#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪০
#লেখনীতে_প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
সুজানা শাড়ি পাল্টে কামিজ গায়ে মুখহাত ধুঁয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই খাটের উপর মাকে পা ভাঁজ করে বসা দেখতে পেল। শপিং ব্যাগটা খুলে শাড়িটা মেলেছে তারপর চুড়ির বাক্সটা খুলছে। সুজানা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে মায়ের পেছনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মা বুঝতে পারলেন মেয়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রশ্ন ছুঁড়লেন
শাড়িটার বেশ দাম হবে। ছেলেটা টাকা পয়সা কামাই?
সুজানা তোয়ালেটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে জানতে চাইলো
কোন ছেলেটা আম্মা?
যে শাড়িটা দিল।
সুজানা জবাব দিল না।
সাজিয়া বেগম চুড়ির বাক্স খুলে চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন। বললেন
পছন্দ ভালো। টাকা পয়সা কামাই ও?
মাথা ধরেছে আম্মা। আগে চা খাই?
শাড়ি আর চুড়ি গুলো নিয়ে বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে সাজিয়া বেগম বললেন
বানিয়ে রেখেছি। খেয়ে যাহ।
সুজানা চটজলদি প্রশ্ন করলো।
এসব নিয়ে কোথায় যাচ্ছ আম্মা?
এগুলো যার কাছ থেকে এনেছিস তাকে ফেরত দেব। আর বলব এইসব জিনিস দেয়ার মানুষ তোর আছে। শুধু শুধু তোর পেছনে টাকা খরচা না করে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া ভালো।
কার কথা বলছ?
মশকরা করছিস? আমি জানি না এসব কে দিয়েছে তোকে? মিথ্যে বলে তুই করিমের সাথে দেখা করতে গিয়েছিস?
প্রশ্ন খুব রুঢ় গলায় বললেও সুজানা হাসি পেল। সে বহুকষ্টে হাসি চেপে ভেজা তোয়ালেটা জানালায় মেলে দিতে দিতে বলল
তোমাকে এভাবে কেউ দিলে ফেরত দিতে?
উদ্দেশ্য এইরকম থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম।
সুজানা ফিরে বলল
ওর উদ্দেশ্য তুমি বুঝতে পেরে গেছ?
কেন তুই বুঝিসনি? শোন সুজানা এতদিন কেন পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করবি বলছিলি আমি এবার বুঝে গিয়েছি। আমি তোকে অত সময় দিচ্ছি না। করিমকে কাল আসতে বলবি।
সুজানা মাথা নাড়ালো। সাজিয়া বেগম যেতে যেতে বললেন
এখনো এটুকুনি ছেলে! রুইমাছ কিনে দিচ্ছে, শাড়ি কিনে দিচ্ছে। শয়তানি সব। আসুক একবার এখানে।
সুজানা দরজা বন্ধ করে হেসে নিল। অভিক ফারদিনের কপালে দুঃখ আছে।
সাজিয়া বেগম রাগ করে করিমের নাম্বারটাও ব্লক করে দিয়েছে। কি সুন্দর সুন্দর কথা বলে গলানো হচ্ছিল উনাকে। অসভ্য ছেলে।
______________
রাতের খাবারটা মাত্রই খেয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে সুজানা। অভিকের দেওয়া বইটা শেষের দিকে। আজকে অন্যকিছুতে তার মন বসছে না। সবকিছু হালকা হালকা লাগছে। এই মুহূর্তে অভিক ফারদিন ছাড়া অন্য সবকিছু ঝাপসা। এত এত চিন্তায় তার মাথা ঝিমঝিম করছে। কি করে আসন্ন পরিস্থিতিকে সে সামাল দেবে?
সুজানা ফোনটা কয়েকবার চেক করলো। একটা ছোট্ট মেসেজ এসেছিল সে বাসায় পৌঁছানোর পর।
পৌঁছেছেন?
সুজানার হাতটাও যেন কাঁপছিল তখন ” জ্বি” বলার সময়। কত পরিচিতের মতো তারা আজ কথা বলেছে। গোঁটা তিন মাসের জমিয়ে রাখা অভিমান গুলো এক দেখায় আলতো হয়ে গেল। সুজানা একফোঁটা সুযোগও পায়নি বলার ” গত তিনমাস আপনি আমার খোঁজ নেননি “।
তার এত এত সাজিয়ে রাখা কথাগুলো যেন তখন কোথায় হারিয়ে গেল । নিজেকে এত পাগল পাগল এর আগে কখনো মনে হয়নি।
খেয়াল করলো তার ফোনটা বাজছে। ফোনের স্ক্রীনে ” এ ” লেটার স্পষ্ট। সে চোখ বন্ধ করলো। রোজ শোনা ফোনের টিউনটা অন্য দিনের চাইতে আজ বেশি ভালো লাগছে শুনতে। চোখ মেলতে যাবে তার আগেই টিউন অফ হয়ে গেল। চোখ মেলে দেখলো মা ফোনটা কানে ধরে রেখেছে। আর ঠোঁট নেড়ে বলল
ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি সুজানার আম্মা বলছি।
করিমের গলা না শুনে কোনো এক মহিলার গলা শুনতে পেলেন সাজিয়া বেগম।
আমি সুজানার আম্মাকেই খুঁজছি।
গলা শুনে সুজানা চমকে গেল। এটা কি রাগী আন্টি?
সাজিয়া বেগম মেয়ের দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন
আপনি কে বলছেন? এটা তো করিমের নাম্বার।
ওপাশে খানিকটা নীরবতা। তারপর আওয়াজ এল।
আমি নবকুঠির থেকে বলছি। অভিক ফারদিনের মা। আমাকে চিনতে পেরেছেন?
সাজিয়া বেগম দ্রুত সুজানার দিকে তাকালেন। সুজানা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকালো মায়ের দিকে। তার বুকটা অসম্ভব রকম কাঁপছে।
সাজিয়া বেগম বললেন,
মাস্টারের মায়ের সুজানাকে কি দরকার হতে পারে?
বাচ্চার বাবার একটা মেয়ের শখ ছিল যে বাইরে বেরোনোর আগে চশমাটা খুঁজে দেবে।
আর আমার মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দেয়ার মতো একটা মানুষ। আমার পর ছেলেটাকে দেখে রাখার মতো বিশ্বস্ত কাউকে। অনেক দেরী হয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম সুজানাই তিনজনের শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারে আর ভরসার জায়গা হতে পারে।
সাজিয়া বেগম খেয়াল করলেন সুজানা মাথা নামিয়ে মেঝেতে চোখ ফেলে রেখেছে। তার চোখে টলমল করছে জলের ধারা।
মায়ের চোখের দিকে না তাকিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিল সে। সাজিয়া বেগম এবার মুখ খুললেন।
ও বিয়ে করতেই চায় না। অনেক কষ্টে আমি রাজী করিয়েছি ফাইনাল পরীক্ষার পর ওর বিয়ে নামাবো। আপনি ওর কাছ থেকে যা আশা করছেন তা পাবেন না।
আমি ওকে আমার মতো করে শিখিয়ে পড়িয়ে নেব। বকুনিঝকুনি দেয়ার পর পাঁপড় ভেজে খাওয়াবো। আজ আড়ি দিলে কাল আবার ভাব করে নেব। দিনশেষে ও আমাদের সাথে ভালো থাকবে। আপনি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে প্রশ্ন করে দেখুন ও এখন আর বিয়ে বিমুখী নেই।
ফোনটা ওকে দিন। ওর সাথে জাস্ট দুটো কথা বলব। যদি ও চায় এই ফোন আসা যাওয়া অটুট থাকবে। যদি না চায় কখনোই আর ফোন যাবে না।
সাজিয়া বেগম ধীরপায়ে হেঁটে রান্নাঘরে গেল। রান্নাঘরে মায়ের প্রবেশ দেখে সুজানা ওড়নার কোণায় মুখ মুছতে থাকলো।
কথা বলতে চায়।
সুজানা ফোনের দিকে তাকালো।
নে।
ফোনটা নিল সে। মায়ের ইশারায় কানেও দিল। তার নাক টানার শব্দ ওপাশে স্পষ্ট হতেই সালমা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন
আমাকে শুনতে পাচ্ছ মেয়ে?
সুজানা চোখের কোণা মুছতে মুছতে ছোট্ট করে জবাব দিল
জ্বি।
আমার অপরিপূর্ণ সংসার পরিপূর্ণ করার জন্য একটা অপরিপক্ক সুজানার দরকার। তাকে পরিপক্ব করার দায়িত্ব এই সংসারের। শোনো মেয়ে আমার পরে আমার হাবাগোবা ছেলেটার দায়িত্ব কিন্তু তোমাকে নিতে হবে।
তোমার মাকে বুঝাও তুমি ছাড়া এই বাড়ি অসম্পূর্ণ। এই বাড়ি ছাড়া তুমি অন্যকোথাও অসম্পূর্ণ। কাল এসে তোমাকে দেখে যাব। অভির দেয়া শাড়িটা পড়ো। ঘোমটার আঁচলটা একটু লম্বা রেখো। অনামিকা আঙুলটা তোমার মাস্টারমশাইয়ের জন্য খালি রেখো। আমি লুকিয়ে একটা কালো টিপ নিয়ে যাব যাতে আর কারো নজর না পড়ে। আমাদের জন্য দুটো টোস্টবিস্কিট আর একটু গরম চায়ের ব্যবস্থা থাকলেই হবে।
চলবে