তার ইচ্ছেকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ইগোতে লেগেছে। সময় দে, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।”
ঠিক তখনই নিশান্তের ফোনে ম্যাসেজ এলো। ওপেন করতেই দেখল এক বাক্যে লেখা,
“আমি আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাই।”
“রজার দ্যাট।”
“এজ সুন এজ পসিবল প্লিজ!” পালটা রিপ্লাই আসতে দেরি হলো না। বিপরীত ব্যক্তিটির অস্থিরতা বোঝা গেল।
নিশান্ত উত্তরটা দেবার আগে কিছু কাজ করে নিল। কত জায়গায় ফোন করল। এরপর সুক্ষ্ম একটা হাসি ঠোঁটে এঁটে রিপ্লাই দিলো, “আগামীকাল সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে। প্রস্তুত হও।”
চলবে…