#অসম্ভবেও আমার তুমি
নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–০৭
ঠিক বাজ পরার পরমুহুর্তে বিকট শব্দ থেকে নিরিবিলিতে মোড় নেয় বৃষ্টি সিক্ত একটি পরিবেশ,,,তবু বিদ্যুৎ চমকানো কিন্তু থেমে যায়না,,,আর না কমে যায় আকাশের বুকে ভাসতে থাকা কালো মেঘের উৎকট লোমহর্ষক ডাকগুলি,,,মাঝে মাঝে ভয় হতে থাকে,,এই বুঝি প্রবল ধেয়ে একটা বাজ এসে গায়ের ওপর পরলো,এক্ষুনি বুঝি ঝলসে গেলো সারা শরীর,,,এমন ভয়ে দিন পার করে প্রত্যেকটা ঘর কূনো মানুষ নামক জীব গুলো।
তাদের প্রশ্ন আসে,, ভীষণ প্রশ্ন আসে….কোথ থেকে আসে এই ভয়ানক গোলাবারুদ এর ন্যায় বাজ? দূরের ওই আকাশ টা থেকে? কিংবা এতো বৃষ্টিই বা কিভাবে সারিবদ্ধ হয়ে ঝরতে থাকে? আচ্ছা,,ওদের কি ক্লান্ত লাগেনা? জানা নেই! জীবনে এমন অনেক প্রশ্ন থাকে যার উত্তর আমাদের সত্যিই জানা নেই!
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ কুসুম ভাবনা ভাবতে থাকে স্নিগ্ধা,,,ঝুম বৃষ্টি নেমেছে দুপুর থেকে,,অবাক হওয়ার বিষয় হলো বৃষ্টির মধ্যেও কখনও কখনো রোদের ঝলকানি দেখা দিচ্ছে।
এগিয়ে এসে জানলার গ্রীলে দুটো হাতের সব গুলো আঙুল বন্দী করে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা। বড্ড শীতল চাহনীতে দেখে সানসেট ছুয়ে গড়িয়ে পরা বৃষ্টির ফোটাগুলোকে। হঠাৎ ই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছেলেমানুষীর সুরে বলতে লাগে,,
এই বৃষ্টিরা তোরা শুনতে পারিস আমাকে? দেখতে পাস?? বুঝতে পারিস আমি কি বলছি? জানিস!
আমার জীবন টাও না তোদের মতই,,,তোরা যেমন অনেক আনন্দ উৎসাহ কৌতূহল নিয়ে ওপর থেকে ছুটে আসিস আমিও ছুটেছিলাম ঠিক এইভাবে,,,কিন্তু দ্যাখ তোরা যেমন আবার মাটিতে মিশে অস্তিত্ব হীন হয়ে পরছিস,আমার অস্তিত্ব টাও ঠিক সেরকম ক্ষীন হয়ে আসছে। বড্ড ক্ষীন!
এটুকু বলে থামে স্নিগ্ধা। শিথিল হাসে,,আচমকা পেছন থেকে বিনম্র গলায় ডেকে ওঠে আবরার দের পুরোনো সার্ভেন্ট মকবূল,,
— ছোট ম্যাডাম!আপনার খাবার দেবো টেবিলে,,,??
ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকায় স্নিগ্ধা। মকবূল কে এক পলক দেখে ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকায় তনয়ার ঘরের দিকে,
,,বন্ধ দরজার ওপাশে তনয়ার বাবা,,আবরার আর তনয়া কোনও গভীর আলাপে ব্যাতিব্যস্ত। সেদিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধা।
ধীর গলায় জবাব দেয়,
— আপনি যান আমি পরে খাবো!
মকবুল ব্যাস্ত গলায় বলে ওঠে,
— কিন্তু ম্যাডাম,,স্যার বলেছেন আপনাকে তাড়াতাড়ি খাবার দিতে।
“” সেতো এখন প্রথম স্ত্রীর সাথে ঘর জুড়তে ব্যাস্ত,,,অপরাধের সাফাই দিতে ব্যাস্ত নিজের শ্বশুর এর কাছে। তার কি আর এসবে মন থাকবে,,,,
মনে মনে ভাবে স্নিগ্ধা,,যথাযথ উত্তর না পেয়ে কিঞ্চিৎ গলা বাড়িয়ে ডাকে মকবুল।
— তাহলে ম্যাডাম খাবার দেবো?
স্নিগ্ধার ধ্যান ভাঙে,, মকবুলের দিকে তাকিয়ে হাল্কা ঠোঁট এলিয়ে জবাব দেয়,
— না। খিদে নেই!
,,
,,
,,
বাবার পাশে চুপচাপ বসে আছে তনয়া। কখনও আড়চোখ তুলে দেখছে আবরার কে,,আবরার তাদের সামনের চেয়ারে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিমায় বসে আছে,,,
এবার তোফায়েল গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,,
— তোমার নতুন বিয়ের কারণ টা আমাকে বলবে আবরার?
আবরার চোখ তুলে তাকায়! উত্তর না দিয়ে চোখ ঘোরায় তনয়ার দিকে,,,
— বাবাকে দিয়ে আমাকে শায়েস্তা করতে চাইছেন তনয়া?? আপনার বুদ্ধির প্রসংশা না করে পারছিনা কিন্তু।
চট করে মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে নেয় তনয়া। তোফায়েল ক্রুদ্ধ গলায় প্রশ্ন করে,,
— তুমি আমার কথার উত্তর দিচ্ছোনা আবরার? বেশ অভদ্র হয়েছো দেখছি।
এবারো উত্তর দেয়না আবরার। আবরার কে চুপ দেখে তোফায়েল আবারও একিভাবে বলে,, ,
—- আমার মেয়ে কি তোমার ঘাড়ে বোঝা হয়ে গেছিলো? কেন এরকম করলে ওর সাথে..??
আচমকা আবরার ঠোঁট বাকিয়ে হালকা শব্দে হেসে ওঠে,,,,তনয়া তোফায়েল দুজনেই ভ্রু কুঁচকে বিস্ময় নিয়ে তাকায়,,,
বিগড়ানো মেজাজ আরো খারাপ হয়ে আসে তোফায়েলের। উঠে দাড়িয়ে রুঢ় গলায় বলে,
— আমি কি তোমাকে কৌতুক শুনিয়েছি যে তুমি হাসছো? বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে..যেটা তুমি পার করে ফেলেছো আবরার। এত বড় অপরাধ করেছো তারপরেও তোমার কথা রাখতে আমি তোমার ওই থার্ড ক্লাশ টাইপ ওয়াইফের সামনে কোনও রিয়্যাক্ট করিনি,,কিন্তু তাই বলে ভেবোনা যে আমি কিছু করতেও পারবোনা…!!
এবার আবরারও উঠে দাড়ায়,দৃঢ় গলায় জবাব দেয়,,
— আমি জানি আপনি কি করতে পারবেন,তার প্রমান আমি পেয়েওছি। কিন্তু স্নিগ্ধাকে এসব নিচু প্রকৃতির বিশেষন দেবেন না।
তোফায়েল দাঁত চিবিয়ে বলে ওঠে,
— তাহলে আমার মেয়েকে ঠকানোর ভুল তুমি কি করতে পারো আবরার?
আবরার হাসে,শীতল হাসে,,জবাব দেয়,
— আজ আপনি আমাকে ঠকাবেন,, কাল আমি আপনাকে ঠকাবো এটাইতো পৃথিবীর নিয়ম আঙ্কেল তাইনা?
চমকে তাকায় তোফায়েল । হতবিহ্বল হয়ে উঠে দাড়ায় তনয়া,,কাপা গলায় প্রশ্ন করে,,
—- মা…নে…কি..বলতে..চা..ন আপনি আবরার?
তনয়ার দিকে আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
— আপনি ভয় পাচ্ছেন মনে হচ্ছে তনয়া?? কিন্তু কেন?
তনয়া ইতস্তত করে,,,কিছু বলতে গেলেও তোফায়েল মাঝপথে বলে ওঠে,,
— আকাশ কুসুম কথা বলোনা আবরার,,,এসব বলে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার চেষ্টা করোনাহ।
জিজ্ঞাসায় গাঢ় হয়ে আসে আবরারের কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয়,বলে ওঠে,
— আমি কোনও অপরাধ করলেই না হয় নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে চাইবো, তাইনা আঙ্কেল?
তনয়া এবার তেঁতে উঠে বললো,
— দেখলে পাপা,, ওনার মধ্যে কোনও অনুশোচনাই নেই,,,ওই মেয়ের রুপের জাদুতে পুরোপুরি বশ করে নিয়েছে ওনাকে,,
আবরার তনয়ার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,,
— আমার অনুশোচনা কেন হবে তনয়া?? আর রুপের কথাই যদি বলেন,তাহলে রুপ তো আপনার ও আছে,, আপনার জাদুতে কেন বশ হলাম না আমি??
বাবা মেয়ে দুজনের মুখই তিক্ত হয়ে আসছে আবরারের এমন রসিকতাপূর্ণ কথায়। চোখে মুখে তীব্র বিরক্তি নিয়ে তনয়া জবাব দিলো,
— কারন আমি বশিকরন শিখিনি,,
আবরার চট করে বলে ওঠে,
— ফাসাতে শিখেছেন তাইতো??
তোফায়েল এবার ক্রোধান্বিত হয়ে মাঝপথে উত্তর দেন,
— পুরোনো কথা রাখো আবরার। যা হয়েছে হয়েছে,,,তাই বলে তার রেশ ধরে তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারোনা।
আবরার শান্ত গলায় বললো,
— কেন পারিনা আঙ্কেল??
তোফায়েল দাঁত চিবিয়ে বলে,
— কারণ টা তুমি জানোনা?? এক স্ত্রী থাকা কালীন আরেকজন কে স্ত্রী বানানো অন্যায়। ঘোর অন্যায়।
আবরার ওপর নিচ মাথা ঝাকায়। বলতে লাগে,
— ওহ আচ্ছা আচ্ছা। তাই?? কিন্তু আঙ্কেল তনয়া আমাকে ভালো বাসতো বলে ও আমাকে বিয়ে করেছে,,তাহলে আমি যাকে ভালোবাসি তাকে আমি বিয়ে করবো সেটা কেন অন্যায় হবে??
তনয়া এবার অধৈর্য গলায় বললো,
— আপনি না জানার ভান করছেন তাইনা?? কি প্রমান করতে চাইছেন আপনি?? আমরা বুঝতে পারছিনা আপনার চালাকি??
আবরার মুচকি হেসে বলে ওঠে,
— চালাকি তো আমি আপনাদের বুঝিনি তনয়া,,,যেটা আপনি আর আপনার ভদ্র লোক বাবা করেছিলেন,,
এবার চালাকি শুধু আপনারাই করবেন,,বাজি মাত দেবেন,,অন্যরা শুধু তার ভুক্তভোগীই হবে,তারা কিছুই করবেনা? তাইতো?
তোফায়েল উত্তেজিত গলায় বলে,
— এসব বলে তুমি সত্যিই কি প্রমান করতে চাইছো আবরার,,,?
আবরার ভ্রু কুঁচকে বলে,
— কিছুই না আঙ্কেল,,আমি তো কোর্টে আসিনি যে প্রমান করবো,, হাত জোর করে বলবো জজ সাহেব আমি নির্দোষ আমাকে ছেড়ে দিন…
কথাটা বলেই শব্দ করে হেসে ওঠে আবরার। তনয়া অবাক হয়ে একবার আবরারের দিকে তাকায় আরেকবার বাবার দিকে,,
আবরারের এমন বিশ্রি মজা গুলো আরো অধিক বিশ্রি লাগতে শুরু করে তোফায়েলের।
রাগে ক্রোধে এক হাতের কব্জি দিয়ে আবরারের গলায় ঝোলানো টাই শক্ত ভাবে হাতে পেঁচিয়ে টেনে ধরে তোফায়েল,,,,কোপিত ক্রুদ্ধ গলায় বলে,
— অনেক হয়েছে তোমার ফাজলামো আবরার। এতক্ষন সহ্য করেছি তুমি আমার মেয়ের জামাই-ই নও বরং আমার বন্ধুর ছেলে বলে,,,কিন্তু তুমি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছো,,,
একে তো একটা মালির মেয়েকে বিয়ে করে আমার মেয়েকে ঠকিয়েছো তারওপর আবার দাঁত কেলিয়ে হেসে অপমান করছো আমাদের?
মৃদূ হেসে তোফায়েলের হাতের মুঠো থেকে টাই ছাড়িয়ে নেয় আবরার। ছোট্ট একটা দম ফেলে বলে ওঠে,,
—- এই একই কথা তো আমিও বলতে পারি আঙ্কেল,,,,শুধুমাত্র আপনি আমার বাবার বন্ধু বলেই আমিও আপনাকে সন্মান দিচ্ছি… নাহলে এমনও তো হতে পারতো যে আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলাম… তাইনা?
তনয়া বিস্মিত হয়ে পরে আবরারের এমন কথায়,,
অন্যদিকে আগুন চোখে তাকিয়ে ধমকে ওঠে তোফায়েল…!!
— আবরার…হাউ ডেয়ার ইউ..??
তুমি আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে?? তোমার এত স্পর্ধা??
— আমার স্পর্ধা অনেক বেশি সেটাতো আপনি জানেন ই,,,কিন্তু এই যে আপনাকে আমি সন্মান দিচ্ছি এটা আমার ভয় বা
স্পর্ধা কম হওয়ার দরুন নয় আঙ্কেল…!! এটা আমার ভদ্রতা।
শীতল গলায় জবাব দেয় আবরার।
তনয়া বিস্মিত চোখে চেয়েই বললো,
— আপনার কি হয়ে গিয়েছে আবরার। আপনি আমার সাথে যা করছেন আমি মেনে নিয়েছি তাই বলে আমার বাবাকেও অপমান করছেন তাও ওই দুই টাকার মেয়ের জন্যে,
সরু চোখে তাকায় আবরার। শক্ত গলায় বলে ওঠে,
— কথা আমাদের মধ্যে হচ্ছে তনয়া। স্নিগ্ধাকে এর মাঝে আনবেন না। আর আমার কিছুই হয়নি,শুরু থেকেই আমি এমন টাই ছিলাম এবং ভবিষ্যৎ এও এমনি থাকবো,,,
আপনি সব মেনে নিচ্ছেন কারণ বিয়েতে আপনার মরিয়া হওয়ার যুক্তিকতা ছিলো,আমার নয়।
তনয়ার চোখ সিক্ত হয়ে আসে অশ্রুতে,,,ফিচেল গলায় বলে,
— আপনাকে ভালোবেসে আমি তবে অন্যায় করেছি?? এটাই বলতে চাইছেন?
আবরার নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো,,
— ভালোবাসা অন্যায় সেটাতো বলিনি। মিথ্যে বলে বিয়ে করা অন্যায়।
এ পর্যায়ে কান্না মুখেই বিদ্রুপ করে হেসে ওঠে তনয়া,,,ভ্রু নাঁচিয়ে বললো,
— আপনি নিজেও তো ওই মেয়েটাকে মিথ্যে বলে জোর করে বিয়ে করেছেন তাইনা আবরার?? তাহলে একই দোষে তো আপনি ও দোষী হলেন।
আবরার শান্ত গলায় উত্তর দেয়,
— আমি মিথ্যে বলিনি,,,আর বিয়েতে ওকে কোনও জোরাজুরি ও করিনি,,,
আপনি এসব ছাড়ুন,,আমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার আমরা বুঝে নেবো।
তনয়া কিছু বলতে নিলে তোফায়েল ধৈর্য হীন গলায় বলে ওঠে,
— এতোটা পতন হয়েছে তোমার? এক স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে অন্য স্ত্রীর কথা তুলছো?? বাহ! ভেরী গুড। ভাগ্যিশ আসাদ বেঁচে নেই। নাহলে ছেলের এত উন্নতি দেখে হয়তো নিজেই সুইসাইড করতো,,,
আবরার স্ফীত হাসে,বলে ওঠে,
— সুইসাইডের থেকেও অনেক বড় স্বাদ আপনি ওনাকে দিয়েছিলেন তো,,, ওটাই অনেক।
এটুকু বলে থামলো আবরার,,,পরক্ষনে তোফায়েলের গরম চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
— আপনার আর কিছু বলার আছে আঙ্কেল?? অনেকটা জার্নি করে এসেছি তো,,,বিশ্রাম দরকার,আপনিও নিশ্চয়ই জার্নি করে এসছেন?? তাহলে আমি মকবুল কে বলছি গেস্ট রুম টা খুলে দিতে,,,কেমন!
আবরার উল্টো ঘুরে হাটা ধরতেই পেছন থেকে অসহ গলায় তোফায়েল বলে ওঠে,
— এতো দাপট দেখাচ্ছো,,,,আমাকে। এই তোফায়েল পাঠান কে?? চাইলে আমি তোমাকে জেলে ঢোকাতে পারি সেটাকি তুমি জানো আবরার??
আবরার পিছু ফিরে তাকায়,,ভ্রু নাঁচিয়ে প্রশ্ন করে??
— তাই.. তা আমার কোন অপরাধে আমাকে জেলে দেবেন আঙ্কেল?
তোফায়েল এবার বাকা হেসে বলেন,
— তুমি তো ছোট আবরার,টগবগে রক্ত তোমার,,,আঈনের ব্যাপার স্যাপার খুব একটা জানোনা এখনও।
আর তাই অজান্তে এমন একটা ভুল কাজ করে ফেলেছো। আমি বুঝতে পারছি।ব্যাপার নয়, এসব ছোট খাটো বিষয় মেটানো আমার বা হাতের কাজ!
আবরার ঠান্ডাস্বরে জবাব দেয়,
— হতে পারে,,,অন্তত আপনার থেকে প্যাঁচালো দুনিয়া কম চিনেছি এটাতে আ’ম শিওর। তবে আপনার কোন আঈন আমাকে জেলে নেবে সেটাওতো বলুন।
তোফায়েল কিছু বলার আগেই তনয়া ভাঙা গলায় বলে ওঠে,
— আমি বলছি আবরার।
এবার এগিয়ে এসে আবরারের মুখোমুখি দাড়ায় তনয়া। জিজ্ঞাসুচক ভঙিমায় তাকিয়ে থাকে আবরার। তনয়া এবার বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে,
— আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন আবরার,,দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়,,,আর আপনার আর ওই মেয়েটার বিয়েতে আপনি আমার অনুমতি নেননি,,সুতরাং আমি আপনার বিরুদ্ধে মামলা করলে কি হবে ভাবতে পারছেন..??
আবরার অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
— কি হবে তনয়া?? ফাসি??
পাশ থেকে তোফায়েল মোটা গলায় জবাব দেয়,
— সেটা সময় এলেই বুঝবে,,
তনয়া পুনরায় কঠোর গলায় বলে ওঠে,
— ফাসি না হোক,,,কমসে কম জেল তো খাটবেন,,,কিন্তু আমি এরকম কিছুই করতে চাইছিনা আবরার। যদি আপনি ওকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে মেনে নেন তো। এখন আপনিই ভাবুন আপনি কি করবেন,,,নিজের ভালোটা কিন্তু পাগল ও বুঝতে পারে।
আবরার চিবুকে হাত ঠেকিয়ে ভাবার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
— সত্যিই চিন্তার বিষয় তো৷ আপনি কিন্তু আমাকে ভয় পাইয়ে দিলেন তনয়া,,
তনয়া এবার ক্ষিপ্ত স্বরে জবাব দেয়,
— আপনি কি ভাবছেন আমি মজা করছি আবরার?
আপনি চান আমি এমন করি…
আবরার সোজা হয়ে পকেটে হাত গুজে দাঁড়ায়। কিঞ্চিৎ বাকা হেসে বলে ওঠে,
— সেটা অবশ্যই আপনার আর আপনার বাবার চয়েজ। আপাতত আমার চয়েজ হলো আমাকে স্নিগ্ধার কাছে যেতে হবে….সো আমি আসি এখন??বাই!
তনয়ার দিকে মুচকি হেসে দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আবরার। পেছনে মেয়ের হতাশ দৃষ্টির সাথে সাথে আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে থাকে তোফায়েল।
— অনেক উড়ছো আবরার,,,অনেক। এর শাস্তি আমি তোমায় দিয়েই ছাড়বো
,,
,,
কাধে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে পেছন ফেরে স্নিগ্ধা।
আবরার ভ্রু নাঁচিয়ে প্রশ্ন করে,,
— তোমাকে তো রুমে যেতে বলেছিলাম।।তুমি এখানে কি করছো??
স্নিগ্ধার মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে আসে আবরার কে দেখে। ক্ষুন্ন গলায় উত্তর দেয়,,,,,
—- এমনি দাঁড়িয়ে আছি।
আবরার ভ্রু বাকায়,,নিচের ঠোঁট জ্বিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয়,,,
কিছু একটা ভেবে চট করে কোলে উঠিয়ে নেয় স্নিগ্ধাকে। আচমকা ব্যাপারটাতে হকচকিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা,,,ভারসাম্য রাখতে আবরারের গলা জড়িয়ে ধরে হাত দিয়ে। ব্যাস্ত গলায় বলে ওঠে,
— কি করছেন নিচে নামান আমায়,পরে যাবো।
আবরার কোনও কথা কানে না নিয়ে রুমের দিকে হাটা ধরে,,,,স্নিগ্ধা অনর্গল নিচে নামাতে বললেও পাত্তা দেয়না সেসবে। রুমের ভেতরে প্রবেশ করে পা দিয়ে দরজা ঠেলে দেয় আবরার। খট করে শব্দ তুলে আটকে যায় সেটি,,এগিয়ে এসে স্নিগ্ধাকে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। স্নিগ্ধা প্রথম কয়েক দফায় অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে,,,আবরার গায়ের কোর্ট খুলতে খুলতে বলে ওঠে,,
— এভাবে তাকিয়ে না থেকে,,, গিয়ে শাড়ি পাল্টে নাও যাও,,,,ক্ষিদে আমারো পেয়েছে।
স্নিগ্ধা একিভাবে বসে থাকে,এবার স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে কপাল কোঁচকায় আবরার।
— কি হলো? যাও।
স্নিগ্ধা মাথা তুলে তাকায়,,,,শীতল গলায় প্রশ্ন ছোড়ে,,
— তনয়া আপু অনেক বড় লোকের মেয়ে তাইনা?
স্নিগ্ধার প্রশ্নে কৌতূহলে গাঢ় হয়ে আসে আবরারের ভ্রু কুঞ্চন।
— হঠাৎ এই প্রশ্ন..??
স্নিগ্ধা মৃদূস্বরে জবাব দেয়,
— ওনার বাবাকে দেখে মনে হলো।
আবরার এবার ভ্রু সোজা করে স্বাভাবিক মুখে বলে ওঠে,
— আর কি মনে হলো..??
স্নিগ্ধা শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
— কিছুনা।
কিছুক্ষনের জন্যে চুপ করে যায় দুজনে,,,,, ততক্ষনে শার্ট থেকে শরীর উন্মুক্ত করে আবরার।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে স্নিগ্ধার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাড়ায়।
এবার স্নিগ্ধা এগিয়ে আসে আবরারের দিকে,,,উদ্বেগপূর্ণ গলায় বলে ওঠে,
— আমাকে বাড়িতে কবে দিয়ে আসবেন তাহলে..??
আবরার স্নিগ্ধার দিকে সরু চোখে তাকায়,জবাব দেয়,
— আজকেই না এলে,,তাহলে? এত ঘনঘন বাবার বাড়ি যেতে নেই,,,,প্রয়োজন পরলে ওনাদের ডেকে নিও।
স্নিগ্ধা শান্ত ভাবে বলে,,,
— আমি বরাবরের মতো দিয়ে আসার কথা বলছি।
আবরার ভ্রু কুঁচকে নেয়,,
— মানে.??
স্নিগ্ধা ধরা গলায় উত্তর দেয়,
— আজ নিশ্চয়ই কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনি?? আর সেটা নিশ্চয়ই আমাকে ডিভোর্স দেয়ার। আমার কিন্তু এতে কোনও আপত্তি নেই।
আবরার এবার গা কাপিয়ে হেসে ওঠে, এরুপ হাসির কারণ বোধগম্য হয়না স্নিগ্ধার,,,বোকার মত তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ।
আবরার আলমারির দিকে এগিয়ে গিয়ে ধূসর রঙের শার্ট বের করে পরতে শুরু করে।
স্নিগ্ধা এবার উদ্বেজিত গলায় বলে,
— কি হলো বললেন না যে,
আবরার শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে জবাব দেয়,
— কি বলবো?? ও হ্যা তোমাকে বাড়িতে বরাবরের জন্যে কবে দিয়ে আসবো?? বা তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি কবে?
স্নিগ্ধা নিচের দিকে তাকিয়ে হ্যা বোধক মাথা ঝাঁকায়,
আবরার কিছু না বলে এগিয়ে আসে ওর দিকে,,,ডান হাত দিয়ে স্নিগ্ধাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস গলায় উত্তর দেয়,,
— সেটা যে এ জীবনে হচ্ছেনা স্নিগ্ধা আবরার চৌধুরী।
স্নিগ্ধা
আবরারের ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে এর আগেই তার চোখ পৌছায় আবরারের গলার দিকে। সেদিকে কিছুক্ষন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধার এরুপ দৃষ্টি দেখে আবরার ভ্রু নাঁচিয়ে বলে ওঠে,
— এভাবে কি দেখছো?
কৌতুহলী মুখ নিয়ে স্নিগ্ধা আবরারের গলার দিকে চোখ ইশারা করে, প্রশ্ন করে,,
— এটা কিসের আঁচড়?
আবরার একবার সেদিকে তাকায়,,কিন্তু দৃষ্টি তার যথাযথ জায়গায় না পৌছালে হাত বোলায় গলাতে,মুহুর্তেই জ্বলে ওঠে জায়গাটা।
স্নিগ্ধা আবারো অধীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
— বলুন এটা কিসের আঁচড়?
আবরার নির্বিকার ভাবে উত্তর দেয়,
— তনয়ার নখের আঁচড়…
স্নিগ্ধা প্রথম দফায় ভ্রু কোঁচকায়,,বিস্মিত হয়,, কয়েক মুহুর্তে নিজেকে সামলে উদ্বেগ গলায় প্রশ্ন ছোড়ে,
— মানে?
আবরার স্নিগ্ধার মুখের দিকে ঝুঁকে আসে,, বাকা হেসে জবাব দেয়,
— একটা মেয়ের নখের আঁচড় কখন একটা ছেলের গলায় থাকে মানেটা তুমিই বুঝে নাও,,,
মুহুর্তেই কান ভারীর সাথে সাথে কাঠ হয়ে আসে স্নিগ্ধার মুখমণ্ডল।
চলবে।