#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (১০)
“অনুভব তুমি কি কখনো সিরিয়াস হবে না?”
আমিন সাহেবের শরীর কাঁপছে। তিনি যেন বিশাল ঝড় পাড় করে এসেছেন। এদিকে তার একমাত্র ছেলে বিছানায় ল্যাদ মে রে ঘুমিয়ে আছে। তিনি ছেলেকে এক প্রকার টেনে টুনেই ওঠালেন। তবে পুত্র অনুভব যেন স্বপ্নে ভাসছে। তার সেই স্বপ্ন যে ভা ঙ ছেই না।
“ইটস টু মাচ বাবা। কতবার বলব, আমি এই সময়ে এই বিরক্তিকর পানীয়টা খেতে পারব না।”
ঘুমন্ত অনুভবের মুখে এক গ্লাস পানি ছুড়ে দিলেন আমিন সাহেব। ছেলেকে তিনি সকাল বেলা লেবু পানি খেতে বলেছেন। সেটাই হয়তো স্বপ্নে দেখছে। অনুভব চোখ মেলে তাকাতেই দেখল তার বাবার পোক্ত দেহটা। ও ভয় পেয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল। বিছানার এক মাথা থেকে আরেক মাথা। তারপর স্মরণ করল, কথা ছিল আজ সে অফিসে যাবে। তাদের বিজনেস পার্টনারদের সাথে তার পরিচয় করানো হবে। এদিকে সে কী না পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে!
অনুভব মাথা নত করে রইল। আমিন সাহেব ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লেন। কপালে হাত দিয়ে বসে রইলেন।
“খুব খারাপ করলে অনুভব। আমি এতটা অপমানিত হলাম।”
অনুভব কথা বলে না। সে কী বলবে? আমিন সাহেব দীঘল শ্বাস ফেলেন। ওঠে পড়েন বসা থেকে।
“ঠিক আছে। তোমাকে আর প্রয়োজন নেই। তুমি দায়িত্ব নিতে চাচ্ছ না। তাহলে, এই ফ্যাসিলিটি ও পাবে না। সব বন্ধ।”
বাবার মুখের ওপর একটা কথা ও বলতে পারল না অনুভব। সে ভেবে দেখল, সে ভীষণ অলস প্রকৃতির। তার শুধু ঘুমাতে ইচ্ছা করে। দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা জাগে না। তবে বাবার টাকা ছাড়া তার গতি কী আসলেই আছে? উহু নেই। এবার সত্যিই তার চোখে মুখে অসহায়ত্ত্বের ছাপ দেখা গেল। পাতলা গড়নের মুখখানি যেন আরো শুকিয়ে গেল। আহারে অনুভব!
মন খারাপ করে বাসার গেটের কাছে বসে আছে অনুভব। বাবা খুব রেগে বের হয়েছেন। মা বাসায় নেই। নানা বাড়িতে আছেন। তাকে কল করার পর সে বলেছে বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে। অনুভব তাই গেটের কাছে বসে আছে। দারোয়ান গিয়েছে চা আনতে। সায়রা বেশ কিছু সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গেট বন্ধ দেখাচ্ছে। এদিকে সে একটু লেট করে ফেলেছে। ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে। তাই একেবারে তৈরি হয়ে আহনাফকে পড়াতে এসেছে।
“দারোয়ান কাকা, গেট খুলুন।”
শব্দ নেই। সায়রা আবার বলল,”দারোয়ান কাকা, গেট খুলুন।”
এবার ও কোনো শব্দ নেই। শব্দ আসবে কেমন করে? গেটে তো দারোয়ান নেই। যে আছে সে অনুভব। আর অনুভব তো ডুবে আছে গভীর ভাবনায়। যেন এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু থেকে সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তার এখন একটাই লক্ষ্য,বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়া। সায়রা বিরক্ত হয়ে এবার গেটে আ ঘা ত করল। কিয়ৎকাল পর গেট খুলে গেল।
“দারোয়ান কাকা,কত সময় ধরে চিল্লাচিল্লি করছি, গেট কেন খুলছিলেন না?”
এ কথা বলেই হনহনিয়ে চলে যেতে নিচ্ছিল সায়রা। তবে ও আবছা আবছা দেখতে গেল দারোয়ান আজ ভীষণ লম্বা হয়ে গেছে। পেটের ভুড়ি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মোটা শরীরটা যেন হাওয়া হয়ে গেছে! এই অতি আশ্চর্য ঘটনা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওকে দ্বিধায় ফেলে দিল। অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,”আমাকে তোমার দারোয়ান মনে হয়?”
ছেলেটাকে ভালো মতন দেখে নিয়ে সায়রা বলল,”তো এখানে বসে আছ কেন? দারোয়ান হও, আর যেই হও, এত সময় চিল্লাচিল্লি করার পর ও কেন শুনছিলে না?”
“তুমি কী আমার নাম ধরে ডেকেছ?”
“তোমার নাম ধরে ডাকব কেন। আমি তো দারোয়ান কাকা বলে ডেকেছি।”
“তাহলে আমি কেন শুনব?”
“উফ আশ্চর্য তো!”
“আশ্চর্য তো তুমি।”
“ধুর।”
এক প্রকার বিরক্তি নিয়েই ছুটে গেল সায়রা। তবে লিফ্টের কাছে এসে দেখল লিফ্ট অফ। অনুভব বেশ ভাব নিয়ে ওর কাছে এল।
“হা, যাও এবার হেটে হেটে।”
“অসহ্য!”
শাড়ির কুচি ধরে এক প্রকার দৌড়াতে লাগল সায়রা। নয় তলায় ওঠতে হবে। কি আশ্চর্য! অনুভব এত সময় পর দেখল, সায়রা আজ শাড়ি পরে এসেছে। দুনিয়ার কিছুর প্রতিই কী তার আগ্রহ নেই?
আমিন সাহেব ফিরেছেন। তবে ছেলেকে পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি ভীষণ রেগে আছেন। অনুভব ও বসে নেই। চেষ্টা চালাচ্ছে। বাবার সাথে সে ফ্রি নয়। তবে একমাত্র সন্তান হওয়ায় স্নেহের পরিমাণ বেশি। সেই জন্যেই কী না বাবার সম্মুখে উপস্থিত হতে পেরেছে অনুভব। সে মাথা চুলকোচ্ছে।
“কী?”
আমিন সাহেবের ভরাট কণ্ঠ। যেন, তিনি জিম ট্রেনার! আর অনুভব তার ছাত্র। অনুভব শুকনো গলা ভেজানোর প্রয়াসে ঢোক গিলল।
“কিছু বলতে চাই।”
“তাহলে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? না বলে?”
“জি, অনুমতির জন্য।”
আমিন সাহেব চোখ সোজা করে চাইলেন। ছেলে তাকে তেল দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এত সহজে তো তিনি এসব মানবেন না। তিনি বরং মুখের কঠোরতা ধরে রাখলেন।
“বাবা, মাফ চাচ্ছি। অভ্যেস নেই তো।”
“অভ্যেস নেই, বলে বাবার সম্মান খোয়াবে নাকি?”
“এরপর আর হবে না।”
“কী হবে না?”
“এমন ভুল।”
“এসব ছেলে ভুলানো কথা অনুভব। আমি বাচ্চা নই। তোমার জন্ম আমার দ্বারা হয়েছে। আমার জন্ম তোমার দ্বারা হয় নি।”
বাবার সোজা কথায় অনুভবের কান গরম হয়ে যায়। সে কিছুটা লজ্জিত বোধ করে।
“দুঃখিত বাবা।”
“সত্যিই দুঃখিত?”
এবার কণ্ঠটা নরম। অনুভব চট জলদি জবাব দেয়।
“খুবই দুঃখিত।”
“সুযোগ চাও?”
“জি চাই।”
সুযোগের কথায় অনুভব তো সায় দিল। তবে সে মনে মনে আসলে সুযোগ চায় না। এত দায়িত্ব তার ভালো লাগে না। সে পাখির মতন উড়ে বেড়াতে চায়। তার ভালো লাগার গুরুত্ব দিতে চায়।
“চাইছো যখন, তবে সুযোগ তুমি পাবে।”
অনুভবের মুখশ্রীতে আঁধার নামে। আমিন সাহেব ছেলের এই অবস্থা বুঝতে পারেন। তবে তিনি সেটা আমলে নেন না। এক মাত্র সন্তান তার। যদি এমন দায়িত্ব জ্ঞান হীন হয় তাহলে তো ভবিষ্যত রসাতলে যাবে। এমনটি করা যাবে না। কিছুতেই না।
সায়রার দেহ ক্লান্ত। বাসায় ফিরে দেখল আমিরা ঘুমিয়ে আছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ও গেল শাওয়ার নিতে। শাওয়ার শেষ করে এসে দেখল অনেক গুলো কল এসেছে। আহনাফের মায়ের নাম্বার থেকে। ও চট করে কল ব্যাক করল।
“হ্যাঁ আপু। আমি আসলে গোসল করছিলাম। তাই ধরতে পারি নি।”
“ঠিক আছে সায়রা। কোনো ব্যাপার না। তোমাকে একটি ব্যাপার জানানোর জন্য কল করেছি।”
“কী?”
“আহনাফ তোমার সাথে ভীষণ মিশে গেছে। তোমায় বন্ধুর মতন ট্রিট করছে।”
সায়রা মৃদু হেসে বলল,”আসলে ওর সময় প্রয়োজন। এটা হলেই ও ঠিক হয়ে যাবে। ওর ডক্টর ও তাই বলেছিল।”
“হ্যাঁ।”
রনুর কণ্ঠে হতাশা। সে যেন ক্লান্ত সব কিছুতে। সায়রা অপেক্ষা করল। রনুই বলল,”আমি আর আহনাফের বাবা বেশির ভাগ সময় অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। আসলে ওকে সময় দেওয়া হয় নি তেমন। তার ওপর ও স্পেশাল চাইল্ড। আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় বিষয় গুলো ভুল করে বসেছি। বুয়ার কাছে থেকেছে বেশি সময়। বুঝতেই পারছো, জীবনে টাকার পেছনে দৌড়াতে গিয়ে ছেলেটার ক্ষতি হয়ে গেল।”
“আসলে আপু এটা আপনাদের দোষ না। ভাগ্যের বেশি আমাদের হাতে কিছু নেই।”
“তা ঠিক। আচ্ছা, শোনো যেটা বলার ছিল। আহনাফের জন্মদিন তিনদিন বাদেই। তোমার তো অফ ডে। তাই আগেই জানিয়ে রাখলাম। তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে। শোনো, ওর বাবা এটা এরেঞ্জ করেছে কক্সবাজারে। সেখানে আমাদের ব্যবসায়ীক একটা পার্টি ও রয়েছে। সেই সাথে আহনাফের বার্থডে টাও সেলিব্রেট করতে চাইছিলাম। তুমি কিন্তু মিস দিবে না। আমি টাইম বলে দিব,সময় মতন আমাদের বাসায় চলে আসব। আমরা সবাই এক সাথে যাব।”
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
পর্ব (১১)
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/403911158836451/?app=fbl