#কমলা_রঙের_রোদ [৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
খুশবুর রাগ করেও লাভ নেই। তার যদি আরও যাওয়ার জায়গা থাকতো তাহলে কয়েক দিনের জন্য ওখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকতো। তার মামা, ফুপু, খালা কেউ নেই। খুশি আর স্মরণ ভাইয়ের মামার বাড়ি আছে। কিন্তু সে বাড়িতে তার যাওয়া কেউ পছন্দ করে না। দু’দিন আগেই জ্বর থেকে উঠেছে। এখন বৃষ্টিতে ভিজে আবার জ্বর এলে তার নিজেকেই ভুগতে হবে। এটা ভেবেই বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো। পা যেন চলছে না। এইটুকু রাস্তা মনে হচ্ছে বেড়ে গিয়ে তিন/চার কিলো হয়ে গেছে।
-এজন্যই বলে রাগ হারাম। রাগ করে না খেয়ে থাকলাম। ভার্সিটি না গিয়ে পথেঘাটে টইটই করে ঘুরলাম। এতে কার কী হলো? লস যা হলো তা তো আমারই হয়েছে।
বৃষ্টির মধ্যে বাইক চালাতে চালাতে স্মরণ চারপাশে খেয়াল রাখছিল। অনেকটা দূরে মানুষের মতো কাউকে দেখতে পেয়ে বুঝে নিলো এটাই খুশবু। কারণ এই সময় কোন পাগলও রাস্তায় বের হবে না। তার সামনে এসে বাইক না থামানো পর্যন্ত খুশবু লক্ষ্য করেনি এটা স্মরণ। স্মরণ রেগে আগুন হয়ে খুশবুকে দেখছে। খুশবু স্মরণকে দেখে আকাশ থেকে পড়ার মতো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলল,
-স্মরণ ভাই! এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাও তুমি?
স্মরণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-এই কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছিস? থাপড়ে দাঁত ফেলে দেব ফাজিলের ছাও। বৃষ্টির মধ্যে তোকে খুঁজতে বের হওয়া লাগে কেন?
খুশবু অবাক গলায় বলল,
-আমাকে খুঁজতে বের হয়েছ! কেন? আমি কি হারিয়ে গেছি যে খুঁজতে বের হবে? সময় হলেই তো আমি বাড়ি ফিরে যেতাম।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে তর্ক করে দু’জন আরও ভিজছে। স্মরণের অলরেডি হাঁচি আসতে শুরু করেছে। ঠান্ডা লেগে পড়েছে।
-চড় খাওয়ার আগে তর্ক বন্ধ করে বাইকে ওঠ।
বাইকে উঠার কথা শুনে খুশবু খুশি হয়ে গেল। আহ্লাদে গদগদ করে বলল,
-আহা তুমি আমাকে আগে বলবে না! বছরে এক দু’দিনই তো সুযোগ পাই তোমার বাইকে বসার।
খুশবু বাইকে উঠে স্মরণের কাঁধে ধরে বসলো। স্মরণ জিজ্ঞেস করল,
-আজ ভার্সিটিতে যাসনি কেন?
-কীভাবে যাবো? তোমার খালা যে আমাকে মেরে হাতে পায়ে সুন্দর সুন্দর নকশা তুলে দিয়েছে ওসব কি বান্ধবীরা দেখত না। এসব কিসের দাগ জিজ্ঞেস করলে কী বলতাম।
স্মরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খালা তাকে মায়ের ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে। তাই চাইলেও খালার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না।
-এবার কী করেছিলি যে মেরেছে?
-আমার কিছু করতে হয় না। তোমার খালার মন চাইলেই আমাকে মারতে পারে। পৃথিবীতে আমি তোমার খালার মার খাওয়ার জন্যই এসেছি।
-থাক রাগ করিস না। খালার অপছন্দের কাজগুলো এড়িয়ে চললেই তো পারিস।
-আমি রাগ করলেও যা না করলেও তা। এই যে রাগ করে রাত থেকে না খেয়ে আছি এতে কারো কি কিছু আসবে যাবে?
-তুই রাত থেকে কিছু খাসনি?
-না।
স্মরণ আর কিছু বলল না। বৃষ্টির মধ্যে বাহিরের দোকান গুলো খোলা না থাকলেও রেস্টুরেন্ট নিশ্চয় বন্ধ করবে না। যাওয়ার পথেই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বাইক থামাল। এখানে তার এক বন্ধু কাজ করে। দু’জনই ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। তাই ভেতরে যাওয়া সম্ভব না। কারো মাধ্যমে তার বন্ধুকে ডাকিয়ে বাইরে নিয়ে এলো। স্মরণকে দেখেই শাকিল বলল,
-কিরে তোরা এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজে রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছিস?
পেছনে খুশির জায়গায় খুশবুকে বসা দেখে শাকিল মজা করে বলল,
-বড় বোনকে ফেলে ছোট জনকে নিয়ে ঘুরছিস খবরটা কী আসল জায়গায় পৌঁছে দিব?
-হ্যাড অফিস থেকে অর্ডার নিয়েই এসেছি। বকবক করে সময় নষ্ট না করে দুইটা বার্গার, চিকেন ফ্রাই নিয়ে আয়। ভালো করে প্যাক করে দিস। ভিজে না যায় যেন।
শাকিল চলে গেলে খুশবু বলল,
-ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি স্মরণ ভাই?
খুশবু কী বলতে চায় আন্দাজ করতে পেরেই স্মরণ বলল,
-তুই কোন কথাই বলিস না।
-একটু বলি।
-চুপ করে বসে থাক। নয়তো ঠোঁট সেলাই করে দিবো।
-তোমাদের কথা কিন্তু আমি জানি।
বারণ করার পরেও খুশবু কথা বললে রাগী চোখে ওর দিকে তাকাল স্মরণ। এতেই কাজ হলো। খুশবু মুখে হাত দিয়ে বোঝাল সে আর কোন কথা বলবে না।
🌸
বৃষ্টির মধ্যে জ্যামে আটকা পড়ে সান রাগটা কার উপর দেখাবে এটাই বুঝতে পারছে না। যেদিনই তার কোথাও যাওয়ার তাড়াহুড়ো থাকে সেদিন জ্যাম থাকবেই থাকবে। ঢাকা শহরের রাস্তায় এত গাড়ি কেন চলতে হবে?
খুশবু কি আজ ভার্সিটিতে এসেছে? ফোন হাতে নিয়ে সান মাহিয়াকে কল করল। প্রথম বারেই মাহিয়া কল তুলে নিয়েছে।
-হ্যাঁ বলো।
-খুশবু এসেছে আজ?
-না।
-আসেনি? আচ্ছা ওর ফোন নাম্বারটা দে তো।
-আমার বান্ধবী ফোন ইউজ করে না ভাই। করলে তো আমিই জেনে নিতাম শয়তানটা কবে আসবে।
কথাটা শুনে সান যথেষ্ট অবাক হলো। আজকাল তো হাই স্কুলের ছেলেমেয়েদের হাতেও ফোন থাকে।
-ভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ের ফোন ইউজ না করার পেছনে কারণ জানতে পারি?
-ওর ফ্যামিলি ভীষণ স্ট্রিট। বিশেষ করে ওর মা।
-হুম বুঝলাম।
হতাশার সাথে সানকে কল রাখতে হলো। গতকাল তো বাসার সামনে গিয়ে দেখা হয়েছিল। আজও কি যাবে? ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা হয়েও যেতে পারে।
সান বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করল। কিন্তু এই হতচ্ছাড়া বৃষ্টি কিছুতেই থামার নাম নিচ্ছে না। সে গাড়ি নিয়ে যেতে পারবে সমস্যা নেই। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে কি খুশবু বাড়ি থেকে বের হবে? নিজের রুমে শুয়ে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে সান বলল,
-তোমার সাথে দেখা করা এত কঠিন হয়ে যায় কেন বলো তো? ইউনিভার্স কি তোমাকে আমার সাথে মেলাতে চায় না।
🌸
খুশবু দাদীর সাথে কাঁথার নিচে শুয়ে আছে। বৃষ্টির দিনে কোথাও যাওয়া যায় না এটাই সমস্যা। তার আবার ঘরে মন টিকে না। দাদার সাথে দাদীর বিয়ে কীভাবে হয়েছিল দাদী সে গল্প বলছে। খুশবুর শুনতে ভালোই লাগছে। মাঝে মাঝে দাদীকে থামিয়ে দিয়ে নানান প্রশ্নও করছে।
-তার মানে দাদার বাবা দাদাকে জোর করে বিয়ে করিয়েছে! বিয়েতে দাদা রাজি ছিল না?
-তোর দাদার তো জমিলা বানুরে পছন্দ আছিল। তার লাইগা নাকি পাগল আছিল।
-এই কথা জেনেও তুমি বিয়েতে রাজি হয়েছিলে! কেন দাদী?
-ধুর। আমগোর সময় কি রাজি অরাজি জিগাইত নাকি? অহন তো তোরা বাপ মা’র মুখে মুখে কত কথাই কস। আগের যুগ এমন আছিল না। বাপের সামনে কথা কওনের সাহস আছিল নাকি?
-পরে দাদা তোমাকে মেনে নিয়েছিল?
-প্রথম প্রথম মাইনা নেয় নায়।
-এটাই স্বাভাবিক। বেচারাকে জোর করে বিয়ে করিয়েছে। দাদার জমিলা সুন্দরীর কী হয়েছিল পরে?
-বিয়ার পরেও তোর দাদা জমিলার পিছা ছাড়ে নাই।
দাদী কথাগুলো সহজ ভাবে বলতে পারলেও খুশবুর একটু একটু রাগ লাগছে।
-তুমি দাদার এসব অন্যায় মেনে নিয়েছ?
নাতনিকে রাগতে দেখে পরী বানু হেসে বললেন,
-আমি তো তগোর মতো অত চালাক আছিলাম না। খুব ছোড কালেই বাপজানে বিয়া দিয়া দিছিল।
-দাদা তোমাকে পছন্দ করেনি তাহলে তোমরা সংসার করেছ কীভাবে? তোমাদের দুই ছেলেই বা হয়েছে কীভাবে?
খুশবুর মুখের দিকে তাকিয়ে পরী বানু হাসছেন। খুশবু এতে আরও বিরক্ত হচ্ছে।
-জমিলা বানুরও বিয়া হইয়া গেলে তোর দাদা কতদিন ঘরবাড়ি ছাইড়া পাগল হইয়া খালে-বিলে ঘুরতে। তোর দাদার বাপ আবার কঠিন মানুষ আছিল। মানুষ লাগাইয়া তোর দাদারে ধইরা আইনা কিছু মশলাপাতি দেওয়ার পর সেইয়ে মানুষ হইছে। আইজেরও মানুষ কাইলেরও মানুষ।
-দাদার এত নাটকের পরেও তুমি তো দাদার সাথে থেকেছ। আমি তোমার জায়গায় থাকলে ঝাঁটা মেরে চলে আসতাম।
-পরে তো তোর দাদা আমার লাইগা পাগল। বউরে ছাড়া চোখে পথ দেহে না। মানুষের মুখে উইঠা পড়ছে।
-এমন পাগলের দাম নেই। তুমি দাদার ফার্স্ট প্রায়োরিটি ছিলে না। সেকেন্ড অপশন হিসেবে তোমাকে পছন্দ করেছে।
-তগোর এত শক্ত কথা আমি বুঝি না।
-বলেছি দাদা তোমাকে কোনদিন সত্যিকারের ভালোই বাসেনি।
-তোরা এই কথা কইতে পারস। কিন্তু আমি পারি না। মানুষটা মরার দিন পর্যন্ত আমার লগে আছিল। হের ভালোবাসায় আমি কোন কমতি দেখি নাই।
খুশবু মনে মনে ভাবছে, বোকা দাদী। ভালোবাসার তুমি কিছুই বুঝো না। মানুষের জীবনে ভালোবাসা একবারই আসে। আর এই প্রথম ভালোবাসাকে চাইলেও কোনদিন ভুলে যাওয়া যায় না। দাদার রিয়েল লাভ তো ছিল জমিলা বানু।
🌸
প্রায় দু’সপ্তাহ পর বান্ধবীকে দেখে মাহিয়াদের দলটা দূর থেকে দৌড়ে এলো। খুশবুও তাদের দেখে চেঁচিয়ে উঠল। তিন চারজন মিলে জড়াজড়ি করে ধরে পাগলের মতো চিৎকার করতেই থাকল। ক্যাম্পাসের প্রায় সবাই তাদের দেখছে। খুশি এই পাগলের কাণ্ড দেখে তাড়াতাড়ি করে দূরে সরে গেল। মাহিয়া বলল,
-বান্ধবী!
খুশবু জবাব দিল,
-হ্যাঁ বান্ধবী।
আরেকজন বলল,
-এতদিন কোথায় ছিলি?
-অসুস্থ হয়ে বিছানায়।
-তোকে অনেক মিস করেছি।
-আমিও তোদের মিস করেছি।
পাগলামির পাট চুকিয়ে দলটা সভ্য মানুষের ন্যায় ক্যান্টিনে এসে বসলো। দীর্ঘ দিন পর খুশবুকে পেয়ে সবাই খুশি। মাহিয়া এর মাঝেই সুযোগ পেয়ে সানকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সান আজ চাইলেও আসতে পারবে না। নিজের মা জননীর সাথে মিটিং নামক এক বিরক্তিকর জিনিসে আটকা পড়েছে।
-মাহি আমার একটা কাজ করবি?
মাহিয়াকে ফোনে কথা বলতে দেখে খুশবু ধমক লাগাল।
-আমাকে রেখে ফোনে কাকে সময় দিচ্ছিস খবিশ? ফোন রাখ।
-একটু দাঁড়া।
-একটু কেন? এক সেকেন্ডও না।
খুশবু মাহিয়ার থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে কল কেটে দিলো। কতদিন পর বান্ধবীরা একসাথে হয়েছে। তাই আজ ক্লাস না করে ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়েছে। বাড়ি ফেরার সময় হলে খুশবু উঠে পড়ল।
-তোরা সবাই কখন যাবি? আমি যাই। খুশিকে খুঁজতে হবে।
মাহিয়া খুশবুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-দোস্ত দাঁড়া।
-দাঁড়িয়েই আছি। বল।
-তোরা আমার জন্মদিনের পার্টিতে আসবি না?
খুশবু ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কবে তোর জন্মদিন?
-এইতো আর দু’দিন পর।
-হুর গাঁজাখোর! এপ্রিল মাসে তোর জন্মদিন হবে কীভাবে? ডিসেম্বরে কার জন্মদিন পালন করেছিলি তাহলে?
চলবে
এডিট ছাড়া পর্ব একটু কষ্ট করে পড়ে নিবেন। আর নতুন ই-বুকটা পড়েছেন তো?
এই লিংকে গিয়ে ঝটপট পড়ে ফেলুন 🤍
“মেঘে রোদে কাছাকাছি”
https://link.boitoi.com.bd/BHed