#সেই_রজনী_দর্শনে🌙 |২|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
থামলো দর্শন,পিছন ঘুরে জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”বলো,তোমার কথাই শুনতে চাইছিলাম। নিজেই তো মুখ বন্ধ করে থাকলে।”
সোফায় দৃঢ় মুখভঙ্গি নিয়ে বসে থাকে জাহিদ, দর্শন এগিয়ে এসে তার অপর পাশের সোফায় বসে। খুব মনোযোগ সহকারে জাহিদের কথা শুনতে চাইছে সে।
_”আমার মেয়ের ব্যাপারে অন্য কারোর কথা বলা আমি পছন্দ করছিনা দর্শন। ভালো পরিবার এর ছেলে, রজনী ভালো থাকবে সেখানে।”
_”ও এম জি! রজনীর ভালো থাকা নিয়ে তুমি এত্ত কনসার্ন? পুরাই আনএক্সপেক্টেড মামু।”
চোখ বড়বড় করে বলে দর্শন। জাহিদ ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারো বলেন,
_”তুমি বাগড়া দিতে না আসলে খুশি হবো। বাকিরা এমনিতেই রাজি হয়ে যাবে।”
_”মামি রাজি হয়ে যাবে?”
_”সেটা আমি দেখে নেবো।”
সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো দর্শন, দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,
_”তুমি বোধ হয় আমার কথা বুঝতেই পারোনি মামু। সোজাসাপ্টা বলতে গেলে, তোমাকে ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়েছি। ভেবোনা নিজের মামা বলে তোমার সব কথা শুনবো আমি। বহুত কষ্টে এখনো রিসপেক্ট দেখাই তোমার প্রতি, বেশিদিন সেটাও থাকবে না।”
_”মুখ সামলে কথা বলো দর্শন।”
কপাট রাগ দেখিয়ে বললেন জাহিদ। দর্শন সোজা হয়ে বসে বললো,
_”সামলেই তো আসছি। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙোনা প্লিজ। কেন যে মেয়ের জন্য তোমার এত চিন্তা উতলে উঠছে তা তো জানি আমি, শুধুশুধু অজুহাত দিয়ে লাভ নেই। আর নানু যে ভালো করেই ব্রেইন ওয়াশ করেছে তাও বুঝতে পারছি।”
ভ্রুকুঞ্চিত করলেন জাহিদ। দর্শন খানিক চিন্তার ভাব নিয়ে থুঁতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে বললো,
_”পুলিশ ও আনার দরকার নেই। জাস্ট বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুটো গলিতে খবর ছড়াতে পারলেই হলো। ভেবে দেখো, বাড়িতে যাই হোক পাড়ায় কিন্তু খুব সম্মান তোমার।”
জাহিদ বেশ ভালোই বুঝতে পারলেন দর্শন শান্ত গলায় হুমকি দিচ্ছে তাকে। এবার হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন জাহিদ, চুপ করেই বসে রইলেন সোফায়। দর্শন বেশি হলে দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করলো। জাহিদকে কিছু না বলতে দেখে বুঝতে পারলো,তিনি একটু হলেও ভয় পাচ্ছেন। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শার্টটা টানটান করে নেয় দর্শন, আরেকবার জাহিদ এর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।
আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো ফাহমিদা। তবে বরাবরের মতোই এবারো তিনি নিরব দর্শক এর ভূমিকা পালন করলেন। মনে মনে ছেলের কাজে খুশি হলেও তা মুখ ফুটে বলতে পারছেন না, আবার ভাইয়ের সামনেও গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না, কোনো এক দ্বিধাবোধ আটকে দেয় তাকে। দর্শনের বয়স যখন মাত্র আট বছর,তখনই এক রোড এক্সিডেন্ট এ তার বাবা মা’রা যায়। অল্প বয়সেই ফাহমিদা হারায় তার স্বামীকে, শশুর বাড়ির লোকজন খুব একটা সুবিধার ছিলোনা। দর্শন আর তাকে যেন এক বাড়তি বোঝা মনে করতো তারা, ঠিকঠাক খেতে পর্যন্ত দিতো না। জাহিদই তখন নিজ উদ্যোগে বোনকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। শিক্ষিত ছিলেন ফাহমিদা, টুকটাক টিউশনি করিয়ে ছেলের খরচ চালিয়ে নিতেন, তবে জাহিদ আলাদাভাবে তার থেকে টাকা নেয়নি কখনো। ভাইয়ের প্রতি তাই কৃতজ্ঞ ফাহমিদা, জাহিদের মতের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস এখনো তার হয়ে ওঠেনি। নিজের ঘরে চলে যান ফাহমিদা, ভাইয়ের সংসারে এখন তার আর থাকতেও ইচ্ছে করেনা। তবে এই বাড়ি ছেড়েও যেতে পারছেন না কেবল দর্শনের জন্য। দর্শন যতটুকু স্বাবলম্বী হয়েছে, মাসে যা ইনকাম করে তা দিয়ে মা ছেলে ভালোমতোই শহরে থাকতে পারবে, তবে রাজি হয়না দর্শন। বেশি জোর করতে পারেননা ফাহমিদা, মায়া হয় রজনীর জন্য। তারা চলে গেলে মেয়েটা একদমই একা হয়ে যাবে, সঙ্গে আফিয়াও।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ফাহমিদা। তিনি বরাবরেই নিশ্চুপ প্রকৃতির, কোনো জায়গায় নিজে থেকে হস্তক্ষেপ করেন না। ঝামেলায় জড়ানো তার পছন্দ হয়,দর্শন হয়েছে ঠিক তার বিপরীত। হয়তো বাবার মতো!
____
_”আসবো?”
ক্লাসরুম এ চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রোল করছিলো দর্শন। আগের ব্যাচ শেষ করেছে পনেরো মিনিট হলো, তারপর একটু বেরিয়েছিল সে। পাঁচমিনিট হলো ফিরেছে।
দরজার দিকে না তাকিয়ে দর্শন উত্তর দিলো,
_”আয়।”
ভিতরে এসে শেষের দিকের দ্বিতীয় বেঞ্চ এ বসে পড়লো রজনী, এটাও জানা কথা, সামনের দিকে সে খুব সহজে বসেনা। দর্শন এবার ফোনটা তার সামনের বেঞ্চে রেখে মাথা নুইয়ে রাখলো কয়েক সেকেন্ড,চোখ তুলে তাকালো রজনীর দিকে, সে চুপচাপ বসে আছে। মাথায় সাদা রঙের হিজাব, আর পরনে নিজের বানানো জামা। বয়স কম হলেও, বেশ ভালো সেলাই এর কাজ জানে রজনী, ফাহমিদার থেকে শিখেছে এটা। আবার ইউটিউব এ দেখে বিভিন্ন ডিজাইন এর জামা বানায় সে, অনেক সময় হাতের কাজ করে তাতে। এত কাজ করেও যেন সময় বেঁচে যায় তার। কি করে? সেটা বুঝতেই পারেনা দর্শন।
রজনীকে সামনে আসার কথা একবারো বললোনা দর্শন, বসুক তার সুবিধামতো। ফোনের লক খুলে সময় দেখলো দর্শন, ৫:০৩ বাজে। রজনী ঠিক সময়ই এসেছে,তবে বাকিদের এখনো কোনো খবর নেই। দর্শন চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,
_”একা আসলি যে? বান্ধবী কই তোর?”
_”ফোনে পাইনি,তাই চলে আসলাম।”
_”আর বাকিরা কোথায়? মেসেজ তো অনেকেই সিন করছে।”
_”আমি জানবো কি করে? ওদের বাসায় গিয়ে দেখে আসছি নাকি?”
সোজাসাপ্টা উত্তর রজনীর। দর্শন শার্টের পকেট থেকে দুটো সেন্টার ফ্রেশ বের করলো। একটা খুলে মুখে দিয়ে চিবোতে লাগলো,অন্যটা রজনীর দিকে দেখিয়ে বললো,
_”খাবি?”
রজনী সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
_”নাহ থাক,আমার দরকার নেই। ওটা তোমার ই দরকার।”
দর্শন ইষৎ হেসে বলে,
_”হ্যা দরকার হতেও হবেনা। তবুও কখনো ইন্টারেস্ট জাগলে,বলিস…আমার হাতের ফার্স্ট চর’টা সেদিনই খাবি।”
কথা ভুল বলেনি দর্শন। আজ পর্যন্ত রজনীর গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক,তাকে মজা করে কখনো চিমটিও দেয়নি সে। পড়ার ক্ষেত্রে কখনো মারার মতো ঘটনাই ঘটেনি। দর্শন এমনিতেও তেমন রাগী ছেলে নয়, তাছাড়া রজনী এমন কিছু কখনোই করে নি, যার জন্য তার মাথা গরম হবে।
_”আল্লাহ মাফ করুক, জীবনেও ওসবের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট আসবে না।”
শব্দ করে হাসতে লাগলো দর্শন। হাসি থামিয়ে বেঞ্চে কনুই ঠেকালো সে, গালে হাত রেখে বললো,
_”চ’ড়টা মিস করলি, সো স্যাড..”
রজনী দর্শন এর দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
_”কথাটা শুনলে না এখনো।”
দু সেকেন্ড ভাবতেই দর্শনের মনে পড়লো বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে রজনী তাকে কিছু বলতে চেয়েছিল,
_”ওহ হ্যা। উম..কেউ আসেনি তো এখনো। বল কি বলবি।”
_”তখন ড্রইং রুমে কি কথা বলছিলে তোমরা? আমি স্পষ্ট বিয়ের কথা শুনলাম। তুমিও কিছু বলতে যাচ্ছিলে, আমাকে দেখেই থেমে গেলে।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো দর্শন, আবারো ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,
_”বলেছিলাম,বড়দের কথায় অতো কান দিতে হয়না।”
_”আম্মু গম্ভীর হয়ে আছে,আমার সাথে কথাও বললো না।আব্বুর কথাতো বাদ ই দেই। আমাকে কি এতই বোকা মনে হয়? অবুঝ আমি?”
দর্শন চোখ তুলে তাকায় রজনীর দিকে, শান্ত স্বরে বলে,
_”আচ্ছা, সব বুঝিস?”
_”অনেকাংশই।”
টানটান হয়ে বসে দর্শন,মাথা কিছুটা পিছনের দিকে এলিয়ে বলে,
_”এতকিছু বুঝতে হবেনা। বাজেদিকের ভাবনা মাথায় আনলে তার প্রভাব পড়াশোনার উপরেই পড়বে, লস তোর নিজের। তাই বলি, কিছু কথা এককান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দে।”
_”তাহলে আমি যা ভাবছিলাম তাই ঠিক?”
দৃষ্টি নামিয়ে বললো রজনী, দর্শন একইভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,
_”হুম”
লম্বা নিঃশ্বাস নিলো রজনী। দর্শনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো,
_”তুমি জানলে কি করে? এইজন্যই তাড়াতাড়ি ফিরে এলে?”
_”শিমলা আপা বলেছে।”
দর্শন এর একটা বৈশিষ্ট্য,সে একদমই স্পষ্টভাষী। কারো থেকে কোনোকিছু লুকোনোর খুব বেশি চেষ্টা করেনা সে। তাই আর রজনীর থেকেও লুকোয়নি,জানতে চায় যখন জানুক। শিমলা হলো তাদের বাড়ির কাজের লোক,অনেক বছর ধরে কাজ করেন বাড়িতে,রজনী আর দর্শনকে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। জাহিদ আর হালিমার কথা আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গেই দর্শন কে তাই খবরটা জানান তিনি।
_”জানতে চেয়েছিস,বলে দিলাম। মুড অফ দেখতে চাইছিনা এখন।”
সোজা হয়ে বসে বললো দর্শন,রজনী প্রতিত্তরে স্মিত হাসলো কেবল। তখন ই হুরমুরিয়ে দরজার সামনে এলো সারা,হাপাতে হাপাতে বললো,
_”আসি ভাইয়া?”
#চলবে?
[কেমন লাগছে দর্শনকে এবং গল্প? কমেন্টে জানাবেন।]