#স্রোতস্বিনী
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
পর্ব ২৮
সেই অন্ধকার রাতের আজ বিশদিন।মেহরাদ এখন অনেকটাই সুস্থ।তবে এখনো হাসপাতালে আছে।আরো কয়েকদিন থাকতে হবে।বিয়ের পরে এতোদিন একসাথে থাকা হয় নি এই যুগলের।মেহরাদ যেনো এক নতুন স্রোতকে আবিষ্কার করেছে এই কয়েকদিনে।এই স্রোতকে সে চেনে না।সে এক অপরিচিত মানবী।সে মেহরাদের ভাবনার চেয়েও অতুলনীয়। মেহরাদ নতুন করে এই স্রোতের প্রেমে পড়েছে।একজন নার্স যেসব কাজ করে স্রোত সেসব কাজ করে।সময়মতো খাইয়ে দেওয়া,ওষুধ দেওয়া,শরীর মুছে দেওয়া,কাপড় বদলে দেওয়া সব কিছু স্রোত করে।মেহরাদের মাঝে মাঝে নিজের এই অচল অবস্থার জন্য রাগ হয়।পরক্ষণেই স্রোতের বিরক্তিহীন এতো যত্ন তার সব রাগ দূর করে দেয়।সে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ তাকে এমন অসুস্থতা দেওয়ার জন্যে।নাহয় সে হয়তো কখনোই তার প্রতি স্রোতের ভালোবাসার গভীরতা, তীব্রতা বুঝতে পারতো না।
মেয়েটার মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।সারাদিন রাত বিশ্রাম নেওয়ার সময়ই পায় না সে।শুধু বিকেলের দিকে বনলতা বেগম আসলে সে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে।মাঝরাতে মেহরাদের ঘুম ভেঙে গেলে স্রোতকে হয় নিজের পাশে বসে থাকতে দেখতে পায় নাহয় জায়নামাজে দেখতে পায়।মেহরাদ অনেকসময় ভেবে উঠতে পারে না এই মেয়ে নাকি বিয়েতে রাজি ছিলো না।স্রোতের বর্তমান আচার-আচরণ, সেবা শুশ্রূষা দেখলে যে কেউ বলবে ওদের বিয়ে হয়েছে অনেকবছর কিংবা তাদের ভালোবাসার বিয়ে।মেহরাদের নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়।
নিজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহরাদের মুখের সামনে তুড়ি মারে স্রোত।মেহরাদ চমকে উঠলে স্রোত হেঁসে ফেলে।ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞাসা করে,
“ইদানীং কোথায় হারিয়ে যান বলুন তো?ধ্যান কই থাকে?পাহাড় থেকে পরে কি মাথাও গেছে আপনার?”
মেহরাদ দুষ্টুমি করে বললো,
“পাহাড় থেকে পরে মাথা নষ্ট হয় নি।হসপিটালে এসে হয়েছে।”
” মানে?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে স্রোত
“বললে রাগ করবে না তো?”
“কেনো রাগ করবো?”
“হসপিটালে এসে একজন মেয়ে ডক্টরকে দেখে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে।তার ভাবনাই এখন সারাদিন মাথায় আসে।প্রেমে পরে গিয়েছি।” আয়েশি ভঙ্গিতে বলে মেহরাদ।
কথাটা স্রোতের বুকে গিয়ে লাগে।বলা বাহুল্য,মেহরাদকে একজন ডাক্তার চেক্ আপ করতে আসেন,তার নাম ডক্টর মিশিরা রাহমান।মেহরাদের সমবয়সী কিংবা একটু ছোট হবে হয়তো।স্রোত খেয়াল করেছে চেক্ আপ করতে আসলে দুইজন অনেক হাসাহাসি করে।ভাবনা বাদ দিয়ে ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করে,
“কে সে?”
“যে আমাকে সারাদিন রাত চেক্ আপ করে!” নিষ্পাপ উত্তর মেহরাদের।
“ওহ!ডক্টর মিশিরা!ভালো তো,অনেক ভালো।আজকে বললেন প্রেমে পরে গিয়েছেন,কালকে বলবেন ভালোবেসে ফেলেছি।ঠিক আছে!”
অল্পতেই যেনো স্রোত কষ্ট পেয়ে গেলো।সে বুঝতেই পারলো না মেহরাদ ঘুরিয়ে পেচিয়ে তার কথাই বলছে।স্রোত কি করে দেখার জন্য মেহরাদ আবার বললো,
“কালকে বলবো কেনো?আজকেই বলছি আমি তাকে ভালোবাসি।”
কথাটা যেনে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো ছিলো। স্রোত আর কিছু না বলে মন খারাপ করে চলে যেতে নিলে মেহরাদ সাবধানে হাত ধরে ফেলে।স্রোত অন্যদিকে তাকিয়ে টলমল দৃষ্টি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে।মেহরাদের মনে পড়ে যায় স্রোত তাকে হ্যালুসিনেশনের নাম করে কি জেলাস ফিল করিয়েছিলো।তার অধর প্রসারিত হয়। সে বাঁকা হেঁসে বলে,
“তুমি কি নকল করে মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলে স্রোত?”
অপ্রাসঙ্গিক কথা শুনে স্রোত অবাক দৃষ্টিতে মেহরাদের দিকে তাকায় আর ভাবে এই লোক বলে কি!
মেহরাদ আবার বলে,
“এতোবছর মেডিকেলে কি টুকলি করে পাশ করেছো?”
এই প্রশ্ন শুনে স্রোতের চোখগুলো বেড়িয়ে আসার যোগাড়। চোখের জল এতোক্ষণে কর্পূরের মতো হাওয়া হয়ে গিয়েছে।
মেহরাদ স্রোতের হাত ছেড়ে দিয়ে দুঃখী ভাব নিয়ে বলে,
“এতো মাথামোটা হয়ে মেডিকেলে পড়ছো!আবার আমাকে বলো আমি ঘটে কি নিয়ে ডিফেন্সে জব করি!”
স্রোত চোয়াল ঝুলিয়ে করুণ স্বরে বলে,
“আমি না আপনার কথার আগা-মাথা,গোড়া-শিকড় কিছুই বুঝতে পারছি না।”
মেহরাদ এবার পূর্ণ দৃষ্টি দেয় স্রোতের ভাবুক চেহারায়। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি রেখে বলে,
“গাধা!ডক্টর মিশিরা কখন আসে আমাকে চেক্ আপ করতে?”
“রাতের বেলায়!” ফটাফট করে বলে স্রোত।
“আর সারা দিন-রাত আমার চেক্ আপ কে করে?”
স্রোত এবারও ফটাফট বলে,
“আমি!”
“তাহলে?আমি কার প্রেমে পড়েছি?কাকে ভালোবাসি?”
স্রোতের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার হয়।
মেহরাদ হাসতে হাসতে বললো,
“দেখো নিজেকে নিয়ে নিজেই জেলাস ফিল করলে কেমন লাগে!”
স্রোত লজ্জায় পড়ে গেলো। কত বড় নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিলো সে।ইশশশশশ!মেহরাদকে জেলাস ফিল করানোর বদলা সে এভাবে নিলো।নিজেকে নিজে পৃথিবীর সবথেকে বোকা ব্যক্তির তালিকায় ফেললো স্রোত।এতো কাজের চাপে তার মস্তিষ্ক থেকে এই ব্যাপারটা বেরিয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু সে তো দমে যাওয়ার পাত্রী নয়।নিজেকে জাহির করার জন্য কোমড়ে দুই হাত রেখে গাল ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
“আমার বিলাই আমাকেই ম্যাও!”
বাক্য কর্ণপাত হতেই মেহরাদ শব্দ করে হেঁসে ফেলে।স্রোতও বিপরীতে মুচকি হাসে।জোরে হাসি দেওয়ার কারণে মেহরাদের বুকে ব্যাথা হয়।সে সাথে সাথেই বুকে হাত দিয়ে “আহহ” বলে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। স্রোত ভয় পেয়ে যায়।সে করুণ স্বরে বলে,
“কি হয়েছে?বেশি ব্যাথা করছে?আপনাকে কতবার না করেছি বেশি কথা বলবেন না।দেখলেন তো কি হলো!হসপিটালে আসার পরে আপনার পাগ লামী আরো বেড়ে গিয়েছে মেহরাদ।এমন করলে সুস্থ হবেন কি করে?”
মেহরাদ সময় নিয়ে থেমে থেমে বাচ্চামো করে বলে উঠলো,
“বিয়ের পরে বউকে এতোদিন কাছে পেয়েছি নাকি?বউ সামনে থাকলে পাগ লামী আমার অজান্তেই বেরিয়ে আসে।আমার কি দোষ!”
“চুপ!একদম চুপ।আর একটা কথা বললে ঘুমের ইনজেকশন পুষ করে দিবো।”স্রোত ধমকে বলে।
মেহরাদ আর কথা বলে নি।এতোক্ষণের হাসি, আনন্দ সব এক নিমিষেই উবে গেলো।দু’জনের চেহারাতেই বেদনার ছাপ স্পষ্ট।একজনের চেহারায় নিজের শারিরীক দুর্বলতার বেদনার ছাপ,আরেকজনের চেহারায় নিজ ভালোবাসার মানুষের অসুস্থতার বেদনার ছাপ।স্রোত মেহরাদকে ওষুধ খাইয়ে দিলো।রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা,রক্তপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা চেক্ করলো।সব ঠিক থাকায় নিশ্চিত হলো সে। জোরে হাসি দেওয়ায় বুকে টান লেগে ব্যাথা করেছে।
স্রোত মেহরাদের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে যাতে সে ঘুমায়।তাহলে একটু আরাম পাবে মেহরাদ।
এভাবে অনেকসময় পার হলেও মেহরাদ ঘুমায় না।নিলীন দৃষ্টিতে চেয়ে রয় স্রোতের দিকে।স্রোত আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“কি দেখছেন?”
“ভালোবাসার বর্ষণ।”
“কোথায়?”
“তোমার চেহারায় আমার প্রতি ভালোবাসা উপচে পরছে,স্রোত।”
“আমার চেহারায় কি লেখা আছে নাকি?”
“উহু!তোমার ঐ টলমলে দু’চোখের আকুলতা, তোমার এই মিষ্টি চেহারার ব্যাকূলতা,নির্জীবতা যে আমার প্রতি তোমার ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।”
“আপনাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না মানুষ হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়েও বউয়ের জন্য পাগ লামী করে।মৃত্যুশয্যায় থেকেও ভালোবাসার কাব্য বলে।”
মেহরাদ স্মিত হেঁসে বললো,
“কাছে আসো।”
“হুম?”
“আমার দিকে ঝুঁকো একটু!”ধীরে ধীরে বললো মেহরাদ।
“কি করবেন?”
“এতো প্রশ্ন করো কেনো!আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে স্রোত।”
করুণ কন্ঠ শুনে স্রোত আর না করলো না,ঝুকলো মেহরাদের দিকে।যে পুরুষ মৃত্যুশয্যায় থেকে প্রেমকথন শোনাতে পারে,সে পুরুষকে পৃথিবীর কোনো শক্তি আটকাতে পারবে বলে স্রোতের মনে হয় না।মেহরাদ মাথাটা একটু উঁচু করে গাঢ় চুম্বন একে দিলো নিজ প্রেয়সীর বদনে।
ধীরে ধীরে বললো,
“হসপিটালের এই কেবিনটা আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী থাকুক,স্রোতস্বিনী।”
স্রোত মুগ্ধ নয়নে নিজ ব্যক্তিগত পুরুষের পাগ লামী দেখে গেলো।
#চলবে…