#প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩৩-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন
শুভ্র শরতের শেষে গুটিগুটি পায়ে পদার্পণ করা হেমন্তের গায়ে লেপ্টে থাকা হিমগন্ধে রাতের আবহ স্নিগ্ধ হয়। তিরতির করে বয়ে যাওয়া নিশি হাওয়া জানান দেয় তুষার রাজ্য থেকে হিমকন্যা আসতে চলেছে প্রকৃতিতে। তার সাগরেদ শিশিরকে একটু আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় সবুজ ঘাসের ওপর জলবিন্দুর গালিচা পেতে তাকে বরন করার প্রস্তুতি নিতে। শহর হতে দূরে, যেখানে প্রকৃতির নিবিড় ছায়া বিছিয়ে থাকে বাংলার বুকে, সেখানে ইতিমধ্যে হেমন্ত তার ঘোমটা তুলে মুখদর্শন দিয়েছে। তেজি সূর্যটা সেখানে দুপুরের পর মূর্ছা যায়। সন্ধ্যা নামে প্রকৃতির নগ্ন গায়ে কাঁপন ধরিয়ে। বালক বালিকারা কাঁথা মুড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে ঘুমায়। শহরে সেই সুখ বড্ড ফিকে।
কনভেনশন হলের লোকে লোকারণ্য সমাবেশ ছেড়ে দোতলার নির্জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেহযাবীন হেমন্তের রাতে মনোনিবেশ করেছিল। সেখানেই সে তার জীবনের প্রথম কাজের আইডিয়া পেয়ে গেল। ডিউ ড্রপ! মেহযাবীন মায়ের ফ্যাশন ব্র্যান্ডের অধীনে শীতকালীন পোশাকের কালেকশন আনতে চলেছে। জীবনের প্রথম অফিশিয়াল পদক্ষেপ। শিশিরের প্রতি অপার মুগ্ধতা থেকেই তার প্রথম কালেকশনের নামকরণ করল ‘ডিউ ড্রপ’। ডিজাইনটা মানসপটে আপনাতেই নীহারের মতো জমতে শুরু করল। ইশ! নোটপ্যাডটা কেন যে হাতের কাছে নেই! মন বেচারা নিশপিশ করে উঠল। পরক্ষণেই কারো ডাক শুনে খেয়াল হলো সে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিনে অবস্থান করছে। ভাইয়ার গায়ে হলুদ। পুরো হলজুড়ে ভিড় করেছে শেখ ও আজাদ বাড়ির সকল আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষীরা। আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে জাওয়াদ ও শাওন। তাদের ঘিরে অসংখ্য লাইট, ক্যামেরা, সেলফি, ভিডিওর ছড়াছড়ি। বড়োদেরকে একত্রে নিয়ে হলুদের পর তরুণদের জন্য রাতভর গান-বাজনার আয়োজনও আছে। মৃদুলয়ে পিয়ানো বাজছে এককোণে। গমগম করা আবহের থেকে দূরে থাকতেই যাবীনের একাকী হেমন্তবিলাস। লোক সমাগমে আজও সে কম্ফোর্টেবল নয়।
স্নিগ্ধ শিশিরঝরা হেমন্তে বাউকুড়ানির মতো অনন্ত এসে চিন্তার সাম্রাজ্য খানখান করে দিলো। ভারী স্বরের অস্থির কণ্ঠে বলল, “কীরে ভাইয়ের বউ ভাবি! তুই আমাদের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?”
পালিয়ে বেড়ানোর কারণটা অনন্ত এই মাত্র আবারও করল। তাকে ভাইয়ের বউ, ভাবি ইত্যাদি বলে বারবার বিব্রত করছে। মেহযাবীন শব্দগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। যতবার কেউ তাকে বৈবাহিক সম্পর্ক মনে করাচ্ছে ততবার জংলী লোকটা তার মনের ভেতর ঢুকে উত্যক্ত করছে। বেয়াইন ডেকে তার ওপর খবরদারি করছে। যাবীন বিরক্ত মুখে জবাব দিলো, “ভাবি বলা বন্ধ না করলে দূরে থাকবি।”
“কেন? তোর কী ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে?”
অনন্তের আকস্মিক প্রশ্নে যাবীন কটমট করে চাইল। ফাইজা অনন্তের পিঠপেছন থেকে উঁকি দিয়ে বলল,
“বিয়ে একটা ছোঁয়াচে রোগ। কোনো যুবতীর বিয়ে হলে তার সমবয়সী বোন এবং বন্ধুদের মাঝেও তা প্রভাব বিস্তার করে। শুধু বিয়ে বিয়ে পায়।”
যাবীন তীব্রচোখে চাইতেই ফাইজা আবার বলল, “নয়তো দেখ না। শাওনের বিয়ে হলো। তার সঙ্গে থেকে তোরটাও হয়ে গেল। এখন আমারও বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে। শুধু পাত্রটা পাচ্ছি না।”
অনন্ত মাথা নেড়ে সায় দিলো, “দোস্ত, আমারও বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে।”
যাবীন বন্ধুদের দিকে চেয়ে হতাশ শ্বাস ফেলল। ফাইজাকে সকালে সত্যিটা জানানো হয়েছে। গোপনীয়তা রক্ষার কড়া হুকুমও দেওয়া হয়েছে। কে শুনবে কার কথা! ভরা হলের মাঝেও এরা মজা নিতে ছাড়ছে না। অনন্ত বলল, “চল, স্টেজে উঠবি। আমরা গ্রুপ ফটো তুলব। ফটোশুট বাকি।”
যাবীনের যেতে ইচ্ছে করছিল না। এমনিতেই একটু আগে রাজ্যের ছবি তুলেছে। লাইটের উজ্জ্বল আলোয় মাথা ধরে গেছে৷ তবুও সবার মন রক্ষায় রাজি হলো। চলে যাওয়ার সময় হুট করেই তার চোখ গেল হলের সামনের রাস্তায়। আবছায়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তিটাকে দেখে মুহূর্তেই তার দৃষ্টি বিস্ফোরিত হয়ে উঠল।
“আমিন!”
_______________
হলুদের নির্দিষ্ট ড্রেসকোড দেওয়া হয়েছিল। মেয়েরা পরবে গোলাপি রঙের শাড়ি। আর ছেলেরা পরবে কচি লেবুপাতা রঙের পাঞ্জাবি। দিলশান তার মায়ের সঙ্গে কচি লেবুপাতা রঙের পাঞ্জাবি পরে দাওয়াত এটেন্ড করতে এসেছে। হালকা রঙ তার পছন্দ কিন্তু এই রঙটা কেন জানি ভালো লাগছে না। তার মনে হচ্ছে নিজেকে ভীষণ বাজে দেখাচ্ছে। যেই ধারণা আদৌ সত্যি নয়। অবিবাহিত মেয়েদের নজরে এই অল্পবয়সী সুদর্শন ডাক্তার ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে। তবে দিলশানের মন বোধহয় অজান্তেই অন্য কারো দেখা চাইছিল। যাকে এখনো সে দেখেনি। দিলশান উপস্থিত অথচ শোভা মৌমাছির মতো উড়ে আসেনি! বিরলতম আশ্চর্যের ব্যাপার বটে।
দস্তগীর গিন্নি সুলেখার কথা বলাই বাহুল্য। পার্লার থেকে সেজে এসেছেন। সর্বদা যত্ন নেওয়া টানটান ত্বক, আধুনিক মেকআপের আঁচড়, ঘাড় অবধি খোলা চুল ও ছিপছিপে দেহের মাধুর্যে বয়সটা যেন আরো কম দেখাচ্ছে। অন্যদিকে দস্তগীর সাহেব থমথমে মুখ করে আছেন। কেননা হলে ঢুকতেই এক ছোকরা তাঁর স্ত্রীকে ভাবি গোছের কেউ ভেবে মশকরা করে সেরেছে। গোলাপ ও রজনীগন্ধার স্টিক দিয়েছে৷ সুলেখা মিষ্টি হেসে সেটা গ্রহণও করেছেন। তাতেই দস্তগীর সাহেব রেগে আগুন। ছোকরা নাহয় ভুল ভেবে ফুল দিলো, সুলেখা কেন নিল? সুলেখা প্রতিবাদ করে বললেন, “দেখো, তুমি আমার কদর না বুঝলেও পুরো দুনিয়া বোঝে। তারা জানে কীভাবে বিউটিকে ফুল দিয়ে সম্মান করতে হয়।”
দস্তগীর সাহেব গোফে হাত বুলিয়ে আক্রোশে বললেন, “হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার বউ এখন জাতির ভাবি হয়ে গেছে। আর আমাকে ডাকছে আংকেল। হতচ্ছাড়ার দল!”
“হতচ্ছাড়া বলছো কেন? তারা যা দেখছে, তাই ভাবছে। তুমি বুড়ো হয়ে গেছো। আমি হইনি।” সুলেখা গর্বের হাসি হাসলেন।
দস্তগীর সাহেব থমথমে কণ্ঠে ছেলেকে ডেকে বললেন, “শোন, তুই মিনিটে মিনিটে মাকে ডাকবি। উচ্চস্বরে ডাকবি। সমস্ত অতিথিরা যেন জানতে পারে এই মহিলা তোর মা।”
দিলশান হতাশ গলায় বলল, “প্লিজ! এটা আমাদের লিভিং রুম নয়। একটু তো সতর্ক হও। নয়তো আমি দূরে গেলাম তোমরা ঝগড়া করো।”
দিলশান সত্যিই দূরে সরে গেল। ঠিক তখনই মিষ্টি এসে পথরোধ করল ওর। বলল, “আপনি কী পাশের বাড়ির মতিচুর?”
“মানে?”
“হোয়াইট হাউজের ইংলিশ বয়?”
“কে তুমি? কী বলছো এসব?”
“আমি পেশেন্টপার্টি। শুনলাম আপনি নাকি ডাক্তার! আমার বোন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নিশ্বাস আটকে গেছে। এখন তখন অবস্থা। নিড ইয়োর হেল্প। এক্ষুনি আসুন। ওই যে রেস্টরুমের দিকটায়।”
মিষ্টির আতঙ্কিত মুখ দেখে দিলশান গুরুতর কিছু ভেবে বসল। সে সত্যিই পা চালিয়ে পিছু পিছু গেল। সর্বশেষ রেস্টরুমটায় ঢুকতেই আক্কেল গুডুম। ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেল। লোডশেডিং নাকি! এমন সনামধন্য একটা হলে জেনারেটর নিশ্চয়ই আছে। দিলশান মেয়েটিকে ডাকল। কোনো সাড়া নেই। রুমটা নিস্তব্ধ। দরজা খুঁজতে গিয়ে আরেকদফা ভড়কালো সে। বাইরে থেকে আটকে দেওয়া হয়েছে! দিলশানের কপাল বেয়ে ঘাম ছুটল। শক্ত থাবায় দরজা ধাক্কাল। তখনই বাইরের মিউজিক সিস্টেম লাউড হলো। তার দরজা ধাক্কানোর শব্দ চাপা পড়ল মিউজিকের বিটে। দিলশান স্থির হয়ে গেল। কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করল না। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বুকে দুই হাত গুজে সে থমথমে কণ্ঠে ডাকল,
“মিনি মনস্টার, ইফ আই এম নট রং ইউ মাস্ট বি ইনসাইড দ্য রুম।”
চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ হলো। পরিচিত কণ্ঠের মিহি সুর দিলশানের কানে এলো। অন্ধকারের বুক চিড়ে একটি দুষ্টু কণ্ঠ সুর করে গাইল,
“বাহার সে কোয়ি আন্দার না আ সাকে
আন্দার সে কোয়ি বাহার না যা সাকে
সোচো কাভি অ্যায়সা হো তো কেয়া…।।
হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হো
আওর চাবি খো জায়ে…।।”
দিলশান হতাশ শ্বাস ফেলে নিশ্চিত হলো সে শোভার ফাঁদে পা দিয়েছে। ফস করে একটা লাইটার জ্বলে উঠল৷ একটা মেহেদি পরা হাত আগুনের শিখা দিয়ে প্রদীপের সলতে জ্বালাচ্ছে। ঘিয়ে ভেজানো সলতে জ্বলে উঠল। সুগন্ধ ছড়াল রুমজুড়ে। শোভা প্রদীপটা মুখের সামনে তুলে ধরে মিষ্টি হেসে দৃঢ় সুরে বলল,
“অন্ধকারে আলোর তালাশ করো?
চেয়ে দেখো তোমার জন্য একবুক ভালোবাসার আলো কুড়িয়ে করেছি জড়ো।
বন্ধ ঘরে দরজা হাতড়ে বেড়াও!
অথচ আমার খোলা মনের দরজাকে তুমি অবহেলায় এড়াও।
পাষাণ কি তবে তোমাকেই বলে?
তুমি কী জানো? তোমার স্মরণে অহর্নিশ আমার প্রেমের প্রদীপ জ্বলে।”
চলবে….