প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৭]
প্রভা আফরিন
আশরাফুল আজাদের ছোটো ভাই শহিদুল আজাদ। দুটি কন্যার জনক তাঁর ছোটো মেয়ের জন্মের কিছুদিন পরই সড়ক দুর্ঘটনায় পরলোক গমন করেছেন। শিরীন বেগম তখন থেকেই দুটো মেয়েকে বুকে আগলে শ্বশুর বাড়ি পড়ে আছেন। উহু, কারো ঘাড়ে চেপে থাকেননি। মানুষটা তিনি একটু বদরাগী ও বোকা গোছের হলেও কর্মপটু ও আত্মসম্মানী নারী। ছাত্রাবস্থায় বিয়ে করে দ্বীপশিখায় পা রাখলেও লেখাপড়া থামাননি। শ্বশুর বাড়ির কেউও উনার পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটায়নি। চাঁদনি বেগম মানুষটা অনেকটা নারিকেলের মতো। ওপরে শক্ত খোলস থাকলেও মনটা নরম। তিনি বউমার সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটিতে লেগে থাকলেও পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারে বাঁধা দেননি। বরং তিনি চান বাড়ির মেয়ে-বউরা সংসারের বাইরেও কিছু করুক। শিরীনের পড়াশোনা শেষ করতে করতে শাওনের জন্ম হয়৷ শোভার জন্মের পর আকস্মিক স্বামীকে হারালে তিনি কারো ঘাড়ে বোঝা না হতে চাকরিতে জয়েন করেন। বাচ্চা সামলাতে বিশেষ ঝামেলা উনাকে পোহাতে হয়নি। এ বাড়ির সব বাচ্চাই চাঁদনি বেগমের কোলেপিঠে চড়ে বড়ো হয়েছে। তাই নাতি-নাতনিদের ওপর উনার খবরদারিটাই যেন একটু বেশি। বিশেষ করে বাড়ির সবচেয়ে ঘাড়ত্যাড়া সদস্য শোভার ওপর। নাতনির সমস্ত ইচ্ছে-আবদার যেমন তিনিই পূরণ করেন তেমনই ইচ্ছেতে বাগড়াও তিনিই দেন।
সকাল থেকে শোভা ঘ্যানঘ্যান করছে স্কুটির চাবি দিতে। আপুর বিয়ে উপলক্ষে এক সপ্তাহ আগেই সেটা জিম্মি করেছিলেন চাঁদের বুড়ি। বিয়ে শেষ হলেও আর ফেরত দেননি। আজ আবার শেখ বাড়িতে দাওয়াত আছে। শাওন ও নতুন জামাইকে এ বাড়িতে আনা হবে। পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক ওয়েডিং রিসেপশনের তারিখ ঠিক হবে। বিয়ের পর এইসব আনা-নেওয়া অনুষ্ঠান শোভার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। তারচেয়ে পথের ধারে বসে দুটো বিড়ালকে আদর করতেও ঢেড় বেশি আনন্দ। নাতনি যে আজ ফাঁকি দিতে পারে সেই ধারণা চাঁদনি বেগম রাখেন বলেই চাবিটা দিচ্ছেন না। মেয়েটির মাঝে সামাজিকতা কম। ডোনেশনের লোভ দেখিয়ে বিয়েতে বেধে রেখেছেন। এখন স্কুটির চাবি আটকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাখার পায়তারা করছেন। শোভা নিজেও সেসব ভালোমতো টের পায়। তাই জেদটাও বেড়েছে কয়েক গুণ। সকালে নাশতা করতে বসে ও হাত গুটিয়ে আছে। আফিয়া ঘিয়ে পরোটা ভেজে দিয়েছেন। সুগন্ধে ম-ম করছে পুরো খাবার ঘর। অথচ ভোজনরসিক শোভা আঁড়চোখে দেখে দেখে মুখ ফেরাচ্ছে। শিরীন মেয়ের গোমড়া মুখ দেখে বললেন,
“তোর আবার কী হলো? খাচ্ছিস না কেন?”
শোভা যেন কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন পেয়েছে। গলা উঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলল, “আজ আমি খাব না। অনশন করছি, অনশন।”
শিরীন অবাক হলেন। আবার কোন নাটক শুরু করছে এই মেয়ে সাত সকালে! বললেন,
“কীসের দাবিতে অনশন?”
“হেড অফ দ্যা হোম মিনিস্ট্রির কাছে দাবি আমার একটাই, স্কুটারের চাবিটা যথাযথ ফেরত চাই।”
চাঁদনি বেগম যেন শুনেও শুনলেন না। নিরবে খই-দুধ দিয়ে নাশতা সাড়ছেন। নাতনি অনশন করছে শুনে ইচ্ছে করেই সুড়ুৎ সুড়ুৎ শব্দ করে দুধে চুমুক দিচ্ছেন। শোভা লোভাতুর চোখ চাইল। সকালের দৌড়াদৌড়ির পর আপনাআপনিই খিদে চড়চড় করে ওঠে। তারওপর দুধ ওর প্রিয় পানীয়। নিজে খায় সে জন্য নয়। বরং নিজের নাম করে নিয়ে বিড়ালকে খাওয়ায়। একটি গর্ভবতী বিড়াল উদ্ধার করেছিল দুই সপ্তাহ আগে। চারটে সাদা-কালো বাচ্চা হয়েছে। মা বিড়াল অসুস্থ থাকায় সেগুলোকে ফিডারে করে দুধ খাওয়াতে হয়। শোভা মনে মনে ঠিক করে নিল কাকিমাকে বলে ঘর থেকেই দুধ নিয়ে যাবে৷ কেনা দুধের চেয়ে বেশি ভালো। দাদির কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে শোভা ক্ষেপে গেল। বলে উঠল,
“যারা কথা দিয়ে কথা রাখে না তাদের সব চুল পড়ে যাক। মাথায় হোক ফকফকা টাক।”
কথার প্রতিক্রিয়া হলো দ্রুত। চাঁদনি বেগম চশমাটা নাকের ওপর থেকে ঠেলে চোখে তুললেন। একপেশে হেসে ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললেন,
“তাহলে তো তোর চুলই আগে পড়বে। কয়টা কথা ঠিকঠাক রাখিস শুনি? এরপর টেকো মেয়েকে কেউ বিয়ে নেবে না।”
নিজের শব্দবাণ নিজের দিকেই ফিরে আসায় শোভা মর্মাহত হলো। একটু নরম স্বরে বলল,
“তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারো না। এবার আমি তোমার সব কথা শুনেছি। বলো শুনিনি? এরপরেও কেন তালবাহানা করছো?”
“তুই কথা শুনলে আমিও কথা রাখব। এত তাড়া কীসের! আজ রাতে চাবি পেয়ে যাবি।”
“ইম্পসিবল! আমার আজ কতগুলো জায়গায় যাওয়ার কথা৷ চাবি এখনই লাগবে।”
চাঁদনি বেগম গা ছাড়াভাবে বললেন,
“তাহলে বরং আজ ফাস্টিং কর। মাঝে মাঝে ফাস্টিং করা শরীরের জন্য উপকারী।”
শোভা রাগে হাত-পা ছোড়ে। অবাক হয়ে দেখে সবাই ওকে ছাড়াই খেয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ ব্যর্থ ক্ষোভে চেয়ে থেকে এরপর হুমকি দেয়,
“আমি কিন্তু চুল কেটে ফেলব।”
মোক্ষম হুমকি! শোভার চুল সব সময় কাঁধ অবধি পড়ে থাকে। যত্ন করতে জানে না বলে ছোটো থেকেই এভাবে রাখা হতো৷ ছোটো চুল ও দাদাগিরি ভাবের ফলেই টমবয় বলে পরিচিত পেয়ে গেছিল। ইদানীং চাঁদনি বেগম চাইছেন শোভার চুল বড়ো হোক। মেয়েসুলভ চলাফেরা আসুক। তিনি নিজেই নাতনির ত্বক ও চুলের যত্ন করবেন। সেই কথার ফলশ্রুতিতেই কাঁধ ছাড়িয়ে ছয় ইঞ্চি বেড়েছে চুলের দৈর্ঘ্য। তবুও চিন্তায় থাকেন আবার কবে না জানি সেলুনে ঢুকে শর্ট লেয়ার কাট দিয়ে আসে৷ তিনি খ্যাঁকিয়ে উঠে বললেন,
“তোর কপালে দুঃখ আছে, শোভা।”
“সাতসকালে এত দুঃখ কেন?” নিশান্তের আগমন ঘটল খাবার টেবিলে। জিম থেকে বেরিয়ে সদ্য গোসল করে নেমেছে। শ্যামলা দেহ সতেজ, চনমনে দেখাচ্ছে। তার মুখপানে চেয়ে শোভা চুপসে গেল। চাঁদনি বেগম যেন হাতিয়ার পেয়ে গেলেন। বললেন,
“তোদের আহ্লাদী বোন আজ অনশন করছে। সে নাকি খাবে না।”
“কারন?” নিশান্ত এক ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল।
“তার স্কুটির চাবি লাগবে। পেলেই সারাদিনের মতো পালাবে।”
নিশান্ত চুপচাপ শুনল। এরপর শোভার পাশেই চেয়ার টেনে বসল। শোভা তখন ঠোঁট টিপে ভাবছিল ভাইয়ার প্রতিক্রিয়া স্বপক্ষে হবে নাকি বিপক্ষে৷ কিন্তু নিশান্ত ওকে অবাক করে দিয়ে ঘি পরোটার প্লেট টেনে নিল। এক টুকরো ছিঁড়ে বোনের মুখের সামনে ধরল। ইশারায় হা করতে বলল। শোভা কাঁদো কাঁদো হয়ে চায়। মাথা নেড়ে বোঝায় সে খেতে চায় না। নিশান্ত একটু তীক্ষ্ণ চোখে চাইতেই মিইয়ে গেল। হা করে টুপ করে খাবারটা গিলে নিল। চাঁদনি বেগম হেসে বললেন,
“পড়েছো মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।”
তিনি চলে গেলেন। নিশান্ত খাইয়ে দিতে দিতে নমনীয় স্বরে বোঝাল, “চাবি দুপুরের পর পাবি৷ তার আগে বড়োরা যা বলছে শুনতে হবে।”
“কিন্তু ভাইয়া…” শোভা প্রতিবাদ করতে চাইছিল। নিশান্ত সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই বলল,
“শাওন যখন দেখবে বোনকে আনতে তুই যাসনি মন খারাপ করবে না? তুই তাই চাস?”
শোভা মুখ নামিয়ে নিল। আলতো করে মাথা নেড়ে বোঝাল সে চায় না। দুপুরে সে অবশ্যই শেখ বাড়িতে যেত। কিন্তু তার আগে কয়েকটা জায়গায় ঢু মেরে আসত। ভাইয়ার মুখের ওপর আর তা বলল না। অনেক দিন পর পর বাড়ি আসে বলে ভাইয়ের অবাধ্য ওরা হতে চায় না৷ এই মানুষটার যেমন রাগ তেমনই কঠোর অভিমান। সহজে ভাঙে না। এতগুলো বছর সে নমুনা দেখেই তো বড়ো হলো।
অনন্ত খেতে বসে অর্ধেক শেষও করে ফেলেছে। ভাইয়াকে খাইয়ে দিতে দেখে তারও একটু ন্যাকামি করতে ইচ্ছে হলো। হাত গুটিয়ে বলল,
“আমারও আজ অনশন।”
নিশান্ত বাঁকা চোখে দেখল ভাইকে। ছেলেমানুষী এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এরপর ঘাড় নেড়ে পাত্তা না দেওয়ার সুরে বলল,
“ওকে! হ্যাপি অনশন।”
অনন্ত আহত চোখে চেয়ে বলল, “এ কেমন দ্বিমুখীতা!”
শোভা ফিক করে হেসে ফেলল।
____________
দেড়খানা পরোটা খেয়ে ভাইয়ের থাবা থেকে ছাড়া পেয়েছে শোভা। বেলা তখন নয়টার ঘর ছাড়িয়েছে অনেকক্ষণ হলো। মাথার ওপর ঝকঝক করছে মেঘশূন্য আকাশ। বাড়ির বাইরে আসতেই দুটো লালরঙা কুকুর ছুটে এলো শোভার দিকে। একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে শুরু করল। শোভা হাসল দেখে। দুই বছর বয়স কুকুর দুটোর। জন্ম থেকেই শোভার চেনা। নিজেরসহ আশেপাশের এলাকায় কোনো কুকুর বিড়াল জন্মালেও কী করে যেন খবর পেয়ে যায় ও। কোনো আত্মীয়ের নতুন বাচ্চা দেখতে যাওয়ার যেমন আনন্দ, তেমনই করে ও ছানাদের দেখতে যায়। এই একই চেহারার দুই কুকুরকে ও নাম দিয়েছে লাউ ও কদু। যেই শোনে কপাল কুচকে বলে,
“আজগুবি নাম!”
শোভা মানুষটাও আজগুবি। নামেও নাহয় কিছু প্রকাশ পাক। দুইজন বডিগার্ড নিয়ে ও টঙয়ের দোকানে গেল। দুটো রুটি কিনে খেতে দিল। তখনই শোভার নজর গেল গলায় হাড়ের ডিজাইনের বেল্ট ঝোলানো ধবধবে কুকুরটির দিকে। ভাবল ছাড়া পেয়ে বাইরে চলে এসেছে। একাকি পেয়ে একটু ভাব জমানোর নিমিত্তেই শোভা আরেকটা রুটি কিনে চুকচুক করে টফিকে ডাকল। টফি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বটে কিন্তু মোটেও এলো না। লাউ ও কদু দুজন শোভার প্রতি কোমল হলেও এলাকার ডেঞ্জারাস পার্টি। টফিকে তারা সহ্যই করতে পারে না। বেচারা যে ভয়েই দূরে আছে বুঝে শোভা নিজেই এগিয়ে গেল। রুটি ছিঁড়ে মুখের সামনে ধরল। টফি তা শুকে যেই না মুখে দিতে যাবে অমনি বেল্টে টান পড়ল। পাশ থেকে একটি ভারী স্বর সতর্ক করে বলে উঠল,
“এইসব রুটিতে ইস্ট আছে। ইস্ট জাতীয় খাবার টফিকে খাওয়ানো নিষেধ।”
শোভা চকিতে পাশ ফিরে চাইল। হাত দুই দূরেই এসে দাঁড়িয়েছে লম্বাটে যুবক। পাতলা ফ্রেমের চশমার ওপারে জ্বলজ্বল করছে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। শোভা বিবশ চোখে চাইল। হাত নেড়ে বলল,
“হাই দিলশান! আপনাকে দেখে আমার হৃদয় হলো খান খান।”
চলবে…