প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২১-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন
শিরীন বেগম খাবার আগলে বসে মৃদু মৃদু নাক টানছেন। দুটো কথা বলেছেন কী বলেননি তার জন্য ছোটো মেয়েটা দুয়ার বন্ধ করে বসে আছে। রাতে খাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। মায়ের মন কী আর সে কথায় শান্ত থাকে! পিতৃহীন মেয়ে দুটোকে নিয়েই তো উনার জীবন। যৌবনের দ্বারপ্রান্তেই বিধবা হবার পর কাছের মানুষরাই তাঁকে আবার বিয়ের কথা বলেছেন। স্বামী নেই বলে কী তাঁর জীবনে শখ-আহ্লাদ থাকবে না! বাকিটা জীবন কাটানোর জন্য একজন সঙ্গীর প্রয়োজন। মেয়েরা একসময় বড়ো হয়ে যাবে, তাদের নিজের জগৎ হবে। তখন মায়ের কী হবে! স্বামীহীনা নারী শ্বশুরবাড়িতে পরগাছার মতো। বিশেষ করে উনার কোনো ছেলে নেই। দুটি অবুঝ শিশু কন্যা। ভাসুর-জায়ের ভরা সংসারে শিরীন কী অবহেলিত হয়ে থাকবেন? নানান জল্পনা-কল্পনা সৃষ্টি হয়েছিল। চাঁদনি বেগম নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন শিরীনকে বিয়ে দিতে। যতদিন তিনি বেঁচে আছেন নাতনিদের নিয়ে ভাবতে হবে না। দ্বীপশিখায় মেয়েরা রাজকন্যার মতো বড়ো হবে। শিরীন সেদিন শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কেঁদেছিলেন। পুনরায় বিবাহে উনার কোনো আগ্রহই ছিল না। মেয়েদের থেকে তিনি কখনোই দূরে থাকতে চান না। তবে এ-ও ঠিক পরের সাহায্য নিয়ে বাঁচার সাধও ছিল না। তিনি ঠিক করলেন চাকরি করবেন। শোভা তখনও দুধ ছাড়েনি। মেয়েটিকে ফেলেই তিনি কাজে ছুটলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অফিস করে বাড়ি ফেরার পর যখন শোভার নিষ্পাপ মুখটা দেখতেন বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হতো। মেয়েদুটোকে পর্যাপ্ত সময় না দিতে পারার বেদনা উনাকে আচ্ছন্ন করে রাখত।
নাতনিদের সময় দেওয়ার ভার ছিল চাঁদনি বেগমের ওপর। মায়ের অবর্তমানে তিনিই মেয়ে দুটোকে বড়ো করেছেন। বড়ো বউয়ের ওপর কোনো দায়িত্ব দেননি। পাছে সম্পর্কে তিক্ততা আসে! হাজার হোক ছোটো জায়ের সন্তান। আফিয়া নিজের দুই ছেলেকে সামলে, রান্নাঘর সামলেই সময় পাননা। যদি ভেবে বসে তিনি গৃহিণী বলেই সবাই খাটিয়ে নিচ্ছে। শিরীনের এদিকেও একটু কুণ্ঠা রয়েছে। ফলে সকালে অফিসে যাবার আগে ও সন্ধ্যায় ফেরার পর তিনি নিজের ও মেয়েদের কাজ যথাসম্ভব সেরে ফেলতেন। রান্নাঘরে হাত লাগাতে চাইতেন। আফিয়ার অবশ্য এদিক দিয়ে মন বড়ো। রান্নাঘরের দায়িত্ব তিনি একাই সামলে গেছেন। কাউকে সে দায়িত্ব তিনি দিতে নারাজ।
আফিয়া বললেন, “কী দরকার ছিল বাড়ি ফেরা মাত্রই মেয়েটিকে এভাবে দুজনে ঘিরে ধরার? এখন নিজেই বসে বসে কাঁদছিস।”
শিরীন বললেন, “আম্মাই তো আমার মাথা গরম করিয়ে দিলো। এই বয়সী মেয়েরা একটু ছোটাছুটি করবে না! মেয়ে কী আমার বখে গেছে বলো? কুকুর-বিড়াল নিয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। সে না বলে বেরিয়ে গেছে সেটাও আমার দোষ!”
চাঁদনি বেগম খ্যাঁকিয়ে উঠে বললেন, “অবশ্যই তোমার দোষ, ছোটো বউ। মেয়ে বের হয়ে যাবে তুমি খেয়াল রাখবে না কেন? সে কী পুরোপুরি ফিট? রোজ অতগুলো মেডিসিন গিলতে হয় কেন তাহলে? তাছাড়া দুদিন আগে বাড়িতে কী কাণ্ড ঘটে গেছে মাথা নেই? নিশান্ত সবাইকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছে সেখানে তোমার মেয়ে না বলে বেরিয়ে যায় কোন সাহসে?”
শিরীন কান্না থামিয়ে সরোষে বললেন, “আপনার নাতনির সাহসের উৎস নিশ্চয়ই আমি নই!”
“হবে কী করে? তোমার খানদানে কোনো সাহসী আছে?”
“এই তো আসল কথা বলে দিলেন। সব দোষ আপনাদের খানদানের। আমি নিরীহ মানুষ বলে আপনাদের সাহসের অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছি। নাতনি আর দাদি মিলে জীবনটা আমার অঙ্গার করে দিলো।”
“তোমাকে সহ্য কে করতে বলেছে শুনি?”
শিরীন কেঁদে উঠে বললেন, “সহ্য করব না আর। চলে যাব। আমার ভাই কদিন বাদেই দেশে আসছে। চলে যাব।”
চাঁদনি বেগম ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন, “চলে যাবেন তিনি! বুড়ো বয়সে পাখা গজিয়েছে।”
“আমি বুড়ো? আপনি কী তাহলে?”
আফিয়া অসহ্য হয়ে বললেন, “কোথা থেকে কোথায় চলে গেলেন? ছিলেন মেয়ের না খাওয়া নিয়ে। শিরীন, তুই কি একটা কথা ছেড়ে দিতে পারিস না?”
“তুমিও আমার দোষই দেখো, ভাবি? চলে যাব। আর বিরক্ত করব না তোমাদের। একটাকে তো বিয়ে দিয়েই দিয়েছি। আরেকটাকে নিয়ে চলে যাব।”
চাঁদনি বেগম তীব্র স্বরে বলে উঠলেন, “এহ! বললেই হলো! মেয়েরা আমার হাতে মানুষ হয়েছে। তুমি কে তাকে নিয়ে যাওয়ার! যেতে হলে একা যাবে।”
শিরীন কান্নার মাঝেই ত্যারচা হেসে উঠলেন,
“এই যে আবার স্বীকার করলেন, মেয়ে আপনার হাতে মানুষ হয়েছে। সুতরাং মেয়ের সব দোষ আপনার। আমাকে কথা শুনিয়ে নিজের দোষ ঢাকতে চাইবেন না।”
চাঁদনি বেগম চোখমুখ শক্ত করে উঠে দাঁড়ালেন। আফিয়াকে নির্দেশ দিলেন, “শোভার খাবারটা সাজিয়ে দাও। নাতনি যেহেতু আমার, ওর ভালোমন্দ আমি একাই বুঝব।”
চাঁদনি বেগম খাবার নিয়ে গিয়ে শোভার দরজায় কড়া নাড়লেন। ভেতর থেকে অভিমানী স্বর ভেসে এলো, “যতই করো প্রহার, খুলবে না এ দুয়ার। আমার মনে দুঃখের পাহাড়, আমি গ্রহণ করব না আহার।”
চাঁদনি বেগম চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
“আমি কী তাহলে বাইরে থেকে তালা দেব? দুদিন না খেলে এমনিতেও মানুষ মরে না। এরপর হাঁটাচলার শক্তি হারালে আর বাইরে যেতে হবে না। আর কোনো ইভেন্ট এরেঞ্জ করতে হবে না।”
বলে চাঁদনি বেগম চুপ করে গেলেন। সত্যিই তালা ঝুলেছে কিনা বুঝতে খানিক বাদেই শোভা দরজা খুলল। চাঁদনি বেগম ওকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। শোভা চ্যাঁচিয়ে উঠে বলল, “চিটিং চিটিং!”
“চুপ বেয়াদব। রাত করে চ্যাঁচাবি না। চুপচাপ খেয়ে মেডিসিন নিয়ে ঘুমাবি।”
শোভা খাটের কোণায় মুখ গুজে বসল। যেন তার কান্না পাচ্ছে এমন করে বলল, “খাব না আমি। তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাসো না। আমার স্কুটি বাজেয়াপ্ত করেছো, আমার ডোনেশন দাওনি। সামান্য পাশের বাড়িতে গেছি বলে শূলে চড়াচ্ছো। আমি খাব না। না খেয়ে একদিন শুকিয়ে মরে যাব। এরপর আর তোমাদের কেউ জ্বালাবে না। কেউ না।”
চাঁদনি বেগম নির্বাক চোখে চেয়ে রইলেন। শোভা তার চুলের ফাঁক দিয়ে দাদিকে আড়চোখে দেখে বুঝতে চেষ্টা করল নিশানা সঠিক জায়গায় লেগেছে কিনা। চাঁদনি বেগম ধমকে উঠে বললেন,
“যত বড়ো মুখ না তত বড়ো কথা! আমার ঋণ শোধ না করেই মরবি? আমি যে তোর পেছনে হাড় ক্ষয় করেছি এর শোধ দিয়ে এরপর মরবি।”
“এখন কি তোমায় কোলে নিয়ে ঘুরে হাড় ক্ষয় করে শোধবোধ করব?”
“হ্যাঁ তাই করবি। খেয়ে আগে গায়ের জোর বাড়া।”
চাঁদনি বেগম শোভার পাশে বসে নিজের হাতে ভাত মাখিয়ে বললেন, “হা কর।”
শোভা মুখ ফিরিয়ে রাখল, “উহুঁ, খাব না। তুমি জানো, রোজ কত স্ট্রিট ডগ না খেতে পেয়ে ঘুমায়? অসুখ হয়ে পথে পড়ে থাকে। কেউ ট্রিটমেন্ট দেয় না। আমাকে যেমন তুমি খায়িয়ে দিতে এসেছো, ওদের কেউ খায়িয়ে দিতে যায় না। আমি বরং আজ খালি পেটে ওদের জন্য একরাত শোক পালন করি।”
চাঁদনি বেগম ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন, “হয়েছে, আর ইমোশনাল ড্রামা করতে হবে না। আমি তোমাকে মানুষ করেছি, তুমি আমাকে না। ঘুরেফিরে সেই ডোনেশন তো! দিয়ে দেব। আগে আমাকে সুস্থ হয়ে দেখা। রিপোর্ট নরমাল এলেই তোর ব্যাংক ট্রানজেকশন কনফার্ম।”
“ওওও…আমার চাঁদের বুড়ি, তোমার নেই কোনো জুড়ি। তুমি কত্ত ভালো!” শোভা আহ্লাদী হয়ে গেল।
চাঁদনি বেগম সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলেন। শোভা পড়ল বিপদে। পেট তার এমনিতেই ভরা। এখন আর খাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে না খেলে দাদির হাত থেকে নিস্তার নেই। শোভা যতই অনুনয় করতে লাগল খাবে না, চাঁদনি বেগম ততই ঠেসে দিতে লাগলেন। সঙ্গে বারবার হুমকি দিলেন কথা না শুনলে ডোনেশন দেবেন না। উভয়সংকটে পড়ে শোভার তখন হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো।
___________
জাওয়াদ আজ বাড়ি ফিরেছে অনেকটা দেরি করে। ফিরেই কারো সঙ্গে কোনোরূপ বাক্যালাপ না করে ঘরে ঢুকে গেছে। নটায় খাবার খেতে নামতেই দেখা গেল ডাইনিংয়ে জরি ও তানি খালা ফিসফাস করে কথা বলছেন।
জরি বললেন, “আমি গ্যারান্টি দিয়া কইলাম ফুলের ডালা যাবীনের লইগ্যা আইছে।”
“আরে বুঝো না! যুবতী বয়সে এইসব তো আইবোই। আমাগো যাবীন কী কম সুন্দর!”
জাওয়াদকে দেখে তারা কথা থামিয়ে দিলেন। জাওয়াদ ভ্রুকুটি করে বলল, “কী নিয়ে কথা বলছো, জরি খালা? ফুল কে এনেছে?”
জরি হাসি চেপে লাজুক স্বরে বললেন, “সকালে ওই ফুলের ডালাটা বাড়িত আইছে যাবীনের লইগ্যা। কেডায় দিছে কইতে পারি না।”
জাওয়াদ তীক্ষ্ণ চোখে দেখল ফুলগুলোকে। মেহযাবীনের ডাক পড়ল সঙ্গে সঙ্গে।
“ফুলগুলো তোমার নামে এসেছে, মিহা?”
এই প্রথম জাওয়াদ তার বোনকে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ করল।
মেহযাবীন অবাকতা চেপে ধীর স্বরে বলল, “কোনো নাম উল্লেখ করে আসেনি।”
মেহযাবীন যথেষ্ট স্বাধীনতা পেলেও তার চারপাশে একটা অদৃশ্য গণ্ডি টেনে রাখা। জাওয়াদের মতো বড়ো ভাই মাথার ওপর আছে বলে কেউ তাকে উত্যক্ত করার সাহস পায়নি কখনো। বাড়িতে ফুল আসা তো দূরের কথা। মেহযাবীনের অল্পবয়সের আবেগে করা প্রথম বোকামো কিংবা ভুলের পর জাওয়াদ তার বোনকে দেখে রাখার দায়িত্বটা সচেতনভাবেই পালন করেছিল। এখন বোন বুঝদার হয়েছে। তাই তাকে সম্মানের সাথে নীরবে ব্যক্তিগত স্পেস ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন হাতের কব্জিতে ঘড়ি ব্যবহার করলে ঘড়ি এঁটে থাকা স্থানের চামড়াটুকুতে দাগ পড়ে যায়। রোদ-তাপের সংস্পর্শ না পাওয়ায় শরীরের বাকি অংশ থেকে সেই অংশ উজ্জ্বল হয়ে থাকে। তেমনই জাওয়াদের ছায়া সরে গেলেও সুরক্ষাদায়ী সচেতন মনটা বোনের মাথার ওপর রয়ে গেছে। দুপুরে রহস্যময় এক ফোনকলের পর জাওয়াদ এমনিতেই বিক্ষিপ্ত ছিল৷ ফলে সামান্য একটা ফুল আসাকে সে সহজভাবে নিতে পারল না। অদ্ভুত এক চিন্তায় ওর মস্তিষ্ক ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকল। সেই চিন্তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাল যখন মাঝরাতে সুলতান শেখ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাবাকে হাসপাতালে নিতে নিতে জাওয়াদ টের পেল তার পরিবারটি চরম অনিরাপত্তায় ভুগছে।
চলবে…