#কমলা_রঙের_রোদ [৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
সান চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে ফোনের স্ক্রিনের লেখাটা আবার পড়ল। ঠিকানাটা ঠিক থাকলে এই পাড়াই। কিন্তু খুশবুদের বাড়ি কোনটা এটা কীভাবে বের করবে সে? বাড়ি বের করলেও খুশবুর সাথে দেখা করতে নিশ্চয় বাড়ির ভেতর চলে যেতে পারবে না।
খুশবু দূর থেকে দেখছে। লোকটা কি কিছু খুঁজছে? হাবভাব দেখে তো এমনই মনে হচ্ছে। সে কি কোনরকম সাহায্য করতে পারবে? খুশবু নিজে থেকেই সানকে ডাকল। কারো ডাক শুনে সান ঘুরে তাকিয়ে খুশবুকে দেখে পানি না চাইতেই যেন শরবত পেয়ে গেল। সান প্রত্যাশাই করেনি রাস্তাতেই খুশবুর দেখা মিলে যাবে। খুশবু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
-আপনি মাহিয়ার ভাই না?
সানও বুঝতে দিতে চাইল না সে খুশবুর সাথে দেখা করতেই এসেছে। সে-ও এমন ভাব করল যেন হঠাৎ করেই ওদের দেখা হয়ে গেছে।
-হ্যাঁ। তুমি খুশবু, রাইট?
-হুম। কোথাও যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ। তুমি এদিকেই থাকো?
খুশবু হেসে বলল,
-এদিকেই থাকি না। বরং এখানেই থাকি। ওইতো আমাদের বাড়ির গেট দেখা যাচ্ছে।
-ওহ। ওদিকে কোথায় গিয়েছিলে?
-আমাদের প্রতিবেশী একটা ছেলের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। ওকে দেখতে গিয়েছিলাম।
খুশবু একটা ছেলেকে দেখতে গিয়েছিল শুনে সান মনে মনে জেলাস ফিল করছে। সে এতগুলো দিন যাকে দেখতে না পেয়ে তৃষার্ত চাতক হয়ে ছিল সে অন্য একজনকে দেখতে যায়।
সানের সাথে কথা বলতে খুশবুকে অনেকেই দেখেছে। শুধু দেখা পর্যন্তই না দু’একজন বাড়ি বয়ে এই খবরটা মানছুরার কানেও পৌঁছে দিয়ে গেছে। খুশবু জানত না তার জন্য বাড়িতে কী অপেক্ষা করছে। বাড়ি ফিরেই ওকে মানছুরার সামনে পড়তে হলো। পরী বানু ছেলের বউকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন মেয়েটাকে যেন মারধর না করে। মাত্রই তো জ্বর থেকে উঠলো।
-দাঁড়া। কোথায় গিয়েছিলি?
খুশবু মা’র মুখের দিকে তাকাল। মা কি রেগে আছে? কিন্তু সে তো বলেই গিয়েছিল পল্টুকে দেখতে যাচ্ছে।
-আমি দাদীকে বলে গিয়েছিলাম।
-রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে ছেলের সাথে কথা বলছিলি কে ওই ছেলে?
হায়রে তার কপাল! এই খবরও মা’র কানে পৌঁছে গেছে? খুশবুর গলা শোকাচ্ছে। আজ তার কপালে খারাবি আছে। মা’র প্রশ্নের জবাবে আমতা আমতা করে খুশবু বলল,
-আমার বান্ধবীর ভাই।
মানছুরা এর বাইরে আর একটা কথাও জানতে না চেয়ে উঠানে পড়ে থাকা বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে কোন দোষ ছাড়াই খুশবুকে মারতে লাগল। মা যে তাকে আজ প্রথমবার মারছে এমনটা না। মা’র মার তার জন্য দুধভাত। কিন্তু গত এক সপ্তাহ কী প্রচণ্ড জ্বরে ভোগার পর আজ একটু উঠে দাঁড়াতে পেরেছে। আজও মা তাকে মারবে এমনটা হয়তো আশা করেনি। তাই খুশবু প্রথমটায় হতভম্ব হয়ে ছিল। আরেকটা প্রশ্নও মনে নাড়া দিচ্ছে। মা কেন মারছে তাকে? তার দোষটা কী? পরী বানু ছুটে এসে নাতনিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। ছেলের বউয়ের সাথে কিছুতেই পেরে উঠতে না পেরে হাঁকডাক লাগিয়ে দিলেন। বাইরে দাদীর চেঁচামেচি শুনে খুশিও বেরিয়ে এসেছে। মা আজ আবার কেন খুশবুকে মারছে? দাদীর সাথে মিলে খুশিও মাকে থামানোর চেষ্টা করছে।
-মা কী করছো? আর মেরো না ওকে। দয়া করে এবার থামো।
খুশবু কিন্তু তখনও অবাক নয়নে মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পরী বানু চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন,
-ডাকাইত! একটা ডাকাইত বউ বাইত আনছি আমি। এইডার ভিত্রে মানুষের দিল নাই।
লাঠিটা চিকন হওয়ায় প্রতিটা মার খুশবুর ফর্সা দেহে গেঁথে গেছে। খুশি খুশবুকে ঘরে নিয়ে এসেছে। খুশবু না কাঁদলেও তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। খুশি ওকে খাটে বসিয়ে প্রশ্ন করল,
-আজ আবার কী করেছিস?
-জানি না।
-তুই না জানলে কে জানবে?
খুশবু কোন উত্তর দিল না। কিছু আঘাতের জায়গা কালো হয়ে চামড়ার ভেতরে রক্ত জমা হয়ে নীলচে পড়ে গেলেও কয়েকটা জায়গা থেকে চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে খুশির ভেতরটা কেঁপে উঠল। তাকে তো মা কখনও এমনভাবে মারে না। খুশবুকে কারণে অকারণেই মারে। খুশবুকে সে যতই অপছন্দ করুক। কিন্তু ছোটবেলা থেকে খুশবুর প্রতি মা’র এই অন্যায় আচরণ খুশির চোখেও বাঁধে। যে ভুলটা তাদের জন্মদাতা লোকটা করেছে তার শাস্তি খুশবু একা কেন বয়ে বেড়াবে? খুশি ঘরে ঔষধ তোলো খুঁজছে। তাদের ঘরে দরকারি কোন জিনিসই থাকে না। ঔষধ তোলোও যে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।
বাইরে এতকিছু ঘটে গেলেও পুরোটা সময় হাসান ঘরেই বসেছিল। রোজকার মতো আজও সে কারো সাথে কথা বলছে। তার সামনে বসা কল্পনার মানুষটা বলছে,
-বাইরে কিসের শব্দ হচ্ছে?
-কিসের শব্দ?
-তুমি শুনতে পাচ্ছ না?
-কই না তো।
-আমি তো শুনছি। মনে হয় তোমাকে ডাকছেন। তুমি কি একবার বাইরে গিয়ে দেখে আসবে?
-না। বাইরে কেউ কাউকে ডাকছে না। আজ সারাদিনে এখন এলে। আমার সাথে কথা না বলে তুমি বাইরের কথা কেন শুনছো?
মানুষটার কথায় বকুল খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসান মুগ্ধ নয়নে স্ত্রীকে হাসতে দেখছে।
খুশি রান্নাঘর থেকে পানি গরম করে নিয়ে এসেছে। পরিষ্কার একটা কাপড় পানিতে ভিজিয়ে আঘাতের জায়গা গুলো পরিষ্কার করতে লাগলে খুশবু বাধা দিল।
-লাগবে না।
খুশি খুশবুর কথা কানে নিল না। সে নিজের কাজ করতে গেলে খুশবু ওর হাত ধরে কিছুটা রেগেই বলল,
-তোকে বলেছি আমার জন্য দরদ দেখাতে? আমার কারো সহানুভূতির দরকার নেই। তোরা তোদের মতো থাক। আমার বাঁচা মরা নিয়ে তোদের মাথা ব্যথা থাকতে হবে না।
খুশিও রাগী গলায় বলল,
-তোর জেদের জন্যেই জীবনে আরও কঠিন সময় দেখবি। মেয়ে মানুষের এত জেদ থাকতে নেই। কার সাথে রাগ দেখাচ্ছিস তুই? আমি তোর দাসীবাঁদী নই।
খুশবুর খসখসে ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কেঁপে উঠল। দু’গাল বেয়ে অঝোরে জল পড়ছে। খুশির মুখের দিকে তাকিয়ে দমকা কান্নাটা গিলে নিলো। খুশি এতগুলো কথা শুনিয়েও উঠে চলে গেল না। খুশবুর পাশে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পর বলল,
-গা মুছতে দিবি?
-না।
-যা খুশি কর তাহলে।
🍃
মানছুরা খাবার বেড়ে শাশুড়ীকে ডাকলেও পরী বানু ঘরে গেলেন না। রাত হয়ে গেলেও বাইরে বারান্দায় বসে রইলেন। খুশিও কয়েকবার দাদীকে ডেকেছে। পরী বানু উত্তরে বলেছে,
-তোরা খা। তগোর খাওন আমি ধইরা রাখছি? আমারে ডাকস কেন? একবেলা না খাইয়া আমি মরমু না। আল্লাহ আমারে অত সহজে নিবো না। পোলা নিছে পোলার বউ নাতি নিছে। আমার সময় আইত না।
পরী বানু মনের দুঃখে একা একাই আরও অনেক কথা বলে যাচ্ছেন। খুশিও আজ খেতে পারলো না। ভাত নিয়ে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করে হাত ধুয়ে উঠে গেল। মানছুরা কাউকে কিছু না বলে নিজের খাওয়া শেষ করে এঁটো বাসনকোসন রান্নাঘরে রেখে এসে ঘরে চলে গেলেন।
স্মরণ খুশবুকে কথা দিয়েছিল সিঙ্গাড়া নিয়ে বাড়ি ফিরবে। তাই আজ তাড়াতাড়িই বাড়িতে চলে এসেছে। বেশি রাত হয়ে গেলে আর দোকান খোলা পাওয়া যেত না। তার হাতের প্যাকেটে ধোঁয়া ওঠা গরম সিঙ্গাড়া। কয়েকটা সসের পাতাও এনেছে। খুশবু রাক্ষসী আজ পাগলই হয়ে যাবে।
স্মরণ বাড়ির ভেতর পা রেখে সোজা খুশির ঘরের দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুটা গিয়ে তাকে থেমে যেতে হলো। খালার ঘরের সামনে অন্ধকারে ওটা কে বসে আছে? যদিও স্মরণের ভূত পেত্নীতে বিশ্বাস নেই। কিন্তু খুশবু গাথী এসবে খুব বিশ্বাস করে। ওটা কি খালা? স্মরণ গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকল,
-খালা! ওখানে কী করছো?
খালা বা যে-ই হোক উত্তর দিচ্ছে না দেখে স্মরণ এগিয়ে গেল। বাড়িতে আজও কিছু হয়েছে নাকি? স্মরণ কাছে এসে দেখল ওটা খালা না। দাদী এই অন্ধকারে ভূত সেজে বাইরে কেন বসে আছে!
-দাদী! আমাকে ভয় দেখানোর আর কোন পথ বের করতে পারলে না! রাতদুপুরে এখন তুমিই ভূত সেজে বসে আছো।
অন্য দিন হলে হয়তো পরী বানু নাতিকে গালি দিত। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। বাড়িতেও করার মতো কত কাজ থাকতে পারে। কিন্তু আজ দাদীকে চুপ থাকতে দেখে স্মরণ বুঝে গেল বাড়িতে আজও ঝামেলা হয়েছে। খালা ঝামেলা করলে সেই ঝামেলায় খুশবু জড়িত থাকবেই। আর দাদী খালার ঝামেলা হলে সেটা অন্য কথা। স্মরণ অন্ধকারে দাদীর পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,
-কী হয়েছে দাদী?
-আমি ক্যান মরি না? আল্লাহ ক্যান আমারে দেখে না?
কথা ক’টা বলেই পরী বানু হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। দাদীর দূর্বল জায়গা স্মরণ জানে। তাই সে দেরি না করে খুশবুর ঘরের দিকে ছুটলো।
খুশবু কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। খুশি পড়ার টেবিলে বসা। তবে সে পড়ছে না। স্মরণ পরিবেশ হালকা করতে দরজার সামনে থেকে বলল,
-এই পঁচা গন্ধের বাচ্চা কি বারো মাসই কাঁথা নিয়ে শোয়! তুই তো কাঁথাকে জাতীয় পুরষ্কার পাইয়ে ছাড়বি দেখা যাচ্ছে।
খুশি একপলক তার দিকে তাকানো ছাড়া পরিবেশে আর কোন পরিবর্তন হলো না। স্মরণ ইশারায় খুশিকে জিজ্ঞেস করল,
-খালা কি আজও মেরেছে?
খুশি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাল। খালাকে কী বলা যায় বুঝে আসে না। এত বড় মেয়ের গায়ে কে হাত তোলে। জ্বর থেকে উঠেই বেচারি মার খেলো। স্মরণ খুশবুর পায়ের কাছে ওর খাটে বসে বলল,
-তুই যে ঘুমাসনি এটা আমি জানি। ঢঙ না করে ওঠ তো। সিঙ্গাড়া ঠান্ডা হয়ে যাবে।
খুশবু কোন সাড়াশব্দই করলো না। স্মরণ ওর মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে দিতে চাইলে খুশি বলল,
-না উঠতে চাইলে থাক। জোড়াজুড়ি কোরো না।
-খেয়েছে কিছু?
-ওকে খাওয়ানোর সাধ্য কার আছে?
স্মরণ কতক্ষণ বসে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। খুশি পেছনে এলে স্মরণ দাঁড়িয়ে বলল,
-খালাকে একটু বুঝাতে পারিস না? এসব পাগলামি কেন করে? মেয়েটা তো বড় হচ্ছে। বাড়িতে রাখতে না চাইলে বিয়েশাদি দিয়ে দিক। তবুও কয়দিন পরপর এরকম মারধোর করার মানে কী?
চলবে