কমলা_রঙের_রোদ [১১] #জেরিন_আক্তার_নিপা

0
299

#কমলা_রঙের_রোদ [১১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশি প্রচুর টেনশনে আছে। ওকে দেখে দেখে খুশবুর টেনশনও বেড়ে যাচ্ছে। আজ তো বাপ ছেলেতে একটা ফাটাফাটি ঝগড়া হবেই।
খুশিকে ঘরজুড়ে পায়চারি করতে দেখে খুশবু বলল,

-এবার থাম। সোজা হাঁটলে দুই কিলো হেঁটে ফেলতি।

খুশি তবুও থামছে না। মা’র মোবাইলটা কোনভাবে আনতে পারলে ভালো হতো। অন্তত স্মরণের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি আগেই জানিয়ে রাখা যেত।

-আরে এত টেনশন করিস না। বড়ো আব্বু স্মরণ ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে না।

খুশি পায়চারি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। খুশবুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-মা’র মোবাইলটা এনে দিতে পারবি?

কথাটা শুনেই খুশবু আঁতকে উঠল। এর থেকে ঘুমন্ত বাঘের নাকি সুড়সুড়ি দিয়ে আসতে বললেও করে ফেলত।

-ওরে বাবারে! আমাকে প্লিজ এই কাজ করতে বলিস না৷ মা’র মোবাইল ধরা আমার জন্য হারাম জানিস তো।

খুশি প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। কীভাবে স্মরণকে জানাবে বাড়িতে কী হচ্ছে।

-আমার একটা কাজ করবি খুশবু?

-মা’র মোবাইল এনে দেওয়া ছাড়া যে কাজ বলবি করে দিবো।

-কোনভাবে স্মরণের সাথে আমার কথা বলিয়ে দিতে পারবি?

খুশবু একটু ভেবে বলল,

-তুই বাড়ি থেকে বের হতে পারল কথা বলিয়ে দিতে পারবো।

সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এখন চাইলেই তারা দু’জন বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না।

-আমার আমি কথা না বললেও হবে। তুই আমার হয়ে বলে দিবি?

-কী বলতে হবে?

-পাপিয়ার বাড়ি থেকে পালানোর সাথে যদি সত্যিই স্মরণ জড়িত থাকে তাহলে যেন সে এই ঝামেলার সমাধান না করে বাড়িতে না ফিরে। পাপিয়ার বাপ ওকে কেটে দু’ভাগ করে ফেলুক। কিন্তু স্মরণ যেন পাপিয়াকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসে।

খুশবু মুখে ‘আচ্ছা পারবো।’ বললেও মনে মনে ভাবল তার বোনটা কতটা স্বার্থপর। শুধু নিজেরটা ভাবছে। বেচারি পাপিয়াকে পেলে কাদের কাকা কি ওকে আস্ত রাখবে?
বাড়ি থেকে বেরোনোর জন্য খুশবু অজুহাত দিলো তার খাতা নেই। দোকান থেকে খাতা কিনে আনতে যাবে৷ পরী বানু বললেন,

-অহনই লাগব খাতা?

-এখনই লাগবে দাদী। স্যার অংশ দিয়ে দিয়েছে। খাতা ছাড়া কিসের মধ্যে অংক করবে?

পড়াশোনার ব্যাপারে দাদীর তেমন জ্ঞান নেই বলে সহজেই দাদীকে বোকা বানাতে পেরেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুশবু দ্রুত পা চালাচ্ছে। সে এ পাড়ায় মোটামুটি ফেমাস। তার জন্য ফোন জোগাড় করা কঠিন কোন কাজ না। খুশি যা যা বলতে বলেছে খুশবু তার থেকেও কিছু বেশিই বলেছে। সব শুনে স্মরণ বলল,

-খালা রাগ করে আছে মানলাম। কিন্তু আব্বা কি সত্যিই লাঠি হাতে বসে আছে? তুই বানিয়ে বলছিস না তো?

-ছি স্মরণ ভাই! এরকম একটা সময়েও আমি তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলবো? জীবনের প্রথম বড়ো আব্বুকে আমি এতটা রাগতে দেখেছি।

-তাহলে তো ঝামেলা হয়ে গেল রে।

-ঝামেলা বলতে! তুমি কেন অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারলে? খুশি বলতে বলেছে, পাপিয়াকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে তুমি যেন বাড়ি না ফিরো।

-খুশি এটা বলেছে?

-আমি যা যা বলছি কিছুই আমার নিজের কথা না। খুশির শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলোই তোতাপাখির মতো তোমাকে মুখস্ত শোনাচ্ছি।

রাতে স্মরণ সত্যিই বাড়ি এলো না। হাসান ছেলের ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে কতক্ষণ চেয়ারে বসেই ঘুমালেন। মানছুরা স্মরণের উপর রেগে থাকলেও ছেলেটার বাড়ি না ফেরা নিয়ে মনে মনে চিন্তিত। পরী বানু তো প্রকাশ্যেই কাদের বেপারিকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন।

-কাদের হারামজাদা আমার নাতিরে কিছু করে নাই তো? আমার নাতির শইলে ফুলের টোকা লাগলেও আমি কাদেররে ছাড়মু না।

খুশির নিচু গলায় খুশবুকে জিজ্ঞেস করল,

-আমি যা বলতে বলেছিলাম তা-ই বলেছিস তো?

খুশবু বিরক্ত চোখে বোনের দিকে তাকাল।

-আজকাল উপকার করলেও মানুষ সন্দেহ করে। ভালোর জামানাই নাই।

-তুই তো সবসময় দুই চার লাইন বেশি বলিস।

-তুই আমার সাথে কথা বলিস না তো। মীরজাফরের বংশধর একমাত্র তুই-ই বেঁচে আছিস।

পরের দিন খুশি মাথা ব্যথার অজুহাত দিয়ে বাড়িতেই থেকে গেল। কিন্তু খুশবু ঠিকই ভার্সিটিতে এসেছে। ওকে দেখেই মাহিয়া এসে খপ করে ধরল।

-কী ঠিক করেছিস? যাবি?

-কোথায়?

মাহিয়া চোখ পাকিয়ে তাকাল। ওদিকে তার ভাই তাকে পাগল করে ফেলছে। আর এই গাধী ভুলেই গেছে কিসের কথা বলছে সে।
খুশবুর মনে পড়লে বলল,

-ওহ। তোর সাথে যাওয়ার কথাটা। বাড়িতে বলতে পারিনি দোস্ত। এমনিতেই এখন সবার মাথা গরম যাচ্ছে।

খুশবু না গেলে সান তাকে আস্ত রাখবে না। বলে দিয়েছে যেভাবেই হোক খুশবুকে রাজি করাতে।

-আমি কিছু জানি না। তোকে যেতেই হবে।

-বাড়ি থেকে অনুমতি না নিয়ে কীভাবে যাবো?

-অনুমতি নে তাহলে।

-দিবে না।

-না না দোস্ত। যেভাবেই হোক তোকে আমার সাথে যেতেই হবে। আমি কিছু জানি না। তুই যেভাবে পারিস অনুমতি নে।

মাহিয়াটা মাথা খাচ্ছে। খুশবু বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছে, এতক্ষণে হয়তো স্মরণ ভাই বাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়িতে হয়তো ছোটখাটো একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। স্মরণ ভাইও তো ঘাড়ত্যাড়া কম না।

খুশবু যা ভেবেছিল বাড়িতে এসে দেখল ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বড়ো আব্বুর ঘরে কাদের কাকা বসে আছেন। খুশবু খুশিকে জিজ্ঞেস করল ঘটনা না। খুশি পরে বলবো বললে খুশবু কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বড়ো আব্বুর ঘরের সামনে গিয়ে আড়ি পেতে শুনতে লাগল।

-হাসান ভাই কাল আপনার বাড়ি এসে নানান কথা শুনিয়ে গেছি। আসলে তখন মাথা ঠিক ছিল না। একটাই মেয়ে আমার। বুঝেনই তো ভাই। স্মরণের উপর রাগ ছিল তাই অনেক আজেবাজে কথা বলেছি। কিন্তু ভাই আসলে এসবে ওর কোন দোষ নেই। স্মরণ আরও আমার যে উপকার করেছে ওর ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।

খুশবুর মুখ বেঁকে গেল। কাদের কাকা এত ভালো মানুষ কবে থেকে হলো? কানে ভুল শুনছে না তো সে! এক রাতে স্মরণ ভাই কী এমন জাদু চালিয়েছে। খুশবু বড়ো আব্বুর ঘরের সামনে থেকে চলে এলো। খুশির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-কাদের কাকা হঠাৎ এত ভালো হয়ে গেল কীভাবে? মুখ থেকে মধু ঝরছে।

-কাল রাতে পাপিয়া ফিরে এসেছে।

-সেটা বুঝলাম। কিন্তু স্মরণ ভাই না পালাতে সাহায্য করেছিল?

-সাহায্য করেনি। বরং পাপিয়াকে বাঁচিয়েছে।

খুশবু ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল,

-কীভাবে?

-পাপিয়া নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। স্মরণ তাকে বাঁচিয়েছে। তখন পাপিয়াকে কথা দিয়েছে শাকিলের সাথে ওকে মিলিয়ে দিবে৷ স্মরণ সাহায্য না করলে কাদের কাকা এতক্ষণে মেয়ে হারা হয়ে যেত।

সব শুনে খুশবু নিজে নিজেই বলছে,

-পাপিয়া তো ডেঞ্জারাস মাল! ভালোবাসার জন্য মরতে গিয়েছিল! এরা তো লায়লি মজনুর প্রেমকেও হার মানিয়ে দিবে। ভাইরে ভাই, মানুষ প্রেম ভালোবাসার জন্য কত কী করতে পারে!

মা বড়ো আব্বু কিছু না বললেও খুশি এখনও স্মরণের উপর রেগে আছে। তাই ঠিকঠাক মতো কথাও বলছে না। স্মরণকে দেখলেই অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। দুপুরে সবাই একসাথে বসে খেয়েছে। খাওয়ার সময়ও স্মরণকে তেমন পাত্তা দেয়নি। খুশবু এদের মান অভিমানের ঢং দেখতে দেখতে বিরক্ত। এসব তার চোখে পড়ে। বাকিরা কি দেখে না?

মাকে বলার সাহস খুশবুর নেই। দাদীকে বললেও লাভ হবে না। দাদী এমনিতেই তার এখানে সেখানে যাওয়া পছন্দ করে না। বললেই বলবে, দিনকাল ভালা না। অহন কোথাও যাওন লাগত না। তাই খুশবু সুযোগ খুঁজছে খুশিকে বলে যদি কাজ হয়। খুশবুর হাবভাব দেখেই খুশি বুঝতে পেরেছে। তাই জিজ্ঞেস করল,

-কী হয়েছে তোর? এরকম চোরা চোখে আমাকে দেখছিস কেন?

খুশবু দাঁত বের করে হেসে বলল,

-ভাবছি একটা বড়ো বোন থাকা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।

-আমার কাছে এক টাকাও নেই। ধার দিতে পারবো না। আর তুই এপর্যন্ত ধার বলে যত টাকা নিয়েছিস তার এক টাকাও ফেরত দিসনি।

-ধার কে চায়? টাকাপয়সার মামলা না।

-তাহলে?

-আমার বান্ধবীর জন্য। অনেক বড় পার্টি রেখেছে। আমাকেও যেতে বলেছে। আমি প্রথমে অনেক না করেছি। কিন্তু বান্ধবীরা কি না শুনে? এখন আমারও একটু একটু যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মাকে কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। আমার হয়ে তুই একটু বলে দে না।

-অসম্ভব। আমি এসবে নেই?

এতক্ষণ অনুরোধ করলেও এখন খুশবু ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে দিয়েছে।

-আমি তোকে সাহায্য করিনি? জানের ঝুঁকি নিয়ে সন্ধ্যাবেলা গিয়ে স্মরণ ভাইয়ের কাছে তোর খবর পৌঁছে দিয়েছি। তুই আমার জন্য মাকে একটু রাজি করাতে পারবি না!

খুশি হতাশ চোখে খুশবুকে দেখল। এই মেয়ের জীবনে শখের শেষ নেই। এসব পার্টি ফার্টিতে মানুষ যায়!

-পার্টি কখন?

-পার্টি তো রাতেই হয়। কিন্তু আমি সন্ধ্যার আগে চলে আসব।

-কথা দিচ্ছিস তো?

-আল্লাহর কসম। আরও কিছু বলতে হবে?

-না।

-তুই তাহলে মাকে রাজি করাবি তো?

-চেষ্টা করে দেখি। তারপরেও মা যেতে না দিলে আমার কিছু করার থাকবে না।

খুশবু খুশির চোটে খুশিকে জড়িয়ে ধরে লাফাতে শুরু করল। খুশি বিরক্ত হয়ে ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।

-তুই চেষ্টা করবি মানেই মা রাজি হয়ে গেছে। থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ থ্যাঙ্কিউ। মাঝে মাঝে তুই এত ভালো হয়ে যাস না! মন চায় তোকে খেয়ে ফেলি।

-ছাড় তো। এসব ডলাডলি আমার পছন্দ না।

খুশি মাকে কীভাবে রাজি করিয়েছে খুশবু জানে না। জানতে চায়ও না। মা রাজি হয়েছে এটাই অনেক। কিন্তু তৈরি হতে গিয়ে খুশবুর সমস্ত আনন্দ চাপা পড়ে গেল। পার্টিতে পরে যাবার মতো কোন কাপড় তার নেই। তার যা কাপড় আছে তা পরে পার্টিতে গেলে মানুষ হাসবে। দু’দিন ধরে মা’র অনুমতি নেওয়ার জন্য নানান ফন্দি আাঁটেছে। কী পরে যে পার্টিতে যাবে এটা একবারও ভাবেনি।
নিজের এই গরিবীর উপর বিরক্ত হয়ে খুশবু বলল,

-আমাকে এক বস্তা টাকা পাইয়ে দিলে তোমার সম্পদের ভাণ্ডার কিছু তো কমে যাবে না আল্লাহ। এত গরিব করে আমাকে কেন পাঠিয়েছ। মানুষ কানাডা সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত ঘুরতে যায়। আমি কক্সবাজার যাব সেই টাকাটাও নেই। দু’টা ভালো জামা নেই। এই ভিখারি জীবন আমি চাই না। তুমি প্লিজ আমাকে বড়লোক বানিয়ে দাও।

খুশি ঘরে ছিল না। দরজার সামনে থেকে এটুকুই শুনলো খুশবু কারো কাছে কিছু চাচ্ছে।

-কার কাছে কী চাচ্ছিস?

-আল্লাহর কাছে টাকা চাচ্ছি?

-আল্লাহ কি আকাশ থেকে টাকা তোর ঘরের চালের উপর ফেলবে? পরিশ্রম করে অর্জন করতে হবে।

-পরিশ্রম করা ছাড়া কীভাবে রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায় জানা থাকলে বল। আর জানা না থাকলে আজাইরা জ্ঞান দিস না। এমনিতেই আমার দুঃখের শেষ নেই।

খুশি খুশবুকে এর বেশি পাত্তা দিতে চাইল না। এই মেয়ের দুঃখ না থাকলেও তার দুঃখ লাগে কেন তার কোন দুঃখ নেই। খুশি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খুশবু রাগ করে আলমারি থেকে তার সব কাপড় নামিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।

🌸

খুশবু কখন আসবে জিজ্ঞেস করে করে সান মাহিয়াকে পাগল করে ফেলেছে। শেষমেশ মাহিয়া কান চেপে ধরে বলল,

-এবার ক্ষমা করো ভাই। তোমার ক্রাশ সময় হলেই চলে আসবে। প্লিজ আমার মাথাটা আর খেয়ো না।

-কখন আসবে?

-আমি কী জানি?

-তুমি কেন জানবি না? তোর বান্ধবী না? বান্ধবীকে না নিয়ে তুই একা কেন চলে এসেছিস?

কথার মাঝখানেই হঠাৎ সান থেমে গেল। তার চোখ একটা মানুষের উপর আটকে গেছে। সানকে চুপ করে যেতে দেখে মাহিয়া ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাল। খুশবুকে দেখে মাহিয়াও ভাইয়ের মতোই মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকল। এটা কি সত্যিই তার বান্ধবী! নাকি কোন অপ্সরা!

চলবে
এডিট ছাড়া পর্ব। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here