#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ২৪
“মধ্যরাতে পাহাড়ি দ স্যুদের সাথে মুখোমুখি সং ঘর্ষ হয় বাংলাদেশ সেনাসদস্যের।একপর্যায়ে সেনাসদস্যরা দস্যুূদের চারিদিক থেকে ঘেরাও করতে নিলে তারা বো মা হামলা করে।ফলে ঘটনাস্থলেই মা রা যায় অনেক দস্যু এবং সেনাসদস্য।নিহতদের চেহারা শনাক্ত করা যায় নি।মৃতদেহ ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।তবে ঘটনাস্থল থেকে মেজর মেহরাদ সাদাফের ইউনিফর্মের ব্যাডজ্ পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে,মেজর মেহরাদ সাদাফ ঘটনাস্থলেই মা রা গিয়েছেন……”
বাকিটা আর শোনা হলো না স্রোতের।এর আগেই হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়।মস্তিষ্ক যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চারিদিক কেমন ঘুরছে,অন্ধকার লাগছে।ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু।শরীর যেনো তার ভার ছেড়ে দিলো।মাথাটা খুব জোরে কোনো শক্ত কিছুর উপর পড়লো।চোখ নিভু নিভু অবস্থায় দেখলো তার দিকে সবাই দৌড়ে আসছে।তারপর সবটা অন্ধকার।
আকাশে কালো মেঘের আবরণ পড়ে গেছে।এই রৌদ্রময় দিনটাকেও ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগছে।চারিদিকে এলোমেলো বাতাস বইছে।প্রকৃতি তার বিরূপ প্রভাব ফেলছে।প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে।স্রোত কাঁদছে, বাড়ির সবাই কাঁদছে। বনলতা বেগম একটু পরপর বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছেন।স্রোত না পারছে উনাকে সামলাতে,না পারছে নিজেকে সামলাতে। আকাশের যেনো আজ বাঁধ ভেঙ্গেছে।সেও স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁদছে। থামার কোনো নামই নেই।এর মধ্যেই এম্বুলেন্সের আওয়াজ শোনা গেলো।মাত্রই বাড়ির সামনে এসে থামলো যেনো।স্রোত তখনই দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো।তার পেছন পেছন ছুটলো মান্ধবী, মাহিরা আর নয়না।মেয়েটাকে আটকানো তাদের উদ্দেশ্য। স্রোত থামলো এম্বুলেন্সের সামনে।ঝড় তার তান্ডব সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছে।কয়েক মুহুর্তের মধ্যে ভিজিয়ে দিলো সবাইকে।স্রোত দেখলো দুজন লোক স্ট্রেচারে করে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা মৃতদেহ বের করলো।তার পা গুলো যেনো ওখানেই আটকে গেছে।এর মধ্যেই মান্ধবী, মাহিরা ওকে ধরলো।মৃতদেহ বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।স্রোত সবটাই অবলোকন করছে।সে যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে।গলায় শব্দরা আটকে যাচ্ছে।অনেক কষ্টে সে তাদের থামতে বলে নিজেকে ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে স্ট্রেচারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা হাতে মৃতদেহের মুখ থেকে সাদা কাপড়ের খানিকটা অংশ সরায়।মেহরাদ চোখ বুঝে আছে।স্রোতের মনে হলো সে ঘুমোচ্ছে। কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সে।বৃষ্টির ফোঁটাগুলা সুদর্শন পুরুষের চেহারা দখল করে নিলো।তবুও মানবের ঘুম ভাঙ্গার নাম নেই।স্রোত চিৎকার করে উঠলো,
“মেহরাদ….”
সাথে সাথেই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলো স্রোত।নিজেকে বনলতা বেগমের বিছানায় আবিষ্কার করলো।মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।বুঝতে পারলো এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে।তার গা জ্বরে পুরে যাচ্ছে তবুও চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার।মাথা চেপে ধরে রাখলো।নিজেকে ধাতস্থ করতেই সব ঘটনা মনে পড়লো। হাস ফাঁস লাগছে।স্বপ্নটা তো সত্যি হয়ে গেলো।মেহরাদ নেই,সে চলে গিয়েছে।আর ফিরবে না।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে।আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো তার এক পাশে মান্ধবী অন্য পাশে বনলতা বেগম বসা।পায়ের কাছে মাহিরা বসা।স্রোতকে উঠতে দেখেই মাহিরা বেরিয়ে গেলো।প্রত্যেকের মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ।
স্রোত পাশ ফিরে বনলতা বেগমের দিকে চাইলো।উনি এতোক্ষণে স্রোতকে আগলে নিয়েছিলেন।স্রোত উনার হাত ধরে ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করলো।কাঁদলো না,সে কাঁদে না।কান্না তাকে মানায় না।সে নিজেকে শক্ত খোলসে আবরণ করতে জানে।দৃঢ় কন্ঠে বনলতা বেগমকে বললো,
“আম্মু, তুমি না বলেছিলে চিন্তা না করতে?তোমার ছেলে ফিরে আসবে!কই ফিরে তো এলো না?”
বনলতা বেগম চুপ করে রইলেন।তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।স্রোত আবার বললো,
“চুপ করে আছো কেনো?বলো!কথা বলো আম্মু।কথা বলো।”
কথাটা বলতে গিয়ে কান্নারা দলা পাকিয়ে আসতে চাইলেও স্রোত নিজেকে সামলে নিলো।মান্ধবী বোনের এই অবস্থা মানতে পারছে না।শেষবার এমন হয়েছিলো তাদের মায়ের মৃত্যুর সময়।সে বোনকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে বুঝে উঠতে পারলো না।বনলতা বেগম এবার স্রোতকে আগলে নিলেন।কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।বললেন,
“এমন তো কত মিশনেই গিয়েছে আমার ছেলে।সবসময় তো আমার কোলে ফিরে এসেছে।আল্লাহ যে আমার কোল এভাবে খালি করে দিবেন আমি তো বুঝতে পারি নি।”
স্রোত চুপ করে রইলো।চোখ দিয়ে একফোঁটা পানিও পড়ছে না।চোখেমুখে কাঠিন্যতা।এর মধ্যে মাহিরা খাবার নিয়ে আসলো।খেয়ে নিতে বললো স্রোতকে।এমন অবস্থায় খাওয়া যায়?বনলতা বেগম চোখ মুছে খাবারের প্লেটটা নিলেন।স্রোতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“খেয়ে নাও।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তোমার।মেডিসিন নিতে হবে।”
“আমি ঠিক আছি।খাবো না কিছু।”
“আমি কয়জনকে সামলাবো বলো?একজন ছেড়ে চলে গেলো।তুমি এমন করছো?কয়জনকে সামলাবো আমি?তুমি যথেষ্ট শক্ত মনের মেয়ে।এমন করবে না,ধৈর্য্য ধরো।নিজেকে সামলাও।”
ধমকে বললেন বনলতা বেগম।
স্রোত টলমল চোখে তাকালো উনার দিকে। তিনি খাবারের লোকমা স্রোতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“খাও।সারারাত কোনো খবরের জন্যে অপেক্ষা করে কাল ভোরবেলায় আমরা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হবো।”
স্রোত দু লোকমার বেশি মুখে নিতে পারলো না।গলা দিয়ে খাবার নামছে না।বনলতা বেগম ঔষধ খাইয়ে দিলেন।স্রোত বিছানা থেকে নামলো।উদ্দেশ্য নিজের রুমে যাবে।নিজের পায়ে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরিয়ে পড়তে নিলে মান্ধবী ধরে ফেলে।নিজে দিয়ে আসতে চাইলে স্রোত নিষেধ করে। শক্ত গলায় বলে,
“ছাড় আমাকে।আমি একাই যেতে পারবো।”
বলে বের হয়ে যায় রুম থেকে।মান্ধবী কান্নায় ভেঙে পড়লো।সে তো ভেবেছিলো বোন এবার সুখী হবে,খুশিতে থাকবে।গম্ভীর, শক্ত খোলস টা থেকে বের হবে।হয়েছিলোও,তাহলে কেনো এমন হলো?
বনলতা বেগমের রুম থেকে স্রোতের রুমে যেতে হলে ড্রয়িংরুমের উপর দিয়ে যেতে হয়।বাড়ির বাকি সবাই ড্রয়িংরুমেই বসে ছিলো।স্রোতকে সোজা হেঁটে আসতে দেখে প্রত্যেকের প্রধান আকর্ষণ হয় স্রোত।স্রোত অপলক সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।মনে হচ্ছে সে যেনো ব্যাটারিচালিত রোবট।অন্যকেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।স্রোতের মামা স্রোতের দিকে এগিয়ে যান।স্রোত ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা নিজের রুমে চলে যায়।মামা পিছু ডাকলেন না।দূর থেকে মেয়ের এই অবস্থা দেখে স্রোতের বাবার চোখ দেখে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।স্রোত জোরে শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে ফেলে।প্রতিটা মানুষ কেঁপে উঠে।ভয়েরা ঝেঁকে বসে।কিন্তু মেয়েটাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে?বিয়ের তিন মাসের মাথায় কেই বা চায় স্বামীহারা হতে?মেয়ের শরীর থেকে তো এখনো নতুন বউয়ের ঝলকই যায়নি।
বাড়ির পুরুষ সদস্যরা চেষ্টা করছে ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করতে।কিন্তু পারছে না।শুধু এতোটুকুই বলা হয়েছে, “আপনারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চট্টগ্রামে আসুন।”
সারাদিন দাপট দেখিয়ে অরুণ পৃথিবীবাসীকে বিষন্ন সন্ধ্যাবেলা উপহার দিয়ে চলে গিয়েছে অনেক আগেই।চারিদিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।চাঁদ উঠে নি,হয়তোবা আজ অমাবস্যা।আকাশের কোথাও কোনো তারা দেখা যাচ্ছে না।আকাশ কি বুঝতে পারলো স্রোতের জীবনটাও ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে?
স্রোত এতোক্ষণ ট্রি টেবিলের উপরে রাখা মেহরাদের ছবিটা নিয়ে মেঝেতে বসে ছিলো।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।এক ফোঁটা চোখের জলও গড়ায় নি।এরজন্যই হয়তো পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে বসে কেউ একজন বলেছিলেন,
“অল্প শোকে কাতর,অধিক শোকে পাথর।”
স্রোতের এবার নজর যায় রুমের এক পাশের দেয়ালের অনেকটা জুড়ে অবস্থান করা মেহরাদ বড় ছবিটার দিকে।কি সুন্দর হাসছে।স্রোত তো প্রথমে এই হাসিটার প্রেমেই পড়েছিলো।স্রোত হাতের ফ্রেমটা রেখে বিছানায় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।টাল সামলাতে না পেরে বিছানার উপর পড়ে যায়।মাথাটা ভন ভন করে ঘুরছে।সে আবার দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ছবিটার দিকে।হাস্যোজ্জ্বল চেহারাটায় কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করে বললো,
“আপনি হাসছেন মেহরাদ?কিভাবে পারছেন হাসতে?বুকটা কাঁপছে না?আমাদের কাঁদিয়ে আপনি হাসছেন?”
আর বলতে পারলো না।শরীরে এই জোরটাই পাচ্ছে না সে।ঢোক গিলে থেমে থেমে আবার বলতে শুরু করলো,
“আপনি না বলেছিলেন আমার সাথে থাকবেন সবসময়?কথা দিয়েছিলেন তো আমাকে কখনো কষ্ট দিবেন না।তাহলে, তাহলে চলে গেলেন কেনো এভাবে?আমাদের তো একসাথে বাঁচার কথা ছিলো।পুরো বিশ্ব ঘুরার কথা ছিলো!এই আপনার ওয়াদা?কেনো করলেন এমন?”
“এই কয়েকদিনে তো আমি অল্প অল্প করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলাম মেহরাদ।আমাদের একটা সংসার হবে।আমরা খুব সুখে থাকবো।আমি আপনাকে ভালোবাসি বলে বলে বিরক্ত করবো।আমি ভালোবাসি বলার আগেই আপনি আমাকে একা করে রেখে চলে গেলেন?বুকটা যন্ত্রণা করছে মেহরাদ,প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে।দমবন্ধ হয়ে আসছে।শ্বাস নিতে পারছি না।ফিরে আসুন না প্লিজ।সবকিছুকে দুঃস্বপ্ন প্রমাণ করে চলে আসুন।”
অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।স্রোত হাত দিয়ে মুছে ফেলতে ফেলতে ঢোক গিলে বললো,
“কাদঁবো না,আমি একদম কাঁদবো না।কার জন্য কাঁদবো?আপনার জন্য?যে কথা দিয়ে কথা রাখে না?যে কষ্ট দিবে না বলে এক সমুদ্র পরিমাণ কষ্ট দিয়ে অচিনপুরে চলে যায়?তার জন্য কাঁদবো? একদম কাঁদবো না,একদম না।”
মন তো এসব বুঝে না।এতোক্ষণ আটকে রাখা অশ্রু যেনো বাঁধ ভাঙ্গলো।অশ্রুর দাপটে স্রোত মেঝেতে হাটু ভেঙ্গে বসে পড়লো।কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগলো,
“মেহরাদ এই কয়েকদিনে তো আমি আপনার সাথে মিশে গিয়েছিলাম।আপনার সাথে একদিন কথা না হলে মনে হতো কত জনম ধরে কথা বলি না,ছুট্টে চলে যাই আপনার কাছে।আপনার বুকে হামলে পড়ি।এখন আমি কার কাছে যাবো মেহরাদ?কার অপেক্ষায় প্রহর গুণবো?কার বুকে মাথা রাখবো আমি?কে আমাকে আগলে নিবে?বলুন না মেহরাদ। চুপ করে আছেন কেনো?কথা বলুন!”
“আমি আপনাকে আর জ্বালাবো না মেহরাদ।আর কষ্ট দিবো না।মজা করবো না আপনার সাথে।ফিরে আসুন,প্লিজ একটাবার ফিরে আসুন।আমার কথা আপনি শুনছেন না মেহরাদ?”
কাঁদতে কাঁদতে শ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড়।হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেলো স্রোত।দেখলো মেহরাদ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে,হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।আর বলছে,
“হাতটা ধরো স্রোত,উঠে এসো।”
স্রোত উঠলো।পিটপিট করে চেয়ে রইলো সামনের মানবের দিকে।হেঁসে হামলে পড়লো বুকে।বলতে শুরু করলো,
“আপনি এসেছেন মেহরাদ?আমি জানতাম আপনি আসবেন।ওরা,ওরা ভুল নিউজ বলছিলো। আমি জানতাম।”
মেহরাদ হাসছে আর বলছে,
“আমি তোমার কল্পনা স্রোত।আমি চলে গেছি দূরে,অনেক দূরে।যেখান থেকে কেউ ফেরে না।কোনোদিন ফিরে নি।তুমি আমার হয়েই থেকো স্রোত।আমরা পরকালে একসাথে থাকবো।তোমার মুখ থেকে ভালোবাসি শোনা এ জন্মে আর হলো না।পর জন্মেই নাহয় শুনবো। ভালো থেকো স্রোত।তুমি অনেক ধৈর্য্যশীল, শক্ত মনের একটা মেয়ে।এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না।”
বলেই ছায়া মানব হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।স্রোত বলতে শুরু করলো,
“না না যাবেন না মেহরাদ।কোথাও যাবেন না।আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।আমি আপনার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি।আমাকে একা রেখে যাবেন না।আমি কি নিয়ে বাঁচবো? কিভাবে থাকবো আপনাকে ছাড়া?দাঁড়ান মেহরাদ যাবেন না।আমি আপনাকে ভালোবাসি। শুনুন মেহরাদ, ভালোবাসি আমি আপনাকে।আমাকে এভাবে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিবেন না।আমি আপনার অপেক্ষায় আছি।মেহরাদ….”
শেষের কথাগুলো চিৎকার করে বলে স্রোত।বাড়ির সব মানুষ চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে যায়। সবাই স্রোতের দরজায় নক্ করছে।তবুও দরজা খোলার নাম নেই।ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না।সময় পেরিয়ে গেলো অনেক্ষণ তবুও দরজা খুললো না।সবাই ভয় পেয়ে যায়।মেয়েটা কিছু করে বসলো না তো।এক পর্যায়ে স্রোতের বাবা সাহস করে দরজায় নক্ করলেন।জানেন না ফলাফল কি হবে,তবে এতোটুকু জানেন মেয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করবে না।আদুরে স্বরো ডাকতে শুরু করলেন,
“স্রোতস্বিনী, দরজা খোলো মা।আমি জানি তুমি এতো সহজে ভেঙ্গে পড়ার মেয়ে না।বেরিয়ে এসো মা,সবাই ভয় পাচ্ছে।তুমি তো বুঝদার মেয়ে,এমন কেনো করছো?বেরিয়ে এসো।আমরা মেহরাদের কাছে যাবো।দরজা খোলো মা।”
কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলে গেলো।স্রোতের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা কারো কাম্য ছিলো না।সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।মান্ধবী অঝোরে কেঁদেই চলেছে।বনলতা বেগম শক্ত গোছের মানুষ।এমন বিপদ উনি অনেক সামলেছেন।ছেলের লা শ দেখার আগ অবধি তিনি বিশ্বাস করেন না ছেলের কিছু হয়েছে।স্রোত বাবাকে জাপটে ধরে কেঁদেই চলেছে।বললো,
“বাবা উনি চলে গেলেন কেনো?আমাকে নিয়ে যেতে পারতেন তো।আমি এখন থাকবো কি করে এখন?প্রথমে মা চলে গেলো এখন উনি চলে গেলেন।কি নিয়ে থাকবো আমি?চলেই যখন যাবেন তাহলে এসেছিলেন কেনো জীবনে?জড়ালেন কেনো আমায়?আমি তো জড়াতে চাই নি।কেনো এমন করলেন!”
স্রোতের হুঁশ নেই।সবার সামনেই বিলাপ করছে।স্রোতের বাবা বুঝতে পারলেন না মেয়েকে কি বলে সান্ত্বনা দিবেন।আজ কত বছর পরে মেয়ে তার সাথে কথা বলেছে,কত বছর পর মেয়ে তার কাছে এসেছে।কিন্তু তিনি অসহায়। উপস্থিত সকলে দেখছে একজন কঠিন মানবীর বিধ্বস্ত রূপ।উপস্থিত সবার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়লো।
বনলতা বেগম এগিয়ে গেলেন স্রোতের কাছে।আগলে নিলেন তাকে।বললেন,
“শোনো আমার বিশ্বাস আমার ছেলের কিছু হয় নি।কিছু হতে পারে না আমার ছেলের।নিজের কি অবস্থা করেছো তুমি?এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে?যতক্ষণ না আমি আমার ছেলের মৃত দেহ দেখছি ততক্ষণ আমি বিশ্বাস করি না।আমার মন বলছে আমার ছেলে সুস্থ আছে।”
স্রোত টলমল চোখে চেয়ে রইলো বনলতা বেগমের দিকে।বনলতা বেগম সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ভোর হওয়ার অপেক্ষা আমি করবো না।আমরা একটু পরই বেরিয়ে পড়বো।ব্যাগ গোছাও।”
মান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“স্রোতের ব্যাগটা গুছিয়ে দাও।তুমিও আমাদের সাথে যাবে।তৈরী হও।”
মধ্যরাতেই দুটো গাড়ি বেরিয়ে পড়লো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।বাড়িতে রইলেন রায়হানের মা,নয়না,নবীন।স্রোতের মামা,বাবা যান নি।বিপদের রাস্তা যেনো শেষ হয় না।স্বাভাবিকভাবে যতসময় লাগে তখন যেনো আরো বেশি সময় লাগে।কি জানি সত্যি কিনা! নাকি মনের ভুল ধারণা।স্রোত আর কান্না করে নি।হয়তো সেও মনে মনে বিশ্বাস করে মেহরাদের কিছু হতে পারে না।সে বেঁচে আছে।
#চলবে..