#অলিখিত_অধ্যায়
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৮।
ফারজাদ সোফায় বসা। নীহালও পাশে তার। দিলরুবা বেগম ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ করছেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে এটাই তাঁর প্রধান দায়িত্ব। মৌমি তার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ান। সে প্রিয়তাকে রুম থেকে বের হতে দিচ্ছে না। তার একটাই দাবি, প্রিয়তা চুল খুলে বের হবে। প্রিয়তার লম্বা চুল, কোমর অবধি। এত বড়ো চুল খুলে গেলেই ঝট পাকাবে, তারপর সেই ঝট খুলতে জান যাবে তার। কিন্তু মৌমি এসব যুক্তি মানতে নারাজ। চুল খুলতে হবে মানে খুলতে হবেই। প্রিয়তা হার স্বীকার করল পরিশেষে, মেয়েটার সাথে কথায় কখনো পেরে উঠে না সে। অবশেষে চুল খুলল তাই।
নিচে নামল দুজন। ফারজাদ একপলক চেয়ে চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও আরো একবার চাইল। প্রিয়তার মুখে হাসি। মৌমির সাথে কথা বলছে সে। তার’ই ফাঁকে চুলগুলো আবার কানের পিছে গুঁজে দিচ্ছে। ফারজাদের এই দৃষ্টির সময়সীমা অতি নগণ্য হলেও বেশ সুন্দর একটা দৃশ্য দেখল সে। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘অবশেষে এলি তাহলে?’
মৌমি চট করে হেসে বলল,
‘এই ভাইয়া দেখো, তোমার আর প্রিয়তা আপুর জামার রং সেইম।’
প্রিয়তা চমকে একবার নিজেকে আরেকবার ফারজাদকে দেখল। বিষয়টা বুঝতে পেরে অবাক হলো ফারজাদও। দুজনেই আজ কালো পরেছে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে মৌমির দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘এই মেয়ে, তুমি আজকে আমাকে এটা পরতে বলেছিলে।’
মৌমি ঠোঁট উল্টে বলল,
‘তো আমি জানতাম না-কি ভাইয়াও যে কালো পাঞ্জাবী পরবে? আমার তো এই কামিজটা ভালো লেগেছিল বলে বলেছি।’
একখান চমৎকার মিথ্যে বলে মনে মনে হাসল মৌমি। ফারজাদ অস্বস্তি এড়াতে বলল,
‘কাকতালীয় ব্যাপার, হতেই পারে। চলো এবার, লেইট হয়ে যাচ্ছে।’
সবাই বেরিয়ে পড়ল। ফারজাদ গাড়ি ঠিক করেছে আগে থেকেই। এখন সমস্যা হচ্ছে এক গাড়িতে সবার জায়গা হবে না। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে নীহাল। পেছনে মৌমি আর দিলরুবা বেগম। আরেকটা সিটে প্রিয়তা বসতে গেলেই মৌমি বলে উঠে,
‘তুমি এখানে কেন বসছো?’
প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,
‘তো আমি কোথায় বসব?’
‘ভাইয়ার সাথে বাইকে বসো গিয়ে।’
‘কেন?’
‘দেখছো না গাড়িটা কত ছোট। এইটুকু জায়গাতে তিনজন হয়?’
প্রিয়তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, গাড়িতে যথেষ্ঠ জায়গা আছে। চাপচাপি করে বসলে আর দুজন অনায়াসে বসতে পারবে। সে বলল,
‘আমি বসতে পারব তো।’
‘আহা আপু! তুমি বুঝতে পারছো না। এমনিতে তো ভাইয়া বাইকে একাই যাবে, তুমি সেখানে চলে যাও না, তাহলে আমরা সবাই একটু আরাম করে যেতে পারব।’
দিলরুবা বেগমও তার সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ প্রিয়তা, তুমি বরং বাইকেই এসো।’
নীহাল সামনে বসে দুই মা মেয়ের কথা শুনে হাসছে। দু’জন কী মারাত্মক চালাক! দিলরুবা বেগমের সায় পেয়ে প্রিয়তা বাধ্য হয়েই ফারজাদের বাইকের কাছে গেল। তাকে দেখে ফারজাদ জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি এখানে কেন?’
‘গাড়িতে না-কি জায়গা হবে না।’
‘কী বলেন? পেছনে তো তিনজন সুন্দর ভাবে বসা যায়, জায়গা হবে না কেন?’
‘কী জানি? আমিও তো বুঝতে পারছি না।’
‘চলুন তো।’
কিন্তু তারা এগুনোর আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল। ফারজাদ ভ্রু কুঁচকাল তা দেখে। বলল,
‘ড্রাইভারের তো দেখছি খুব তাড়া।’
প্রিয়তা মুখ কালো করে বলল,
‘এবার?’
‘এবার আর কী? আমার বাইকে গিয়ে বসুন।’
বাইকে বসল প্রিয়তা। ফারজাদ স্টার্ট দিল। তবে তাদের যাত্রাপথে বিপত্তিতে পড়ল প্রিয়তা। সাঁ সাঁ বাতাসে তার চুল ধরে রাখতে মারাত্মক বেগ পোহাতে হচ্ছে তাকে।কোনোভাবেই চুল ঠিক থাকছে না। বাতাসের গতিতে যেন উড়ন্ত কেশে ডানা গজিয়েছে তার। লুকিং গ্লাসে ব্যাপারটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেয়াল করছে ফারজাদ। চুল নিয়ে প্রিয়তার বিরক্তমাখা মুখখানা দেখে মজাও পাচ্ছে বেশ। তার কুঁচকানো ভ্রু, বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ানো, বারবার কানের পিছে চুল গুঁজা, সবকিছুই বেশ সুন্দর ঠেকছে যেন। ফারজাদ ততক্ষণাৎ আবিষ্কার করল, ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক না। প্রিয়তার ভাবভঙ্গি কেন তার কাছে সুন্দর লাগবে? এটা তো উচিত নয়। সে ব্রেক কষল। আচমকা ব্রেক কষায় ফারজাদের পিঠের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্রিয়তা। ঘাবড়ে গেল খানিক। ঢোক গিলে বলল,
‘কী হয়েছে?’
ফারজাদ বলল,
‘নামুন।’
প্রিয়তা বুঝে উঠতে পারল না কিছু। নেমে দাঁড়াল। ফারজাদ তাকাল তার দিকে। ভীত দেখাচ্ছে তাকে। ফারজাদ বলল,
‘চুল বাঁধুন।’
প্রিয়তা অস্বস্তি নিয়ে হাসল ক্ষীণ। বলল,
‘আপনি বিরক্ত বোধ করছেন, তাই না?’
‘জি।’
প্রিয়তা এবার আরো বেশি অস্বস্তিতে পড়ল। ব্যাগ হাতিয়ে দেখল একটাও ব্যান্ড আনেনি সে। উপায়ান্তর না পেয়ে হাত খোঁপা করল। ফারজাদ দেখল তাকে পুরোটা সময়। মেয়েটার সবকিছুই আজকাল বেশ চোখে লাগছে তার। সে বলল,
‘এবার বসুন।’
প্রিয়তা বসল। চোখে মুখে তার আষাঢ়ের কালো মেঘের ছায়া। ফারজাদ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,
‘একে তো কোনোরকমে আলগা হয়ে বসে আছেন, তারউপর চুল ঠিক করতে বেশ নাড়াচাড়া করছেন, পড়ে যাওয়ার রিস্ক বিধায় চুল বাঁধতে বলেছি, এর জন্য মুখ কালো করে বসে থাকার কোনো মানে হয়না।’
প্রিয়তা থতমত খেয়ে ফারজাদকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই লুকিং গ্লাসে চোখ যায় তার, ফারজাদ তাকেই দেখছে। প্রিয়তা আর কিছু বলতে পারে না তাই। ফারজাদও চোখ সরায় অতঃপর।
গাড়ি গিয়ে নিজেদের গন্তব্যে থামে। একটা ছোট্ট সুন্দর রিসোর্টে এসেছে তারা। চারদিকে বেশ সুন্দর গোছানো পরিবেশ। প্রিয়তা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়। ফারজাদ যায় বাইক পার্কিকে রাখতে। গাড়িটাও এসে থেমেছে। নীহাল নেমে এসে দিলরুবা বেগমের পাশের দরজাটা খুলে দিল। দিলরুবা বেগম প্রসন্ন হেসে নেমে দাঁড়ালেন। ভেতর থেকে মৌমি বলে উঠল,
‘আমার পাশেরটা খুলবেন না?’
নীহাল নিচু হয়ে বলল,
‘কেন, আপনার হাত নেই?’
‘আম্মিরও তো হাত ছিল।’
নীহাল ভ্রু কুঁচকালে মৌমি ঠোঁট চেপে হেসে নিজেই দরজা খুলল। তারপর নেমে দাঁড়িয়ে ঠাস করে আবার লাগাতে গিয়ে ওড়নাটাও আটকে গেল তাতে। নীহাল হেসে বলে,
‘বেশি কথা বললে এমনিই হবে।’
মৌমি নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠে,
‘উচিত কথা বললে সবারই গায়ে লাগে।’
‘আপনি তো আচ্ছা পাঁজি মেয়ে।’
‘আপনিও অতো ভালো নন।’
‘কী?’
ততক্ষণে প্রিয়তা সেখানে এসে বলে,
‘তোমরা বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছো কেন, ভাইয়া?’
‘উনিই তো আগে শুরু করেছেন।’
‘মোটেও না। আপনিই পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করছেন।’
‘আন্টি, আপনি বলুন তো কে আগে শুরু করেছে?’
দিলরুবা বেগম হেসে বললেন,
‘দুজনেই ভীষণ ঝগড়ুটে।’
প্রিয়তাও হেসে ফেলল। বলল,
‘হয়েছে, এবার চলো। বাকি ঝগড়া পরে করো নাহয়।’
মৌমি ভেংচি কাটল। নীহাল নাক মুখ কুঁচকে মনে মনে বলল,
‘অসভ্য মেয়ে।’
________
রিসোর্টের ভেতর প্রবেশ করল সবাই। প্রথমেই চোখে পড়ল একটা বাগান। তার পাশেই ছোট পার্ক করা, বাচ্চাদের খেলার জন্য বোধ হয়। তার কিছু সামনে সাদা রঙের তিনতলা একটা বিল্ডিং। বেশ চকচকে রংটা। গেইট থেকে শুরু হয়ে হাঁটার পথ পুরোটাই পিচঢালা রাস্তা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও বেশ। তারা হাঁটতে হাঁটতে সামনে গেল কিছুটা। একটা সুন্দর সুইমিং পুল পেল। মৌমি তো সেটা দেখে বেশ খুশি। সে ছুটে গেল সেখানে। সিঁড়ির কাছটায় গিয়ে পা ভিজিয়ে বসল। প্রিয়তাকেও ডাকল তার সঙ্গ দেওয়ার জন্য। প্রিয়তাও গেল তার কাছে, তবে বসল না। দিলরুবা বেগম একটা বসার জায়গায় বসলেন। নীহাল আর ফারজাদ হেঁটে হেঁটে গল্প করছে। সুইমিং পুলের কাছে কেবল প্রিয়তা আর মৌমি। এর মাঝেই কোথ থেকে যেন একটা ছেলে এসে মৌমির পাশে বসে পড়ল। মৌমি ভ্রু কুঁচকাল সেটা দেখে। প্রিয়তাও। প্রিয়তা উর্দূতে বলল,
‘এত জায়গা থাকতে আপনি এখানে এসে বসলেন কেন?’
ছেলেটি হেসে বলল,
‘আমার মর্জি, তাই।’
জবাব পেয়েই মনে হলো অভদ্র বেশ। মৌমি কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ছেলেটা এবার টিচ করে বলল,
‘উঠে পড়লে কেন, সুন্দরী? বসো না কিছুক্ষণ।’
প্রিয়তা এবার রেগে গেল খুব। কর্কশ গলায় বলল,
‘এই যে, ভদ্র ভাবে কথা বলুন। নয়তো সুন্দরী তার অসুন্দর রূপটা দেখাতে দু’বার ভাববে না কিন্তু।’
ছেলেটা হাসল শব্দ করে। বলল,
‘তাই না-কি? তাহলে তো সেই রূপটা দেখতেই হয়। দেখাও না, প্লিজ, আমিও দেখতে চাই।’
মৌমি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘দেখতে চাস, না? দাঁড়া, দেখাচ্ছি।’
এই বলেই সে ছেলেটাকে জোরে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেয়। প্রিয়তা হকচকিয়ে উঠে তার এই কাজে। মৌমি তার হাত চেপে বলে,
‘চলো তাড়াতাড়ি।’
তারা দ্রুত সেখান থেকে চলে আসে। ছেলেটা পানিতে থেকেই দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠে,
‘তোদের আমি দেখে নিব।’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/