#কমলা_রঙের_রোদ [৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
শয়তান জ্বর মুখের রুচির ইন্না-লিল্লাহ করে দিয়ে গেছে। পেটে খিদে তো অনেক আছে। কিন্তু কিছুই খেতে পারছে না। সব নিমপাতার রসের মতো তিতা লাগে। খুশবু স্মরণকে খুঁজছে। সকাল থেকে দেখাই পাচ্ছে না। আজকে একটু বিছানা থেকে উঠতে পারছে মাথা ঘোরাচ্ছে না। পরী বানু খুশবুকে দেখে ডাকলেন।
-ওই ছেড়ি এইদিকে আ।
খুশবু দাদীর দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। দাদী ছায়ায় বসে আছে। সে এখন রোদ থেকে উঠে যেতে পারবে না। তাই বলল,
-তুমি এদিকে আসো। দরকার তোমার।
পরী বানু খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
-কত বড় খবিশ হইছে দেখছস। গুরুজনের কথাও হুনে না।
খুশবু কিছু না বলে ভেঙাল। দাদীর সাথে তার সম্পর্কটাই এমন। কখনও টক, কখনও ঝাল আবার কখনও গুড়ের মতো মিষ্টি। পরী বানু ওখান থেকেই বললেন,
-রইদে বইয়া রইছস ক্যান? আবার জ্বর আইত?
-জ্বর এলেও কি? তুমি তো আর সেবাযত্ন করোনি। জ্বর তোমাকেও ছুঁয়ে দিবে ভেবে দূরে দূরে থেকেছ।
-হুর খবিশ। চোখের সামনে থেইকা দূর হ।
দাদীকে রাগতে দেখে খুশবু খিলখিল করে হাসছে। পরী বানু মুগ্ধ হয়ে দেখছেন। মনে মনে ভাবছেন,
-মানছুরার রঙ চাপা। খুশিও মা’র রঙ পাইছে। খুশবু মনে হয় ওর মায়ের রঙ পাইছে। বিদেশি মা। সাদা চামড়ারই হইবো। হেই কারণেই এই মাইয়া এইরাম দুধে-আলতা রঙ পাইছে।
খুশবুকে প্রথমদিকে পরী বানুও মেনে নেয়নি। ছেলে যতদিন বেঁচে ছিল খুশবুকে ধারের কাছেও ঘেঁষতে দেননি। দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন। বাবাই ছিল এই দুনিয়ায় খুশবুর একমাত্র আপনজন। সেই বাবা মরে গেলে পরী বানু মেয়েটাকে নিজের ছায়ায় বড় করেছেন। তিনি না থাকলে হয়তো মানছুরার অবহেলা নির্যাতনে মেয়েটা কবেই মরে যেত।
পরী বানু তীক্ষ্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
-হেই মা কেমন যে তোরে পেটে ধইরাও নিজের কাছে রাখল না। রঙ পাইলেও কী হইবো? কপালই তো পাইলি না। নাহইলে তোর কপালে সুখ লেখা নাই কেন? মাইয়াডা কী খায়, কী পিন্ধে মানছুরা তো জীবনেও চাইয়া দেহে না। বাপটা বাঁইচা থাকলে এই মাইয়ার কপালে এইরাম দুর্গতি হইত না।
দাদী চুপ মেরে গেছে। বুড়ী এত গভীর মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছে? খুশবু উঠে ঘরে চলে যাচ্ছিল। তখনই স্মরণকে ব্রাশ হাতে উঠানে হাঁটতে হাঁটতে দাঁত মাজতে দেখা গেল। খুশবু চোরা চোখে দেখে নিল আশেপাশে কোথাও মা আছে কিনা। না নেই। সে এক দৌড়ে স্মরণের কাছে চলে এলো। ওকে ছুটে আসতে দেখে স্মরণ ভ্রু বাঁকিয়ে জানতে চাইল উদ্দেশ্য কী। খুশবু মুখে হাসি নিয়ে বলল,
-স্মরণ ভাই পঞ্চাশটা টাকা দিবে?
মুখভর্তি ফেনা নিয়ে স্মরণ সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। পিক করে ফেনাটুকু ফেলে দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,
-ডাকাত! এত টাকা দিয়ে কী করবি তুই?
খুশবু অভিমানে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-এত টাকা! পঞ্চাশ টাকা তোমার কাছে কোন টাকা নাকি। পঞ্চাশ/ষাট টাকা তো তোমার হাতের ময়লা। পকেট ঝাড়া দিলেই একশো দুইশো বেরিয়ে আসবে।
-তোর পামে এখন আর কাজ হবে না। দিনদিন তোর চাহিদা কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে।
-আর তুমিও দিনদিন তোমার খালার মতো কিপ্টা হয়ে যাচ্ছ।
-খালা এই কথা শুনলে তোর খবর আছে। টাকা নেই। যা ভাগ।
-টাকা দিবে না তো তুমি?
-ওরে তুই কি আমাকে ব্যাংক মনে করিস।
-অন্য কারো জন্যে না হলেও আমার জন্য তুমি বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন দাও না পঞ্চাশ টাকা।
-টাকা দিয়ে কী করবি?
-সিঙ্গাড়া খাবো।
-আচ্ছা যা আমি নিয়ে আসবো।
-সত্যি?
-তোর সাথে আমি মিথ্যা কবে বলি রে বাপ।
খুশিতে খুশবুর হাসি দুই কানে গিয়ে ঠেকল। স্মরণের মাথায় খড়কুটো লেগে ছিল। খুশবু ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে এসে বলল,
-টারজান হয়ে জঙ্গলে ঘোরাফেরা না করলেই পারো। নয়তো পাখি তোমার মাথাকে নিজের বাসা মনে করে বাচ্চা তুলতে শুরু করবে।
🌼
আজও খুশি কলেজ গেট থেকে বেরিয়ে দেখল স্মরণ তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। খুশবু সাথে নেই বলে প্রতিদিনই নিতে আসছে। আশেপাশের মানুষের কথা স্মরণ ভাবে না। কিন্তু খুশি ভাবে। তবুও স্মরণকে হাজার বার বারণ করেও একথা শোনাতে পারে না। খুশি খানিক বিরক্তি নিয়েই বলল,
-আজও কেন নিতে এসেছ?
-কাল থেকে আসবো না। পঁচা গন্ধ সুস্থ হয়ে বাড়িতে ছুটাছুটি করছে। কাল থেকেই তোর আঁচল ধরে কলেজে আসবে। আজ যেহেতু শেষ দিন তাই আর নাটক করিস না।
-আমি নাটক করি?
-না। তুই তো সিনেমা করবি। এখন বোস তো।
খুশি সাবধানে বাইকের পেছনে বসলো। আজও স্মরণ ওকে কাঁধে হাত ধরে বসার কথা মনে করিয়ে দিল। আজকে খুশির মন অন্য দিনের থেকে খারাপ। কারণ কলেজে আসার সময় মা আর দাদীর কিছু কথা শুনেছে সে। মা দাদী তার বিয়ের কথা ভাবছে। খুশি উদাসীন মনে বলল,
-আমাকে বাইকের পেছনে বসানোর তোমার এত শখ কেন?
-মানুষের আরও কত সব উদ্ভট শখ থাকে। আমার শখ এতটাও উদ্ভট না।
-খুশবুকে কেন বসাও না। ও বেচারীর কত শখ।
-খুশবু আর তুই কি এক?
-কেন এক না?
খুশির এজাতীয় কথাবার্তায় স্মরণের মেজাজ চড়ে যাচ্ছে।
-কেন এক না তুই জানিস না?
-জেনেও বা কী হবে?
স্মরণ হঠাৎ করে ব্রেক করলে খুশি ওর পিঠের উপর হেলে পড়ল। স্মরণ খুশির দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
-কী বলতে চাচ্ছিস তুই? পরিষ্কার করে বল তো।
-মা আর দাদী আমার বিয়ের কথা ভাবছে।
এই কথাটা শুনে স্মরণ কতক্ষণ চুপ করে থাকল। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে বাইক স্টার্ট করে কিছুটা পথ গিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,
-যে তোকে বিয়ে করতে আসবে তার গাড়ি আমাদের গলিতে ঢুকবে না। এটুকু তুই জেনে রাখিস।
-কী করবে তুমি?
-যা-ই করি। তোর জেনে কাজ নেই।
খুশি জানে তাদের এই সম্পর্কের যেমন কোন নাম নেই। তেমন এর কোন পরিনতিও নেই। অনার্স কমপ্লিট করে স্মরণ আর পড়াশোনা চালিয়ে যায়নি। জেঠাও ছেলেকে এনিয়ে কিছু বলেনি। স্মরণের প্রতি মা’র অগাধ ভালোবাসা থাকলেও মেয়েকে কখনও ভাগ্নের হাতে তুলে দিবে না। এর কারণও খুশি জানে। বাবা মা’কে ঠকানোর পর এই বংশের ছেলেদের প্রতি মা’র বিশ্বাস কাজ করে না। হোক সেটা নিজের বোনের ছেলে। নিজের সাথে যা ঘটেছে মা তা কখনও নিজের মেয়ের সাথে ঘটতে দিবে না।
🌼
সান দুপুরে বাড়ি ফিরে আবার বিকেলে বেরোচ্ছে দেখে মিসেস সুলতানা ছেলেকে ডেকে দাঁড় করালেন। সান বাড়িতেও সানগ্লাস পরে ছিল। মা’কে দেখে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে পকেটে রাখল। মা’র দিকে একগাল হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
-হ্যালো বিউটিফুল লেডি!
ছেলের মিষ্টি কথাতে তিনি আজ গলবেন না। মানুষ তাকে ভয় পেলেও নিজের ছেলের কাছেই তিনি অবহেলিত।
-তুমি আজ দুপুরে কোথায় ছিলে?
সান ঠোঁট বাঁকিয়ে মনে করার চেষ্টা করছে মা’র সাথে আজ তার কোন প্রোগ্রাম ছিল কিনা। একটু ভাবতেই মনে পড়ল। ওহ নো, আজ তো মা’র সাথে এনজিওতে যাবার কথা ছিল। ইশ, মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মা’র কাছে বকুনি খাওয়ার আগেই সান বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলতে লাগল,
-আ’ম রিয়েলি ভেরি স্যরি মম। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম। তুমি কি আজ গিয়েছিলে? নয়তো প্লিজ চলো কাল দু’জনে যাই।
মিসেস সুলতানা ছেলেকে নিয়ে প্রতিবারই হতাশ হয়। কাজের প্রতি তিনি যতটা স্ট্রিক্ট তার ছেলে ততটাই বেখেয়ালি।
-প্রতিবারই তুমি আমাকে নিরাশ করো সান।
-আর করবো না মা প্রমিজ। এটাই লাস্ট বার ছিল।
সানের ব্যাপারে তিনি কঠিন হতে পারেন না। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখনও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই ছেলের জন্যই তিনি শূন্য থেকে আজকের এই পজিশনে উঠে এসেছেন। একজন মানুষকে দেখিয়ে দিতে পেরেছেন ছেলের জন্য সে যা করতে পারেনি মা হয়ে তিনি করেছেন। ব্যর্থ মানুষটা হয়তো দূর থেকে তার সাফল্য দেখে একবার হলেও অনুতপ্ত হয়। তিনি শুধু ঘরসংসার আর ছেলেকেই মানুষ করেননি। পাশাপাশি নিজের একটা পরিচয়ও তৈরি করেছেন।
🌸
বিকেলে খুশবু পল্টুকে দেখতে গিয়েছিল। ইতরটাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। খুশবুকে দেখে পল্টু এতটাই খুশি হয়েছে যে একটুর জন্য ভাঙা পা নিয়েই উঠে পড়তে চাচ্ছিল।
-বাইক ওয়ালাদের আর দোষ কী? তুই যদি বাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াস তাহলে তো তারা ঠুকে দিয়েই যাবে।
-আল্লাহর কসম খুশবু। আমি তো রাস্তার কিনারা দিয়েই যাচ্ছিলাম।
খুশবু চোখ পাকিয়ে শাসন করে বলল,
-খবিশ! মরতে মরতে বেঁচে আছিস তবুও আমার নাম ধরে ডাকা ছাড়বি না। জানিস আমার বয়স কত? তোর এই পাপের কারণেই আল্লাহ শাস্তি দিয়েছে।
-তুমি কাঁদো নি?
-কেন কাঁদব?
-আমার এত বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হলো। সবাই নাকি মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিল। তুমি কাঁদো নি?
-তোর জন্য কেন কাঁদব রে বাদর? আমার চোখের পানি কি এত সস্তা?
-তুমি ভাই হেভি পাষাণ আছো।
-তুইও শয়তান কম না। এখন থেকে একটু মানুষ হোস। পা তো মনে হয় গেছে।
-আরে না। ডাক্তার বলেছে হাঁটতে পারবো। কিন্তু একটু সময় লাগবে।
পল্টুদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় আরেকটা জিনিস দেখে খুশবু অবাক হয়ে গেল। মাহিয়ার ভাই না ওটা? হ্যাঁ, তেমনই তো মনে হচ্ছে। আগেও কয়েকবার কথা হয়েছে। কিন্তু ইনি এখানে কেন?
চলবে