কমলা_রঙের_রোদ [১] #জেরিন_আক্তার_নিপা

0
311

#কমলা_রঙের_রোদ [১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

🌸
দীর্ঘ ছয় বছর পর আজ মানছুরার স্বামী দেশে আসছে। সকাল থেকে ছুটাছুটি করে মানছুরা সব কাজ করছেন। স্বামীর পছন্দের সব খাবার রান্না হয়েছে। মানুষটা এত বছর পর দেশে আসছে।
বকুল মানছুরার খুশি দেখে মুখ টিপে হাসে। মানছুরা বোনের হাসি দেখেও এড়িয়ে যায়। বকুল মানছুরার ব্যাকুলতা দেখে বলে,

-আসতে দে বাড়িতে। কান টেনে যদি ছিড়ে না ফেলেছি তাহলে কিসের ভাবী আমি?

মানছুরা মুখ কালো করে বোনের দিকে তাকায়। বলে,

-সম্পর্ক পাল্টে নিচ্ছ বুবু! আমার বোন থেকে তোমার দেবরের ভাবী হয়ে গেলে?

বকুল হেসে জবাব দেয়,

-ছোট বোনের বরের কান টানতে পারব? কিন্তু দেবরের কান টানা ভাবীদের ভাবীগত অধিকার। আমার বোনটাকে কম অপেক্ষা করায়নি। সব সুদে আসলে উসুল করে নিব।

দুই বোন এক বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। বকুলের শ্বশুর প্রথমে তাকে পছন্দ করে বিয়ে করিয়ে আনে। ছোট ছেলের জন্য যে মানছুরাকে পছন্দ তা মানছুরার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে জানায়। মেয়ের শ্বশুর আবদার অনুরোধ করলে বাবারও কিছু করার থাকলো না। ওই বিয়ে ভেঙে দিয়ে এক রাতের মাঝে হাবিবের সাথে মানছুরার বিয়ে হয়।

চুলার আঁচে থেকে বকুলের মুখ লাল হয়ে গেছে। মানছুরা বোনকে জোর করে চুলার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

-বুবু তুমি ঘরে যাও তো। এই সময়ে তোমার গরমে দাঁড়ানো ঠিক না। তুমি ফ্যানের নিচে গিয়ে বসো।

-সব তো তুই একাই করেছিস। আমি তো শুধু দাঁড়িয়ে দেখছি।

-তোমার দাঁড়িয়ে দেখতেও হবে না। রাতের কথা ভুলে গেছো? আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।

-রাতে একটু ব্যথা হচ্ছিল। কিন্তু সকাল থেকে কোন ব্যথা নেই।

বকুলের এটা নয় মাস চলছে। শরীরটাও আজকাল তেমন ভালো যাচ্ছে না। প্রথম ছেলের জন্মের দশ বছর পর দ্বিতীয় বার মা হতে যাচ্ছেন। মানছুরার জোড়াজুড়িতে বকুল আর রান্নাঘরে থাকতে পারলো না। বকুল চলে গেলে মানছুরা ভাবছে,

-ভালো সময়েই আসছেন তিনি। বুবুর ডেলিভারির সময়ও কাছাকাছি চলে এসেছে।

মানছুরার বিয়ের তিন মাসের মাথায় হাবিব সৌদি চলে যায়। মানছুরা তখনও জানতো না হাবিব তার ভেতর নিজের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। মেয়ে হবার খবর শুনেও হাবিব আসেনি। মেয়ের বয়স পাঁচ বছরে পড়েছে। হাবিব এখনও তার মেয়েকে দেখেনি। মানছুরাও অভিমান থেকে হাবিবকে মেয়ের কোন ছবি পাঠায়নি। যে পিতার মেয়ের প্রতি কোন টানই নেই তাকে কেন মেয়েকে ছবি পাঠাবে? এতগুলো বছর হয়ে যাওয়ার পরেও হাবিব যখন দেশে ফিরেনি এলাকার অনেক মানুষই অনেক কথা বলেছে। কেউ কেউ তো এটাও বলেছে,

-তুমি নিজেকে যতই সান্ত্বনা দেও। খবর শোনা যাচ্ছে তোমার স্বামী বিদেশে বিয়ে করে ঘরসংসার করছে।

মানছুরা মানুষের কথা কানে নেয়নি। সে সবার কথার উত্তরে এটাই বলেছে,

-ওখানে তার সংসার থাকলে দেশে আমাদের কেন খরচ পাঠাতো? সে তো চাইলেই আমাকে তালাক দিতে পারতো।

-মেয়ের জন্য তালাক দেয়নি। কিন্তু হাবিব তো দেশেও আসছে না।

-তার আসার সময় হলেই আসবে। দেশে তার বাবা মা আছে। না এসে চিরজীবন বিদেশ থাকতে পারলে থাকুক। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব।

মানুষের কথা পুরোপুরি সত্য প্রমাণ হয়নি। ওখানে যদি বিয়েই করে ফেলত তাহলে ছয় বছর পর দেশে আসত কেন? মানছুরা চুলার আঁচে দাঁড়িয়ে এসব কথাই ভাবছিল। চুলায় তরকারি পুড়ে যাচ্ছে তার খেয়াল ছিল না। পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগলে মানছুরা তাড়াহুড়ো করে পাতিল নামাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলল। তার খেয়ালই ছিল না পাতিল গরম। খালি হাতে নামানো যাবে না। সাথে সাথে দুই হাতের আঙ্গুলে ফোস্কা পড়ে গেল। এরকম সময় খুশি দৌড়ে এসে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা’কে ডাকল,

-মা, মা। আমাদের বাড়িতে কে যেন এসেছে।

মানছুরা ব্যথা লুকিয়ে মেয়ের দিকে ফিরে একগাল হেসে বলল,

-যিনি এসেছে তিনি তোর বাবা হয় খুশি।

-বাবা! কিন্তু তুমি তো বলেছিলে আমার বাবা বিদেশ থাকে।

-তোর বাবা বিদেশ থেকেই এসেছে। বাবার কাছে যা।

-না। আমি তোমার সাথে থাকব।

মানছুরা হাত পুড়ে যাওয়ার কথা ভুলেই গেল। মনের মধ্যে লুকানো সুপ্ত রাগ থাকলেও এতবছর পর মানুষটাকে দেখার ইচ্ছেটা দমাতে পারল না। দৌড়ে রান্নাঘরে থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় এসে উঠোনে হাবিবকে দেখতে পেল। কিন্তু মানছুরার খুশি একমুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। হাবিব একা আসেনি। ওর সাথে ওই মেয়েটা কে? তাহলে কি এতদিন মানুষ যা বলতো তা-ই সত্যি!

🌼

হাবিব তার মায়ের ঘরে বসে আছে। ছোট্ট খুশবু শক্ত করে বাবার হাত ধরে পাশে বসে আছে। সে টলটল চোখে সবকিছু দেখছে। কিন্তু এসবের কিছুই যে ছোট্ট মেয়েটা বুঝতে পারছে না এটা খুব ভালোই বোঝা যাচ্ছে। হাবিব মা’কে সব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পরী বানু ছেলের একটা কথাও শুনতে চাচ্ছেন না।

-মানুষ তাইলে ঠিকই কইত। তুই বিদেশ গিয়া আরেকটা বিয়া করছস। হেই ঘরে তোর আবার মাইয়াও হইছে। আল্লাহ এই দিন দেখানির লাইগা তুমি আমারে বাঁচাইয়া রাখছো!

দরজার আড়ালে দাঁড়ানো বোনের ছায়া দেখে বকুলের বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। তার বোনটা কি এতটাই অভাগী! বকুল রাগে, ঘৃণায় হাবিরের সাথে একটা শব্দও বলেনি। হাবিব তার সাথে কথা বলতে গেলেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

হাবিব জানে সে অন্যায় করেছে। কিন্তু এই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে করতে হবে তার জানা নেই। ঘরে এই তিনজন মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। মেয়েটা তার স্বামীর সন্তান এই কথা জানার পর মানছুরা পাথরের মূর্তির মতো রান্নাঘরের মেঝেতে বসে আছে। খুশি এসে তাকে নানান কথা জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু মানছুরা কোন উত্তরই দিচ্ছে না।

-মা ওই ছোট বাবুটা কে? ওই বাবুর পুতুলের মতো আমাকেও একটা পুতুল কিনে দাও। ও মা, দাও না। পুতুল দাও।

মানছুরা হঠাৎ মেয়ের গালে কষিয়ে এক চড় মেরে বসলো। ছোট্ট মেয়েটা বুঝতেই পারল না মা কেন তাকে মেরেছে। ছলছল চোখে কতক্ষণ মা’র দিকে তাকিয়ে থেকে খুশি চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মানছুরাও ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল।

🌼

হাবিবের বড় ভাই হাসান ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। ছেলে বাবার হাত ধরে গল্প করতে করতে বাড়িতে পা রেখেছে।

-আজকে কি কাকা আসবে আব্বা?

-হুম।

-কাকা এতদিন কোথায় ছিল?

-সৌদি আরব।

-সৌদি আরব কোথায় আব্বা।

-অনেক দূরে।

-কতদূরে?

হাসান জানেন তার ছেলের প্রশ্ন সহজে শেষ হবে না। যেকোনো বিষয় জানার ছেলেটার ভীষণ আগ্রহ। এটা অবশ্য ভালো লক্ষণ। যত আগ্রহ থাকবে ততই নতুন কিছু শিখতে পারবে। হাবিব মা’র ঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-তোর কাকা মনে হয় চলে এসেছে।

স্মরণ বাবার হাত ছেড়ে খুশি হয়ে বলে উঠল,

-আমি কাকাকে দেখে আসি?

হাসান হেসে বললেন,

-যা। কাকা অনেক দূর থেকে এসেছে। বেশি যন্ত্রণা করিস না।

হাসান ঘরে এসে স্ত্রীকে কপালে হাত ধরে বসে থাকতে দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললেন,

-তোমার শরীর ঠিক আছে বকুল?

বকুল ক্লান্ত দৃষ্টি নিয়ে স্বামীর দিকে তাকালো। হাসান স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন,

-শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তারের কাছে যাবে?

-আমার কিছু হয়নি।

হাসান হাঁফ ছাড়লেন। আলনার সামনে গিয়ে শার্ট ছাড়তে ছাড়তে বললেন,

-হাবিব এসেছে?

-হুম।

কী হলো বকুলের? স্কুলে যাওয়ার সময় তো বেশ হাসিখুশি দেখে গিয়েছিল। হাবিবের বাড়ি ফেরা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ বকুলেরই ছিল। এখন তাহলে এভাবে কথা বলছে কেন? হাসান শার্ট ছেড়ে এসে আবার বকুলের পাশে বসে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

-কী হয়েছে?

বকুল এবার আর কান্না আটকে রাখতে পারল না। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ওকে কাঁদতে দেখে হাসান হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বকুল কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-তোমার ভাই আমার বোনটার সাথে এমন কেন করলো? আমার বোনটার তো কোন দোষ ছিল না।

হাবিব কিছু করেছে! কী করেছে ও? আজই তো দেশে এসেছে। বাড়িতে এসেই মানছুরার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি তো?

-কী করেছে হাবিব?

বকুল কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। সকাল থেকে শরীরটা ভালো লাগলেও এখন পেটে সামান্য ব্যথা হচ্ছে। তবে এই কথাটা বকুল কাউকে বলেনি।

-তোমার ভাই একা আসেনি। মানুষ এতদিন যা বলতো তা-ই সত্যি। মেয়ের মা সাথে না এলেও খুশির মতোই বড় একটা মেয়েকে নিয়ে ফিরেছে। এটা নাকি ওরই মেয়ে।

কথাগুলো শুনে হাসান স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। বকুল কাঁদছে। কিন্তু ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। তার নিজের ভাই তাদের সবাইকে এত বড় একটা ধোঁকা দিতে পারল!

চলবে
সকলে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন 🤍

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here