#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বিশ[প্রথমাংশ]
ভরা ক্যাম্পাসে একটা ছেলের গায়ে সপাটে থাপ্পড় মে’রে বসলো তারিন। প্রথমদিন কলেজে এসেই এমন পরিস্থিতে পড়তে হবে, তারিন ভাবতেও পারেনি। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারিনের দিকে। তারিনও রাগী দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে চেয়ে আছে। ওর পাশেই তামজিদ বেশ শান্ত হয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ানো। ক্যাম্পাসের উপস্থিত সবার দৃষ্টি ওদের উপর। কি হয়েছে কেউ বুঝছে না।
‘কিছুক্ষণ আগের ঘটনা’
–
–
প্রথম দিন কলেজে পা রাখতেই হুট করে কেউ একজন পেছন থেকে তারিনের বেনুনী টেনে ধরতেই, তারিন ব্যাথায় খানিকটা কুকিয়ে উঠলো। পেছন ফিরে দেখলো কয়েকটা ছেলে এক জোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে তারিন মনে মনে বেশ ঘাবড়ে গেলেও মুখ স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠল। ছেলে গুলোর মুখে রয়েছে হাসি। তারিন সোজাসাপটা কঠিন স্বরে প্রশ্ন করল,
“কারা আপনারা? আমার বেনুনী ধরে এভাবে টান কেনো দিলেন?”
ছেলে গুলোর মাঝে একজন বেশ হাস্যজ্বল স্বরে বলে উঠল,
“আমাদের চিনো না, মামনি? তাহলে চলো একটু চিনিয়ে দেই।”
“আপনাদের চেনার মতো সময় বা রুচি কোনোটাই আমার নেই। একবার অসভ্যতামি করেছেন আমি কিছু বললাম না। দ্বিতীয় বার ভুলেও একই কাজ করলে বুঝবেন আমি কে?”
বলেই তারিন সামনের দিকে হাঁটা ধরতেই, পেছন থেকে একজন বলে উঠল,
“আরে, আরে কোথায় যাচ্ছো? আমরা তো তোমাকে চিনতেই চাই, বেবি। তোমার ওই নরম হাতের ছোঁয়া পেতে চাই।”
তারিনের পা জোড়া থেমে গেলো। ছেলেগুলোর চাহনী আর কথা বলার ভঙ্গি দেখে রাগে শরীর রি রি করে উঠল। কিন্তু প্রথম দিন কোনো প্রকার ঝামেলায় জড়াতে চায় না বলে, তারিন চুপ রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল।
“কি হচ্ছে এখানে?”
হুট করে চেনা কণ্ঠ স্বর পেতেই তারিন পেছন ঘুরে তাকালো। তামজিদকে দেখেই মুখে হাসি ফুটল। তারিন আর তামজিদ দুজনেই একসাথে এসেছিলো। তারিনকে নামিয়ে দিয়ে তামজিদ গাড়ি পার্কিং করতে গিয়েছিলো। তামজিদ গাড়ি পার্কিং করার সময় দূর থেকে সবটাই খেয়াল করেছে। তামজিদকে দেখেই ছেলেগুলো ভয় পেলো খানিকটা। আমতা আমতা করে একজন বলে উঠল,
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার। ভালো আছেন।”
তামজিদও বেশ শান্ত স্বরে জবাব দিলো,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ! তা তোমরা এখানে কি করছো?”
ছেলেগুলো কিছু বলার আগেই তারিন এগিয়ে এসে বলল,
“আমি বলছি, মাস্টার মশাই। এখানে কি হয়েছিলো।”
তারিনের মুখে ‘মাস্টার মশাই’ শব্দটা শুনে ছেলেগুলো একটু অবাক হলো বটে। সচারাচর সবাই ‘স্যার’ শব্দটা ব্যবহার করে। তারিন অন্যরকম ভাবে সম্মোধন করলো। তামজিদ তারিনের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
“আমি আপনার কাছের থেকে শুনতে চাইনি। আপনি এখানে চুপচাপ দাঁড়ান।”
তারপর ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমরা চুপ করে আছো কেনো? বলো? এখানে সবাই মিলে দল বানিয়ে কি করছিলে? আর এই মেয়েটার সাথে কি সম্পর্ক তোমাদের?”
ছেলেগুলোর মধ্যে একজন আমতা আমতা করে বলল,
“কোনো সম্পর্ক নেই, স্যার। মেয়েটা নতুন আমাদের কলেজে, ক্লাস রুম খুঁজে পাচ্ছিলো তাই আমরা হেল্প করছিলাম। এই আর কি…?”
বলেই সবাই মাথা নাড়িয়ে মেঁকি হাসলো। তারিন এবার আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। গর্জে উঠে কিছু বলার আগেই তামজিদ হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল,
“বাহ! বেশ ভালো কাজ করেছো তো! তা ভালো কাজ করলে তো পুরষ্কার প্রাপ্য তাইনা বলো? তোমাদেরও তো একটা পুরষ্কার দেওয়া উচিত। কি পুরষ্কার দেই বলো তো?”
বলেই থুতনিতে হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলো। ছেলেগুলোর মধ্যে একজন হেসে হেসেই গর্বের সুরে বলে উঠল,
“আরেহ, স্যার.! কিছু লাগবে না। আমরা এখন আসি, স্যার।”
বলেই সবাই মিলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। এর মধ্যেই তামজিদ পেছন ডেকে বলে উঠল,
“আরে, আরে! কোথায় যাচ্ছো? দাঁড়াও।”
বলেই তামজিদ তারিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নিচু স্বরে বলে উঠল,
“এই তুমি প্রতিবাদী? কেউ তোমাকে অসম্মান করলো আর তুমি প্রতিবাদ না করেই চলে যাচ্ছো? ভয় পাচ্ছো?”
তারিন মাথা দুই দিকে নাড়ালো। অর্থাৎ ‘না’। তামজিদ পুনরায় ফিসফিস করে বলে উঠল,
“তাহলে ওদের পুরষ্কারটা তুমি নিজের হাতে দাও। আবার বলো না কি পুরষ্কার দিবে? আশা করি, তুমি সেটা জানো। রাইট?”
তারিনের ঠোঁটদ্বয়ে হাসি ফুটল। মাথা নাড়ালো। মানে ‘হ্যাঁ’। ওদের দুজনকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে দেখে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন অন্যজনকে বলে উঠল,
“এই মেয়েটার সাথে স্যার কি কথা বলছে? মেয়েটা কি স্যারের পরিচিত কেউ? গার্লফ্রেন্ড নাকি?”
অপরজন আবার বলে উঠল,
“আরে মামা। স্যার, বিবাহিত। স্যারের বউ আছে।”
তামজিদ ওদের কথার মাঝেই সুন্দর করে হেসে বলে উঠল,
“বয়েজ, পুরষ্কার নেওয়ার জন্য রেডি তো?”
তামজিদের কথাশুনেই ছেলেগুলোর মুখ কালো হয়ে গেলো। তামজিদ যে ভালো উদ্দেশ্যে কথাটা বলছে না তা বেশ বুঝতে পারছে। তাই একজন আমতা আমতা করে বলল,
“স্যার, আমাদের ক্লাসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখন আসি। আসসালামু আলাইকুম। ”
বলেই পা বাড়াতেই তারিন এসে পথ আটকে সামনে দাঁড়ালো। মিষ্টি হেসে বলল,
“আরে চলে যাচ্ছেন যে? আমাকে চিনবেন না? আমার নামটাই তো এখনো জানলেন না। চিনবেন কি করে বলুন তো?”
তারপর ছেলেগুলোর উদ্দেশ্য বলে উঠল,
“শুনুন আপনারা সবাই। আমার নাম তুবাইতা তারিন। আমি এই কলেজের ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের ছাত্রী। আর এইযে আমার…।”
বলেই তামজিদের দিকে তাকাতেই তামজিদ ইশারায় কিছু নিষেধ করতেই তারিন থেমে গেলো। প্রসঙ্গে পাল্টে বলল,
“আমার নরম হাতের ছোঁয়া পেতে চান, তাইনা?” ছেলেগুলো তামজিদের দিকে একবার তাকাল। তামজিদের মুখ দেখে ভয়ে ঢোক গিলতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। ভয়ে ভয়ে একজন অপরজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তামজিদ এবার হাঁক ছেড়ে বলল,
“শোনো মেয়ে, শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করছো। আজকে প্রথম ক্লাস কিন্তু আমার। লেট হলে একদম ঢুকতে দিবো না। ওদের পুরষ্কারটা দাও। আর তাড়াতাড়ি ক্লাসে আসো।”
তারিন এবার তামজিদের দিকে তাকালো। তামজিদ চোখের ইশারা করতেই তারিন সামনের ছেলেটাকে সজোরে একটা থা’প্পড় মে’রে বসলো। থা’প্পড় খেয়ে সামনে থাকা ছেলেটা চিৎকার করে বলে উঠল,
“এই মেয়ে!”
ছেলেটা চিৎকার করতেই তারিনও বেশ চিৎকার করে বলল,
“একদম গরুর মতো চিৎকার করবেন না। তাহলে আরেক গালেও আমার নরম হাতের ছোঁয়া পেয়ে যাবেন।”
ছেলেগুলো এমন চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে যে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ওকে গিলে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু তামজিদ সামনে দেখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। তারিন এবার আগের ন্যায় কঠিন স্বরে বলে উঠল,
“আর একদিন যদি দেখেছি কোনো মেয়েকে এমন নোংরা উদ্দেশ্য নিয়ে ডিস্টার্ব করেছেন, তাহলে এই যে দেখুন (পায়ের দিকে ইশারা করে) এই জুতো জোড়া আপনাদের গাল লাল করে দিবে। আজকে একজনের গালে আমার নরম হাতের ছোঁয়া লেগেছে। সেদিন সবার গালে নরম জুতোর ছোঁয়া পড়বে। আজকে এই অব্দি। আল্লাহ হাফেজ৷ ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।”
বলেই তারিন হনহন করে চলে গেলো। ছেলেগুলো ওর দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে রইলো। তামজিদ বেশ হেসে সে স্থান ত্যাগ করল।
–
–
–
তারিন একা একা ক্লাস রুমে ঢুকেই মাঝের সারিতে বসলো। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে৷ অচেনা জায়গায়, এতগুলো অচেনা মুখের মধ্যে অস্বস্থি লাগাতেই স্বাভাবিক। তারিনের পাশেই একটা মেয়ে বসে আছে। চুপচাপ হয়ে। কিছুক্ষণ ধরেই তারিনকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। তা খেয়াল করে তারিন হেসে প্রশ্ন করল,
“আসসালামু আলাইকুম। আমি তারিন। কেমন আছো?”
মেয়েটাও খুব সুন্দর করে হেসে সালামের জবাব নিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আমি নিহা৷ তোমার ক্লাসমেট। আসলে এখানে কাউকে চিনিনা তো তাই তোমার সাথে বন্ধুত্ব করার সুযোগ খুজছিলাম। কিন্তু কি মনে করবে ভেবে সাহস হচ্ছিলো না।”
এই নিয়ে ওদের দুজনের মধ্যে কথা শুরু হয়ে গেলো। প্রায় আধঘন্টা দুজনে মিলে বকবক করতেই চলে গেলো। ওদের দেখে কেউ বলবে না৷ ওরা সদ্য পরিচিত হয়েছে। ওদের কথা মাঝেই তামজিদ ক্লাসে ঢুকে। তামজিদ ক্লাসে ঢুকতেই তারিনের মুখে হাসি ফুটলো। তামজিদ সবাইকে বসতে বলে চারদিকে নজর বুলাতে লাগলো। তারিন বেশ বুঝতে পারছে তামজিদ ওকেই খুঁজছে। তারিনকে দেখতে পেয়েই তামজিদ হাঁফ ছাড়লো। সবার সাথে পরিচিত হওয়া শুরু করলো। সবার নাম, পরিচয় ও নিজের সম্পর্কে দুই লাইন বলতে বলেছে। একে একে সবার সিরিয়াল শেষ করে সিরিয়াল এসে থামলো তারিনের কাছে। তারিন দাঁড়িয়ে খুব সুন্দর করে হাসলো। ওর মাথায় চট করেই দুষ্টু বুদ্ধিরা হানা দিলো। বেশ হাসিখুশি ভাবে বলল,
“আমার নাম তুবাইতা তারিন। আমি বিবাহিত। আ…।”
তারিনের কথা সম্পূর্ণ শেষ না হতেই তামজিদ বেশ অবাকের সুরে বলে উঠল,
”বিবাহিত! সত্যি? এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে নাকি বিবাহিত ভাবা যায়?”
তারিনের মুখটা চুপসে গেলো। মাথা থেকে সব দুষ্টু বুদ্ধিরা উধাও হয়ে গেলো। চোখে মুখে রাগে ফুটে উঠল। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে অসহায় মুখে বলা শুরু করল,
“নিজের দুঃখের কথা কি আর বলবো, স্যার? ঘরের কথা কি বাইরে বলা যায় বলুন?”
তামজিদ তারিনের ফেস রিয়েকশন দেখে বেশ উৎসাহিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“সমস্যা নেই। তুমি বলো। আমরা একটু শুনি। দেখি কি এমন দুঃখ তোমার? কি বলো তোমরা সবাই? শুনবে?”
সবাই জোরে চিল্লিয়ে সমর্থন করলো। তারিন ও আগের ন্যায় দুঃখী দুঃখী মুখে বলতে লাগলো,
“স্যার, আমার বাবা মা আমাকে জোর করে একটা বুইড়া বেডার লগে আমারে বিয়ে দিয়ে দিছে। আমি কি করতাম বলেন?”
তারিনের কথা শেষ হতে না হতেই তামজিদ কাশতে শুরু করলো। কী সাংঘাতিক! সোজাসুজি তামজিদের মতো একটা হ্যান্ডসাম ছেলেকে ‘বুইড়া’ বলে দিলো!
#চলবে
[আমি অসুস্থ ছিলাম। এখনো অসুস্থ। দুইদিন লিখে আজকে এক পর্ব দিলাম। রাতে এক পর্ব পাবেন ইন শা আল্লাহ। ছোট্ট একটা মন্তব্য করে যাবেন, নয়তো দিবো না😒]