প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [১৩-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন
লোকটার নাম বদরুদ্দীন। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। সকালে সাইকেল চালিয়ে পত্রিকা বিলি করে এবং সারাদিন মোটরযান সারানোর একটি দোকানে বসেই কাটায়৷ নিশান্ত তাকে পাকরাও করল দোকানেই। এবং প্রথম দর্শনেই নিশ্চিত হলো এই লোক সকালে পত্রিকা দিতে যায়নি। বদরুদ্দীন নিশান্তকে চিনত। দেখেই বিনীতভাবে এগিয়ে এলো। নিশান্ত প্রশ্ন করল,
“আপনি দ্বীপশিখায় রোজ পত্রিকা দেন?”
“জি বাবা। তোমারে আমি চিনি। দেখছি কয়েকবার।”
“আজ পত্রিকা দিতে যাননি?”
বদরুদ্দীন রয়েসয়ে বলল,
“দিতে গেছিলাম তো। মাঝপথে সাইকেলটা ছিনতাই হয়ে যায়৷”
নিশান্তের কপালে ভাজ পড়ে। এক ভ্রু উঁচিয়ে স্বগোতক্তি করে,
“ছিনতাই!”
“হ্যাঁ, সাতসকালে দুইজন ছেলেপেলে আইসা সাইকেলটা হাতিয়ে নিয়ে গেল। আমার কী আর অত গায়ের জোর যে ওদের সঙ্গে পারব? সাইকেলের ঝুড়িতেই পত্রিকা রাখতাম। সব গেছে। তাই আর দেওয়া হয় নাই। কাল দুইদিনেরটা দিয়ে আসব।”
লোকটা সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা তা বোঝা যাচ্ছে না। যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে রহস্য জোড়ালো। প্রথমে পত্রিকাওয়ালার সাইকেল ছিনতাই, পরে বাড়িতে প্রবেশ, এরপর গাড়িতে র’ক্ত। একদম নিখুঁত পরিকল্পনা। নিশান্ত মৌন হয়ে একটু ভাবল। পকেট থেকে ফোন বের করে সিসিটিভিতে দৃশ্যমান হওয়া ক্যাপ পরিহিত লোকটাকে দেখিয়ে বলল,
“দেখুন তো সাইকেল ছিনতাই করা ছেলেদের সঙ্গে এর কোনো মিল আছে কিনা!”
বদরুদ্দীন ফোনের ওপর ঝুঁকে পড়ল। ছেলেটার হাঁটাচলা ও পোশাক খেয়াল করে বলল,
“হ্যাঁ, এই ছেলেটা ছিল। আমাকে গালাগালি করছে খুব।”
“মুখ দেখলে চিনতে পারবেন?”
“পারব।”
“ঠিক আছে। একে ধরতে পারলে আপনার সাইকেলও ফিরিয়ে দেব।”
___________
কান্নার সময় মানুষের মন সবচেয়ে বেশি নাজুক হয়ে পড়ে। সান্ত্বনা খোঁজে, ভরসা চায়। বোবা প্রাণীরা কি সে কথা বোঝে! বোঝে হয়তো! বিশেষ করে গৃহপালিত পশুরা মানুষের সংস্পর্শে থাকে বিধায় মানুষের ভাব, আবেগ, অনুভূতি একসময় তাদের আয়ত্ত্বে চলে আসে। টফিও বোধহয় বুঝেছিল শোভার ভাঙা মনের যন্ত্রণা। কখনো নিকটে ঘেষতে না চাওয়া প্রাণীটা আজ হঠাৎই পায়ে পায়ে ঘুরতে লাগল। শোভার চোখের কোল জলে ভরে আছে। নাক টানছে মৃদু। প্রত্যেক মানুষের একটা সফট কর্ণার থাকে, যেখানে মানুষ দুর্বল। শোভার সেই দুর্বলতা এইসব বোবা প্রাণীরা। এই যে লাল-সাদা হৃষ্টপুষ্ট বিড়ালটা মরে পড়ে আছে, শোভার বুকের ভেতরটা গুমরাচ্ছে। টফি সামনের এক পা তুলে দিল বসে থাকা শোভার পিঠে। সম্বিত ফিরে পেল ও। দেখল ধবধবে পশমের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুটি বাদামী চোখ অপলক তার দিকে চেয়ে আছে। শোভা ওকে ধরতে গিয়েও ময়লা হাতে আর স্পর্শ করল না। কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যে ওদের মাঝে একটা মায়াময় ভাব বিনিময় হয়ে গেল। শোভা বিড়ালটা সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে এলো। শিরীন মেয়ের হাতে মৃত বিড়াল দেখেই ধমক দিলেন,
“সারাক্ষণ এইসব নিয়ে পড়ে থাকিস কিছু বলি না। তাই বলে মৃত বিড়াল ধরে আনবি? ফেলে আয় এক্ষুনি।”
শোভার নাকের পাটা কাঁপছে। ঠোঁট ঈষৎ উলটানো। কচু পাতায় জমা পানি যেমন টোকা লাগলেই গড়িয়ে পড়ে তেমন একটা টোকা লাগলেই শোভার চোখ হতে গলগল করে পানি ঝরবে দশা। রুদ্ধ কণ্ঠ ভেঙে বলল, “মা, বড়ো ভাইয়াকে ছোটাছুটি করতে বারন করো। আমার ধারণা এই বিড়ালের র’ক্তই হয়তো জাওয়াদ ভাইয়ার গাড়িতে লাগানো হয়েছে।”
শিরীন অবিশ্বাস্য চোখে চাইলেন। বলেন,
“তুই কী করে বুঝলি?”
“ওর গায়ে ধা’রালো কিছু চালানো হয়েছে কিন্তু কোনো র’ক্ত নেই। গাড়ির র’ক্ত পরীক্ষা করাতে বলো।”
“জাওয়াদ পুলিশ ডেকেছে। ওর বিজনেস রাইভাল অনেক। তারাও পেছনে লাগতে পারে।”
শোভা হতাশ হলো। পুলিশ জড়িয়ে গেছে ঘটনায়! বিষধর সাপ খুঁড়তে গিয়ে শেষে কেচো না বেরোয়। এক্ষুণি গোপন সলাপরামর্শ দরকার।
অনন্ত হতভম্ব হয়ে মেহযাবীনের পাশের স্থান দখল করে বলল,
“কীরে ভাই! বাড়িতে এতকিছু হয়ে গেল, আমি কোন জগতে ছিলাম?”
“ঘুমের জগতে।” শাওন কটাক্ষ করল।
অনন্ত দুঃখী হবার ভান করে বলল,
“এই ঘুমের জন্য আমার ক্যারিয়ার হবে না। বিয়ে হবে না। আমি চির কুমার রয়ে যাব।”
শাওন ভ্রুকুটি করে। বাড়ির সবাই চিন্তায় রক্তচাপ বাড়িয়ে ফেলেছে আর এই ছেলে কিনা ঘুম থেকে উঠে এসে নিজের ভবিষ্যত ভেবে দুঃখিত হচ্ছে! অনন্ত শাওনের দিকে সুতীব্র চোখে চেয়ে সন্দিগ্ধ স্বরে বলল,
“কেসটা কী! গাড়িতে নাকি ব্লাডের ফ্লাড বয়ে গেছে? তোর জামাইয়ের মাঝে কোনো গণ্ডগোল নেই তো?”
যাবীন ও শাওন উভয়েই কটমট করে চাইল। জাওয়াদ ওদের দুজনেরই প্রিয়পাত্র! তার সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে দুই নারীকে মোকাবিলা করতে হবে। শোভা বাইরে থেকে এসে ওপরে যেতে যেতে বলল,
“তোমরা তিনজন তেতলায় আসো। কথা আছে।”
শোভার গুরুতর মুখভঙ্গি দেখে কেউ আর দ্বিমত করল না। তিনতলায় টেনিসকোর্টের রুমে গিয়ে বসল ওরা। শোভা এলো একটু বাদে। বলল,
“তোমরা কী কিছু টের পাচ্ছো না?”
“কোন ব্যাপারে?” যাবীনের প্রশ্ন।
“প্রথমে আমিনের গায়েব হওয়া, এরপর আমার এক্সিডেন্ট ঘটানো, এখন গাড়িতে র’ক্ত…”
অনন্ত থামিয়ে দিল কথার মাঝে, “এক মিনিট! তোর এক্সিডেন্ট ঘটানো মানে? বাড়িতে এসে তো বললি ব্রেক সামলাতে পারিসনি।”
“মিথ্যা বলেছিলাম যেন কেউ টেনশন না করে। কিন্তু আজকের ঘটনার পর এটা আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। গাড়িতে বিড়ালের র’ক্ত লাগিয়ে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে কেউ।”
শোভা খুলে বলল সব। একটা নিরব হাওয়া বয়ে গেল সকলের মাঝে। নিরবতার সমাপ্তি ঘটল শাওনের কণ্ঠের আহাজারিতে। দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল সে,
“সব দোষ আমার, সব।”
যাবীন বিরক্ত হয়ে একটা ধমক দিল,
“অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে নেওয়া বন্ধ কর। আমরা নিশ্চিত নই এসবের পেছনে আমিন আছে। থাকলেও সম্পূর্ণ দোষ এক এবং একমাত্র আমিনেরই। শখের নারীকে যে ভালোবেসে আগলে রাখতে জানে না, নারী চলে যাওয়ার পর তার জন্য দিওয়ানা হওয়াও সাজে না। অবশ্য এটা তো দিওয়ানা নয়, বলা ভালো অনিষ্ট চাওয়া। ওকে তোরা বেঁধে রেখে মে’রেছিলি তাই এখন বদলা নিচ্ছে। ব্যাপারটা এতদিন আমাদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন পারিবারিকভাবে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমিনকে আগে ধরতে হবে। নয়তো পরের ধাক্কাটা শাওন কিংবা আমার ভাইয়ার ওপর আসবে না তার কী নিশ্চয়তা?”
“ওই শালাকে তো ছেড়ে রাখা বিপদজনক। এখন পাবো কোথায়?” অনন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
যাবীন বলল, “আগে আমিনের বাড়িতে খোঁজ লাগাতে হবে। ভার্সিটিতে আমিনের যেসব বন্ধুবান্ধব আছে তাদের মাধ্যমেও খোঁজ করা যেতে পারে। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে না দিলে ওকে ধরাটা সহজ।”
শোভা বলল, “নিশান্ত ভাইয়া ইতিমধ্যে ব্যাপারটায় নাক গলিয়েছে। জাওয়াদ ভাইয়াও পুলিশ ডেকেছে।সামান্য ক্লু মিললেই টেনে বের করে আনবে।”
অনন্ত বলল, “আনুক। ওদের কাছে সাসপেক্ট নেই। ওরা কোনো ক্লু পেলে তাই ধরে এগোবে। আমাদের কাছে একজন সাসপেক্ট আছে। আমরা তাকে ধরেই এগোবো। দেখি পুলিশের আগে চোর ধরতে পারি কিনা।”
শাওনের চোখের কার্নিশে তখনো নোনাধারা। তার সমস্ত চিন্তা এখন জাওয়াদ কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। শাওন পারবে না ওই মানুষটার সঙ্গে লুকোচুরি করতে। বিপদ যদি সত্যিই ওর দ্বারা আসে তবে আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়া ভালো। সে তো আর চিট করেনি! সুতরাং ভয়েরও কিছু নেই। শাওন ওদের সাংসারিক জীবনে কোনোরকম গোপনীয়তা কিংবা দ্বিধার উপস্থিতি রাখতে চায় না।
বিকেল নাগাদ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেল জাওয়াদের গাড়িতে লেগে থাকা র’ক্ত আসলেই বিড়ালের। কিন্তু এ ধরনের বিকৃত ও জঘন্য কাজ যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ করতে পারে না সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কে বা কারা, কোন উদ্দেশ্যে কাজটি করেছে তা অজানা। তবে এ নিয়ে বাড়িতে একটা ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। বিকেলে বাড়ির পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই যাবীন বাড়ি ফিরতে চাইল। চাঁদনি বেগম আপত্তি তুলে বললেন,
“একটা সুস্থ মেয়েকে এনে দুর্বল মেয়েকে পাঠালে শেখ বাড়ির কাছে আমাদের মান থাকবে? আজ আর ফিরে কাজ নেই। রাতটা বিশ্রাম নিয়ে কাল একদম চাঙ্গা হয়ে ফিরবি।”
না ফেরার প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেছে জাওয়াদ। সে যে কদিনেই বউপাগল হয়ে গেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শাওনও চাইছে মানুষটা থাকুক। রাতেই সমস্তটা জানিয়ে দেবে ও। কিন্তু যাবীন নাছোরবান্দা। সে থাকতে চায় না। নিশান্ত বাড়ি ফিরল তখনই। যাবীনের শরীরের খোঁজ করার জন্যই বোধহয় মেয়েটির দিকে সুক্ষ্ম নজরে চাইল। পরনে অফ হোয়াইট কামিজ, শিফনের ওড়না গলায় প্যাঁচিয়ে রাখা। কানে ছোটো একজোড়া টপ, চুল ঘাড়ে ফেলে রাখা। চোখে-মুখে সতেজতার বদলে অস্বস্তির তরঙ্গ খেলছে। নিশান্তের মনে পড়ল সকালের কথাগুলো। চাঁদনি বেগমকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি বলল,
“দাদি, পেইন্টিংটা আমাকে শিলা গিফট করেছে। শিলা মেহযাবীনকে দিয়েই আঁকিয়েছে ওটা। আর একটু বাদে শিলা আসছে এ বাড়িতে।”
কথাটা শুনেই অনন্ত বুকের বা পাশে হাত রেখে বলল, “শিলা কি জাওয়ানি… মাই সিনিয়র ক্রাশ ইজ কামিং!”
চলবে…
আমি কি লেখা ভুলে যাচ্ছি! নয়তো গল্পটা লিখতে ইচ্ছে করে না কেন? একবার ইচ্ছে হয় বাদ দেই, আবার মন চায় শুরু থেকে আবার এডিট করি। নয়তো আমার মেইন প্লটটা কিছুতেই খাপ খাচ্ছে না। আবার মনে হয় সব প্যাচ, টুইস্ট সরিয়ে ফেলে সরল রোমান্টিক লিখে ফেলি।