#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |৩|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
দর্শন দরজার দিকে না তাকিয়েই বেঞ্চের উপর থাকা মার্কারটা হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে মারলো দরজার দিকে। সারা বিচক্ষণতার সাথে তা হাতে ধরে বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলো দর্শন এর দিকে। দর্শন তখনো দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড বাদে নিজের ভুল বুঝতে পেরে জীভে কামড় দিলো সারা, মেকি হেসে বললো,
_”সরি সরি ভাইয়া,আর বলবোনা।”
দর্শন আশেপাশে আরো কিছু খুজতে নিতেই সারা আবারো তড়িঘড়ি করে বলে,
_”না না, স্যার। আসবো স্যার? একদম দৌড়ে দৌড়ে এসেছি। কি শান্তিতে ঘুমিয়েছিলাম,জোস একটা স্বপ্ন দেখতেছিলাম। আর দেড়ি হবেনা স্যার,আসি এবার?”
_”আর আসা লাগবেনা, দাঁড়ায় থাক বাইরেই।”
কাঁদোকাঁদো দৃষ্টিতে রজনীর দিকে তাকায় সারা,তা দেখে দর্শন বলে,
_”ওর দিকে তাকায় লাভ নাই, আজকে ওখানেই দাঁড়ায় থাকবি তুই। বাজে কয়টা?”
সারা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
_”পাঁচটা দশ।”
_”পড়া কয়টায় ছিলো?”
_”পাঁচটায়।”
নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় সারা। দর্শন কিছুক্ষন বাদে ফোনের দিকে নজর রেখে বলে,
_”আয়, নেক্সট টাইম..”
_”থ্যাংক ইউ স্যার।”
বাকি কথা বলার আগেই রজনীর পাশে এসে বসতে চায় সারা। দর্শন তাকে বাঁধা দিয়ে বলে,
_”উম হু,ওখানে না। সামনে এসে বোস, শাস্তি এটা।”
_”এমন করেন কেন স্যার? আর দেড়ি হবেনা সত্যি, বসি একটু এখানে?”
সারার অসহায় কণ্ঠে বলা কথার উত্তর দিলোনা দর্শন, রজনীর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো,
_”তুইও আয় সামনে। তেমন কেউ আসবে বলে তো মনে হচ্ছেনা, কি আর ক্লাস করাবো!”
_”আসতেই হবে?”
_”ইয়োর উইশ।”
এবার সারা টেনে দাড় করালো রজনীকে। তার সামনে বসতে সমস্যা নেই, তবে রজনীকে নিয়েই বসবে। রজনীও দ্বিমত করলো না, বোঝাই যাচ্ছে তেমন কেউ আসবে না। সারা,রজনী দুজনেই এসে দ্বিতীয় বেঞ্চ এ বসে পড়লো। ঠিক তখনি ক্লাসে এলো আরো দুটি মেয়ে।
_”মে আই কাম ইন স্যার?”
একসঙ্গে বললো দুজন। দর্শন একবার তাকালো তাদের দিকে। আর বকাঝকা না করেই বললো,
_”কাম ইন।”
সারা রজনীর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
_”আইছে আমাদের মডেল।”
ভুল কিছু বলেনি সারা। রিতা আর টিয়া দুজনেই সবসময় সেজেগুজে আছে ব্যাচ এ, তাদের দেখে যে কেউ বলবে যেকোনো পার্টিতে এসেছে তারা।
রজনীকে সামনের দিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো রিতা, সে তো সামনের দিকে বসেনা কখনো। রিতা আর টিয়া গিয়ে অপর পাশের প্রথম বেঞ্চে বসে পরলো। টিয়া রিতার কানেকানে বললো,
_”ঐ ভাবওয়ালী আজকে সামনে বসছে কেন?”
_”কি জানি! আমাদের জায়গা দখল করছে এসে।”
দর্শন ফোনটা বেঞ্চে রেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
_”আর কেউ আসবে বলেতো মনে হয়না। পড়ানো কি শুরু করবো?”
সারা মেকি হেসে বলে,
_”আজকে না পড়ালে হয়না স্যার? না মানে, বাকিরা পড়াটা মিস করবে। নেক্সট ক্লাস এ এসে আপনার কানের বারোটা বাজাবে,আবার সেই বাধ্য হয়ে আপনাকে পড়া রিপিট করতে হবে। শুধুশুধু এত ঝামেলার কি দরকার?”
_”ঠিক আছে না পড়াই, পড়া জিজ্ঞেস করি। বই দাও..”
বোকা বোনে যায় সারা। পাশের বেঞ্চ থেকে টিয়া বলে ওঠে,
_”নাহ স্যার প্লিজ। পড়া তো ছিলো সাত দিনের জন্য, তিনদিনে কি করে শেষ করবো?”
_”স্যার আমার না মনে পরলো, পরিক্ষা সামনে। সিলেবাস বাকি তো এখনো, নতুন অধ্যায় শুরু করা খুবই প্রয়োজন স্যার।”
পাল্টি খেয়ে এমন কথাই বললো সারা। আপাতত পড়া দেওয়ার হাত থেকে বাঁচা অতি গুরুত্বপূর্ণ। দর্শন দুদিকে মাথা নাড়ে এদের ফাঁকিবাজি দেখে। পুনরায় চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করে,
_”কোন অধ্যায় পড়া ছিলো?”
সবাই চুপ করে রইলো, রজনীর নজর বরাবরের মতোই নিচের দিকে। প্রশ্ন করা ব্যাতীত সে নিজে থেকে কখনো কোনো উত্তর দেয়না, বেশ ইন্ট্রোভার্ট সে, আর সেই কারণে ক্লাস এর অনেকেই বলে সে নাকি ভাব নিয়ে থাকে। এসব অবশ্য কানে নেয়না রজনী।
_”রজনী, পড়া কি ছিলো?”
_”একাদশ অধ্যায়।”
সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো রজনী। রজনী পাশ থেকে রাগী চোখে তাকালো তার দিকে। দর্শন রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,
_”তুমি বলো, এগারো অধ্যায়ের নাম কি?”
পাশে থাকা টিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো রিতা। সে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো নিজেও জানেনা। অনেক্ষন চিন্তা করে ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো রিতা। দর্শনের বর্তমানে মুড ভালো, মারতে ইচ্ছে হলোনা কাউকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
_”আর একদিন টাইম দিচ্ছি শুধু, নেক্সট ক্লাস এ যে পড়া পারবে না তার জন্য স্পেশাল গিফট অপেক্ষা করছে। বই দাও এখন।”
কারোর এখন পড়ার ইচ্ছে নেই, রিতা আর টিয়া বই ও আনেনি ভুলে। আর সারা ইচ্ছে করে দিলোনা বই,বললো সেও বই আনেনি। দর্শন বেঞ্চের উপর মার্কার এর সাহায্যে টোকা দিয়ে হাতের ইশারায় বই চাইলো রজনীর থেকে। রজনী এবার ব্যাগ থেকে বইটা বের করে এগিয়ে দিলো। দর্শন কয়েক সেকেন্ড উলটে পালটে নিজেই বই বন্ধ করে রাখলো। বেঞ্চে হাত রেখে বললো,
_”নাহ, পড়ানোর মুড নাই। বাকিগুলো আবার পরেরদিন এসে কান্নাকাটি শুরু করবে।”
_”ছুটি স্যার? বাসায় যাই?”
উৎসাহিত হয়ে বলে টিয়া। দর্শন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো ত্রিশ মিনিট বাকি। বইটা রজনীর সামনে রেখে দিয়ে বললো,
_”বাসায় ই যাবে তো? আন্টির নম্বর কিন্তু আছে আমার কাছে, ফোন দিলেই বুঝতে পারবো।”
ভয়ে ভয়ে চুপ করে থাকে টিয়া। এর আগে একদিন দর্শন তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়েছিলো। সেদিন বাসায় না গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলো সে, ভাগ্যক্রমে দর্শনের সামনে পরে যায়। তখন কিছু না বললেও এখন যে সেই কথাই উল্লেখ করছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না টিয়ার।
দর্শন দু মিনিটের মতো ফোন স্ক্রোল করে বললো,
_”যাও,ছুটি। কালকে পড়াবো,এই টাইম এই।”
সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে দাঁড়ালো। দর্শন এর উদ্দেশ্যে সালাম দিয়েই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো টিয়া আর রিতা, তারা ঘুরতে যাবে তা বুঝতে পারলো দর্শন। সারা আর রজনী একসঙ্গে বেরোতে গেলো, তবে রজনীর কিছু মনে পরতেই থেমে যায় সে। সারার উদ্দেশ্যে বলে,
_”একটু দাড়া,আসতেছি আমি।”
সারা বের হয় ক্লাস থেকে, রজনীর ব্যাগ কাধে নিয়ে দর্শনের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
_”ফুপ্পি বলেছে, ইনাম ভাইয়াকে কল করে বাড়িতে আসতে বলতে। কারোর কথাই তো শোনেনা,তোমার কথা শুনবে হয়তো।”
_”আমি কি বলিনাই? শা’লা আমার কথাও শুনে না। তুই বলে দেখিস। ওহ,তুই আর কি বলবি,তোর সাথে তো কথাই বলবে না।”
রজনীর দিকে তাকিয়ে বলে দর্শন। এবার কথা ঘুরিয়ে নেয় রজনী, জিজ্ঞেস করে,
_”ক্লাস আছে আর? বাসায় যাবে এখন?”
_”নাহ ক্লাস নাই। যাবো,দশ মিনিট পর।”
রজনী বিরক্তির সাথে বলে,
_”ট্যুরে গিয়ে তোমার অভ্যাস আরো খারাপ হয়ে গেছে।”
_”কথা ভুল না।”
বলেই উঠে দাঁড়ায় দর্শন। শার্ট টানটান করে বলে,
_”থাক, এখনি যাবো।”
_”আমি সারার সাথে যাই?”
_”হুম, যাহ।”
সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো রজনী। টিচার হিসেবে সে যথেষ্ট সম্মান করে দর্শনকে। বাড়ি বেশি দূরে নয় এখান থেকে। হাটতে হাটতেই চলে গেলো রজনী আর সারা। সারার বাসা কাছেই, বাকি পথ রজনী একাই গিয়েছে। আর দর্শন তার বাইক নিয়ে আরো আগেই চলে গেছে বাড়িতে।
____
_”রজনী ক্যাচ..”
কথাটা বলেই রজনীর দিকে আচারের প্যাকেটটা ছুড়লো দর্শন। আকস্মিক হলেও রজনী ধরে ফেললো ক্যাচটা। টেবিলে বসে অঙ্ক করছিলো সে। দর্শন এগিয়ে এলো, বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো রাফিন ঘুমোচ্ছে। হাতে থাকা বাকি আচারের প্যাকেটগুলো থেকে আরো তিনটে টেবিলের উপর রেখে বললো,
_”একটা রাফিনকে দিস, বাকিগুলো তোর।”
দ্বিমত পোষণ করলো রজনী, আচারের প্যাকেট এর দিকে তাকিয়ে বললো,
_”তা কেন হবে? ওকে একটা দিয়ে আমি তিনটে কেন নেব? আমার দুটো ওরও দুটো।”
চোখ নামিয়ে সামান্য হাসলো দর্শন। আরেকটা আচারের প্যাকেট রজনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
_”এই যে কথাটা বললি, তাই তোর জন্য একটা এক্সট্রা। পাঁচটা দিলাম, তিনটে তোর আর দুটো রাফিন এর।”
চুপ করে আবারো খাতার দিকে তাকিয়ে অঙ্ক করায় মনোযোগ দিলো রজনী। দর্শন কিছুক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থেকে পাশে চেয়ার টেনে বসলো। রজনীর উদ্দেশ্যে আদুরে কণ্ঠে বললো,
_”কি হয়েছে রাতপাখি? মন খারাপ? কষ্ট হচ্ছে?”
খাতার দিকে দৃষ্টি রেখেই কিঞ্চিত হাসলো রজনী। দর্শনের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”আমাকে এই প্রশ্নটা করাই অবান্তর দর্শন ভাই। কারণ শেষ কবে আমি ভীষণ আনন্দিত ছিলাম তাই আমার মনে পরেনা”
#চলবে?
[অনেকেই বলতে পারেন, কাজিনদের সম্পর্ক ঝগড়াঝাঁটির হয়ে থাকে। আমি বলবো সবক্ষেত্রে তেমন হয়না,এই গল্পেও তাদের মধ্যে ঝগড়ার সম্পর্ক খুজে পাবেননা। আগেই বলে দিলাম সেটা।
হ্যাপি রিডিং।]