#প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩৩]
প্রভা আফরিন
মেহযাবীনকে পার্লারে নামিয়ে দিয়ে নিশান্তের গাড়ি ছুটেছে বনানীর পথে। মেয়েদের সাজগোজ শেষ হতে হতে বিকেল গড়াবে। এইটুকু সময়ে নিশান্তকে বেশ কয়েকটি কার্য সমাপ্ত করতে হবে।
বাড়িটা তিনতলা। আশেপাশের পাঁচ, দশতলা ভবনের সামনে এই উচ্চতা যেন নস্যি। শুধু তাই নয়, চাকচিক্যের দিক থেকেও মলিন। বাড়ির সামনে আয়রন রডের লম্বা একটি গেইট। তার মধ্যে আরো একটি পকেট গেইট। ভেতরে কারা কারা আছে বোঝা মুশকিল। নিশান্তের ইনফর্মার গত রাত থেকে বাড়ির আশেপাশে প্রহরায় ছিল। কে বের হয়েছে, কোথায় গেছে সমস্ত খবর সংগ্রহ করেছে। ইনফর্মার ছেলেটি কাজের বেশ। অল্পবয়স, নাম সালাম। রাত জেগে পাহারা দিয়ে সকালে যখন ঘুমে ক্লান্ত হয়ে সে চায়ের দোকানে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে চা নেয় তখনই দেখতে পায় নজরে রাখা বাড়ির নাইট ডিউটি করা দারোয়ান চা খেতে এসেছে। সালাম সচকিত হয়। একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা ধরায়। তার উদ্দেশ্য আলাপ জমানো।
“ভাই কি ঘুমান নাই? চোখ লাল হইয়া আছে।” সালাম চায়ে চুমুক দিয়ে খোশমেজাজে জিজ্ঞেস করল।
দারোয়ান লোকটি তিক্ত স্বরে বলল, “কুত্তার চাকরি করি বুঝলেন। রাইতে ঘুম হইব কেমনে?”
“মানে? শহরে এমন চাকরিও আছে নাকি?” সালাম কৌতুক করল।
দারোয়ান থু করে একদলা কফওয়ালা থুতু নিক্ষেপ করে পরিষ্কার পিচঢালা পথের সৌন্দর্য নষ্ট করল। সালাম তা দেখে ঘেন্নায় মুখ ফেরায়। বাঙালির যেখানে সেখানে কফ, থুতু ফেলার স্বভাব জীবনেও যাবে না। পথ যদি সোনায় মুড়িয়ে দেওয়া হয় তবুও হাঁটতে হাঁটতে কফ-থুতুর উপস্থিতি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলে ধরে নিতে হবে সেখানে বাঙালি নেই।
দারোয়ান লোকটি রয়েসয়ে জবাব দিলো,
“দারোয়ানের চাকরিরে আমি কুত্তার চাকরি মনে করি। সারা রাইত রাস্তার ধারে দারোয়ান আর কুত্তারা জাইগা থাকে।”
সালাম একটু বিরোধ করার চেষ্টা করল, “কথাটা ঠিক কইলেন না, ভাই। কোনো কাজকেই ছোটো করে দেখা ঠিক না। কামাই তো হারাম না।”
“কোনো কাজরে ছোটো কইরা দেখা ঠিক না এই কথা মিডিয়াতেই সুন্দর মানায়। বাস্তবে যদি মানুষ তাই দেখত তইলে এত ভেদাভেদ হইতো না। বড়োলোকের বাড়ির দারোয়ানের চাকরি কইরা দেখছি, হেরা আমাগো কুত্তার চোখেই দেখে। মানুষ ভাবলে আচরণ মাইনষের মতোই হইতো।”
সালাম দাঁত বের করে হেসে বলল, “কথায় একটু ভুল আছে। লোমওয়ালা কুত্তারে বড়োলোকেরা বিছনায় নিয়ে ঘুমায়। বিদেশি ফুড কিনে খাওয়ায়। কাশি দিলেও ডাক্তার দেখায়। দারোয়ানের সঙ্গে তা করে না।”
দারোয়ান রোগা লোকটি আরেকটু দুঃখী হয়ে উঠল। চায়ে চুমুক দেবার কথা ভুলে গেল। বলল, “তাইলেই বুঝেন আমরা হেগো চোখে কত নিচে।”
“ভাই মনে হয় কোনো কারণে রাইগা আছেন। আপনার মালিক কি কুত্তার মতো দুর্ব্যবহার করে নাকি?”
দারোয়ান লোকটি চোখ তুলে সরাসরি সালামের দিকে চাইল। সালাম একটু ঘাবড়ালো। দ্রুতই এগোলো নাকি! দারোয়ান সন্ধিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল, “আপনারে তল্লাটে আগে তো দেখি নাই। কাল রাইতে থাইকা দেখতাছি।”
সালাম হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিল দক্ষভাবে। বলল, “গেরাম থাইকা আসছিলাম শহরে কামের খোঁজে। কাম না হইলেও আঙ্গুরির লগে মোহাব্বর হইলো। হেই মাইয়া আমার টেকাপয়সা কচকচ কইরা খাইয়া এহন নতুন কারো সন্ধান পাইছে। তারেই খুঁজতাছি কাল থাইকা। হুনছি এই এলাকায় কার বাড়িত নাকি কাম নিছে। মাইয়া আস্ত বদমাইশ।”
সালাম চিন্তিত হলো দারোয়ান কথাটি বিশ্বাস করবে কিনা। আশ্বস্ত হলো যখন রোগা লোকটি বলল, “ও! মাইয়া মাইনষের কেস! এইসব টাউট মাইয়াগোরে ছাই দিয়াও ধরতে পারবেন না।”
“ভাই কইলেন না তো। মালিকের উপরে এত রাগ ক্যান? না মানে আমিও দারোয়ানের চাকরি করার বাসনা করতাছি। তাই কোন এলাকা কেমন জাইনা রাখা ভালো।”
“আর কইয়েন না। শালার মালিক বাড়িতে মাসে একবার আসে না। তার সব মেহমানের ডিউটি দেই। সেই মেহমানের পোলাপাইন এক একটা টাউট। সকালে একটায় আইলো। গেট খুলতে দেরি হইছে বইলা বাপ তুইল্যা গালি দিলো।”
সালাম আফসোস করে বলল, “এইরকম দুর্ব্যবহার সয়ে চাকরি করেন ক্যান?”
“দিনশেষে পেটই সব ভাই। তাছাড়া কইলাম না এরা মেহমান। আইবো। কয়দিন আমোদ ফূর্তি করব আবার যাইবোগা। কালকে একটায় আইছে। আজ তার পোলায় আইছে। ক্যাডা জানে কয়দিন থাকে।”
স্পিকারে সমস্ত কথাই শুনতে পেয়েছে নিশান্ত। বুঝতে পারে এখানে শুধু ফাহাদ হোসেন নয়, তার ছেলেও এসে উঠেছে সকালে। ছেলের ব্যাপারে নিশান্ত আগ্রহবোধ করল। তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। টার্গেট করা শিকারের আশপাশ সম্পর্কেও অবগত হওয়া ভালো। কোনো ফাঁকফোকর জুটে গেলে সহজেই প্রবেশ করা সম্ভব। সমস্যা হলো ওদের কারো ফোন নম্বর নেই। থাকলে র্যাবে কর্মরত বন্ধুকে দিয়ে সিম কোম্পানিতে যোগাযোগ করে ডিটেইলস বের করে আনতে পারত। কাজ আরেকটু এগোতো। নিশান্তের কাজ এখন শুধু অপেক্ষা করা। একটা সুযোগের অপেক্ষা।
দুপুরের ঠিক আগ মুহূর্তে কালো গেইটটির ভেতর থেকে গতরাতের প্রাডোটা বের হলো। নিশান্ত আশেপাশেই ছিল। খবর পেয়ে এসে ক্যাচ করতে অসুবিধা হলো না। গাড়িতে কে আছে নিশ্চিত না জেনেই পিছু নিয়েছে সে। অনেকটা অন্ধগলিতে হাতড়ানোর মতোই। দুটো সিগন্যাল পেরিয়ে গাড়িটা তেল ভরতে থামল। নিশান্ত তখনই নিশ্চিত হলো গাড়িতে ফাহাদ হোসেন নেই। কিছুক্ষণ আগে খবর পাওয়া সোর্সের তথ্যমতে এই অল্পবয়সী যুবকটি ফাহাদ হোসেনের ছেলে জিসান। যার মাধ্যমে একটা মাত দেওয়ার সুযোগ সে পেতে চলেছে।
______________
ব্রাইডাল মেহেদি পরার মতো ধৈর্য নিয়ে শোভা জন্মায়নি। চার ঘণ্টা ধরে থেমে থেমে যাবীন ও শাওনের দুইহাতে মেহেদি দেওয়া হয়েছে। এরপর মুখে স্পা ট্রিটমেন্ট নিয়ে মেকআপ করতে বসেছে। এর মাঝে শোভার অনেক কাজ শেষ হয়েছে। দুপুরে রান্না করা হয়েছিল স্ট্রিট ডগদের খাওয়ানোর জন্য। স্বেচ্ছাসেবী ছেলে-মেয়েরা মিলে সেসব বিভিন্ন স্থানে সাপ্লাই দিয়েছে। শোভার কাছে আপাতত স্কুটি নেই তাতে কী! বন্ধুর বাইক নিয়ে শহরে ছুটেছে। বাইক, স্কুটি বা যেকোনো যানবাহন চালানোর ওপরই তার দক্ষতা আছে। লেডি বাইকার হিসেবে কম্পিটিশনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বাড়ির সকলের কঠোর আপত্তিতে তা করা হয়নি।
শোভার সঙ্গে সর্বদা মেডিসিন থাকে। পথে ঘা-যুক্ত কুকুর, বিড়াল পেলে লেগে যায় ট্রিটমেন্ট দিতে। কামড়, নখের আঁচড়ের অগণিত দাগ তার দুই হাতে, পায়ে। ইনজেকশন নিতে হয় তার জন্য। তবুও থেমে থাকে না। কিছুদিনের মাঝেই ওদের র্যাবিস ভ্যাকসিনের কর্মকাণ্ড শুরু হবে। কুকুরের কামড় খেয়েও তাকে আদর করে পেছনে ছুটতে হয় তখন। ইনজেকশন পুশ করতে হয়। মেয়েটির এইসব দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড নিয়েই বাড়ির সবার ভয়।
শোভা দুপুরের পর বাইক ছুটিয়ে পার্লারে এলো। শাওনের হলুদের মেকআপ করা তখন শুরু হয়েছে। যাবীন বিরক্ত হয়ে দুই হাতের মেহেদি দেখছে। তালুতে আবার সুন্দর করে তার ও তার বদ স্বামীর নামের অক্ষর দিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে মেহযাবীনকে না জানিয়েই। ক্লান্তিতে এমনিতেই সে ঘুমঘুম ভাব নিয়ে দুইহাত মেলে বসেছিল। তখনই শাওন কারসাজিটা করেছে। কেউ দেখলে কী ভাববে! যাবীনের এখন প্রিয় বান্ধবীর মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে। নেহাৎ সে ভাইয়ার বউ। তার কিছু হলে ভাইয়া কষ্ট পাবে বলেই যেন দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নিচ্ছে ভাবির অত্যাচার। শোভা পার্লারে ঢুকেই হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিলো। হেনা আর্টিস্টকে ডেকে অস্থির গলায় বলল,
“আমার অত ধৈর্য নেই যে হাত ভরে মেহেদি দেব। আপনি শুধু আমার এক হাতের তালুতে ডিজাইন করে দেবেন। আমি যেভাবে বলব সেভাবে। ওকে?”
হাতের তালুতে সুন্দর করে মেহেদি পরল শোভা। টানা ইংরেজি শব্দে দিলশান নামটি লিখতে ভুলল না। এটা সে লিখল লুকিয়ে। হেনা আর্টিস্টকে চোখ টিপে বুঝিয়ে দিয়েছিল বলে রক্ষা। হলুদের অনুষ্ঠানে দিলশান সপরিবারে আমন্ত্রিত। সেখানে তাকে কীভাবে শায়েস্তা করবে সেই ফন্দিই আঁটছে মনে মনে। ব্যাটা শোভার সঙ্গে চালাকি করে! একবার বাগে পেয়ে নিক। ঘুমের ঘোরেও শোভাকেই দেখবে সে।
হলুদের সাজ শেষ হতে হতে বিকেল গড়াল। কনের সঙ্গে ফ্রিতে সেজেছে ফাইজা ও মিষ্টি। তবুও মিষ্টি বারবার সবুজ, হলুদ মিশেলে শাড়ি পরা যাবীনকে ঘুরে ঘুরে দেখে বলল, “শাওন আপুর চেয়ে কোনো অংশে কম হলো না মেহযাবীন আপুর সাজ। মনে হচ্ছে দুজনেরই হলুদ।”
শাওন হেসে বলল, “ধরে নে তাই।”
বিয়ের আয়োজনের জন্য কনভেনশন হল ভাড়া করা হয়েছে। এখান থেকে ওরা সরাসরি সেখানেই যাবে। যথা সময়ে নিশান্ত নিতে এলো ওদের। একে একে সকলে গাড়ির ব্যাকসিটে উঠে গেল। সামনের সিট অঘোষিতভাবে ফাঁকা রইল একজনের জন্য। মেহযাবীন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশান্ত আপাদমস্তক নিজের স্ত্রীকে দেখে নিল। আশেপাশের মানুষরাও মুগ্ধ চোখে দেখছে। নিশান্ত এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে তাকে দেহের আড়াল করে ফেলল। একপেশে হাসির আড়ালে অসন্তোষ লুকিয়ে বলল,
“বেয়াইন সাহেবা, মানুষকে সাজ দেখানো শেষ হলে গাড়িতে উঠুন। ভুলে যাবেন না আপনি সংরক্ষিত।”
হাসির আড়ালে লুকানো ধমক যেন মেহযাবীন বুঝতে পারল। তারচেয়েও বেশি বিহ্বল করল সংরক্ষিত শব্দটি। ক্রুর মেজাজে বলল,
“বেয়াই সাহেব, আপনার কী মনে হচ্ছে না আপনি একটু বেশিই কনসার্ন দেখাচ্ছেন আমার প্রতি?”
নিশান্ত জাদরেল হাসিটা দিয়ে চাপা গলায় বলল,
“একদমই না। আপনি নিজেকে নিয়ে সচেতন না হলে আমাকে যে হতেই হবে। আমার একমাত্র বৈধ বেয়াইন বলে কথা।”
চলবে…
(পর্বের বর্ধিতাংশ কাল বা পরশু)