#কমলা_রঙের_রোদ [১০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
মাহিয়া মনে মনে কতক্ষণ সানের গোষ্ঠী উদ্ধার করল। আজুহাত দেওয়ার আর কিছু পেলো না? আর তার বান্ধবীটাও আল্লাহর বান্দা কোন কিছুই সহজে ভুলে না। নয়তো তার জন্মদিন মনে রাখতে কে বলেছে। তবুও মাহিয়া কোনভাবে কাটিয়ে দিতে চাইল।
-আমার জন্মদিন ডিসেম্বরে পালন করে ফেলেছি! ওহ মনে ছিল না।
খুশবু তীক্ষ্ণ চোখে মাহিয়াকে দেখছে। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
-সত্যিই কি আজ গাঁজা টাজা খেয়ে এসেছিস? নিজের জন্মদিন আবার মনে থাকে না কীভাবে?
মাহিয়া করুণ মুখ বানিয়ে বলল,
-গাঁজা কোথায় পাবো দোস্ত! আমার স্মৃতিশক্তি তোর মতো ভালো না। তাই বলে এভাবে অপমান করবি?
-নাটক করিস না তো। এর থেকে বড়ো বড়ো অপমানও তোর গায়ে লাগে না।
-এখন কি তুই আসবি না?
-কোথায় আসবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
-আমার পরিচিত একজনের জন্মদিন। আমার একা যেতে মন চাচ্ছে না। তুই আমার সাথে চল না দোস্ত।
খুশবু বুঝতে পারছে না এই গাধীর আজ হলোটা কী? এরকম ন্যাকামি করছে কেন?
-এতক্ষণ তাহলে মিথ্যে কেন বললি যে তোর জন্মদিন।
-সত্য বললে তুই রাজি হবি না।
-মিথ্যা বলেছিস এখনও রাজি হবো না। তোর পরিচিত কারো জন্মদিনে আমি কেন যাব? আমি কি তাকে চিনি? নাকি আমাকে ইনভাইট করেছে?
-তুই তাকে চিনিস।
-চিনলেও সে তো আর আমাকে যেতে বলেনি।
-আমি বলেছি তো। আমার কথা তুই রাখবি না?
খুশবুর খুশিকে খুঁজতে যাওয়ার আগেই খুশি চলে এসেছে। খুশি খুশবুকে যাওয়ার জন্য ডাকলে খুশবু মাহিয়াকে বলল,
-ঠিক আছে। ভেবে দেখব।
-ভাবাভাবির কী আছে দোস্ত।
খুশি দাঁড়িয়ে আছে। খুশবু এখনও আসছে না। বিরক্ত হয়ে খুশি আবার ডাকল।
-খুশবু আসবি? নাকি আমি চলে যাব।
-দাঁড়া একটু।” খুশিকে দাঁড়াতে বলে খুশবু তাড়াহুড়ো করে মাহিয়াকে বলল,
-আচ্ছা যাব। কিন্তু ওখানে গিয়ে যদি দেখি তোর পরিচিত ব্যক্তি আমাদের পাত্তা না দেয় তাহলে তোর খবর আছে।
খুশবু রাজি হয়েছে এতেই মাহিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। মনে মনে বলল,
-তোকে পাত্তা না দিলে পৃথিবীর আর কাকে পাত্তা দিবে? তোর জন্যই তো এত কাঠখড় পুড়ানো।
🌸
কাদের বেপারি দলবল নিয়ে খুশবুদের বাড়ি এসে উঠল। বাড়িতে পা রেখেই তিনি নানান গালিগালাজ করে যাচ্ছেন। তিনি স্মরণকে ধরে নিতে এসেছেন। স্মরণ তার মেয়েকে ফুসলিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেছে। তাই তিনি বিচার বসিয়ে স্মরণকে শাস্তি দিতে চান। বাইরে এত শব্দ শুনে মানছুরা, পরী বানু দু’জনই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মানছুরাকে দেখেই কাদের বেপারি বললেন,
-বদমায়েশটাকে কই লুকাই রাখছো? বাইরে বের করো৷ এত বীরত্বের কাজ করে এখন লুকিয়ে আছে কেন? কুলাঙ্গারটাকে এইবার জন্মের শিক্ষা দিয়া ছাড়ব।
এতগুলো মানুষ কেন এসেছে, কী ঘটেছে মানছুরা জানে না। কিন্তু কাদের বেপারির মুখের ভাষা সে বরদাস্ত করবে না।
-মুখ সামলে কথা বলুন। সভ্য সমাজে বসবাস করছেন। নিজেকে ভদ্র মানুষ দাবি করলে মুখের ভাষাটাও তেমনই রাখুন।
-আমাকে ভদ্রতা শিখাতে এসো না। তোমরা যে কেমন ভদ্র মানুষ তা সবারই জানা আছে।
পরী বানু কাদের বেপারির সামনে এগিয়ে এসে ঝাঁঝাল গলায় বললেন,
-গলা নামাইয়া কথা ক। আমরা তগোর বাড়িত যাই নাই। তোরা আইছস।
-আপনার কুলাঙ্গার নাতি আসতে বাধ্য করেছে।
বাইরে এত হৈচৈ শুনে খুশিও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। সবাই তাদের বাড়িতে এসে ঝামেলা করছে কেন?
-কী করছি আমার নাতি? তোমার কোন পাকা ধানে মই দিছে?
-আমার মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে।
খুশি এনাদের কথোপকথনের প্রথম অংশ না শুনলেও এই কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। স্মরণ পাপিয়াকে নিয়ে পালিয়েছে! পরী বানু এই কথা বিশ্বাসই করলেন না।
-মিছা কথা কওনের জাগা পাও না। আমার নাতি তোমার মাইয়ারে ভাগাইয়া নিব!
-নিজে নেয় নাই। ওর বাদাইম্মা বন্ধু শাকিলের জন্য নিয়েছে।
এটা শুনে খুশির সারা পরী বানুও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
-হেইডা কও। আমার নাতি তোমার মাইয়ারে ভাগাইয়া আনলেও তো আমি মাইনা নিতাম না। তুমি কোন জাতের লোক আমি কি জানি না?
এপর্যায়ে মানছুরা শাশুড়ীকে থামিয়ে দিলেন। ঘটনা সত্যি হলে স্মরণ সত্যিই অপরাধ করেছে। কারো বাড়ির মেয়েকে ভাগিয়ে দেওয়ার সে কে? মানুষের সম্মান নিয়ে খেলার অধিকার তাকে কেউ দেয়নি। কাদের বেপারি রগচটা লোক। তবুও তিনি পরী বানুর সাথে ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলছেন।
-বদমাশটাকে আপনারা ছাড় দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আমি ছাড় দেব না। এইবার ওর হাড্ডি মাংস আলাদা করে ফেলব। এইটা করতে না পারলে আমার নামও কাদের বেপারি না।
তিনি সমানে হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। মানছুরা মাথা ঠান্ডা রেখে বললেন,
-কাদের ভাই, কী হয়েছে আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু আপনার কথা যদি সত্য হয় তাহলে স্মরণকে এর জবাবদিহি করতে হবে। কেন ওর এমনটা করেছে।
মানছুরা এক কথার মানুষ। তাকে ছোট বড়ো সকলেই মানে। নিজের স্বামীকে যে ক্ষমা করেনি সে অন্যের অন্যায়ও ক্ষমা করবেন না।
-আপনি বাড়ি যান। আমি কথা দিচ্ছি। সন্ধ্যার আগেই আপনার মেয়ে আপনার বাড়িতে ফিরে যাবে। আর স্মরণেরও বিচার হবে।
কাদের বেপারি মানছুরাকে বিশ্বাস করে আর গণ্ডগোল করলেন না। দলবল নিয়ে ফিরে গেলেন। ওরা চলে যেতেই পরী বানু বললেন,
-মাইনষের কথা বিশ্বাস করো তুমি? স্মরণ কেন এই খচ্চরের মাইয়ারে ভাগাইয়া নিবো। আর নিলেও দোষ কি একলা আমার নাতির?
মাইয়া ভাগছে হের নাগরের লগে। ওই মাইয়া না গেলে কি জোর কইরা নিতে পারতো? ওই মাইয়ার নামেই পাপ।
-আম্মা এবার থামেন তো। নিজের ছেলেমেয়ে নাতির দোষ কখনোই আপনার চোখে ভাসবে না। পাপিয়া নিজের ইচ্ছেতে যাক যা খুশি তা করুক। স্মরণ এমন একটা কাজের সাথে যুক্তই কেন থাকবে? সে জনসেবক হয়ে মানুষের বাড়ির মেয়ে ভাগিয়ে নিবে। মানুষ কেন বিচার নিয়ে আমার বাড়িতে আসবে?
পাপিয়াকে দেখে কখনোই মনে হয়নি এই মেয়ে এমনকিছু করবে। দেখে তো মনে হতো কিছুই বুঝে না। খুশি একারণেই স্মরণকে হাজার বার বারণ করে ওসব বন্ধুদের সাথে না চলতে। শাকিলের ভালোবাসা চুলোয় যাক৷ তোর কী হ্যাঁ? মা’র রাগ দেখে স্মরণের উপর তার রাগ আরও বাড়ছে। দাঁত কিড়মিড় করে বলছে,
-স্মরণের বাচ্চা! অন্যের ভালোবাসা পূর্নতা পাইয়ে দিতে গিয়ে নিজের পেছনে বাঁশ দিতে তোকে কে বলেছে। সমাজ সেবক হয়েছ, না? আজ খালি বাড়ি ফিরো। মা তোমার সেবক গিরি ছুটিয়ে দিবে। আমিও কিছু বলবো না। যা খুশি করো তোমরা।
গণ্ডগোলের সময় খুশবু বাড়িতে ছিল না। তবে সে একটা খবর নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। খবরটা মা দাদীকে দেওয়া যায় না। তাই খুশিকে জানাতে চলে এলো।
-জানিস আজ কী হয়েছে? পাপিয়া পালিয়ে গেছে। পুরো পাড়ায় বদনামি পড়ে গেছে। সেদিনের মেয়ে, নাক টিপলে দুধ বের হবে তুই প্রেম ভালোবাসার কী বুঝিস রে? বাপ মা’র মুখে চুনকালি মাখিয়ে চলে গেছিস। তোকে পেলে…
খুশবুর বকবক শুনে খুশি ধমক দিয়ে বলল,
-চুপ কর তো।
খুশবু চুপ হয়ে গেলেও অনুসন্ধানী চোখে খুশিকে দেখছে৷ এর আবার কী হলো? এত হট একটা নিউজ শোনাচ্ছ তবুও তাকে ধমক দিচ্ছে!
-কী হয়েছে তোর?
-কিছু হয়নি।
-কিছু হয়নি তাহলে অন্য কারো রাগ আমার উপর দেখাচ্ছিস কেন? আমি তো কিছু করিনি।
-সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা ছাড়া তোর কি আর কোন কাজ নেই? মানুষের ব্যাপার নিয়ে এত আগ্রহ কেন তোর?
-আমি মানুষ তাই অন্য একটা মানুষ সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। তোর মতো রোবট হয়ে বাঁচতে পারব না। রোবটনী কোথাকার।
খুশবু উল্টো চেত দেখিয়ে চলে গেলে খুশি রাগে টেবিলের উপর থেকে একটা বই তুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলল।
দুপুরে খুশবু বুঝতে পারল খুশির মেজাজের কেন তেরোটা বেজে আছে। এই আকামের পেছনে স্মরণ ভাইও জড়িত। কাদের কাকা বাড়ি এসে স্মরণ ভাইয়ের নামে বিচারও দিয়ে গেছে। খুশবু মা’র রাগের মাত্রা অনুমান করতে পারল এ দেখে, আজ মা বড় আব্বুর কাছে স্মরণ ভাইয়ের নামে বিচার দিয়েছে। স্মরণ ভাই যত অন্যায়ই করুক মা কখনও বড় আব্বুর কাছে বিচার দেয় না।
-স্মরণ যদি বাড়ির বাইরে এসব করে বেড়ায় তাহলে মানুষ তো বিচার নিয়ে আসবেই।
হাসান কতক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে বসে থেকে হঠাৎ মুখ তুলে বলল,
-কী করেছে স্মরণ?
-কাদের ভাইয়ের মেয়েকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
কথাটা শুনে হাসান কিছুটা সময় চুপ করে থাকল। তারপর শুধু এটুকু বলল,
-স্মরণ বাড়ি ফিরলে আমাকে জানিও।
খুশবু কান পেতে সবটা শুনেছে। শুকনো একটা ঢোঁক গিলল খুশবু। বড়ো আব্বু পাগলা টাইপের লোক। সবাই জানে বড়ো আব্বুর একটা অসুখ আছে। অনেকে তো পাগলও বলে। কিন্তু খুশবুদের কখনও তা মনে হয়নি। মানুষটা পাগল না। বউকে ভীষণ ভালোবাসতো এই যা। বড়মা কেমন ছিল খুশবু জানে না। তবে দাদীর মুখে শুনেছে বড় মা’র মতো নাকি মানুষ হয় না। স্মরণ ভাইয়ের ছোট বোনকে জন্ম দিতে গিয়ে মানুষটা পৃথিবী থেকে চলে যায়। স্ত্রী সন্তান দু’জনকে একসাথে হারিয়ে বড় আব্বুর মাথায় একটু গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে এটা ঠিক। তবে বড় আব্বু তাকে ভীষণ ভালোবাসে। যখন সুস্থ থাকে তাকে ডেকে গল্প করে। রেগে গেলে আবার উপায় ছাড়া। খুশবু বড় আব্বুর রাগকে ভীষণ ভয় পায়। সাধারণ সময় বড়ো বড়ো জিনিস নিয়েও বড়ো আব্বু খুব একটা মাথা ঘামায় না। আবার অনেক সময় ছোট ছোট বিষয় নিয়েও যা হাঙ্গামা করে! আজ স্মরণ ভাইয়ের কপালে কী আছে আল্লাহই জানে।
🌸
একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে সান মাহিয়াদের বাড়িতে এসে উঠে। আগে থেকে কোন বলা নেই কওয়া নেই। মাহিয়ার মা তো বোনের ছেলেকে পেয়ে ভীষণ আনন্দিত। সেই সাথে একটু অবাকও। সানকে আসতে বলতে পারল এখন আর বলেনই না। এই ছেলে তার বাড়িতে খুব একটা আসে না। শুরু তার বাড়ি কেন? কারোর বাড়িতেই যায় না। মাহিয়া অবশ্য বুঝেছে সান কেন এসেছে।
-তুই কীভাবে আমার বাড়িতে এলি বাবা! তোকে তো বলেও কোনদিন আনানো যায় না।
সান হেসে জবাব দিল,
-তোমার কথা মনে পড়ছিল খালামনি। তাই চলে এলাম। কেন, তুমি কি খুশি হওনি? খুশি না হলে কিন্তু আবার চলে যাবো।
-শোনো পাগলের কথা! আমার থেকে বেশি খুশি আর কে হবে? তোর মাকেও সাথে নিয়ে আসতি।
-মা জানে না আমি যে এসেছি। বলে আসিনি।
মা একটু আড়ালে চলে গেলেই মাহিয়া বলে উঠল,
-খালাকে দেখতে এসেছ! আমার মা’কে মিথ্যা কেন বললে?
-পুরোপুরি মিথ্যা না। আংশিক সত্য আছে। তুই বল খুশবু রাজি হয়েছে? আসবে ও?
-জানি না। এখনও কিছু জানায়নি।
-তুই ওকে কল কর। যেভাবেই হোক খুশবুকে কিন্তু তোর রাজি করাতেই হবে?
-কেন? সেদিন কি ওকে তুমি প্রপোজ করবে?
-করতেও পারি।
-তুমি খুশবুকে নিয়ে এতটা সিরিয়াস আমি সত্যিই কল্পনা করিনি। ভেবেছিলাম এমনিতেই হয়তো মজা করছো।
-আমাকে কি তোর প্লে বয় টাইপ ছেলে মনে হয়? যে মজা করার জন্য কোন মেয়ের পেছনে ঘুরবো। আমি সত্যি সত্যিই খুশবুকে পছন্দ করি। ওকে নিয়ে ভবিষ্যত ভাবতে চাই।
চলবে
এই গল্পের রিচের যে ভয়াবহ অবস্থা! এটা ঠিকঠাক লিখে শেষ করতে পারব কি-না বুঝতে পারছি না। আপনারা যদি গল্প না-ই পড়েন তাহলে এটা বন্ধ করে নতুন গল্প ধরবো।
মেঘে রোদে কাছাকাছি নতুন ইবুকটা পড়েছেন তো?
“মেঘে রোদে কাছাকাছি”
https://link.boitoi.com.bd/BHed