#প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৩৫]
প্রভা আফরিন
বিয়ে বাড়ি! এই শব্দটির সঙ্গে উৎসব, হৈচৈ, হাসিমজা, সাজগোজ ইত্যাদির সম্পর্কে যেন অবিচ্ছেদ্য। সেই সঙ্গে বাঙালি বিয়ের এক একটি রীতি যেমন গেইট ধরে টাকা আদায়, বরের জুতো চুরি, হাত ধোয়ানো, রুসমতও আমেজে পরিপূর্ণ হয়। এমন একটি সুখকর অনুষ্ঠানের ইতি ঘটে চোখের জলে। সেই চোখের জল একটা বিচ্ছেদের, একটা নতুন বন্ধনের। তবে আজাদ বাড়ি কর্তৃক অনুষ্ঠিত আজকের বিয়ের প্রোগ্রামটা যেন ফুটে উঠেও উঠছে না। সকলের আনন্দ অনেকটা স্ফুলিঙ্গের মতো ধপ করে উপরে উঠে এরপর নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ গতকালের আকস্মিক ঘটনা৷ দুর্বৃত্তরা হঠাৎ গোলাগুলি করে পুরো আমেজে জল ঢেলে দিয়েছে। প্রতিটি মনে সঞ্চার করেছে আতঙ্ক। ফলশ্রুতিতে দেখা গেল বিয়ের প্রোগ্রামে অতিথি যা আসবার কথা ছিল, এসেছে তার অর্ধেক। তাদেরও ফোন করে বলে কয়ে আনতে হয়েছে। পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন আছে। কনভেনশন হলের সুরক্ষা ব্যবস্থাও দ্বিগুণ করা হয়েছে। তবুও গতকালের আতঙ্ক কাটছে না।
নিশান্তের কোর্সমেট ক্যাপ্টেন সজল এসেছে বিয়েতে। এলিজিবল ব্যাচেলর বলতে যা বোঝায় তাকে ঠিক তেমনই বলা যায়। নিশান্তের সঙ্গে সজলের পরিচয় ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনা থেকেই। সেই সূত্রে পরিবারের উৎসবে, আমেজে তার নিমন্ত্রণ থাকে বাধ্যতামূলক। কিন্তু আর্মির বাধাধরা চাকরিতে কখন কোথায় পোস্টিং হয়, আর কখন ছুটি মেলে তার ঠিক নেই। ফলে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা আর হয়ে ওঠে না। এবার সজল ঢাকা সেনানিবাসে থাকায় নিমন্ত্রণটা ফসকাতে দেয়নি। সজল টিভি চ্যানেলেই শুনেছে গতকালের আকস্মিক গোলাগুলির কথা। কেউ হতাহত না হলেও অজ্ঞাত বন্দুকধারী পালাতে পেরেছে। প্রতিটি সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সেই খবর ঠাঁই পেয়েছে। শহরের অভিজাত একটি কনভেনশন হলে এমন ঘটনা বিরল। ইতিমধ্যে অজ্ঞাতজনকে আসামী করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে হল কর্তৃপক্ষ থেকে। তাদের সুনামও বিনষ্ট হয়েছে এই ঘটনায়। এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সজল বন্ধুকে বলল, “তোদের সাহস আছে বলতে হবে। এমন ঘটনার পরেও আয়োজন থামিয়ে রাখিসনি! যাক, এই সুযোগে দাওয়াতটা তো খেতে পারলাম।”
নিশান্ত জবাব না দিয়ে স্মিত হাসল। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো গতকালের বন্দুকধারীর আকস্মিক গুলিবর্ষণ ঘটনার পেছনেও আরেকটা গল্প লুকিয়ে আছে। সে খবর মিডিয়ার হাতে পৌঁছায়নি। নিশান্ত ব্যতীত ভিন্ন কেউ জানেও না।
গতকাল দুর্বৃত্তের গুলিবর্ষণের প্রথম টার্গেট ছিল সিসিটিভি ফুটেজ। সে বাইরের সিসিটিভিগুলো বিনষ্ট করে। এরপর অগ্রসর হয়ে ভেতরের দিকে। গুলিবর্ষণকারী যে ডেস্পারেট হয়ে এলোমেলো গুলি করছিল তা তার গোলাগুলির ধরনই বলে দেয়। নিশান্ত আগে মেহযাবীনসহ পার্কিংলটের আরো কয়েকজন ব্যক্তিকে নিরাপদে হলের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে বাইরে থেকে গেইট আটকে দেয়। এরপর পালটা গুলি ছুড়লে অজ্ঞাত ব্যক্তিটি পিছু হটে যায়। এত সহজে পিছু হটে যাওয়া দেখে সহজেই অনুমান করা যায় ব্যক্তিটির উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্ক সৃষ্টি করে পালিয়ে যাওয়া। যে কাজ করতে সে সক্ষম হয়েছিল। তবে নিশান্ত হার মানে না। সে ধাওয়া করে হলের পেছনের রাস্তায় ওঠে। নিশান্তের স্পষ্ট মনে আছে আধো অন্ধকার গলিতে তার রিভলবার থেকে বের হওয়া একটা বুলেট সরাসরি সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির শরীরে বিঁধেছে। যদিও ব্যক্তিটাকে সে ধরতে পারেনি। তবে বুলেটবিদ্ধ হবার প্রমাণস্বরূপ তার ব্লাড মিলেছে পথের ওপর। হয়তো আশেপাশে কোথাও গাড়ি ছিল। একটানে চলে যেতে পেরেছে। পেছনদিককার সিসিটিভি নষ্ট হওয়ায় নিশান্তের এই কর্মটি কেউ জানতে পারেনি। তার রিভলভার থেকে বের হওয়া দুটো গুলিকেও সকলে সেই দুর্বৃত্তের ভেবে নিয়েছে। নিশান্ত তৎক্ষনাৎ ব্লাড স্যাম্পল কালেক্ট করে নিতেও ভোলেনি।
“ওই জ্যন্ত পরিটা কে রে?”
সজলের কথায় নিশান্তের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। তার বন্ধু মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে ভোরের সূর্যের মতো টকটকে লাল জামদানি শাড়ি পরা মেয়েটির দিকে। যে কিনা দুদিন আগেই নিশান্তের বউয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। নিশান্ত ছোটো করে জবাব দিলো, “আমার একমাত্র বেয়াইন।”
“বরের বোন!”
সজলের গলায় উচ্ছ্বাস টের পাওয়া গেল। ব্যাপারটা কোনদিকে এগোচ্ছে তা বুঝতে ওর খুব একটা অসুবিধা হবার কথা নয়। রাজেন্দ্রাণী সেজে মেহযাবীন হলময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বসন্তের হাওয়ায় দোলায়মান লতাঞ্জের মতো তার কানে ঝুমকা দুলছে, উচ্ছ্বল ঝরণার মতো কলকল করা হাসি, চুড়ির রিনিঝিনি ছন্দ কিংবা দমকা হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো এলোকেশ যেন সন্তর্পণে এক রূপকথা রচনা করছে। শরতের খেয়ালি মেঘের মতো সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।আগত অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে। এদিকে তার রূপমুগ্ধদের দেখে যে কারো বুকের ভেতর ফণা তোলা সাপ ফোঁস করে উঠছে সেদিকে বোধহয় বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সজল আগ্রহের সঙ্গে মেহযাবীনের সঙ্গে আলাপ করতে চাইল। বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মেয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু কাউকে মনে লাগছে না সহজে। কাজেই এমন এক্সেপশনাল বিউটি যে ওর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সজল যেই মাত্র ভাবছিল মাকে বলবে মেহযাবীনের কথা তখনই গমগমে কণ্ঠটি মুগ্ধতা চিড়ে প্রবল অধিকারবোধ নিয়ে বলে উঠল, “শি ইজ মাইন। সো বি কেয়ারফুল।”
সজল হতভম্ব হয়ে গেল। কথাটা বোধগম্য হওয়া মাত্রই বিস্ময়ে তাকাল। যতদূর জানত পাইলট শিলার সঙ্গে নিশান্তের একটা উড়ো উড়ো সম্পর্ক তৈরির সম্ভাবনা ছিল। সেটাকে পায়ে ঠেলে শেষে বোনের ননদে মন থমকাল! সজল মনে মনে আপসেট হলো। মুগ্ধতা শুরু হবার আগেই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। তবুও বন্ধুত্বকে বিব্রত না করতেই স্মিত হেসে বলে উঠল, “মজা করছিলাম। শেষে পাইলট ছেড়ে বেয়াইনে মজলি?”
নিশান্ত পাতলা একটা হাসি টানল ঠোঁটে। গৌরবের মুকুট যেন সেই হাসিতে শোভা পায়। দৃঢ় সুরে বলল, “পাইলটকে কখনো ধরিনি। বেয়াইনকে কখনো ছাড়িনি।”
নিশান্ত বন্ধুকে ডেজার্টের কাপ এগিয়ে দিয়ে উঠে গেল। মেহযাবীনের শাড়ির আঁচলটা একটু বেশিই লম্বা হয়ে গেছে। লাল গালিচার মতো মেঝেতে লুটিয়ে আছে। নিশান্ত এগিয়ে গিয়ে নিঃসংকোচে আঁচলটা তুলে নিল। পেছন দিক থেকে প্যাচিয়ে এনে ডান হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “আঁচল অতি সংবেদনশীল বস্তু। এর দ্বারা যেমন নারীরুপ গোপন করা যায়, আবার উন্মুক্তও করা যায়। তোমার উন্মুক্ততা উপভোগ করার অধিকার একমাত্র আমার। একে সামলে রাখো।”
মেহযাবীন বিমূঢ় হয়ে আঁচল ধরল। গতকালের পর থেকে সে পারতপক্ষে নিশান্তের মুখোমুখি হতে চাইছে না। জীবনের কিছু দুর্বলতম মুহূর্ত থাকে, যা মানুষকে না চাইতেও তার চিরাচরিত স্বভাবের বাইরে নিয়ে যায়। যাবীনের জীবনের দুর্বলতম ক্ষণ ছিল গতকাল। যা ওকে আরো বেশি খোলসাবৃত করেছে, অন্যদিকে নিশান্তকে করেছে খোলসহীন। সে ডুবন্ত গোধূলির সবটুকু রঙ নিজের গালে ধারণ করে একছুটে নিশান্তের সামনে থেকে সরে গেল। ওদের আঁচল গুছিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি দূর থেকে মনোযোগ দিয়ে দেখল মিষ্টি। ভ্রু কুচকে বলল, “সামথিং ইজ ভেরি ফিশি।”
অন্যদিকে নিশান্ত চাঁদনি বেগমের কাছে আর্জি পেশ করল, “দাদি, মেহযাবীন আর আমার সম্পর্ক নিয়ে আগামীকাল ঘোষণা দেবে তুমি।”
চাঁদনি বেগম নাতির কণ্ঠে চিন্তার আভাস পেলেন। অকারণে কোনো কথা সে বলে না। তিনি বললেন, “তোর শাশুড়ি তো কড়াভাবে নিষেধ করেছে কাউকে জানাতে।”
নিশান্ত অবগত সে ব্যাপারে। তার ব্যবসায়ী চালাক শাশুড়ি এ কথা এমনি এমনি বলেনি। তবুও শাশুড়ির রাগ মাথা পেতে নিতে মনস্থির করে বলল, “মেহযাবীনের সঙ্গে ভবিষ্যতে সংসার বাঁধতে চলেছি এটুকু জানালেই হবে। বাকিটা আমি বুঝে নেব।”
________________
রিসেপশন পার্টি এরেঞ্জ হয়েছে শেখ বাড়ির পক্ষ থেকে। আর এটিই এই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে জমকালো আয়োজন। ব্যবসায়ীমহল থেকে রাজনীতিবিদ সকলেই নিমন্ত্রিত। এমনকি শেখ টেক্সের সঙ্গে যুক্ত সকল কর্মীদের জন্যও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এলাহি আয়োজনের মাধ্যমে শেখ বাড়ির বউকে জনসমক্ষে আনা হয়েছে। শাওনের পরনে আজ দিল্লী থেকে আনা এক্সক্লুসিভ লেহেঙ্গা। মেহযাবীনের জন্যও একই ডিজাইনারের গাউন আনা হয়েছে। হালকা ডায়মন্ডের গয়নার সাথে তার সাজ আজ রাজকন্যার মতোই লাগছে। আগত অতিথিরা ওদের আপ্যায়নে, জৌলুশে প্রশংসায় ভাসছে।
অন্যদিকে নিশান্ত তার ফোনে আসা ম্যাসেজটা দেখছে মনোযোগ দিয়ে। সময় ঘনিয়ে এসেছে। একটু পরই বেরিয়ে যেতে হবে। তার আগে কিছু কাজ করে না গেলে অশান্তি রয়ে যাবে। জাওয়াদকে ইশারায় ডেকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলো। জাওয়াদ বলল, “আর ইউ শিওর?”
“ইয়াপ! কাটা দিয়েই কাটা তুলতে হয়। শুধু দমে যাবি না। আমি একটু পরেই রওনা হচ্ছি। না ফেরা অবধি আমার বউয়ের সুরক্ষার দায়িত্ব তোর। ফিরে এসে বুঝে নেব।”
জাওয়াদ মুচকি হেসে বলল, “আমার পরিবার আমার প্রাণের অংশ। তাদেরকে স্পর্শ করতে হলে আমার পাজর ভেদ করতে হবে। তুই অপারেশন শেষ করে সুস্থভাবে ফিরে আয়। আমার প্রাণের অংশকে বুঝে নিতে হবে।”
ঠিক তখনই চাঁদনি বেগম কারো সঙ্গে আলাপ না করে, কারো অনুমতির অপেক্ষা না করে স্পিকারে একটি ঘোষণা দিয়ে বসলেন। অদূর ভবিষ্যতে উনার বড়ো নাতি নাফিউন আজাদ নিশান্তের সঙ্গে শেখ বাড়ির একমাত্র কন্যা মেহযাবীন শেখ মিহা সাংসারিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। তারই স্বীকৃতি স্বরুপ আজ ওদের আংটিবদলের ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ আয়োজনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুমা বেগম ও মেহযাবীন এই ঘোষণায় স্তব্ধ হয়ে গেল। বাকিদের উল্লাস বেড়ে দ্বিগুণ হলো। হলভরা মানুষের সামনে নিশান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মেহযাবীনের অনামিকায় নিজের স্বাক্ষর তুলে দিলো। সেই আংটিটা, যা সে মেহযাবীনকে দিয়েই পছন্দ করিয়েছিল। নিশান্ত ঝুঁকে ওর অনামিকায় একটা চুমুও খেল আলতো করে। হলময় উল্লাসধ্বনি উঠল। নিশান্ত স্মিত হেসে বলল,
“অতীতে চড় মেরেছিলাম কিছু ব্যক্তির সামনে। সেই ক্ষোভ আজও ভুলতে পারোনি। আজ হাজারো মানুষের সামনে চুমু খেলাম। আশাকরি এই স্পর্শও মনে রাখবে। আমি হারিয়ে গেলেও আমার স্পর্শকে কোনোদিন ভুলে যেও না।”
নির্বাক মেহযাবীনকে ফেলে নিশান্ত লোক সমাগমে মিলিয়ে গেল।
চলবে…
লিখতে বসে দেখি শব্দেরা পালিয়ে গেছে। কিছুতেই লেখা আসে না। এটি একটি জোরপূর্বক লেখা পর্ব।