প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [২৭-বর্ধিতাংশ]
প্রভা আফরিন
“আমার কাছে আর একটি মাত্র সপ্তাহ সময় আছে, নিশান্ত। রিসেপশনের একদিন পর ফ্লাইট। জার্মানির উদ্দেশ্যে ফ্লাই করা মাত্রই ওরা আমার সিদ্ধান্ত বুঝে ফেলবে। এরপর মরিয়া হয়ে উঠবে আমাকে যেকোনো ভাবে ধ্বংস করতে। তাই এর মাঝেই কিছু কাজ আমাকে সম্পন্ন করতে হবে।”
“কী কাজ?”
“শত্রুর হাতে যতক্ষণ তোমার দুর্বলতা কুক্ষিগত, ততক্ষণ তুমি অসহায়। আমার দুর্বলতাগুলোকে ওদের কবল থেকে সরাতে হবে। নাহয় ওদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। প্রথমত, একজনকে খুঁজে বের করতে হবে যাকে ওরা লুকিয়েছে। যে আমার বিজনেসের হুমকি। আর আমার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা অর্থাৎ আমার পরিবারকে সুরক্ষিত রেখেই যেতে হবে। এতদিন ওদের মেইন টার্গেট আমি ছিলাম। এখন ওরা শেখ বাড়ির কলিজায় হাত দিয়েছে।”
একান্ত সাক্ষাতে জাওয়াদের বলা কথাগুলো বারবার নিশান্তের মস্তিষ্কে বেজে চলেছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই অনেকগুলো কাজ সমাপ্ত করতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে। এর ফলাফলও যে খুব একটা সুবিধের হবে না তাও সে বুঝতে পারছে। কিন্তু বড়ো কোনো বিপর্যয় ঠেকাতে হলে কিছু সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে।
মেহযাবীন অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে নিশান্তের দিকে চেয়ে আছে। এসেছে রিং কিনতে অথচ সেদিকে সামান্যতম খেয়াল নেই! ও বলল,
“আপনার মতলবটা কী বলুন দেখি? বললেন রিং কিনবেন অথচ মনে হচ্ছে ধ্যান করতে বসেছেন। বাজেট নিয়ে টেনশন?”
ভাবনার হাট সাঙ্গ করে নিশান্ত সরু চোখে চাইল। সদা গম্ভীর কণ্ঠে ঝাঝ মিশিয়ে বলল, “তোমার ধারণা আমি আমার বোনকে একটা ডায়মন্ড রিং গিফট করার ক্ষমতা রাখি না? আমি কী তোমার মতো বেকার?”
মেহযাবীন প্রথম কথায় থতমত খেল। নিশান্ত অবশ্যই সে সক্ষমতা রাখে। সে তো শুধু একটু মজা নিতে চাইছিল। কিন্তু বোঝা উচিত ছিল মজা আর নিশান্ত দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। যথারীতি দ্বিতীয় কথায় ও জ্বলে উঠল,
“আমি বেকার? এক্সকিউজ মি, আমি এখনো স্টুডেন্ট।”
যেন বাচ্চাসুলভ কথা শুনল এমন ভঙ্গিতে হেসে নিশান্ত বলল,
“ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমি স্টুডেন্ট অবস্থায় বাংলাদেশ আর্মিতে ঢুকেছি। সম্মানের সাথে শিক্ষা সমাপ্ত করেছি। আর স্টুডেন্ট অবস্থাতে বাংলাদেশের অনেক ছেলেমেয়েরা ইনকাম করা শুরু করে। অন্তত নিজের খরচা সামলাতে। অন্যের সামর্থ্যের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজেকে দেখবে।”
যাবীন রাগে-দুঃখে ফুলে উঠল। এই লোক পরোক্ষভাবে তাকে বুঝিয়ে দিলো সে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল! তার যোগ্যতাকে খাটো করা! শক্ত অথচ মাপা স্বরে বলল,
“আমি আপনার মতো বাধাধরা চাকরি হয়তো করি না। মাস গেলে মাইনে পাই না। কিন্তু আমার যেটুকু দক্ষতা আছে তা দিয়ে মন চাইলেই আয় করতে পারি। অন্তত আপনাকে এক কাপ চা খাওয়ানোর সামর্থ্য রাখি।”
নিশান্ত আঁড়চোখে চাইল। মেজাজে ম্যাডামের ফরসা মুখ পাকা সিঁদুরলাল আমের মতোই টসটস করছে। রমনী রূপে ও তর্কে দমবার পাত্রী নয়। সেও কি থোরাই কথা ছাড়বার পাত্র! সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল,
“তো কবে খাওয়াচ্ছো? তোমার সামর্থের চা!”
যাবীন ফ্যালফ্যাল করে চাইল। সে তো কথার কথা বলেছে। এই লোক সত্যিই চায়ের দাওয়াত চেয়ে বসবে কে জানত! গম্ভীর গলায় বলল,
“আমি তো বেকার। আমার হাতে অফুরন্ত সময়। আপনারা সব ব্যস্ত মানুষ। যখন সময় হবে বলবেন।”
“ওকে, মাইন্ড ইট।” বলে দাম্ভিক হাসির রেশ ঠোঁটে মেখে সে সামনে মেলে রাখা রিংগুলোকে দেখতে লাগল। সাদা সোনার ওপর হীরে বসানো একটি আংটিতে নজর থমকাতেই সেটা তুলে নিল। মেহযাবীন তখন এই আংটিটাই তুলতে যাচ্ছিল। দুজনের একটা আংটিই পছন্দ হয়েছে। নিশান্ত ওর এগিয়ে আসা হাতটা নিজের মুঠোয় চেপে ধরে সরু অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দিলো। এরপর নেড়েচেড়ে দেখল সাইজ একদম মানানসই।
মেহযাবীন ভ্রুকুটি করল নিশান্তের কাজে। বলল, “আমার আর শাওনের সাইজ এক না। ওর আঙুল আরেকটু মোটা। আরেক সাইজ বড়ো লাগবে।”
নিশান্ত আংটিটা ওর হাত থেকে খুলে রেখে বলল, “অন্য ডিজাইন দেখো।”
“কেন? এটাই তো বেশি ভালো লাগছে। হাতে ফুটে থাকবে।”
“আমার ভালো লাগছে না।”
মেহযাবীনের বিরক্তি বাড়ল, “তো নিজেই যখন পছন্দ করবেন আমাকে ডাকা কেন?”
নিশান্ত মাথা দুলিয়ে বলল, “কাম টু দ্য পয়েন্ট। ডেফেনেটলি কোনো রিজন আছে।”
মেহযাবীন তীক্ষ্ণ চোখে চাইল, “রিজনটা কী?”
“সেফটি ইস্যু। বের হয়ে কথা বলি?” নিশান্তের ইঙ্গিত বুঝে মেহযাবীন কথা বাড়াল না। শো-রুমের কর্মীরা এমনিতেই কান খাড়া করে ওদের ঝগড়া শুনছে। ওরা বেশি সময় না নিয়েই আংটি কিনল। শপ থেকে বেরিয়েই মেহযাবীন প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইলে নিশান্ত ভণিতা ছাড়াই বলল,
“তোমার কাছে একটা গোলাপের বুকে সহ চিরকুট এসেছিল। এরপর এমন আর কোনো অজ্ঞাত কিছু এসেছে?”
মেহযাবীন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়েছিল। চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
“এই আপনার রিজন?”
“তোমার কী মনে হয় তোমার সঙ্গে এখানে একাকী আড্ডা দিতে এসেছি আমি?”
মেহযাবীন দুই হাত মুঠ করে চোখ বুজে লম্বা নিশ্বাস নিল। মনে মনে নিজেকে বোঝালো, ‘কন্ট্রোল, কন্ট্রোল।’
নিশান্ত পুনরায় বলল,
“তুমি কেয়ারলেস সেটা আগেই জানতাম। কিন্তু এতটা জানতাম না। এই বিষয়টাকে এত হালকাভাবে নিচ্ছো কোন বুদ্ধিতে? চোখ কান একটু খোলা রাখলেই দেখবে তোমার চারপাশ আর আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত নেই।”
মেহযাবীন মৌন রইল। কথাটা মিথ্যা নয়। তাছাড়া তার কাছে চিরকুট আসার পর আরো একটি ম্যাসেজও এসেছে অজ্ঞাত নম্বর থেকে। আর মেহযাবীন খেয়াল করেছে তার কাছে ফুল আসাটা ভাইয়াও স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। সে গোপন না করেই বলল,
“একটা অচেনা নম্বর থেকে ম্যাসেজ এসেছিল। জানি না এক ব্যক্তি কিনা।”
নিশান্তের অভিব্যক্তি কঠিন হলো,
“আমাকে দেখাও।”
মেহযাবীন ইতস্তত করে। তাকে পাঠানো প্রেমের আলাপ আরেকজনকে দেখাতে অস্বস্তি হচ্ছে। নিশান্ত তা বুঝতে পেরে আরো কঠোর সুরে বলল, “আমাকে স্ক্রিনশটসহ সেই নম্বরটা পাঠিয়ে দেবে। আজই। ভাববে না অনধিকার চর্চা করছি। তোমার ভাইয়ার অনুমতি আছে।”
শোভা সকলের থেকে আলাদা হয়ে নিজের জন্য কিছু শপিং করেছে। পরিবারের পছন্দে ভদ্রস্থ মুখ করে কেনাকাটার অভ্যাস তার নেই। তারওপর চাঁদের বুড়ির শাসানি তো আছেই। সে দুইহাতে দুটো শপিং ব্যাগ ঝুলিয়ে আপনমনে এগিয়ে যাচ্ছিল রেস্টুরেন্টের দিকে। পথিমধ্যে বড়ো ভাই আর যাবীনের কঠিন অবয়ব তাকে থামিয়ে দিলো। এগিয়ে এসে বলল,
“কী ব্যাপার, তোমরা এমন মুখ করে আছো কেন? ঝগড়া করেছো?”
“তোর ভাই স্বাভাবিকভাবে এক মিনিট কথা বলতে পারে কিনা জিজ্ঞেস কর।”
বলেই মেহযাবীন হনহন করে হেঁটে গেল।
শোভা বড়ো ভাইয়ের দিকে চেয়ে কাষ্ঠ হেসে যাবীনের পিছু নিল। বলল,
“আপু, তুমি কী জানো তুমি আমাদের চেয়ে কম সাহসী হয়েও একটা জায়গায় দুঃসাহসী।”
মেহযাবীন হাঁটতে হাঁটতেই প্রশ্নোক্ত চোখে চাইল। শোভা বলল, “আমরা কেউ ভাইয়ার মুখের ওপর কথা বলার সাহস রাখি না। আর তুমি রীতিমতো ঝগড়া করো। তুমি কত্ত লাকি!”
যেন খুবই সাহসী কাজ করে এমন একটা দাম্ভিক হাসি দিয়ে মেহযাবীন বলল, “তোরাও করবি। ভুল কিছু বললেই প্রতিবাদ করবি।”
“কিন্তু ভাইয়া তো ভুল কথা বলে না। যথেষ্ট ভেবেচিন্তে কথা বলে। তাহলে তোমাদের ঝগড়া হয় কেন?”
মেহযাবীন থতমত খেয়ে গেল। নিশান্ত লম্বা লম্বা পা ফেলে ওদের ধরে ফেলেছে অনায়াসে। শোভার শেষ কথাটা শুনে সে কটাক্ষ করার সুযোগটা এবারও ছাড়ল না, “আমি ভুল বলি না। কিন্তু কেউ সে কথার ভুল মানে বের করতেই পারে।”
নিশান্ত নির্বিকার পথচারীর মতো পাশ কাটিয়ে চলে গেল। মেহযাবীন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, “কী বলে গেল দেখলি? এইরকম ষাঁড়ের মতো শিং উঁচিয়ে গুতো মারা কথা বললে কার রাগ উঠবে না বল?”
শোভা ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে রহস্য করে বলল, “একজন মানুষ পুরো দুনিয়ার সামনে যা নয়, তোমার সামনে তাই। সো ইউ আর ভেরি মাচ স্পেশাল, রাইট?”
মেহযাবীন থমকে দাঁড়াল। শোভার বলার ধরনটা তার পছন্দ হলো না। বলল,
“পুরো দুনিয়ার সামনে এক আর আমার সামনেই শিংওয়ালা ষাঁড় কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র। সো আমি অবশ্যই স্পেশাল। শত্রু হিসেবে।”
_____________
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বের হতে হতে রাত গড়াল অনেকটা। জাওয়াদকে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আগেই বেরোতে হয়েছে। শাওনরা ফেরার পথে মেহযাবীনকে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। নিশান্ত নিজেও রয়ে গেছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরের পার্কিং এড়িয়ায় দুই গাড়িতে সকলে একে একে বসতে শুরু করেছে। মিষ্টি হিসেব করে দেখেছে একটা সিট কম পড়বে। তাই সে গাড়ি থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়েছে যেন সকলে উঠে পড়তে পারে। নিশান্তের গাড়িটা ফাঁকাই থাকবে। অতিরিক্ত সদস্যকে তার গাড়িতে উঠতেই হবে। একে একে সকল সদস্যরা নিজেদের সিট বুঝে উঠে পড়ছিল। পরিকল্পনা সফল হতে আর কিছুক্ষণ। মেহযাবীন আপু হেঁটে আসছে। সে উঠে গেলেই প্ল্যান সাকসেসফুল। এরই মাঝে হঠাৎ মেহযাবীন হাঁটা থামিয়ে দিলো একটা কালো রেঞ্জ রোভারের সামনে। গাড়িটার দরজা খুলে গেল। কে যেন কথা বলছে মেহযাবীন আপুর সঙ্গে। পরিচিত বোধহয়। ধুর! দেরি করছে কেন? মিষ্টি ছটফটিয়ে ওঠে।
মেহযাবীন অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এমন স্থানে হঠাৎ মাহিরের সঙ্গে দেখা হবে সে ভাবেনি। লোকটাকে তার খুব যে ভালো লাগে এমন নয়। কেমন একটা চাপা অস্বস্তি ঘিরে ধরে। মাহির ওকে দেখেই ডাকল। বলল, “এখানে একটু কাজে এসেছিলাম। তুমি কী শপিং করে ফিরছো? চাইলে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি।”
মেহযাবীন কিছু বলতে মুখ খোলার আগেই একটি রুক্ষ হাত চেপে ধরল ওর কবজি। মাহিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “নো থ্যাংকস, মিস্টার। ওকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে ওর গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা আমার। আমাকেই পালন করতে দিন। ইনজয় ইয়োর টাইম।”
এরপর মেহযাবীনকে হাত ধরে এনে নিজের গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসিয়ে দিলো। মেহযাবীন ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “কী করলেন এটা? এমন করে কেউ টেনে আনে? উনি আমাদের ম্যানারলেস ভাবল নিশ্চয়ই।”
নিশান্ত গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে চেয়ে বলল, “আর পরিবার সঙ্গে থাকতেও সে তোমাকে আলাদা করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার অফার করছে এটা খুব গুড ম্যানার্স?”
“হয়তো উনি ভেবেছেন আমি একা।”
“সে কতদূর কী ভাবতে পারে তা আমাকেই বুঝতে দাও।” নিশান্ত ঠাস করে গাড়ির দরজা আটকে দিলো। এরপর শাওনকে বলল মেহযাবীনের সঙ্গে এসে বসতে।
মিষ্টি তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। নিশান্ত ওকে বলল, “তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? গাড়িতে ওঠো গিয়ে।”
মিষ্টি ব্যথিত হৃদয়ে তার বাবার পাশে গিয়ে বসল। অন্যদিকে শোভা চাঁদনি বেগমের গলা জড়িয়ে ধরে গাড়ির জানালা দিয়ে পুরো ঘটনা অবলোকন করে ফিসফিস করে বলল, “চাঁদের বুড়ি, আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই ভাবছো?”
চাঁদনি বেগম একই স্বরে ফিসফিস করলেন, “তাই তো মনে হয়।”
নিশান্ত মেহযাবীনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে জাওয়াদকে একটা নতুন তথ্য দিলো। তার ধারণা মেহযাবীনের লোকেশন ট্র্যাক করা হচ্ছে। এই সংবাদ শোনার পর জাওয়াদ তার করণীয় কি তা ঠিক করে ফেলল। সর্বপ্রথম বাবার কাছে গিয়ে বলল,
“মিহাকে বিয়ে দিয়েই আমি জার্মানি যাব।”
চলবে…