#কমলা_রঙের_রোদ [২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
ঘরের ভেতর পা রেখেই দরজার সামনে থেকে স্মরণ বলে উঠল,
-মা কাকা ওইটা কাকে নিয়ে এসেছে? ওই ছোট মেয়েটা কে?
বাবা বা মা কেউই তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। তারপরও স্মরণ প্রশ্ন করা থেকে থেমে থাকল না।
-ওই মেয়েটা কি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে?
স্মরণ এতক্ষণে তার মা’র চোখে পানি দেখতে পেয়ে পুরোপুরি চুপ করে গেল। মা কাঁদছে এটাই তার কাছে সবথেকে বেশি বিস্ময়ের জিনিস।
-মা তুমি কাঁদছো কেনো? তোমার চোখে পানি কেন?
বকুল ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল,
-দূর পাগল! কাঁদছি কই?
-আমি দেখেছি। তোমার চোখে পানি।
বকুল ছেলেকে কাছে টেনে নিল। কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে চুমু খেয়ে বলল,
-স্কুল থেকে এসেছিস। জামাকাপড় পাল্টে নে। খিদে পায়নি?
-পেয়েছে।
-কলপাড় থেকে সুন্দর করে হাতপা ধুয়ে আয়। খুশি আর তোকে একসাথে খাইয়ে দিব।
খুশিকেও খাইয়ে দিবে শুনেই স্মরণ বেঁকে বসলো। তার মা’র ভালোবাসার ভাগ সে কাউকে দিতে রাজি না। খুশিকে তো এজন্যই দেখতে পারে না। মা তার সাথে খুশিকেও আদর করে।
-না। তুমি খুশিকে খাইয়ে দিবে না।
ছেলের হিংসুটেপনা দেখে বকুল হাসতে হাসতে বলল,
-মা’র ভাগ পুরোটাই তোমার লাগবে। কয়দিন পর যে বোন আসবে, তখন?
স্মরণ মা’র উঁচু পেটের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল,
-বোনকে আদর করতে দিব। বোন তো ছোট থাকবে। নিজে নিজে খেতে পারবে না। বড় হয়ে গেলে কিন্তু আর আদর করতে দিব না।
বকুল ছেলেকে বুকের সাথে মিলিয়ে নিয়ে মাথার চুলে অজস্র চুমু খেলো। মা ছাড়া এই ছেলের পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
🌼
খুশবু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কোনকিছু বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু বেচারীর ছোট্ট মস্তিষ্ক ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুক্ষণ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল,
-পাপা তুমি কি স্যাড?
হাবিব এতক্ষণ অন্য ভাবনায় ডুবে ছিল। মেয়ের দিকে খেয়াল ছিল না। মেয়ের ডাক শুনেই মনে পড়ল মেয়েটা অনেকটা সময় ধরে কিছু খায়নি। ওর হয়তো খিদে পেয়েছে। মেয়েকে কোলে বসিয়ে হাবিব জিজ্ঞেস করল,
-খিদে পেয়েছে মা?
ছোট্ট খুশবু মাথা নেড়ে জানাল তার খিদে পেয়েছে। হাবিবের নিজেকে বড়ো অপরাধী লাগছে। খুশি এখন পর্যন্ত তার কাছে আসেনি। নিজের মেয়েকে হাবিব এখনও ছুঁয়ে দেখতে পারেনি। মেয়ের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনেনি। খুশবু কাছে থাকলেও ওর খেয়ালও ঠিকঠাক মতো রাখতে পারছে না। বাড়িতে রান্না হলেও হাবিব কাউকে ডেকে খুশবুর খাওয়ার কথা বলতে পারবে না। মেয়ের হাত ধরে হাবিব ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
দোকান থেকে খুশবুর জন্য খাবার কিনে বাড়িতে ঢুকতেই পরী বানু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ছেলের উপর গর্জে উঠলেন।
-শান্তি হইছোস? এইবার তোর মন খুশি হইছে? মানুষ হাসানির যেইটুকু বাকি আছিল হেইডাও পুরা কইরা আইছোস। আমার বাড়িতে কি ভাত নাই? নাকি তুই মনে করছোস তোর মাইয়ার খাওনে আমরা বিষ মিশাইয়া দিমু।
-মা!
-তুই আমারে মা ডাকবি না। তোর মুখে মা ডাক হুনার চেয়ে আমার মরণ ভালা।
হাবিব মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মা তাকে এত বড় কথা বলে ফেলল! সে কি এতটাই নীচ?
🌼
বাড়ির পরিবেশ আজ অন্য দিনের থেকে ভিন্ন এটা স্মরণ আর খুশিও বুঝে গেছে। সেজন্যই আজ দুইজন ঝগড়া না করে মিলেমিশে থাকছে। হাসান হাবিবের সাথে একটা কথাও বলেনি। হাবিব ভেবেছিল ভাই তাকে বকবে, বোঝাবে কিছু তো বলবে। কিন্তু ভাইও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সারাটা দিন হাবিব না খেয়ে আছে ভেবে বকুল ওর জন্য সন্ধ্যায় খাবার নিয়ে এসেছে। ভাবী তো অন্তত তার কথা শুনবে।
-ভাবী আপনিও কি..
-খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেয়ে নাও।
ব্যস! এই একটা বাক্য বলেই বকুল খাবার রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।
মানছুরা পুরোটা দিন নিজেকে ঘর বন্দী করে রেখেছিল। অনেক ভাবার পর সে ঠিক করে নিয়েছে। দিনের আলোতে গেলে মানুষ দেখতো। তাই রাত হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। মানছুরা নিজের ও মেয়ের জামাকাপড় গুছিয়ে খুশিকে ডেকে বাড়ি থেকে যেতে নিলে পরী বানু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন।
-তুমি কই যাও বউ? আমার নাতনিরে নিয়া কই যাইতাছো?
-এটা তো আমার বাড়ি না আম্মা। আপনার ছেলের বাড়ি। তার বাড়িতে আমি থাকতে পারব না।
পরী বানু হা-হুতাশ করে বলতে লাগলেন।
-কী কও এইগুলা! বাড়িতে থাকবা না মানে?
-স্বামী ছাড়া এতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছি। ভেবেছি দূরে থাকলেও মানুষটা তো আমারই। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল ছিল আম্মা। ওই মানুষ আমার না।
খুশবু হাবিবের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছোট শরীর এত ধকল সইতে পারেনি। বাইরে থেকে মানছুরার প্রতিটা কথা হাবিব শুনে ফেলেছে। মানছুরা চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সে নিজেই মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পরী বানু এখনও মানছুরাকে থামানোর চেষ্টায় লেগে আছেন।
-পাগল হইয়ো না বউ। তুমি কেন যাইবা? তোমাকে আমি এই বাড়িতে আনছি। আমার অনুমতি ছাড়া তুমি কোত্থাও যাইতে পারবা না।
মানছুরা কিছু বলতেই যাচ্ছিল। কিন্তু হাবিবকে দেখে থেমে গেল। হাবিব কাছে এসে বলল,
-কারো কোথাও যেতে হবে না। আমিই চলে যাচ্ছি।
বকুল শুয়েছিল। সন্ধ্যার পর থেকে তার শরীরটা বেশিই খারাপ করেছে। কিন্তু বাড়ির পরিবেশ এরকম দেখে ছোটখাটো ব্যথায় কাউকে হয়রান করতে চাচ্ছে না। বাইরে শব্দ শুনে বকুল খুব কষ্টে উঠে এসেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেটের কাছে হাবিব মানছুরা শাশুড়ীকে দেখে উঠানে নেমে এসেছে।
-আম্মা কী হয়েছে?
পরী বানু বড় বউকে দেখে যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি বলে উঠলেন,
-দেখো না বউ, এরা আমার বাড়িরে কী পাইয়া লইছে! মানুষ হাসাইয়া শখ পূরণ হইছে না। এহন বাড়ি ছাইড়া যাওয়ার নতুন নাটক রচাইতাছে।
বকুল এসে বোনের হাত ধরে বলল,
-কী শুরু করেছিস তোরা? তোদের কথাতেই সব হবে? কেউ কোথায় যাবি না। ঘরে যা বলছি।
মানছুরা কতটা জেদি হাবিব তা জানে। একবার মানছুরা ঠিক করে ফেলেছে সে বাড়িতে থাকবে না। এখন তার এই সিদ্ধান্ত ফেরানোর ক্ষমতা কারো হয়নি। তাই নিজেই জেদে অটল থাকল।
-না ভাবী। আমার এই বাড়িতে থাকার কোন অধিকার নেই। তাই ভালো হবে আমিই চলে যাই।
-হাবিব তুমিও কি অবুঝ হয়ে গেছো! কেন পাগলামি করছো?
স্মরণ আর খুশি একসাথে পড়তে বসেছিল। যদিও খুশি এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। তারপরও স্মরণ খুশিকে অ, আ লিখতে শেখায়। বাইরে শোরগোল অনেক বেশি হয়ে গেলে স্মরণ খুশি দু’জনই বেরিয়ে এলো। স্মরণ ফিসফিস করে খুশিকে জিজ্ঞেস করল,
-কী হয়েছে রে খুশি? জানিস তুই?
-আমি জানি না স্মরণ ভাই।
স্মরণ দেখল তার মা কাকার হাত ধরে টানাটানি করছে। তখনই মায়ের কিছু হলো। মা কেমন কাঁদতে শুরু করেছে। স্মরণ দুই লাফে মা’র কাছে ছুটে এলো। বকুল সন্ধ্যা থেকেই ব্যথা চেপে রাখছিল। যা এখন সহ্য সীমার বাইরে চলে গেলে ব্যথায় মাটিতে বসে পড়ল। মানছুরাও বুঝে গিয়েছে। বুবুর বাবু আজই দুনিয়ায় আসবে। সে বোনকে ধরে তাড়াহুড়ো করে বলতে লাগল,
-বুবুকে হাসপাতালে নিতে হবে আম্মা। ভাইজানকে ডাকেন।
মা’কে কষ্টে দেখে স্মরণও ঘাবড়ে গেছে। সে-ও মা’র মুখের উপর ঝুঁকে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
-মা কী হয়েছে তোমার? ও মা। কাঁদছো কেন তুমি?
মানছুরা স্মরণকে শান্ত করতে বুঝিয়ে বলল,
-তোমার মা’র কিছু হয় নাই আব্বা। একটু পরে তোমার বোন আসবে। তুমি ঘরে যাও। খুশির সাথে খেলো।
-আমি মা’কে ছেড়ে কোথাও যাব না খালা।
বকুল প্রসব বেদনার মাঝেও দু’হাতে ছেলের মুখ ধরে গালে কপালে চুমু খেয়ে দূর্বল কন্ঠে বলল,
-তোমার খালার কথা শুনো আব্বা। আমার কিছুই হয় নাই। তুমি ভয় পাইয়ো না। তোমার আব্বা কই?
হাসান বাড়িতে ছিল না। তাকে এক ছাত্র এসে নিয়ে গিয়েছিল। হাবিব বকুলকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাথে মানছুরাও যায়। পরী বানু তিন নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাড়িতে একা থাকেন। খবর পেয়ে হাসান হাসপাতালে ছুটে যায়। বকুলের শরীর খারাপ বুঝতে পারলে যত জরুরি কাজই থাকতো সে কোনদিন বাড়ি থেকে যেত না।
হাবিব সারারাত হাসপাতালে কাটিয়ে সকালে বাড়ি ফিরেছে। পরী বানু পুরোটা রাত একটা বারের জন্য দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। স্মরণ খুশি ঘুমালেনও ছোট মেয়েটা সারারাতই বাবার জন্য কেঁদেছে। পরী বানু চেষ্টা করেও খুশবুকে শান্ত করতে পারেননি। হাসপাতালে কী হচ্ছে এটা ভেবেও বুক অস্থির লাগছিল। হাবিবকে দেখেই ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-বড়ো বউয়ের কী হইছে? হাসান কই? কহন আইবো ওরা?
হাবিব শুকনো মুখে মা’র দিকে তাকিয়ে কেঁপে ওঠা গলায় বলল,
-ভাবীকে নিয়ে আসছে মা।
পরী বানু খুশি হয়ে গেলেন। গেটের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন।
-যাক আল্লাহ ভালোয় ভালোয় উদ্ধার করছে। আল্লাহর কাম সবই ভালা। কী হইছে বউয়ের ঘরে? পোলা না মাইয়া?
হাবিব মা’র চোখে মুখে খুশি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ে নিচে বসে পড়ল। পরী বানু হতভম্ব হয়ে ছেলেকে দেখছেন।
-কান্দোস ক্যান হাবিব? বড়ো বউয়ের কী হইছে? কথা ক। কী হইছে বড়ো বউয়ের?
দমবন্ধ কান্নায় হাবিব কথা বলতে পারছে না। পরী বানুর বুক ভার হয়ে আসছে।
-ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছে মা। কিন্তু ভাবী বাচ্চা কাউকেই…
হাবিব কথা শেষ করতে পারল না। পরী বানু ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে দু’হাতে বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলেন।
চলবে