#কমলা_রঙের_রোদ [৩]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
মৃত্যু কী এটা বোঝার ক্ষমতা স্মরণের হয়েছে। সে জানে মানুষ মারা গেলে আর ফিরে আসে না। তার মা-ও কি আর কোনদিন ফিরে আসবে না? মা ফিরে না এলে সে কার কাছে থাকবে? কে তাকে আদর করবে? ছোট ছেলেটাকে মা’র নিথর দেহের উপর পরে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে ঘরে উপস্থিত সকলের চোখে পানি চলে এসেছে। বোনকে হারানোর শোক কাটিয়ে মানছুরা স্মরণকে সামলাতে পারছে না। সে নিজেই এখনও বোনের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। বুবু কেন তাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেল? বকুলের মুখ ঢেকে দিলে স্মরণ বারবার মা’র মুখ থেকে চাদর সরিয়ে দিচ্ছে। মহিলারা তাকে মা’র কাছ থেকে দূরে নিতে চাইলে তেড়ে উঠে সবাইকে বলছে,
-তোমরা আমার মা’র মুখ ঢেকে দিচ্ছ কেন? আমি মা’কে দেখতে পারছি না। সরো তোমরা। আমার মাকে ধরবে না কেউ।
পরী বানু কী বলে এই নাতিকে সান্ত্বনা দিবেন? যে ছেলেটা মা’কে একপলক না দেখে থাকতে পারতো না সে সারাটা জীবন কীভাবে মা ছাড়া কাটাবে?
হাসান অনুভূতি শূন্য মানুষের মতো বসে আছে। প্রিয় স্ত্রীকে হারানোর শোক যেন তাকে ছুঁতে পায়নি। তার চোখে পানি নেই। বকুলের নিথর দেহের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। এটা তার বকুল না। তার মনে হচ্ছে বকুল ঘরে আছে। ঘরে গেলেই এক্ষুনি বকুলকে দেখতে পাবে।
লাশ বেশি সময় উপরে রাখা ঠিক না। দ্রুত জানাজা দেওয়াই উচিত। মহিলারা বকুলকে গোসল দিয়েছে। লাশ নিয়ে যাওয়ার আগে শেষ বার মা’কে দেখার জন্য স্মরণকে আনা হয়েছে। মা’কে সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখতে দেখে স্মরণ আবার পাগলামি করতে লাগল। হাবিবও ভাতিজাকে ধরে রাখতে পারছে না।
-কাকা আমাকে ছাড়ো। আমাকে মা’র কাছে যেতে দাও কাকা। মা’কে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
হাবিব স্মরণকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরল। তার চোখও জলে ভেজা।
-পাগলামি করিস না বাবা। মা’কে নিয়ে যেতে দে।
-কেন নিয়ে যাবে? ওরা আমার মা’কে কোথায় নিয়ে যাবে। তুমি ওদের না করো কাকা।
আজকের আগে এরকম পরিবেশ খুশবু নিজের চোখে কোনদিন দেখেনি। তার জন্য এসবকিছু ভীতিকর। সকলকে কাঁদতে দেখে আশেপাশে বাবাকে না পেয়ে ভয় পেয়ে খুশবুও কাঁদতে শুরু করেছে।
জানাজা থেকে হাসান সবার আগে বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ফিরেই ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। পরী বানুর সাজানো গুছানো সংসারটা এক মুহূর্তেই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। বড়ো বউটা এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল! যাওয়ার বয়স তো তার হয়েছিল। হাবিব বাড়ি ফিরে দেখে খুশবু একা একাই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মানছুরা স্মরণের কাছ থেকে নড়ছে না। এই নিয়ে খুশিও আজ আপত্তি করেনি। আজকে বাড়িতে কী হয়েছে এটা বোঝার ক্ষমতা খুশির হয়নি। কিন্তু খুশি এটা বুঝতে পেরেছে স্মরণ ভাই আজ কেঁদেছে। তাকে কি কেউ মেরেছে?
পাশের বাড়ির ভাবী খাবার নিয়ে এসেছে। সকাল থেকে কারো পেটে একটা দানাও পড়েনি। মানছুরার পাশে বসে ভাবী বললেন,
-জীবন মৃত্যু আল্লাহর হাতে বোন। ভাগ্যের লেখা কি কেউ আটকাতে পারবে? যে যাওয়ার সে তো চলেই গেছে। তাই বলে তোমাদের কি নিজেদের সামলাতে হবে না? কারো কথা না ভাবো। মা হারা এই ছেলেটার কথা তো ভাববে। তুমিও যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে স্মরণকে কে সামলাবে। তোমার বোনের আমানত তোমার কাছে রেখে গেছে। এই আমানতের খেয়াল তোমাকেই তো রাখতে হবে।
🌼
খুশি বান্ধবীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনে স্মরণকে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো। কিন্তু তার বিরক্তি প্রকাশ পেলো না। স্মরণ দু’পায়ে বাইক ঠেলে খুশির দিকে এগিয়ে এসে বলল,
-এত ঘনঘন বান্ধবীর বাড়িতে আসার কারণ কী তোর?
প্রশ্নটা শুনে খুশি মোটেও খুশি হলো বলে মনে হলো না। সে কী করলো বা না করলো এই কৈফিয়ত কাউকে দিতে পছন্দ করে না। স্মরণকে তো না-ই। বয়সে স্মরণ তার বড় বলে অসভ্যতাও করতে পারে না। তার উপর মা’র কাছে যদি বিচার দেয় এই ভয়ও কাজ করে।
-তুমি জানো কীভাবে আমি এখানে এসেছি?
-তোর সব খবর আমার কানে এসে যায়। কেন এসেছিলি?
-নোটস নিতে।
-বাড়ি এসে নোটস নিতে হয়?
-পড়াশোনার তাগাদা থাকলে বাড়ি এসেই নিতে হয়। কেউ আমার জন্য নোটস বাড়ি বইয়ে দিয়ে আসবে না।
স্মরণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কতক্ষণ খুশিকে দেখল। তার সাথে সরাসরি অভদ্রতা না করলেও কেমন চেটাং চেটাং কথা বলে।
-বাইকে বোস।
খুশি ভাঙাচোরা বাইকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কার বাইক এটা?
-বন্ধুর।
-বন্ধুর বাইক ধার নিতে শরম করে না?
-বন্ধুর নোটস নিতে তোর শরম করে বুঝি?
খুশি তর্ক করলো না। এর সাথে তর্ক করেও লাভ নেই এটা খুশি খুব ভালো করেই জানে। খুশি বাইকে উঠে বসলে স্মরণ বলল,
-ধরে বোস।
খুশি আপত্তি করলেও লাভ হবে না। তাই স্মরণের কাঁধে হাত রেখে ধরে বসলো। স্মরণ আয়নায় খুশিকে দেখে সামান্য হেসে বাইক স্টার্ট দিলো। পথেই স্মরণের উপর খুশির রাগের কারণটা জানা গেল।
-কাল রাতে বাড়ি ফিরোনি কেন তুমি?
-মাস্টার মশাই নিশ্চয় লাঠি হাতে বসে ছিল।
-বসে থাকারই কথা।
-সেকারণেই ফিরিনি।
-কোন বন্ধুর বাড়িতে ছিলে?
-বললেও চিনবি না।
-চিনবো কীভাবে? তোমার বন্ধুর অভাব আছে!
-বন্ধু থাকাটা কি ভালো না?
-বন্ধু থাকা আর বাজে সঙ্গের পাল্লায় পড়া একা কথা না।
-ওরা কেউ বাজে ছেলে না রে।
-তাহলে তুমিও তো বাজে ছেলে না।
-তোর মনে হয় আমি বাজে ছেলে?
এই প্রশ্নের জবাবে খুশি কিছু বলল না। ওকে চুপ মেরে যেতে দেখে স্মরণ বলল,
-আমি একটু করলেও শালারা খালার কাছে আরেকটু বানিয়ে লাগায়। যেখানে দোষ পুরোপুরি আমার থাকে না।
খুশি প্রায় নিভে আসা গলায় বলল,
-ভালো ছেলেদের মুখের ভাষা এমন হয়? তারা যাকে তাকেই শালা বলে দেয়?
খুশিটা কথায় কথায় এরকম সেন্টি খেলে কীভাবে চলবে? শালার মেয়ে মানুষের সমস্যাই এটা। এরা একটুতেই ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে ফেলে। স্মরণ খুশিকে কাঁদাতে চায় না। তাই কোন অপরাধ না থাকা স্বত্বেও বলল,
-আচ্ছা আজ রাতে বাড়ি ফিরে আসবো। তবুও তুই এখন সেন্টি খাস না তো।
-তুমি বাড়ি ফিরো মন চায় না ফিরো তাতে আমার কী?
-কিছু না তো?
-উঁহু।
-ভেবে বল কিন্তু।
-ভেবেই বলেছি।
-চল মিথ্যুক। মনে এক মুখে আরেক কথা বলিস। তুই তো আমার থেকে বড় বাটপার।
🌼
স্মরণ খুশিকে বাড়ি থেকে একটু আগে নামিয়ে দিয়েছে। পাড়ার কেউ দেখে ফেললে আরেক কাহিনি বানাতো। এমনিতে তো বাতাসে কাহিনি কম উড়ছে না। খুশি বাড়ি ফিরে দেখলো মা দাদী কেউ বাড়িতে নেই। এই সময় কোথায় গেল সবাই? যেখানে খুশি যাক তার জেনে কী? ঘরে গিয়ে টেবিলের উপর ব্যাগ রেখে দেখল এই গরমের মাঝেও খুশবু কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। দেখেও খুশি কিছু বলল না। গা ঘামে ভিজে আছে। তাই কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলে গেল। গোসল করে ঘরে এসেও দেখল খুশবু আগের মতোই শুয়ে আছে। সকালে দেরি হয়ে যাওয়ায় খেয়ে যেতে পারেনি। এখন খিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। খুশি রান্নাঘরে গিয়ে দেখল দুপুরে রান্না হয়নি। মা না রেঁধে কোথায় চলে গেল? ঘরে এসে খুশি খুশবুকে ডেকে তুললো।
-মা কোথায় গেছে?
খুশবু এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছে। নাপা খেয়েও কোন কাজ হয়নি। জ্বরের ঔষধ হিসেবে দাদী কবিরাজের থেকে মাধুলী টাধুলী এনে হাতে বেঁধে দিয়েছে। মেয়েটার জ্বর সারছে না। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও মা তেমন গরজ করছে না। খুশবুও কাউকে কিছু না বলে কাঁথাকে সঙ্গী বানিয়ে একটা সপ্তাহ ধরে পড়ে আছে। খুশি গায়ে সামান্য ঠেলা দিয়ে ডাকলে খুশবুর চোখ খুললো। বোনকে দেখে দূর্বল কন্ঠে চিঁচিঁ করে বলল,
-চলে এসেছিস?
-হু। মা দাদী কোথায় গেছে জানিস?
-বাড়িতে নেই?
-না। কোথায় গেছে তোকে বলে যায়নি?
-না।
মা দাদীর খোঁজ নেই। রান্নাও হয়নি কিন্তু খিদে পেয়েছে। এখন দু’টি পথই তার কাছে খোলা আছে। এক, নিজে রান্না করে খাবে। দুই, রাগ করে না খেয়ে বসে থাকবে। অবশ্য তার এই রাগ মা পাত্তা দিবে না। এটা ভেবে খুশি নিজেই রান্নাঘরে চলে এলো। মোটামুটি সব রান্নাই আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। শুধু পোলাওটা মা’র মতো ঝরঝরে হয় না। যতই পানি মেপে দিক তারপরও কেমন প্যাচপেচে হয়ে যায়। শুধু ভাত আর একটা ডিম ভেজে প্লেট নিয়ে খুশি ঘরে চলে এলো। ডিম ভাজার ঘ্রাণে খুশবুর পেটেও খিদে জানান দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটাই জ্বর হওয়ার পর থেকে কিছুই খেতে পারছে না। সব নিম পাতার মতো তিতা লাগছে। খুশি নিজে খাওয়া শুরু করার আগে খুশবুকে জিজ্ঞেস করল,
-খেয়েছিস কিছু?
-না।
খুশবু না খেয়ে আছে জেনেও খুশি একা খেয়ে উঠতে পারলো না। বোনের ভালোবাসা তো দূর খুশবুর প্রতি কোনরকম মায়া বা টান না থাকার পরেও সে এতটা স্বার্থপর হতে পারলো না। তাই নিজের ভাগটা খুশবুর জন্য ছেড়ে দিয়ে বলল,
-উঠে খেয়ে নে।
চলবে
এত সুন্দর টাইপো মাকসুদা রত্না আপু ছাড়া আর কে করবে?
যতনে রাখিবো গল্পটাও লিখবো। একটু সময় দিন।