প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩৪] প্রভা আফরিন

0
406

#প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩৪]
প্রভা আফরিন

দিনের সবচেয়ে রঙিন ক্ষণ হলো গোধূলি। সূর্য ডোবার আগমুহূর্তে প্রকৃতিতে অদ্ভুত রঙবাহারের দেখা মেলে। পশ্চিমাকাশ সেজে ওঠে লালচে, কমলাটে, ধূসরশুভ্র রঙে। কবি সে রূপ দেখে রচনা করে প্রেমের মিলনাত্মক পঙক্তি। শিল্পীর তুলি প্রাণ সঞ্চার করে ক্যানভাসে। প্রেমাবেগে পূর্ণ মানুষের কাছেও সেই ক্ষণের বিশেষ একটি নাম আছে। ‘কনে দেখা আলো’। সেই আলোয় কত পুরুষের মন চুরি হয়, কত প্রেমের সূচনা ঘটে সে হিসেব রাখে শুধু বহমান হাওয়া।
এই ক্ষীণ আলোর বন্ধ ঘরে হাওয়া বইছে না। রঙবাহারের মেলা বসেনি। তবুও দিলশান নিষ্কলুষ দৃষ্টিতে প্রদীপের যে রং, রূপ, ঔজ্জ্বল্য দেখল তাকে মনে করল ‘কনে দেখা আলো’। এক টুকরো কমলাটে শিখা অন্ধকার ক্যানভাসে একটি নারীরূপ ফুটিয়ে তুলেছে। যে দিলশানের চোখের অলক্ষ্যে রয়ে গেছিল এতকাল। কিংবা সে ইচ্ছে করেই সরিয়ে রেখেছিল। ওর চশমার ভারী কাচে মেয়েটির প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল। ফুটে উঠল চোখের তারায়।

শোভা প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রসাধনবিহীন মুখশ্রীতে আজ যত্ন করে মেকআপ করা হয়েছে। মিনিমাল সাজ। গালে হালকা ব্লাশ, ত্বকের উচ্চ পয়েন্টগুলোতে হাইলাইটারের চিকচিকে আভা। সদা চঞ্চল চোখে লাইনারের সরু টান দৃষ্টিকে আরো বাঙময় করেছে। বাকপটু ঠোঁট নিজের দুষ্টুমি আড়াল করেছে পিচি ন্যুড শেডের লিপস্টিকের আড়ালে। খেয়ালি, ছন্নছাড়া চুলে গুজেছে টকটকে গোলাপগুচ্ছ। দুই হাতের চুড়িরা আজ বাদ্যযন্ত্র হয়ে উৎপন্ন করছে রহস্যময় এক বাজনা। সেই বাজনায় কারো মন বাঁধা পড়ে কী! কানের লম্বা দুলের সঙ্গে কারো মনও দোলে কী! খোপায় গোজা ফুলের মতো সুবাস ছড়ায় কী কারো হৃদয়ে! কিংবা সেই হাতের রাঙা মেহেদি, যাতে মিশে আছে আবেগের সবটুকু রং, তাতে কী অনুভূতিরা খোলস ছেড়ে জলকেলি করতে নামে! শোভা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিলশানের মুগ্ধ চোখের দিকে চেয়ে সে ঠোঁট টিপে হাসল। সেই হাসি তার মুখশ্রীতে যোগ করল শিশিরভেজা শিউলি ফুলের পেলবতা। জিজ্ঞেস করল,
“পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?”

দিকভ্রান্ত পথিক এবার নিজ কক্ষপথ ফিরে পেল। তবুও মুছল না মুগ্ধতার রেশ। লুকানোর চেষ্টাও করল না। সত্যিটা স্বীকার করতে কার্পণ্যও করল না সে,
“তুমি কী সত্যিই শোভা? সেই টমবয় শোভা, যাকে সারাক্ষণ অলিতে গলিতে দাদাগিরি করতে দেখা যায়? নাকি কোনো কূহক, যে শুধুই ভ্রমে ফেলছো।”

“যদি বলি শোভার ভূত, তাহলে কী প্রেম করবেন? প্রেম করে দেখতে পারেন। ভূত হলেও প্রেমিকা হিসেবে আমি মন্দ হবো না।”
বলেই শোভা চোখ টিপল।

“আমার মনে হয় ভূতের চেয়েও শোভা বেশি ডেঞ্জারাস। তার মতো নিপুণভাবে ঘাড়ে চেপে বসার দক্ষতা ভূত জাতিরও নেই। তাই নিজেকে ভূত বলে অবলা ভূত জাতির অপমান কোরো না।”

অপমানটা বুঝতে পেরে শোভা ঠোঁট ফোলালো। দুচোখে অভিযোগের পশরা মেলে বলল, “তবুও শোভাকে ভালোবাসা যায় না?”

এই নির্দোষ অভিযোগের বিপরীতে রূঢ় কিছু বলার ভাষা আজ দিলশানের জানা নেই। মেয়েটিকে রাগাতে তার ইচ্ছে করছে না। কোমল সুরে বলল, “শোভার কী ভালোবাসার অভাব?”
“একটা শানের অভাব।”

কোনো নারীর আরাধ্য হতে পারা সেই পুরুষটির জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। কত পুরুষের মনে ক্ষত জমে থাকে নারীর আরাধ্য হবার বাসনায়। কত পুরুষ বেখেয়ালি হয় অবহেলায়। অথচ শান একটি কৈশোর পেরোনো মেয়ের সবচেয়ে নির্মলতম, সরলতম আবেগ পেয়েছে বিনা প্রচেষ্টায়। সেও তো একজন সুস্থসবল, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। তার অনুভূতিগুলো ঘুমন্ত নয়। একটি মেয়ে আদুরে বিড়ালছানার মতো ক্রমাগত তাকে ভালোবাসার আহ্বান করছে, তার মনের সক্ষম অনুভূতিগুলো কী তাতে লণ্ডভণ্ড হয় না! দিলশান স্মিত হেসে বলল,
“তোমাকে সুন্দর লাগছে।”
“শুধুই সুন্দর?”
“একটু আগে যে চরণগুলো আবৃত্তি করলে, সেটাও সুন্দর ছিল। কবি শোভানন্দ আজাদকে আমার প্রশংসা জানিয়ো।”
“অর্থাৎ আপনি শুধুই শ্রোতার মতো শুনলেন? অনুভব করলেন না?” শোভার মুখভঙ্গি কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।

দিলশান আবারো নিষ্পাপ হাসলো। এবার শোভা নিজের ধৈর্য বহাল রাখতে অক্ষম হলো। কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়ার মতোই ফুঁসে উঠে এগিয়ে এলো সে। খ্যাঁকিয়ে উঠে বলল,
“এই ব্যাটা এই! আমি সেই দুপুর থেকে হাতে মেহেদি পরে, ভারী সাজ সেজে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলাম আপনাকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাব বলে? ব্যাপারটা খুব সিলি লাগছে না?”

দিলশান লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, “আজকের তুমিটা সত্যিই মুগ্ধতা চয়নকারী। বাট গার্ল, মুগ্ধতা আর ভালোবাসা এক নয়।”
“মুগ্ধতা থেকেই ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।”
“সেই মুগ্ধতা হতে হয় ন্যাচারাল। আর্টিফিশিয়াল বিউটি দিয়ে শুধু মুগ্ধই করা যায়। মন জয় করতে চাই সৌন্দর্যের নিজস্ব স্বকীয়তা। কোনো ভান কিংবা ছদ্মবেশ নয়। আর আমি কোনো দ্বিমত ছাড়াই বলছি তুমি তোমার নিজস্বতায় অনন্য। সেই সৌন্দর্যের কাছে এইসব সাজগোজ ম্লান। তবে হ্যাঁ, সাজটা তোমাকে সত্যিই নারীসুলভ একটা কোমলতা দিয়েছে। মাঝে মাঝে শাড়ি, লেহেঙ্গা, সালোয়ার কামিজ পরা কিন্তু মন্দ নয়। তাতে একঘেয়েমি কাটে। নিজেকে নানাভাবে আবিষ্কার করা যায়।”

শোভা পুলকিত হলো দিলশানের কথায়। সত্যি বলতে তার এই সাজগোজের ফলে সৃষ্ট রূপ যদি দিলশানকে বিগলিত করত শোভা মনে মনে আহতই হতো। ভাবত আর পাঁচটা পুরুষের মতোই নারীর রূপই তাদের মন ভোলাবার মূলমন্ত্র। দিলশান তার দৃঢ় বক্তব্যে প্রমাণ করে দিলো শোভা ভুল কারো প্রতি দুর্বল হয়নি। দিলশান তার নিজস্বতায় আরো বেশি আকর্ষণীয় এক পুরুষ। শোভা আর কোনো প্রশ্ন করল না। রুমের বাতি জ্বেলে দিলো। উজ্জ্বল আলোয় দিলশান এবার শোভাকে পরিপূর্ণরূপে দেখল। গোলাপি রঙের ফ্লোরাল বার্বি লেহেঙ্গায় তাকে যেন বার্বি ডলের মতোই লাগছে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে শোভা তার হাত মেলে ধরল দিলশানের চোখের সামনে। গাঢ় রঙের ইংরেজি অক্ষরে দিলশানের নামটা ওর পেলব হাতের তালুতে সযত্নে ফুটে আছে। দিলশান চোখ কপালে তুলে বলল,
“করেছো কী! কেউ দেখলে?”

শোভা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“দেখলে দেখবে। আমি থোরাই কাউকে ডরাই!”

“সাধে তোমায় ডেঞ্জারাস বলি! বদনাম করার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছো। একটা জনবহুল হলের রেস্টরুমে তুমি আমাকে আটকে দিয়েছো। কেউ যদি ঘূণাক্ষরেও টের পেয়ে যায় কেলেঙ্কারি হবে।”

“ভালোই হবে বলুন। একটু চ্যাঁচামেচিও করা যায়। তাহলে লোক জড়ো হবে। এরপর বড়ো বোনের গায়ে হলুদের রাতে ছোটো বোনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এমনিতে তো আপনি আমাকে পেছনে ঘুরিয়ে মজা নেবেন। তারচেয়ে বিয়ে হয়ে যাক।”

“আর মানসম্মান ভেসে যাক!”

“গেলে যাক ভেসে সব মান। তবুও তোমাকেই চাই জান।”

দিলশান কেশে উঠল। মেয়েটির হাবভাব সুবিধার লাগছে না। কখন কী করে বসবে ঠিক নেই। তার বিবেক এখানে থাকতে সায় দিচ্ছে না। দিলশান বোঝানোর চেষ্টায় বলল, “দরজাটা খুলে দিতে বলো। তার আগে বাতি নেভাও। কেউ যেন বুঝতে না পারে রুমে তুমি, আমি দুজনে ছিলাম। তুমি আগে বের হবে। পথ ক্লিয়ার করে আমাকে ইশারা দেবে।”

শোভা না শোনার ভান করে হাই তুলে চেয়ারে বসে পড়ল। কোমরে হাত রেখে বলল, “তো কী যেন বলছিলেন গতকাল? কলরেকর্ড ফাঁস করবেন? এমনিতেও আপনি রেকর্ড ফাঁস করলে আমি ফেঁসে যাব। একা আমার বদনাম হবে। তারচেয়ে আজ দুজনেই বদনাম হয়ে যাই। শোভা বদনাম হুয়ি ডার্লিং শানকে লিয়ে…”
শোভা সুর করে আবারো গান ধরল।

দিলশান অস্থির ভঙ্গিতে শোভার সামনে বসল। বিপন্ন সুরে বলল, “আরে কীসের রেকর্ড! আমি ওসব কিছুই করব না। তোমাকে জব্দ করতে এমনিই বলেছি।”

“আমার সঙ্গে চালাকি করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া! বিয়ে হয়ে গেলে আপনার গাড়িটা আমারই হয়ে যাবে বলুন?”

দিলশান হতাশ গলায় বলল, “শোভা প্লিজ!”

শোভা ম্লান হাসল, “শান, আমি আপনার জীবনে জুলুম ছাড়া কিছুই নই, তাই না?”

দিলশান কোনো জবাব দিলো না। শোভার এই কণ্ঠস্বর তার অচেনা লাগল। যেন কোনো পরাজিত সৈনিকের সুর। শোভা হাই তুলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পুনরায় বলল, “আজ আমি একটা ফাইনাল ডিসিশন নিতে চাইছিলাম। নিয়ে ফেললাম।”

দিলশান অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী সেটা?”

“আপনাকে নিষ্কৃতি দিলাম। আপনার লাইফ আজ থেকে শোভা ফ্রি। আমি আপনার রাস্তা কাটব না। আপনি কাটলে না দেখার ভান করে থাকব। আর আপনি তো এমনিতেই অন্ধ। যাইহোক, আমাদের শেষ বৈঠককে স্মরণীয় করতে আমি একটি ছোট্ট দুঃসাহসিক কাজ করতে চলেছি। আগেই সরি।”

দিলশান স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

চলবে…
আমার ধৈর্য এটুকুই। এক পর্বে সবাইকে চাইলে সপ্তাহে একটা পর্ব দেব বিশাল বড়ো করে। সবাইকে পাবেন। নতুবা ছোটো ছোটো করেই মেনে নিতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here