প্রেমের_প্রদীপ_জ্বলে [৫]
প্রভা আফরিন
স্থানীয় সুপরিচিত, সম্মানিত ও দাপুটে বাড়িটির নাম দ্বীপশিখা। বাড়িটা একজন ব্রিগেডিয়ার সাহেবের শুধু এ জন্যই নয়, বংশীয় ও ঐতিহাসিক দিক থেকেও তারা স্বনামধন্য। এ বাড়িটা পাকিস্তান আমলে নির্মিত হয়। তখন অবশ্য এত আধুনিকতায় মোড়ানো ছিল না। চাঁদনি বেগমের স্বামী শরিফুল আজাদ পেশায় পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। কর্মরত ছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। তিনি একজন বিশুদ্ধ দেশপ্রেমিকও ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন পাকসেনাদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হলে তিনিও ছিলের ব্যারাকের মধ্যে। সেখান থেকে পালিয়ে আগরতলা চলে যান, ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধেই বীরদর্পে শহীদ হন। বাড়ির নাম দ্বীপশিখা রাখা হয় উনারই স্মৃতিতে। যে শিখা নিজে নিভে দেশের হাজারটা প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে যায়৷ গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই শরিফুল আজাদের নামে একটি সাদাকালো ছবিসহ স্মৃতিফলক চোখে পড়ে। চাঁদনি বেগম রোজ ভোরে এসে নিজের আঁচলে ফলকটি মুছে দেন। ফলকের চারিধারে অর্কিড লাগানো হয়েছে। সেগুলোর যত্ন নেন। উনাকে দেখে তখন মনে হয় বর্তমানে অবস্থান করছেন না। সময়টা চলে গেছে অতীতে। তিনি যেন স্বামীরই সামনে আছেন। এই নিত্যদিনকার দৃশ্যটি যেন আরো বেশি আবেগঘন করে তোলে দ্বীপশিখার আবহাওয়াকে।
পূর্বদ্বারে রক্তিম আভা ফুটেছে। সতেজ ভোর আড়মোড়া ভেঙে একটি চনমনে সূর্যযাত্রার সঙ্গী হতে প্রস্তুত। এমন সময় শোভা প্রাতঃভ্রমণের জন্য কেডস পরে বেরিয়ে এসেছে। এ বাড়িতে শরীরচর্চার প্রচলন প্রাচীন। ফলে সকালটা বেশ আড়ম্বর করে শুরু হয়৷ কারো গ্রিন টি, কারো চিয়া, ফ্ল্যাক্স সিড, কারো হানি এন্ড লেমন ওয়াটারসহ কত রকমের পানীয়-এর বায়না! সঙ্গে সকালের পত্রিকাটা চাই। তবে নিশান্তকে ভারী এক্সারসাইজ করতে হয় বলে তার জন্য বাদাম, দুধ ও খেজুরের তৈরি এনার্জি ড্রিংক তৈরি করতে হয়, যেন জলদিই খিদে না পায়। আর লম্বা সময় ঘাম ঝরাতে পারে। বাড়ির মেয়ের বিয়ের পরদিন বলেই আজকের বিশেষ ঘটা দেখা গেল না। বড়োরা বিয়ের ঝামেলায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। ফলে বাড়িটা আজ তুলনামূলক নিরব। সকলে নিভৃতে কন্যা বিয়োগের বিরহ পালন করছে।
শিউলিঝরা, শিশিরস্নিগ্ধ শরতের ভোরে একটা মিষ্টি হিম হিম আভাস থাকে। সেই মিষ্টত্বকে পদদলিত করে খটখট শব্দ তুলে লনে এলো শোভা। পনিটেইল করা পিঙ্গলবর্ণের কোঁকড়া চুল ঘোড়ার লেজের মতো পিঠের ওপর ঝুলছে। দাদিকে দেখেই অদৃশ্য টানে সেদিকেই ছুটে গেল সে। চাঁদনি বেগম ওকে দেখেই বিরক্ত চোখে চান। শোভা দাঁত কেলিয়ে বলল,
“চাঁদের বুড়ি, তোমার নেইকো জুড়ি, তোমার কথায় আমি পরেছি শাড়ি। সুতরাং আমার ডোনেশনটা দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি।”
চাঁদনি বেগমকেও যেন একই কথার সুর পেয়ে বসল। তিনিও নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন,
“হতচ্ছাড়ি! আমার কী টাকার কাড়ি?”
শোভা চুটকি বাজিয়ে জবাব দেয়,
“এবার কিন্তু হচ্ছে বাড়াবাড়ি। কথা না রাখলে তোমার সঙ্গে আড়ি।”
“তাতে আমার বয়েই গেল ভারী!”
চাঁদনী বেগম বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। শোভা আহত চোখে চেয়ে রইল। কত বড়ো প্রতারণা! ডোনেশন আটকে রেখে বললেন শাড়ি পরতে। সাংসারিক হতে। শোভা শুনল সব কথা। কিংবা বলা যায় নিজের স্টাইলে শোনার চেষ্টা করল। এখন এভাবে ফাঁকি দেওয়া! ওদিকে সে একটা ইভেন্টের ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে ডোনেশনের ভরসায়। পূর্বের অভিজ্ঞতা থাকায় বিকল্প পন্থা পেতে অবশ্য বেশি সময় লাগল না। শুধু একটা বাঁকা হাসি ফুটল ঠোঁটের কোণে।
______________
দ্বীপশিখা থেকে হাতের বাঁ দিকে এগোলে একটা সাদা রঙের শৌখিন বাড়ি নজর কাড়ে। গেইটের সামনে মার্বেল পাথরে খোদাই করা আছে বাড়ির নাম। ‘হোয়াইট হাউজ’। আমেরিকার হোয়াইট হাউজের মতো এই বাংলাদেশী হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট বাস না করলেও বাঙালি জাতের ইংরেজের দেখা মেলে। বাড়ির মালিক দস্তগীর সাহেবের বংশগত সুইটস এন্ড বেকারির বিজনেস আছে। প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মতিচুর’। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর, উপশহরে তাদের আউটলেট আছে। দস্তগীর সাহেব যতটাই বুদ্ধিমান এবং ধৈর্যশীল, উনার স্ত্রী সুলেখা ততটাই অধৈর্য, কিছুটা বোকা ধরনের মহিলা। ভীষণ সরল প্রকৃতিরও। ফলে সহজে উনাকে যে কেউ ঠকিয়ে যেতে পারে। সেই ঠকানোর লিস্টে সবার ওপরের নামটা বোধহয় শোভারই থাকবে। সে বেশ কয়েকটা ইভেন্টে সুলেখাকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করে বিরাট বিরাট ডোনেশন বাগিয়ে নিয়েছে। যার পুরো অর্থটাই গেছে কুকুর-বিড়ালদের চিকিৎসা ও খাদ্যের পেছনে। সুলেখা শো-অফ করতে ভালোবাসেন, শোভা সেই শো-অফের সুবিধা নিতে ভালোবাসে৷ দুজনের কাজের ফলাফলস্বরূপ যদি কিছু অবলা প্রাণের সেবা হয়ে যায়, তাতে মন্দ কী! এমনটাই ভাবনা শোভার।
ধানমন্ডি লেক পার্ক থেকে এক চক্কর ঘুরে এসে শোভা হোয়াইট হাউজের সামনে থামল। সূর্য তখন নিজের খোলস ছেড়ে দিনের যাত্রা শুরু করেছে৷ রাস্তাঘাট এখনো লোকারণ্য হয়ে ওঠেনি। আবাসিক এলাকা বিধায় এখানে ভারী যান চলাচল করে না। বেলা দশটার আগ পর্যন্ত চারপাশ শান্ত, নিরব থাকে। মাঝে মাঝে অফিস কিংবা স্কুলযাত্রীদের বয়ে নিয়ে যাওয়া প্রাইভেট কার, বাইক কিংবা রিকশার হর্ণ ও ল্যাম্পোস্টের তারে বসে থাকা কাকের দলের খোশগল্প শোনা যায়। শোভা কপালের ঘাম মুছে হোয়াইট হাউজে ঢুকল। গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চওড়া পথের দুই ধারে ছেঁটে রাখা ঝাউগাছ। পথের সমাপ্তিতে বাড়িতে প্রবেশের তিন ধাপের উঁচু সিড়ি। এরপর সদর দরজা। শোভাকে কলিংবেল চাপত হলো না। দরজা খোলাই আছে। পায়ের কাছে খবরের কাগজ পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিল। কী ভেবে যেন লনের পাশ কাটিয়ে বাগানে ঢুকে গেল। একটা অলকানন্দা ছিঁড়ে এনে এরপর ঢুকল বাড়ির ভেতর।
সুলেখা পাশ্চাত্যের অধুনিকতা, সৌন্দর্যের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী। নিজের মাঝেও তার কিছু ছাপ রাখেন। উনার চুলগুলো কাঁধ অবধি ছাটা। কানের পাশের চুলগুলোতে বাদামী রংয়ের প্রলেপ। গাউন এবং সালোয়ার কামিজেই অভ্যস্ত তিনি। ট্রেডিশনাল প্রোগ্রাম ব্যতীত শাড়িতে খুব একটা দেখা মেলে না। কথার মাঝেও ব্রিটিশ একসেন্ট লক্ষ্যণীয়। এসবের কারণে শোভা উনাকে ইংলিশ আন্টি বলেই ডাকে। তবে তিনি মানুষ হিসেবে ভালো। যা মনে, তাই মুখে। ভান জানেন না। শোভা বসার ঘরে ঢুকে ফুলটা এগিয়ে দিল। আহ্লাদী স্বরে বলল
“বিউটিফুল ফ্লাওয়ার ফর দিস বিউটিফুল ইয়াং লেডি। টেক ইট, আন্টি।”
ইংলিশ আন্টি বিগলিত পড়লেন। বললেন,
“থ্যাংক ইউ, মাই ডার্লিং!”
নেইলপেইন্ট করা টানটান চামড়ার ফরসা হাতটা বাড়িয়ে ফুলটা নিলেন। গুজলেন নিজের কানে। মধ্যবয়সী ও এক পুত্রের জননী এই নারী আসলেই দেখতে নজরকাঁড়া সুন্দরী। নিজের যত্ন নেন বলে বয়সের ছাপ ত্বককে কাবু করতে পারেনি।
শোভা দুই গালে হাত দিয়ে বিস্ময়ে উচ্চারণ করে,
“অলকানন্দার কানে অলকানন্দা! কাকে ছেড়ে কাকে যে দেখি! উফ আন্টি, আপনার রূপের গোপন রহস্যটা যদি বলতেন?”
ইংলিশ আন্টি ঠোঁটে একটা গম্ভীর হাসি টেনে আত্মগৌরব প্রকাশ করেন। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলেন, “যাও দুষ্টু মেয়ে! তোমরা হলে সতেজ ফুল, আমি বাসি ফুল।”
“কিছু ফুল বাসি হলেও কদর আছে। যেমন বকুল ফুল। বাসি হলেও ঘ্রাণ অমলিন। আপনি ততটাও বাসি নন। রূপ, সুবাস দুটোই অম্লান।”
“এত তেল দিয়ো না, শোভা। এমনিতেই ফুলে বেলুন হয়ে যাচ্ছে। এরপর ফানুস হয়ে উড়ে যাবে।” দস্তগীর সাহেব কেতাদুরস্ত হয়ে নিচে নামতে নামতে কথাটা বললেন।
শোভা লজ্জা পেয়ে কান চুলকায়। ইংলিশ আন্টি অবাক গলায় বললেন, “ফুলে যাচ্ছি মানে? আমি কী ওয়েট গেইন করে ফেলেছি?”
“নিজেকে আয়নায় দেখো না? মিষ্টির ভাণ্ডার আমার আর চর্বি বাড়ে তোমার!” রসিকতার সুরে বললেন দস্তগীর সাহেব। বোকা বউকে ক্ষ্যাপিয়েও আনন্দ।
ইংলিশ আন্টি রুষ্ট স্বরে বলেন, “আমি মোটেও তোমার ভাণ্ডারের সুইট ইন্টেক করি না, ময়রা কোথাকার।”
“সুইট বেঁচে পাওয়া সুইট মানিগুলো তো ঠিকই ইন্টেক করো।”
সুলেখা এবার প্রকৃত অর্থেই ফুলে উঠলেন। শোভা চায় না ইংলিশ আন্টির মেজাজ বিগড়ে যাক। ও তড়িঘড়ি করে হাতের কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল আপনার খবরের কাগজ।”
দস্তগীর সাহেবের পত্রিকা পড়ার সময় নেই৷ নতুন আরেকটা আউটলেটের জায়গা চুজ করতে যাবেন রাজশাহী। সকাল সকাল বেরোনো প্রয়োজন। তিনি চলে গেলেন। ইংলিশ আন্টি বললেন,
“তুমি বোসো, শোভা। আমি একটু আসছি। চলে যেও না।”
ইংলিশ আন্টি ভেতরে চলে গেলে শোভা আয়েশ করে সোভায় গা এলিয়ে দিল। সেন্টার টেবিলে কিছু ফ্যাশন, লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনের ওপর একটা বিস্কুটের পাত্র রাখা ছিল। ইংলিশ আন্টির পছন্দের বিদেশি ব্র্যাণ্ডের বিস্কুট। শোভা একটা তুলে নিয়ে মুখে দিতে যাবে এমন সময় কোত্থেকে ধবধবে সাদা লোমশ কুকুরটা লাফিয়ে বের হলো। চিকন কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল হাতের বিস্কুটের দিকে চেয়ে। শোভা প্রথমটায় ভড়কেছিল। সামলে উঠতেই বুঝল মালকিনের বিস্কুটে হাত দেওয়ার অপরাধেই এই চেঁচামেচি। শোভা চোখ ছোটো করে। কুকুর-বিড়াল নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকে ও। কারো সঙ্গে বিবাদ হয় না। বরং ওকে দেখলেই কুকুরগুলো দৌড়ে আসে আদরের জন্য, খাবারের জন্য। ব্যতীক্রম এই ইংলিশ ধলা কুকুরটা। দেখলেই তেড়ে আসে। শুরুতে স্বভাবসুলভ আদরের জন্যই শোভা এটার সঙ্গে ভাব করতে চেষ্টা করেছে। ছলেবলে আদর করতে চেয়েছে। কিছুতেই পারল না। ওর জানতে ইচ্ছে করে এই কুকুরকে ট্রেইন-আপ করেছে কোন ব্যাটা। শোভা চাপা গনগনে কণ্ঠে বলে উঠল,
“খাবো, আরো বেশি করে খাবো। বিস্কুটও খাবো, তোর মালকিনের মাথাও খাবো। পারলে ঠেকা।”
“টফি চেঁচাচ্ছে কেন?” ভেতর থেকে ইংলিশ আন্টির কণ্ঠ শোনা গেল। শোভা বিস্কুটটা সবে মুখে দিয়েছে। কামড়টাও দিতে পারেনি। আন্টির ফিরে আসার পদধ্বনি পেয়ে বিস্কুটটা নিজের মুখ থেকে বের করে টফির মুখে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে বসল। ইংলিশ আন্টি এসে দেখলেন টফি বিস্কুট মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গরম চোখে চেয়ে বললেন,
“তুই বিস্কুটের পাত্রে মুখ দিয়েছিস! তোকে না শিখিয়েছি নিজের প্লেট ছাড়া অন্য কোথাও খাবার দেখলেই মুখ না দিতে?”
অবলা জাত। সে শুধু জানত মালকিনের জিনিসপত্র অন্যের হাত থেকে রক্ষা করতে হয়। চোর যে উলটে তাকেই বকা খাওয়াবে কে জানত! টফি বিস্কুটটা নামিয়ে রেখে শোভার দিকে চেয়ে আবারো চেঁচিয়ে উঠল। শোভা সিলিংয়ের ডিজাইন দেখতে ব্যস্ত৷ ইংলিশ আন্টি ধমকে ওকে সরিয়ে দিলেন। যাওয়ার সময় মুখ থেকে নামিয়ে রাখা বিস্কুটটাও নিতে ভুলল না টফি।
ইংলিশ আন্টি বসতেই শোভা এবার আসল কথায় এলো। বলল,
“আন্টি সামনে আমাদের এনজিও-এর বড়ো একটা ইভেন্ট আছে। আপনি তো বেশ কয়েকবার প্রধান অতিথি হিসেবে গেছেন। আমি ভাবছিলাম এবারও যদি যোগ দেন আপনাকে সভাপতি করার জন্য প্রস্তাব পেশ করব। আপনার প্রতি সকলের পজিটিভ সাইন আছে।”
“বলো কী! একেবারে সভাপতি?” ইংলিশ আন্টির চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগাড়।
শোভা হাঁটুতে কিল দিয়ে বলল, “আলবাত। আমাদের সেচ্ছাসেবী সংস্থার কার্যক্রম বর্তমানে ঢাকায় হলেও টিম বড়ো হচ্ছে। শাখা প্রসারিত হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় ছড়াবে। আপনার নামও প্রসার হবে তখন। তাছাড়া চৌধুরী আন্টি শুনলাম নারী সংস্থা নিয়ে বেশ সরব। কিন্তু নারীদের নিয়ে কাজ করার জন্য এখন অনেক সংস্থা হয়েছে। পশু-প্রাণীদের জন্য কয়টা! ভেবে দেখুন, আন্টি।”
এলাকার সম্রান্ত, ধনী বাড়ির মানুষদের মাঝে সমাজসেবা করে নাম কামানোর একটা প্রবণতা আছে। বিশেষ করে শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের বউরা এ ধরনের কাজে ইদানীং বেশ সরব হচ্ছে। অনেকের কাছে আবার দুর্নাম ঢাকার পদ্ধতিও এটি। ইংলিশ আন্টির সেসবের দোষ নেই। কিন্তু নারীতে নারীতে অহংকার, গৌরব ও বিলাসিতা প্রদর্শনের একটা প্রতিযোগিতা আছে। ইংলিশ আন্টি সেই স্বভাববর্জিত নন। তিনি বললেন,
“তোমাদের নেক্সট ইভেন্ট কবে? আমাকে ভেন্যু, দিন, তারিখ, সময় সব জানিয়ে দিয়ো।”
শোভা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে,
“থ্যাংকিউ আন্টি। আমি সব জানিয়ে দেব আপনাকে।”
“ঠিক আছে। তুমি নিশ্চয়ই নাশতা করোনি? বসো, একটা ইটালিয়ান রেসিপিকে বাঙালি স্টাইলে করেছি। টেস্ট করে যাও।”
শোভা ঢোক গিলল। উনার হাতের এক্সপেরিমেন্টার খাবার খেয়ে পেট খারাপ হওয়ার চান্স শতভাগ। ইংলিশ আন্টি উঠতে যাচ্ছিলেন। শোভা তড়িঘড়ি করে উনার হাত চেপে ধরে বলল,
“মা আমার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে, আন্টি। আপনি প্লিজ ব্যস্ত হবেন না।”
“খাবে না? একটু টেস্ট করো। এবার খুব ভালো হয়েছে।”
শোভা ঠোঁট টিপে এদিক ওদিক চাইল৷ বলল,
“বাড়িতে আর কেউ নেই? তাহলে একসঙ্গে খাওয়া যেত।”
“আমি আর টফিই আছি আপাতত। তোমার আংকেল তো রাজশাহীর জন্য বের হলো। আর রিয়াদের ইমার্জেন্সি ওটি পড়েছে। ভোরেই বেরিয়ে গেছে।”
শোভাকে একটু নিস্তেজ হতে দেখা গেল। যেন আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বলল,
“আজ আসি, আন্টি। গোসল না করে কিছু খাব না। আবার আসব।”
শোভা উঠে দাঁড়ায়। বসার ঘরের একটা দেয়ালে ফ্যামিলি ফটো সাজিয়ে রাখা। সেখানে সবচেয়ে বড়ো ছবিটায় ওর চোখ চলে যায়। সাদা এপ্রোন পরিহিত যুবকের বিজয়ীর হাসি দেওয়া এক ছবি। দিলশান দস্তগীর রিয়াদ। হোয়াইট হাউজের একমাত্র রাজপুত্র। শোভা সেটার দিকে চেয়ে মুখ বেঁকিয়ে বেরিয়ে গেল।
দ্বীপশিখার লোহার দানবাকৃতির বিশাল গেইটের সামনে যেতেই নিশান্তের সামনে পড়ল শোভা। চলার গতি রোধ হলো আচমকা। একটা সন্ত্রস্ত, বিনয়ের ভাব ফুটে উঠল ঊনিশ বর্ষিয়া তরুণীর চেহারায়। বলল,
“শুভ সকাল, ভাইয়া।”
নিশান্ত মৃদু মাথা নাড়ল। টাইট শিডিউলের প্রফেশন বলেই নিত্য দিনকার অনুশীলন ওকে মেনে চলার অভ্যাস। বাড়িতে এলেও বসে থাকে না। তবে গত দিনের ক্লান্তির স্পর্শ তার দেহেও লেগেছে। ফলে আজ জিমে না ঢুকে একটু হাঁটাহাঁটি, ছোটাছুটি করবে বলেই মনস্থির করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে ভ্রু কুচকে ছোটো বোনের পায়ের দিকে চেয়ে আছে। মেয়েটি অত্যাধিক ছন্নছাড়া। হাতের কাজ একদমই ভালো না। দুটো কেডস-এর একটার ফিতেও সুন্দরমতো বাঁধা হয়নি। গোজামিল দিয়ে কিছু একটা করে রাখা। নিশান্ত এক হাঁটু গেড়ে বসল। গম্ভীর গলায় বলল,
“একবার দেখাব। মন দিয়ে দেখবি। এরপর থেকে জুতোর নকশা উলটোপালটা হলে কিন্তু…”
কিন্তুতেই ভাই-বোনদের গলা শুকায়। আর না শুনলেও চলবে। নিশান্ত ধীর হাতে, সময় নিয়ে এক পায়ের ফিতে বেঁধে দেখিয়ে দিল। অপর পায়ে ইশারা করে বলল,
“নাও ইয়োর টার্ন।”
শোভা কিন্তু দেখেছে মন দিয়ে। অবশ্য ও জানেও। কিন্তু কেন জানি ঠিকঠাক বাঁধতে আগ্রহই জাগে না। আর এখন তো ক্যাপ্টেনের কমান্ড মানতেই হবে। শোভা বসে অপর পায়ের ফিতেটা বাঁধতে গিয়ে ভীত মস্তিষ্কে হ-য-ব-র-ল করে ফেলল। নিশান্তকে সবাই মান্য করে। তবে এতটাও ভয় পায় না যে বিচলিত হবে। শোভা আজ বাস্তবিকই বিচলিত হচ্ছে। এর কারণটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যখন গমগমে স্বরে ভাইয়া জিজ্ঞেস করল,
“গতকাল রাতে তিনতলায় কী হয়েছিল, শোভা?”
শোভার গলা শুকিয়ে গেল। ভাইয়া যদি সত্যিটা জানে সবার কপালে দুঃখ আছে। নাকি জেনে গেছে! তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে শুকনো ঢোক গিলল সে।
চলবে….
আজকে শুধু শোভা হয়ে গেল।